বাংলাদেশের নদীগুলোর জরুরি পুনর্বাসন প্রয়োজন by অমিত রাজন
১৯৭১
সালে তৎকালিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা
দিয়েছিলেন, সেই বাংলাদেশ ৪৮ বছরে অলৌকিকভাবে বদলে গেছে। বহু বছর ধরে এই
দেশটি ৬-৭% প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে এবং ২০১৮ সালে বহু দেশকে পেছনে ফেলে ৭.৩%
প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তবে, প্রবৃদ্ধির সুবিধা অবশ্য সবাই পাচ্ছে না, এবং
কয়েক দশক ধরে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির সাথে সাথে অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের
সংখ্যাও দেশটিতে বেড়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় দেশে অপুষ্টিতে আক্রান্তের সংখ্যা ২০০৪-০৬ সালে ছিল ২৩.৮৫ মিলিয়ন, যেটা ২০১৮ সালে বেড়ে ২৪.২ মিলিয়নে এসে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশানের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তাছাড়া, দেশের নদীগুলোর স্বাস্থ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আজাদ মজুমদারের মতে, বাংলাদেশের প্রায় ২৩০টি ছোট ও বড় নদী রয়েছে, যেগুলোর উপর প্রায় ১৪০ মিলিয়ন মানুষ তাদের জীবিকা ও পরিবহনের জন্য নির্ভর করে। কিন্তু নদীগুলোর অধিকাংশই অতিমাত্রায় দুষিত এবং নদীর পাড়গুলো শক্তিধর লোকেরা দখল করে নিয়েছে।
দেশের নদীগুলো দুষিত হওয়ার একটা বড় কারণ হলো গার্মেন্টস কারখানা থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ। এই খাত থেকে দেশের রফতানি পণ্যের ৮২% আসছে। মাইকো সাকামোতো ও তার সহকারীরা এক গবেষণায় দেখেছেন যে, এই গার্মেন্টস কারখানাগুলো যদি গতানুগতিক উপায়ে কাজ চালিয়ে যায়, তাহলে ২০২১ সাল নাগাদ তাদের উৎপাদিত বিষাক্ত বজ্যের পরিমাণ হবে ৩৪৯ মিলিয়ন ঘনমিটার। এগুলো বাংলাদেশের নদীগুলোর অবস্থা আরও খারাপ করে দেবে।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী বুড়িগঙ্গা দুষণ ও দখলের কবলে পড়ে ধ্বংসের পর্যায়ে চলে গেছে। ফটোসাংবাদিক অ্যালিসন জয়েসের ২০১৫ সালে এই নদীর দুর্দশার চিত্র ধরা পড়ে। এই নদী এতটাই দুষিত যে, এর পানি কালো থকথকে জেলের মতো হয়ে গেছে। ঢাকার হাজারিবাগের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা, তাদের বর্জ্য নদীতে ফেলছে। নদীর পানি দুষণের এটাই প্রধান কারণ।
নগরীর অধিবাসীরা আরও বহু ধরনের বর্জ্য নদীতে ফেলছে। ঢাকার কাছের অন্যান্য নদীগুলো হলো শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু। এগুলোর অবস্থাও কম বেশি একই রকম। বিশ্ব ব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, এই সবগুলো নদীতে প্রতিদিন ১.৫ মিলিয়ন ঘনমিটার বর্জ্য মিশছে।
বেশ কিছু পরিবেশ সচেতন মানুষ এই নদীগুলো পরিস্কার করার দাবি তুলেছেন এবং এজন্য আদালতে আবেদন করেছেন। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ২০১৯ সালের এপ্রিলে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যাতে তারা নদীতে বর্জ্য না ফেলে। তিনি আরও বলেছেন যে, “প্রতিটি শিল্প ইউনিটের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম থাকতে হবে যাতে এর কারণে নদী দুষিত না হয়”। দুর্ভাগ্যজনকভাবে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
২০১৯ সালের মে মাসে ঢাকা হাই কোর্ট দেখতে পেয়েছে যে, বেশ কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও এমনকি সরকারী কর্মকর্তারা নদী দখলের সাথে যুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশী ও ভারতীয় মিডিয়ায় যেমনটা প্রকাশিত হয়েছে যে, আদালতের পর্যবেক্ষণের কয়েক মাস আগে, বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি ঢাকার চারপাশের নদীতীরগুলোতে বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। ওই অভিযানে প্রায় ৪০০০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয় এবং ৭৭ হেক্টর জমি উদ্ধার করা হয়।
২০১৯ সালের ২ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি রায় দেয়, যেখানে তুরাগ নদীকে ‘বৈধ ব্যক্তি’ বা ‘জীবন্ত সত্ত্বার’ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। রায়ে আদালত বলেছে যে, “নদী হত্যার অর্থ হলো সম্মিলিতভাবে আত্মহত্যা করা”।
রায়ে ন্যাশনাল রিভার কনজার্ভেশান কমিশনকে দেশের পানীয় সম্পদের বৈধ অভিভাবকত্ব দেয়া হয়েছে। আদালত নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে যে, কেউ নদী দখল এবং দুষণের জন্য দোষি সাব্যস্ত হলে তাকে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, মিউনিসিপ্যালিটি, সিটি কর্পোরেশান এবং সংসদ নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।
রায়ে আরও বলা হয়েছে যে, নদী দখলদার এবং দুষণ সৃষ্টিকারীদের ব্যাংক ঋণও দেয়া যাবে না। নদীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য আদালত বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে যাতে প্রতি দুই মাস পর পর সকল সরকারী ও বেসরকারী স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘন্টাব্যাপী ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়।
আগামী বছরগুলোতে যদি সবকিছু গতানুগতিক গতিতেই চলতে থাকে, তাহলে বর্ধিত জনসংখ্যার কারণে আরও বেশি বর্জ্য তৈরি হবে এবং সেগুলো নদীতে মিশবে। এই বর্জ্য পরিশোধিত না হলে নদীগুলো আরও দুষিত হবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে।
একই সাথে দখলে ও দুষণে নদীর মৃত্যু হলে দেশের প্রবৃদ্ধি কমে আসবে। তাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখার জন্য নদীগুলো সংরক্ষণের কোন বিকল্প নেই।
>>>অমিত রঞ্জন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় দেশে অপুষ্টিতে আক্রান্তের সংখ্যা ২০০৪-০৬ সালে ছিল ২৩.৮৫ মিলিয়ন, যেটা ২০১৮ সালে বেড়ে ২৪.২ মিলিয়নে এসে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশানের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তাছাড়া, দেশের নদীগুলোর স্বাস্থ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আজাদ মজুমদারের মতে, বাংলাদেশের প্রায় ২৩০টি ছোট ও বড় নদী রয়েছে, যেগুলোর উপর প্রায় ১৪০ মিলিয়ন মানুষ তাদের জীবিকা ও পরিবহনের জন্য নির্ভর করে। কিন্তু নদীগুলোর অধিকাংশই অতিমাত্রায় দুষিত এবং নদীর পাড়গুলো শক্তিধর লোকেরা দখল করে নিয়েছে।
দেশের নদীগুলো দুষিত হওয়ার একটা বড় কারণ হলো গার্মেন্টস কারখানা থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ। এই খাত থেকে দেশের রফতানি পণ্যের ৮২% আসছে। মাইকো সাকামোতো ও তার সহকারীরা এক গবেষণায় দেখেছেন যে, এই গার্মেন্টস কারখানাগুলো যদি গতানুগতিক উপায়ে কাজ চালিয়ে যায়, তাহলে ২০২১ সাল নাগাদ তাদের উৎপাদিত বিষাক্ত বজ্যের পরিমাণ হবে ৩৪৯ মিলিয়ন ঘনমিটার। এগুলো বাংলাদেশের নদীগুলোর অবস্থা আরও খারাপ করে দেবে।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী বুড়িগঙ্গা দুষণ ও দখলের কবলে পড়ে ধ্বংসের পর্যায়ে চলে গেছে। ফটোসাংবাদিক অ্যালিসন জয়েসের ২০১৫ সালে এই নদীর দুর্দশার চিত্র ধরা পড়ে। এই নদী এতটাই দুষিত যে, এর পানি কালো থকথকে জেলের মতো হয়ে গেছে। ঢাকার হাজারিবাগের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা, তাদের বর্জ্য নদীতে ফেলছে। নদীর পানি দুষণের এটাই প্রধান কারণ।
নগরীর অধিবাসীরা আরও বহু ধরনের বর্জ্য নদীতে ফেলছে। ঢাকার কাছের অন্যান্য নদীগুলো হলো শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু। এগুলোর অবস্থাও কম বেশি একই রকম। বিশ্ব ব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, এই সবগুলো নদীতে প্রতিদিন ১.৫ মিলিয়ন ঘনমিটার বর্জ্য মিশছে।
বেশ কিছু পরিবেশ সচেতন মানুষ এই নদীগুলো পরিস্কার করার দাবি তুলেছেন এবং এজন্য আদালতে আবেদন করেছেন। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ২০১৯ সালের এপ্রিলে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যাতে তারা নদীতে বর্জ্য না ফেলে। তিনি আরও বলেছেন যে, “প্রতিটি শিল্প ইউনিটের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম থাকতে হবে যাতে এর কারণে নদী দুষিত না হয়”। দুর্ভাগ্যজনকভাবে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
২০১৯ সালের মে মাসে ঢাকা হাই কোর্ট দেখতে পেয়েছে যে, বেশ কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও এমনকি সরকারী কর্মকর্তারা নদী দখলের সাথে যুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশী ও ভারতীয় মিডিয়ায় যেমনটা প্রকাশিত হয়েছে যে, আদালতের পর্যবেক্ষণের কয়েক মাস আগে, বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি ঢাকার চারপাশের নদীতীরগুলোতে বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। ওই অভিযানে প্রায় ৪০০০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয় এবং ৭৭ হেক্টর জমি উদ্ধার করা হয়।
২০১৯ সালের ২ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি রায় দেয়, যেখানে তুরাগ নদীকে ‘বৈধ ব্যক্তি’ বা ‘জীবন্ত সত্ত্বার’ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। রায়ে আদালত বলেছে যে, “নদী হত্যার অর্থ হলো সম্মিলিতভাবে আত্মহত্যা করা”।
রায়ে ন্যাশনাল রিভার কনজার্ভেশান কমিশনকে দেশের পানীয় সম্পদের বৈধ অভিভাবকত্ব দেয়া হয়েছে। আদালত নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে যে, কেউ নদী দখল এবং দুষণের জন্য দোষি সাব্যস্ত হলে তাকে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, মিউনিসিপ্যালিটি, সিটি কর্পোরেশান এবং সংসদ নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।
রায়ে আরও বলা হয়েছে যে, নদী দখলদার এবং দুষণ সৃষ্টিকারীদের ব্যাংক ঋণও দেয়া যাবে না। নদীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য আদালত বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে যাতে প্রতি দুই মাস পর পর সকল সরকারী ও বেসরকারী স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘন্টাব্যাপী ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়।
আগামী বছরগুলোতে যদি সবকিছু গতানুগতিক গতিতেই চলতে থাকে, তাহলে বর্ধিত জনসংখ্যার কারণে আরও বেশি বর্জ্য তৈরি হবে এবং সেগুলো নদীতে মিশবে। এই বর্জ্য পরিশোধিত না হলে নদীগুলো আরও দুষিত হবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে।
একই সাথে দখলে ও দুষণে নদীর মৃত্যু হলে দেশের প্রবৃদ্ধি কমে আসবে। তাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখার জন্য নদীগুলো সংরক্ষণের কোন বিকল্প নেই।
>>>অমিত রঞ্জন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো
ঢাকার পাশে একটি নদী থেকে প্লাস্টিকের জিনিস সং করছে এক লোক, ছবি: রয়টার্স |
No comments