এরশাদের জীবনাবসান
সাবেক
প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইন্তেকাল
করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ১০ দিন ঢাকার সম্মিলিত
সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে গতকাল সকাল পৌনে আটটায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করেন বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে জানানো হয়।
বিরোধী দলের নেতা এরশাদের মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ,
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন। এরশাদের মৃত্যুতে শোকের
ছায়া নেমে এসেছে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মাঝে। গতকাল বাদ যোহর ঢাকা
সেনানীবাসের সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদে এরশাদের প্রথম জানাজার পর লাশ সিএমএইচের
হিমঘরে রাখা হয়। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এরশাদের
দ্বিতীয় জানাজা হবে। এরপর বেলা ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত মরদেহ রাখা হবে
কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। বাদ আসর বায়তুল মোকাররমে হবে তৃতীয়
জানাজা।
বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে মঙ্গলবার সকালে লাশ নেয়া হবে এরশাদের পৈত্রিক নিবাস রংপুরে। সেখানে জেলা ঈদগাহ মাঠে হবে চতুর্থ জানাজা। এরপর ঢাকায় এনে বনানীর সামরিক কবরস্থানে তাকে দাফনের কথা রয়েছে। তবে এরশাদের লাশ উন্মুক্ত স্থানে দাফনের দাবি তুলেছেন দলের নেতাকর্মীরা। এ দাবিতে গতকাল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন নেতাকর্মীরা। রংপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীদের এমন দাবির প্রেক্ষিতে দলটির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙা গতকাল বিকালে জানান মঙ্গলবার দাফনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বুধবার বাদ আছর গুলশানের আজাদ মসজিদে এরশাদের কুলখানি হবে বলে পার্টির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সর্বশেষ গত ২৬শে জুন অসুস্থতা নিয়ে সিএমএইচ-এ ভর্তি হন এরশাদ। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে প্রথমে আইসিইউতে পরে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। এরপর দলের পক্ষ থেকে প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে এরশাদের অবস্থা জানানো হয়।
গুরুতর অসুস্থ হওয়ার কিছু দিন আগে এরশাদ নিজের সব সম্পত্তি একটি ট্রাস্টের অধীন দিয়ে যান। একই সঙ্গে ভাই জিএম কাদেরকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন। এরশাদ স্ত্রী, দুই পুত্র ও দুইজন পোষ্য সন্তান রেখে গেছেন। তাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা সম্পত্তি রেখে গেছেন তিনি।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার দিনহাটা গ্রামে। তার পিতা মকবুল হোসেন ও মাতা মজিদা খাতুন। পিতা ছিলেন আইনজীবী। এরশাদ প্রথমে কুচবিহার ও পরে নিজ শহর রংপুরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে যোগ দেন। ১৯৬০ থেকে ৬২ সালে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট ছিলেন। এরশাদ ১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় অবস্থিত স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৮ সালে শিয়ালকোটে ৫৪তম ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এরশাদ। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৬৯ থেকে ৭০ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং ১৯৭১ থেকে ৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাচালে এরশাদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে চাকরি করেন। প্রথমে তিনি ঢাকায় অবস্থান করলেও পরে পাকিস্তান চলে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশে ফিরেন। এর এরশাদ দেশে ফিরে তার এক চাচার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এসে চাকরিতে যোগ দেয়ার আর্জি জানান। এরপরই সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ দেন এরশাদ। ১৯৭৩ সালে এরশাদকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর কর্নেল পদে এবং ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন এরশাদ। একই বছর তিনি ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। ওই বছরই আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিয়োগ দেয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৮১ সালের ৩০শে মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পর থেকেই প্রচারের আলোয় আসতে থাকেন এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। তিনি দেশের সংবিধানকে রহিত করেন। এছাড়া জাতীয় সংসদ বাতিল ও সাত্তারের মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেন। এরশাদ নিজেকে দেশের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে দেশে সামরিক আইন জারি করে। ১৯৮৪ সালে ১৮ দফা ঘোষণা করে বাস্তবায়ন পরিষদ তৈরি করেন তিনি? সেবছরই সিনিয়র রাজনীতিকদের নিয়ে গঠন করেন ‘জনদল’? কিছুদিন পর ‘জনদল’ পরিবর্তন করে তৈরি করেন বর্তমানের জাতীয় পার্টি? ১৯৮৬ সালের পাতানো নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়? বিরোধী দল হয় আওয়ামী লীগ? ১৯৮৮ সালে ওই সংসদ ভেঙে দিয়ে আবারও নির্বাচন দেন এরশাদ? কোনো দল ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করে এরশাদের বিরুদ্ধে? নয় বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এরশাদ? তারপরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জেল থেকে অংশ নিয়ে পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেন সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ। ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ? ২০০১ সালে জাপা একাই নির্বাচন করলেও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন করে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপিসহ অন্যান্য অনেক দল বয়কট করলে এরশাদের জাতীয় পার্টি নানা নাটকীয়তার মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেয়। পরবর্তীতে জাপা হয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল। এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়। ২০১৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে বিরোধী জোট আসন কম পাওয়ায় জাতীয় পার্টিকেই বিরোধী দলের আসনে বসায় আওয়ামী লীগ।
জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার মধ্যে জাতীয় পার্টির (জাপা) মূল ধারাটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন এরশাদ।
নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসা এরশাদ স্বৈর শাসকের তকমা পেয়েছিলেন। নানা কারণে তিনি ছিলেন আলোচিত সমালোচিত। কিন্তু গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনা ও ‘৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’ এই স্লোগান দিয়ে গ্রাম-বাংলায় তিনি ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। এজন্য পার্টির পক্ষ থেকে তাকে পল্লীবন্ধু উপাধি দেয়া হয়। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগীতা সংস্থা (সার্ক) গঠনে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এরশাদ ভুমিকা রাখেন। এছাড়া উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থা কার্যকর করা, শিল্প, ভূমি সংস্কার, গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ উন্নয়নের পরিকল্পনা করেছিলেন। এছাড়া প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং দেশে ব্যক্তিখাতের বিকাশে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল সরকারি মালিকানাধীন উত্তরা, পুবালী ও রূপালী ব্যাংকের বিরাষ্ট্রীকরণ। এসময়ে দেশে প্রথমবারের মত কয়েকটি বেসরকারি বাণ্যিজ্যিক ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিকে কার্যক্রম শুরুর অনুমতি প্রদান করেন। দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন ও সংস্কারেও এরশাদ সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নেন। দেশের মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করার মাধ্যমে জেলার সংখ্যা ৬৪টি করা হয় এরশাদ সরকারের আমলে। আর এগুলোর অধীনে ৪৬০টি উপজেলা বিন্যস্ত করা হয়। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা বিকেন্দ্রিকরণের উদ্দেশ্যে এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৮শে এপ্রিল একটি প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও সংস্কার কমিশন গঠন করেন, যার সুপারিশ অনুযায়ী জনপ্রশাসনকে নতুন করে সাজানো হয়। এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেন, যা বাংলাদেশের অসামপ্রদায়িক চরিত্র বদলে দেয় বলে সমালোচনা করলেও পরবর্তীতে তা আর কোন সরকারই সংশোধণ করার উদ্যোগ নেয়নি। এছাড়া তিনি শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। ক্ষমতায় থাকার সময় সেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, দমনপীড়ন ও অনৈতিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ ছিল এরশাদের বিরুদ্ধে। ক্ষমতায় থাকার সময় পাওয়া উপহার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে আর্থিক অনিয়মের মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত এরশাদকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়। দুই যুগ পর হাইকোর্ট সেই সাজা বাতিল করে এরশাদকে খালাস দেন। জাপানি নৌযান কেনায় অনিয়মের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় এরশাদের প্রথমে তিন বছর এবং পরে হাইকোর্টে আপিলে সাজা কমে দুই বছরের কারাদণ্ড হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই বছর কারাগারে কাটানোয় এরশাদকে নতুন করে আর ওই মামলায় দণ্ড ভোগ করতে হয়নি। জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালত এরশাদকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলো। প্রায় ১৭ বছর পর হাইকোর্ট সাজা কমিয়ে এরশাদকে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চলাকালে এরশাদের সাড়ে ৩ বছর কারাভোগ শেষ হওয়ায় আপিল বিভাগ পরে জরিমানার দণ্ড বহাল রেখে এরশাদকে অবশিষ্ট দেড় বছর সাজাভোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। এছাড়া স্বর্ণ চোরাচালান, টেলিকম দুর্নীতি, পোল্ট্রি ফার্ম দুর্নীতি মামলা, আয়কর ফাঁকি, জাহাজ কেনায় দুর্নীতি, রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, হরিপুরে তেল অনুসন্ধানে দুর্নীতি এবং রাডার কেনায় দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে আরও ১৯টি মামলা ছিলো এরশাদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে কয়েকটিতে তিনি নিম্ন আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান। কয়েকটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়। তকে সেনা কর্মকর্তা মঞ্জুর হত্যা মামলাটি এখনও চলমান রয়েছে। এ মামলাটি এরশাদের সামনে তুরুপের তাস হিসেবে ছিল বলে অনেকে মনে করতেন।
সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা: হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রথম জানাজা বাদ যোহর ঢাকা সেনানীবাসের সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। নামাজে ইমামতি করেন ওই মসজিদের পেশ ইমাম ও ধর্মীয় শিক্ষক আহসান হাবীব। জানাজার পূর্বে এরশাদের ছোট ভাই ও জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন। তিনি এরশাদের বর্ণাঢ্য জীবন তুলে ধরে বলেন, রোববার সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে সিএমএইচে আমার বড় ভাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি ১৯৯১ সালের পর থেকে একটি সংসদ নির্বাচন ছাড়া প্রতিটি সংসদেই বিজয়ী হয়েছেন। তার পূর্বে ৯ বছর দেশের শাসনভার পরিচালনা করছেন। তিনি দেশ ও মানুষের স্বার্থে অনেক ভাল কাজ করে গেছেন। তিনি তিনবার কাবা ঘরের মধ্যে নামায পড়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। মানুষ মাত্রই ভুল হয়ে থাকে। তাই আমার ভাইও ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তিনি কোনো ভুল ত্রুটি করে থাকলে সকলে ভাইকে ক্ষমা করে দেবেন। জানাজার পূর্বে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এরশাদের পেশা জীবন তুলে ধরা হয়। এসময় জানানো হয়, এরশাদের দাফন সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হবে।
জানাজায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী ও সাবেক সেনা প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকসহ তিন বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকতারা অংশ নেন। এছাড়া এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের, বড় ছেলে শাদ এরশাদ, জাপা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, ব্যরিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সাহিদুর রহমান টেপা, হাবিবুর রহমানসহ পার্টির নেতাকর্মীরা জানাজায় অংশ নেন।
জাপার তিন দিনের শোক: জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে পার্টির পক্ষ থেকে তিনদিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল বিকালে জাপা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি জানান, সারাদেশে জাপার নেতাকর্মীরা তিনদিন শোক পালন করবে। এসময় নেতাকর্মীরা কালোব্যাচ ধারণ করবেন। জাপা কার্যালয়ে দলীয় পতাকার সঙ্গে কালো পতাকা টাঙানো থাকবে। এছাড়া ১৫ থেকে ১৮ই জুলাই পর্যন্ত শোকবই খোলা থাকবে। কূটনীতিকসহ সর্বসাধারণের জন্য তা উন্মুক্ত থাকবে।
প্রেসিডেন্ট পার্কে শোকাতুর এরিক: বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের ছয় তলায় ৭ হাজার ৪’শ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ। তার সঙ্গে থাকতো ছেলে এরিক এরশাদ। এরশাদ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে সে অনেকটা একা। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এরিক সকালে স্কুলে ছিল। এরশাদের মৃত্যুর পর সেখান থেকেই তাকে সিএমএইচে আনা হয়। এরশাদের ব্যক্তিগত গাড়ি চালক আব্দুল মান্নান জানান, সকালে এরিক’কে নিয়ে স্কুলে যান তিনি। সাড়ে আট’টার দিকে এরশাদের আরেক ব্যক্তিগত গাড়ির চালক আব্দুল আউয়াল তাকে ফোন করে বলেন এরিক’কে স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য, এরশাদের অবস্থা তেমন একটা ভালো না। এরিক’কে নিয়ে গাড়ি করে আব্দুল মান্নান সোজা চলে যান সিএমএইচ-এ। সেখানে বাবা’কে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এরিক। চাচা জিএম কাদের, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙাসহ পরিচিতজনকে দেখলেই জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে এরিক। সেনানীবাসের জানাজার পর এরিককে প্রেসিডেন্ট পার্কে নেয়া হয়। সেখানকার কর্মচারিরা জানিয়েছেন, বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে এরিক। সে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে পায়চারি করেছে আর কান্না করেছে।
যে প্রতিক্রিয়া দিলেন বিদিশা: হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন তার সাবেক স্ত্রী বিদিশা এরশাদ। এরশাদের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন তিনি। তিনি ভারতের আজমির শরীফে রয়েছেন। বিদিশা তার ফেসবুকে লেখেন, এ জন্মে আর দেখা হল না। আমিও আজমীর শরীফ আসলাম আর তুমিও চলে গেলে। এতো কষ্ট পাওয়ার থেকে মনে হয় এই ভালো ছিল। আবার দেখা হবে হয়তো অন্য এক দুনিয়াতে যেখানে থাকবে না কোনো রাজনীতি।
বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে মঙ্গলবার সকালে লাশ নেয়া হবে এরশাদের পৈত্রিক নিবাস রংপুরে। সেখানে জেলা ঈদগাহ মাঠে হবে চতুর্থ জানাজা। এরপর ঢাকায় এনে বনানীর সামরিক কবরস্থানে তাকে দাফনের কথা রয়েছে। তবে এরশাদের লাশ উন্মুক্ত স্থানে দাফনের দাবি তুলেছেন দলের নেতাকর্মীরা। এ দাবিতে গতকাল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন নেতাকর্মীরা। রংপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীদের এমন দাবির প্রেক্ষিতে দলটির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙা গতকাল বিকালে জানান মঙ্গলবার দাফনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বুধবার বাদ আছর গুলশানের আজাদ মসজিদে এরশাদের কুলখানি হবে বলে পার্টির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সর্বশেষ গত ২৬শে জুন অসুস্থতা নিয়ে সিএমএইচ-এ ভর্তি হন এরশাদ। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে প্রথমে আইসিইউতে পরে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। এরপর দলের পক্ষ থেকে প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে এরশাদের অবস্থা জানানো হয়।
গুরুতর অসুস্থ হওয়ার কিছু দিন আগে এরশাদ নিজের সব সম্পত্তি একটি ট্রাস্টের অধীন দিয়ে যান। একই সঙ্গে ভাই জিএম কাদেরকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন। এরশাদ স্ত্রী, দুই পুত্র ও দুইজন পোষ্য সন্তান রেখে গেছেন। তাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা সম্পত্তি রেখে গেছেন তিনি।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার দিনহাটা গ্রামে। তার পিতা মকবুল হোসেন ও মাতা মজিদা খাতুন। পিতা ছিলেন আইনজীবী। এরশাদ প্রথমে কুচবিহার ও পরে নিজ শহর রংপুরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে যোগ দেন। ১৯৬০ থেকে ৬২ সালে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট ছিলেন। এরশাদ ১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় অবস্থিত স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৮ সালে শিয়ালকোটে ৫৪তম ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এরশাদ। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৬৯ থেকে ৭০ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং ১৯৭১ থেকে ৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাচালে এরশাদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে চাকরি করেন। প্রথমে তিনি ঢাকায় অবস্থান করলেও পরে পাকিস্তান চলে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশে ফিরেন। এর এরশাদ দেশে ফিরে তার এক চাচার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এসে চাকরিতে যোগ দেয়ার আর্জি জানান। এরপরই সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ দেন এরশাদ। ১৯৭৩ সালে এরশাদকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর কর্নেল পদে এবং ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন এরশাদ। একই বছর তিনি ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। ওই বছরই আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিয়োগ দেয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৮১ সালের ৩০শে মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পর থেকেই প্রচারের আলোয় আসতে থাকেন এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। তিনি দেশের সংবিধানকে রহিত করেন। এছাড়া জাতীয় সংসদ বাতিল ও সাত্তারের মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেন। এরশাদ নিজেকে দেশের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে দেশে সামরিক আইন জারি করে। ১৯৮৪ সালে ১৮ দফা ঘোষণা করে বাস্তবায়ন পরিষদ তৈরি করেন তিনি? সেবছরই সিনিয়র রাজনীতিকদের নিয়ে গঠন করেন ‘জনদল’? কিছুদিন পর ‘জনদল’ পরিবর্তন করে তৈরি করেন বর্তমানের জাতীয় পার্টি? ১৯৮৬ সালের পাতানো নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়? বিরোধী দল হয় আওয়ামী লীগ? ১৯৮৮ সালে ওই সংসদ ভেঙে দিয়ে আবারও নির্বাচন দেন এরশাদ? কোনো দল ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করে এরশাদের বিরুদ্ধে? নয় বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এরশাদ? তারপরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জেল থেকে অংশ নিয়ে পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেন সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ। ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ? ২০০১ সালে জাপা একাই নির্বাচন করলেও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন করে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপিসহ অন্যান্য অনেক দল বয়কট করলে এরশাদের জাতীয় পার্টি নানা নাটকীয়তার মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেয়। পরবর্তীতে জাপা হয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল। এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়। ২০১৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে বিরোধী জোট আসন কম পাওয়ায় জাতীয় পার্টিকেই বিরোধী দলের আসনে বসায় আওয়ামী লীগ।
জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার মধ্যে জাতীয় পার্টির (জাপা) মূল ধারাটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন এরশাদ।
নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসা এরশাদ স্বৈর শাসকের তকমা পেয়েছিলেন। নানা কারণে তিনি ছিলেন আলোচিত সমালোচিত। কিন্তু গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনা ও ‘৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’ এই স্লোগান দিয়ে গ্রাম-বাংলায় তিনি ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। এজন্য পার্টির পক্ষ থেকে তাকে পল্লীবন্ধু উপাধি দেয়া হয়। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগীতা সংস্থা (সার্ক) গঠনে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এরশাদ ভুমিকা রাখেন। এছাড়া উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থা কার্যকর করা, শিল্প, ভূমি সংস্কার, গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ উন্নয়নের পরিকল্পনা করেছিলেন। এছাড়া প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং দেশে ব্যক্তিখাতের বিকাশে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল সরকারি মালিকানাধীন উত্তরা, পুবালী ও রূপালী ব্যাংকের বিরাষ্ট্রীকরণ। এসময়ে দেশে প্রথমবারের মত কয়েকটি বেসরকারি বাণ্যিজ্যিক ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিকে কার্যক্রম শুরুর অনুমতি প্রদান করেন। দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন ও সংস্কারেও এরশাদ সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নেন। দেশের মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করার মাধ্যমে জেলার সংখ্যা ৬৪টি করা হয় এরশাদ সরকারের আমলে। আর এগুলোর অধীনে ৪৬০টি উপজেলা বিন্যস্ত করা হয়। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা বিকেন্দ্রিকরণের উদ্দেশ্যে এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৮শে এপ্রিল একটি প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও সংস্কার কমিশন গঠন করেন, যার সুপারিশ অনুযায়ী জনপ্রশাসনকে নতুন করে সাজানো হয়। এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেন, যা বাংলাদেশের অসামপ্রদায়িক চরিত্র বদলে দেয় বলে সমালোচনা করলেও পরবর্তীতে তা আর কোন সরকারই সংশোধণ করার উদ্যোগ নেয়নি। এছাড়া তিনি শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। ক্ষমতায় থাকার সময় সেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, দমনপীড়ন ও অনৈতিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ ছিল এরশাদের বিরুদ্ধে। ক্ষমতায় থাকার সময় পাওয়া উপহার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে আর্থিক অনিয়মের মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত এরশাদকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়। দুই যুগ পর হাইকোর্ট সেই সাজা বাতিল করে এরশাদকে খালাস দেন। জাপানি নৌযান কেনায় অনিয়মের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় এরশাদের প্রথমে তিন বছর এবং পরে হাইকোর্টে আপিলে সাজা কমে দুই বছরের কারাদণ্ড হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই বছর কারাগারে কাটানোয় এরশাদকে নতুন করে আর ওই মামলায় দণ্ড ভোগ করতে হয়নি। জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালত এরশাদকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলো। প্রায় ১৭ বছর পর হাইকোর্ট সাজা কমিয়ে এরশাদকে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চলাকালে এরশাদের সাড়ে ৩ বছর কারাভোগ শেষ হওয়ায় আপিল বিভাগ পরে জরিমানার দণ্ড বহাল রেখে এরশাদকে অবশিষ্ট দেড় বছর সাজাভোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। এছাড়া স্বর্ণ চোরাচালান, টেলিকম দুর্নীতি, পোল্ট্রি ফার্ম দুর্নীতি মামলা, আয়কর ফাঁকি, জাহাজ কেনায় দুর্নীতি, রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, হরিপুরে তেল অনুসন্ধানে দুর্নীতি এবং রাডার কেনায় দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে আরও ১৯টি মামলা ছিলো এরশাদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে কয়েকটিতে তিনি নিম্ন আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান। কয়েকটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়। তকে সেনা কর্মকর্তা মঞ্জুর হত্যা মামলাটি এখনও চলমান রয়েছে। এ মামলাটি এরশাদের সামনে তুরুপের তাস হিসেবে ছিল বলে অনেকে মনে করতেন।
সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা: হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রথম জানাজা বাদ যোহর ঢাকা সেনানীবাসের সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। নামাজে ইমামতি করেন ওই মসজিদের পেশ ইমাম ও ধর্মীয় শিক্ষক আহসান হাবীব। জানাজার পূর্বে এরশাদের ছোট ভাই ও জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন। তিনি এরশাদের বর্ণাঢ্য জীবন তুলে ধরে বলেন, রোববার সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে সিএমএইচে আমার বড় ভাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি ১৯৯১ সালের পর থেকে একটি সংসদ নির্বাচন ছাড়া প্রতিটি সংসদেই বিজয়ী হয়েছেন। তার পূর্বে ৯ বছর দেশের শাসনভার পরিচালনা করছেন। তিনি দেশ ও মানুষের স্বার্থে অনেক ভাল কাজ করে গেছেন। তিনি তিনবার কাবা ঘরের মধ্যে নামায পড়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। মানুষ মাত্রই ভুল হয়ে থাকে। তাই আমার ভাইও ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তিনি কোনো ভুল ত্রুটি করে থাকলে সকলে ভাইকে ক্ষমা করে দেবেন। জানাজার পূর্বে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এরশাদের পেশা জীবন তুলে ধরা হয়। এসময় জানানো হয়, এরশাদের দাফন সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হবে।
জানাজায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী ও সাবেক সেনা প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকসহ তিন বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকতারা অংশ নেন। এছাড়া এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের, বড় ছেলে শাদ এরশাদ, জাপা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, ব্যরিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সাহিদুর রহমান টেপা, হাবিবুর রহমানসহ পার্টির নেতাকর্মীরা জানাজায় অংশ নেন।
জাপার তিন দিনের শোক: জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে পার্টির পক্ষ থেকে তিনদিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল বিকালে জাপা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি জানান, সারাদেশে জাপার নেতাকর্মীরা তিনদিন শোক পালন করবে। এসময় নেতাকর্মীরা কালোব্যাচ ধারণ করবেন। জাপা কার্যালয়ে দলীয় পতাকার সঙ্গে কালো পতাকা টাঙানো থাকবে। এছাড়া ১৫ থেকে ১৮ই জুলাই পর্যন্ত শোকবই খোলা থাকবে। কূটনীতিকসহ সর্বসাধারণের জন্য তা উন্মুক্ত থাকবে।
প্রেসিডেন্ট পার্কে শোকাতুর এরিক: বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের ছয় তলায় ৭ হাজার ৪’শ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ। তার সঙ্গে থাকতো ছেলে এরিক এরশাদ। এরশাদ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে সে অনেকটা একা। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এরিক সকালে স্কুলে ছিল। এরশাদের মৃত্যুর পর সেখান থেকেই তাকে সিএমএইচে আনা হয়। এরশাদের ব্যক্তিগত গাড়ি চালক আব্দুল মান্নান জানান, সকালে এরিক’কে নিয়ে স্কুলে যান তিনি। সাড়ে আট’টার দিকে এরশাদের আরেক ব্যক্তিগত গাড়ির চালক আব্দুল আউয়াল তাকে ফোন করে বলেন এরিক’কে স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য, এরশাদের অবস্থা তেমন একটা ভালো না। এরিক’কে নিয়ে গাড়ি করে আব্দুল মান্নান সোজা চলে যান সিএমএইচ-এ। সেখানে বাবা’কে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এরিক। চাচা জিএম কাদের, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙাসহ পরিচিতজনকে দেখলেই জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে এরিক। সেনানীবাসের জানাজার পর এরিককে প্রেসিডেন্ট পার্কে নেয়া হয়। সেখানকার কর্মচারিরা জানিয়েছেন, বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে এরিক। সে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে পায়চারি করেছে আর কান্না করেছে।
যে প্রতিক্রিয়া দিলেন বিদিশা: হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন তার সাবেক স্ত্রী বিদিশা এরশাদ। এরশাদের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন তিনি। তিনি ভারতের আজমির শরীফে রয়েছেন। বিদিশা তার ফেসবুকে লেখেন, এ জন্মে আর দেখা হল না। আমিও আজমীর শরীফ আসলাম আর তুমিও চলে গেলে। এতো কষ্ট পাওয়ার থেকে মনে হয় এই ভালো ছিল। আবার দেখা হবে হয়তো অন্য এক দুনিয়াতে যেখানে থাকবে না কোনো রাজনীতি।
No comments