যৌনপল্লীতে শিশুদের দুর্বিষহ জীবন by মোহাম্মদ ওমর ফারুক
শ্যামলা
মায়াবী চেহারার কলি ও শিউলি। এক যুগ আগে কিশোরী বয়সে পায়ে নূপুর আর মুখে
প্রসাধনী মেখে দু’বোন পা রেখেছিল মা-নানীর পেশায়। জন্ম সূত্রেই তারা যৌন
দাসত্বের অন্ধকার বৃত্তে ঘুরছে। তাদের মা কল্পনা বেগম। ছোটবেলায় স্কুলে
ভর্তি করাতে চেয়েছিল দু’জনকেই। দুইজন নাকি স্কুলেও গিয়েছিল দু’দিন। এ
পর্যন্তই। মানুষের বাঁকা চাহনি, স্কুলের সহপাঠী আর শিক্ষকদের তাচ্ছিল্যে
দুইদিনেই ইতি টানতে হয় স্কুল জীবনের।
এর পরের গল্পটা মা নানীর মতোই।
টাঙ্গাইল শহরের কান্দাপাড়ার প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশুই বেড়ে ওঠছে এভাবেই। কথা হয় কলি ও শিউলের সঙ্গে। তারা বলেন, এখানে জন্ম নেয়া যে কত বড় পাপ সেটা একমাত্র আমরা ছাড়া অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। আমরা যখন স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম, দুইদিন ক্লাস করেছিলাম। তখন আমাদের দিকে মানুষ এভাবে তাকাচ্ছিলো কেন? বলতে পারবেন? আমাদের সঙ্গে টেবিলে পর্যন্ত কেউ বসেনি, বলে আমরা খারাপ মানুষ। পরে রাগে ক্ষোভে দু’বোন আর স্কুলে যাইনি। সেই দিন যদি আমাদেরকে সবাই ভালোভাবে নিতো আজ আমাদের এ জায়গায় থাকতে হতো না। এ পল্লীতে জন্ম নিয়েছি। এ জন্মে কি আমাদের কোনো হাত আছে?
যৌন পল্লীর শিশুদের সঙ্গে মিশতে মানা, খেতে মানা, কথা বলতে মানা। এসব মানা নিয়েই বেড়ে ওঠছে তারা। শুধু তাই নয় নিজেদের পল্লীর মধ্যেও টেনেহিঁচড়ে চলছে তাদের জীবন। ছোট একটি রুম। দিনে ভাড়া তিন’শ থেকে চার’শ টাকা। সেখানেই থাকা, খাওয়া, সন্তানদের পরিচর্যা। সঙ্গে মায়েদের যৌন ব্যবসা। এখানে শিশুদের পড়ার পরিবেশ নেই। অলি-গলিতে মদের দোকান, নাচানাচি ও চিৎকার চেঁচামেচি। ঘরে জায়গা না পাওয়ায় রাস্তায়, ফুটপাতে কিংবা মাসির ঘরে দিনাতিপাত করে যৌনকর্মী মায়ের অবুঝ শিশুরা। ?এতো গেলো পল্লীর ভিতরের অবস্থা। পল্লী থেকে বের হয়ে সন্তানদের বাবা মায়ের পরিচয়সহ নানান বিষয় নিয়ে প্রতি পদে পদে সঙ্কটে পড়তে হয় তাদের। বিয়ের ক্ষেত্রে, চাকরি পেতে, বিদেশ গমনে, সম্পত্তি রক্ষাসহ সর্বত্র তারা হয়রানির শিকার হয়। সবার জন্ম যে এখানে এমনটি নয়। অনেকে আছে যাদের জন্মের অনেক পরে মা যৌনকর্মী হয়েছেন। এসব মায়ের সন্তানরাও পরিচয় সঙ্কটে ভুগছে।
কথা হয় যৌন পল্লীর এক কিশোরী শিক্ষার্থীর সঙ্গে। পড়ছেন টাঙ্গাইলের একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে। ওই কিশোরী বলেন, মা পল্লীতে থাকলেও আমি থাকি না। আমি আমার বোনের সঙ্গে আলাদা বাসা নিয়ে থাকি। তারপরও কত কথা শুনতে হয়। সবাই জানে আমি এই পল্লীর মেয়ে। মানুষ আমাদের দেখলেই ঘেন্নার চোখে তাকায়। ক্লাসে নানান ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলে। তখন খুব কষ্ট হয়। নিরবে কাঁদি।
যৌনকর্মী হাজেরা বেগম দুই সন্তানের মা। তিনি বলেন, ঘর ভাড়া, খাওয়া দাওয়া, বৃদ্ধ মায়ের দেখাশুনা, সাজসজ্জায় অনেক রকম ব্যয়। কাস্টমার না ধরলে একদিনও চলে না। ঘরে কাস্টমার নিলে বাচ্চার পড়ার জায়গা দিতে পারি না। কিন্তু বাচ্চা তো মানুষ করতে হবে। আমি চাই না মায়ের মতো,আমার মতো বাচ্চা দু্ইটা এ পথে আসুক। কষ্ট করে হলেও আমি তাদের মানুষ করবো। কেউ আমাদের ভালো চোখে নেয় না। আর আমাদের বাচ্চাদের তো দেখতেই পারে না।
হাজেরা বলেন, সবাই শুধু বাচ্চার বাবার পরিচয় চায়। স্কুলে বা কোনো জায়গায় কিছু করতে গেলে এই সমস্যায় ভুগি। আর আমার আসল পরিচয় পেলে তো কথায় বলতে চায় না কেউ।
আরেক যৌনকর্মী বৃষ্টি রানী বলেন, সরকার আমাদের কোনো সুযোগ সুবিধা না দিক আমাদের সন্তানদের তো পড়াশোনার ব্যবস্থাটা করে দিতে পারে। বাচ্চাদের জন্য একটা জন্মসনদ আনতে গেলেও আমাদের নানা হয়রানির মুখে পড়তে হয় ।
প্রতিদিন একটু একটু করে অন্ধকার জগতের হিমশীতল গলিতে হারিয়ে যাচ্ছে এ শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ। পল্লীর শিশুরা সবাইকে আপন করে নিতে পারলেও সাধারণ মানুষ তাদের আপন করে নিতে পারে না। যার জন্য তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা ব্যহত হয়। ফলে কন্যা শিশুরা তাদের মায়েদের পথে হাটে আর ছেলে শিশুরা বখাটে হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা.ঝুনু শামসুন নাহার বলেন, একটা শিশু যখন দিনে দিনে এমন তাচ্ছিলো বড় হবে, তখন তার মানসিক অবস্থা খুব ভয়ঙ্কর হয়ে দাড়াবে। সে মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করবে না। তাদেরকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এসব শিশুদের মানসিকভাবে হেয় করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এবং সামজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, যৌন পল্লীর শিশুদের মূলশ্রোতে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তারাও এ দেশের নাগরিক। বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ না নিলে তাদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। তাদের শিক্ষা, বস্ত্র, খাদ্য, বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
এর পরের গল্পটা মা নানীর মতোই।
টাঙ্গাইল শহরের কান্দাপাড়ার প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশুই বেড়ে ওঠছে এভাবেই। কথা হয় কলি ও শিউলের সঙ্গে। তারা বলেন, এখানে জন্ম নেয়া যে কত বড় পাপ সেটা একমাত্র আমরা ছাড়া অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। আমরা যখন স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম, দুইদিন ক্লাস করেছিলাম। তখন আমাদের দিকে মানুষ এভাবে তাকাচ্ছিলো কেন? বলতে পারবেন? আমাদের সঙ্গে টেবিলে পর্যন্ত কেউ বসেনি, বলে আমরা খারাপ মানুষ। পরে রাগে ক্ষোভে দু’বোন আর স্কুলে যাইনি। সেই দিন যদি আমাদেরকে সবাই ভালোভাবে নিতো আজ আমাদের এ জায়গায় থাকতে হতো না। এ পল্লীতে জন্ম নিয়েছি। এ জন্মে কি আমাদের কোনো হাত আছে?
যৌন পল্লীর শিশুদের সঙ্গে মিশতে মানা, খেতে মানা, কথা বলতে মানা। এসব মানা নিয়েই বেড়ে ওঠছে তারা। শুধু তাই নয় নিজেদের পল্লীর মধ্যেও টেনেহিঁচড়ে চলছে তাদের জীবন। ছোট একটি রুম। দিনে ভাড়া তিন’শ থেকে চার’শ টাকা। সেখানেই থাকা, খাওয়া, সন্তানদের পরিচর্যা। সঙ্গে মায়েদের যৌন ব্যবসা। এখানে শিশুদের পড়ার পরিবেশ নেই। অলি-গলিতে মদের দোকান, নাচানাচি ও চিৎকার চেঁচামেচি। ঘরে জায়গা না পাওয়ায় রাস্তায়, ফুটপাতে কিংবা মাসির ঘরে দিনাতিপাত করে যৌনকর্মী মায়ের অবুঝ শিশুরা। ?এতো গেলো পল্লীর ভিতরের অবস্থা। পল্লী থেকে বের হয়ে সন্তানদের বাবা মায়ের পরিচয়সহ নানান বিষয় নিয়ে প্রতি পদে পদে সঙ্কটে পড়তে হয় তাদের। বিয়ের ক্ষেত্রে, চাকরি পেতে, বিদেশ গমনে, সম্পত্তি রক্ষাসহ সর্বত্র তারা হয়রানির শিকার হয়। সবার জন্ম যে এখানে এমনটি নয়। অনেকে আছে যাদের জন্মের অনেক পরে মা যৌনকর্মী হয়েছেন। এসব মায়ের সন্তানরাও পরিচয় সঙ্কটে ভুগছে।
কথা হয় যৌন পল্লীর এক কিশোরী শিক্ষার্থীর সঙ্গে। পড়ছেন টাঙ্গাইলের একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে। ওই কিশোরী বলেন, মা পল্লীতে থাকলেও আমি থাকি না। আমি আমার বোনের সঙ্গে আলাদা বাসা নিয়ে থাকি। তারপরও কত কথা শুনতে হয়। সবাই জানে আমি এই পল্লীর মেয়ে। মানুষ আমাদের দেখলেই ঘেন্নার চোখে তাকায়। ক্লাসে নানান ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলে। তখন খুব কষ্ট হয়। নিরবে কাঁদি।
যৌনকর্মী হাজেরা বেগম দুই সন্তানের মা। তিনি বলেন, ঘর ভাড়া, খাওয়া দাওয়া, বৃদ্ধ মায়ের দেখাশুনা, সাজসজ্জায় অনেক রকম ব্যয়। কাস্টমার না ধরলে একদিনও চলে না। ঘরে কাস্টমার নিলে বাচ্চার পড়ার জায়গা দিতে পারি না। কিন্তু বাচ্চা তো মানুষ করতে হবে। আমি চাই না মায়ের মতো,আমার মতো বাচ্চা দু্ইটা এ পথে আসুক। কষ্ট করে হলেও আমি তাদের মানুষ করবো। কেউ আমাদের ভালো চোখে নেয় না। আর আমাদের বাচ্চাদের তো দেখতেই পারে না।
হাজেরা বলেন, সবাই শুধু বাচ্চার বাবার পরিচয় চায়। স্কুলে বা কোনো জায়গায় কিছু করতে গেলে এই সমস্যায় ভুগি। আর আমার আসল পরিচয় পেলে তো কথায় বলতে চায় না কেউ।
আরেক যৌনকর্মী বৃষ্টি রানী বলেন, সরকার আমাদের কোনো সুযোগ সুবিধা না দিক আমাদের সন্তানদের তো পড়াশোনার ব্যবস্থাটা করে দিতে পারে। বাচ্চাদের জন্য একটা জন্মসনদ আনতে গেলেও আমাদের নানা হয়রানির মুখে পড়তে হয় ।
প্রতিদিন একটু একটু করে অন্ধকার জগতের হিমশীতল গলিতে হারিয়ে যাচ্ছে এ শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ। পল্লীর শিশুরা সবাইকে আপন করে নিতে পারলেও সাধারণ মানুষ তাদের আপন করে নিতে পারে না। যার জন্য তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা ব্যহত হয়। ফলে কন্যা শিশুরা তাদের মায়েদের পথে হাটে আর ছেলে শিশুরা বখাটে হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা.ঝুনু শামসুন নাহার বলেন, একটা শিশু যখন দিনে দিনে এমন তাচ্ছিলো বড় হবে, তখন তার মানসিক অবস্থা খুব ভয়ঙ্কর হয়ে দাড়াবে। সে মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করবে না। তাদেরকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এসব শিশুদের মানসিকভাবে হেয় করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এবং সামজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, যৌন পল্লীর শিশুদের মূলশ্রোতে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তারাও এ দেশের নাগরিক। বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ না নিলে তাদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। তাদের শিক্ষা, বস্ত্র, খাদ্য, বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
No comments