হাসিনা-লি বৈঠক ৩ চুক্তি সই

কূটনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ এবং সংস্কৃতি বিনিময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ৩টি চুক্তি সই হয়েছে। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সফররত কোরীয় প্রধানমন্ত্রী লি নাক-ইয়নের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর ওই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর আগে বিকাল সোয়া ৪টা থেকে দুই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীণ বাংলাদেশ ও কোরীয় প্রতিনিধি দলের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। তেজগাঁওস্থ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং চুক্তি সই হয়েছে বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস। বাসসের রিপোর্ট মতে, দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ঢাকা-সিউল বিদ্যমান সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই নতুন ৩ চুক্তি সই হয়। চুক্তিগুলো হচ্ছে- (এক) কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিপ্লোমেটিক একাডেমি এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা।
দুই. বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষে কোরীয় ট্রেড ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সি এবং বালাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির মধ্যে সমঝোতা। তৃতীয় এবং সর্বশেষ হচ্ছে- বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ২০১৯-২৩ সাল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক। কূটনীতি বিষয়ক সমঝোতায় দক্ষিণ কোরিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী লী তায়েহো এবং বাংলাদেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির প্রিন্সিপাল সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ খন্দকার নিজ নিজ দেশের পক্ষেই সই করেন।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত সমঝোতায় সই করেন এ সংক্রান্ত কোরীয় এজেন্সির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়ং ওহ এবং বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট অথরিটির নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল হক। আর সংস্কৃতি বিনিময় সংক্রান্ত সমঝোতায় নিজ নিজ দেশের পক্ষে সই করেন কোরীয় উপ-পররষ্ট্রমন্ত্রী লী তায়েহো এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. আবু হেনা মোস্তাফা কামাল। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী লি বিকেল সোয়া ৪টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে টাইগার গেইটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্বাগত জানান।
এ সময় ফুলের তোড়া দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। পরে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একান্ত বৈঠক হয়। এরপর প্রতিনিধি দলদ্বয়ের নিয়ে আনুষ্ঠানিক-দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কোরীয় প্রধানমন্ত্রী লি নিজ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠক এবং চুক্তি সইয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। সচিব জানান, টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে তার নেতৃত্বে গত ১০ বছরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন লি। ইহসানুল করিম বলেন, বৈঠকে কোরীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও বিনিয়োগের সুযোগ থাকার কথা তুলে ধরেন। কোরিয়া জ্বালানি, তথ্য-প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চায়। পরমাণু বিদ্যুতে বিনিয়োগেও দেশটির আগ্রহ রয়েছে। বৈঠকে শেখ হাসিনা দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশে কোরিয়ার আরও বেশী বিনিয়োগ দেখতে চেয়েছেন তিনি। কোরিয়ার বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রেস সচিব বলেন, জবাবে কোরিয়ান প্রতিনিধি দল বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের জন্য যা যা করা সম্ভব সবই করবে কোরিয়া: প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আরও জানান, দুই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীণ আনুষ্ঠানিক বৈঠক প্রায় ৪০ মিনিট স্থায়ী হয়। বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কট এবং দুই দেশের মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ পরিস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় আসে। নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গা এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মানবিক এ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের এবং দ্বিপক্ষীয় চাপ অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। প্রেস সচিব বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে এ-ও বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য যা যা করা সম্ভব সবই করবে কোরিয়া। বাংলাদেশের উন্নয়নে কোরিয়া সহায়তা অব্যাহত রাখবে জানিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জানান, বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) থেকে বাংলাদেশের জন্য তারা এক বিলিয়ন বরাদ্দ রেখেছেন। বাংলাদেশের এক হাজার ছাত্র কোরিয়াতে পড়াশোনা করেন। এর মধ্যে অনেকে বৃত্তি পান। এটি আরও বাড়ানোর আশ্বাস দেন কোরীয় প্রধানমন্ত্রী। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ৪ দেশ সফরের অংশ হিসাবে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী লি নাক-ইয়ন তিন দিনের সরকারি সফরে শনিবার বিকালে বাংলাদেশে আসেন।
বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় পাশে থাকবে দক্ষিণ কোরিয়া-লি: এদিকে মধ্য আয়ের দেশ দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী লি নাক-ইয়ান। রোববার বিকালে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই আশার কথা শোনান তিনি। প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন গণমাধ্যমকে বলেন, সাক্ষাতের সময় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালে মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তা সফল হবে। কোরিয়া বাংলাদেশের এই উন্নয়নযাত্রায় পাশে থাকবে। এর আগে বঙ্গভবনে পৌঁছালে লি নাক-ইয়োনকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান আবদুল হামিদ। সাক্ষাতে সময় আবদুল হামিদ বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে সমপ্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশে কোরিয়ান বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বাংলাদেশের রপ্তানি প্রকিয়াজাতকরণ এলাকায় (ইপিজেড) আরও বিনিয়োগের আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট বলেন, কোরিয়া এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। কোরিয়ার উন্নয়ন দেখে বাংলাদেশ উৎসাহিত।
স্মৃতিসৌধে কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা: ওদিকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার, সাভার থেকে জানান, সফররত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী লি নাক-ইয়োন গতকাল সকালে জাতির বীর সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে সকাল ৯টা ১০ মিনিটে স্মৃতিসৌধে প্রবেশ করেন। এ সময় তাকে স্বাগত জানান গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আকবর হোসেন। প্রায় ২০ মিনিট স্মৃতিসৌধে অবস্থানকালে তিনি বীর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে একটি ‘নাগেশ্বরী’ ফুলের একটি চারা রোপণ করেন। সবশেষে তিনি পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করে ৯টা ৩০ মিনিটে জাতীয় স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করে সাভারস্থ ডিইপিজেড (পুরাতন) জোনে দক্ষিণ কোরিয়ার মালিকানাধীন ইয়ংওয়ান হাইটেক স্পোর্টস ওয়্যার লি. কারখানাটি পরিদর্শনে যান। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা জেলার পুলিশ কমিশনার শাহ মিজান শাফিউর রহমান, গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবী এবং প্রধান বৃক্ষবিদ মো. শাহাদাত হোসেন কুদরত-ই-খোদা প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.