পাহাড়ে সেনাক্যাম্প বাড়ানোর দাবি by কাজী সোহাগ
বড়
ধরনের সন্ত্রাসী হামলার হুমকি রয়েছে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি,
বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ হুমকি দেয়া হচ্ছে। ১৮ই
মার্চ বাগাইছড়িতে উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের গাড়িতে জেএসএস (সন্তু
লারমা) এবং ইউপিডিএফ (প্রসিত) এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় ৮ জন
নিহত এবং ১৮ জন আহত হয়। এরপরই পাল্টা-পাল্টি হামলার হুমকি দেয়া হচ্ছে ওই
দুই সশস্ত্র গ্রুপের পক্ষ থেকে।
পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিষয়টি আমলে নিয়ে তৎপর রয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, এখানকার সশস্ত্র গ্রুপগুলো অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। পাহাড়কে অশান্ত করতে তারা সবসময় তৎপর থাকে। নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে একে অপরকে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ দেয়।
এতে প্রাণহানি ও ভোগান্তির শিকার হন নিরীহ মানুষ। ভয়ে ও নিরাপত্তাহীনতায় তটস্থ থাকেন তারা। গত কয়েক মাসে প্রায় অর্ধশত হত্যকান্ডের ঘটনা ঘটে পার্বত্য জেলাগুলোতে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শান্তিচুক্তির আওতায় সেনাবাহিনী এরইমধ্যে অনেক ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা।
যেসব এলাকা থেকে ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হচ্ছে সেসব এলাকায় রাতারাতি আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সশস্ত্র গ্রুপগুলো ওইসব এলাকা দখল ও পাল্টা দখলের খেলায় মেতে উঠছে। এতে বাড়ছে খুনোখুনি, চাঁদাবাজি আর অপহরণ ধর্ষণের মতো ঘটনা। সংশ্লিষ্টরা জানান, পার্বত্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ২৪০টি নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি একটি ব্রিগেড সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে চারটি ব্রিগেড কাজ করছে। এগুলো রয়েছে-রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও গুইমারায়। ২০০৮ সালে কাপ্তাই থেকে ব্রিগেডটি সরিয়ে নেয়া হয়। ফলে অরক্ষিত এ অঞ্চলের সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ হয়ে পড়েছে নিরাপত্তাহীন। এ অবস্থায় প্রত্যাহার করা ক্যাম্পগুলো পূণঃস্থাপন করা হলে শান্তি ও নিরাপত্তায় সহায়ক হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। রাঙ্গামাটি শহরের বাসিন্দা শামসুদ্দিন মানবজমিনকে জানান, আগে এখানে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করতে পারলেও এখন পরিস্থিতি খুবই খারাপ। যে কোন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে। সন্ধ্যা নামার আগেই বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু সেখানেও যে খুব নিরাপদ তা নয়।
শহরের তুলনায় প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে অবস্থা আরও বেশি খারাপ। দূর্গম এলাকা হওয়ায় সেসব জায়গা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তিনি বলেন, যেসব সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেসব জায়গা দখল করে নিয়েছে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। সেখানে তৈরি করছে নিজেদের আধিপত্য। এতে বাড়ছে চাঁদাবাজি আর খুনোখুনি। তিনি নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে প্রত্যাহার করা সেনাক্যাম্পগুলো আবারও স্থাপনের দাবি জানান। স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ে প্রতিযোগিতা করে চলছে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর চাঁদাবাজি। এসব সংগঠন সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতে শান্তিপ্রিয় পার্বত্যবাসির জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সন্ত্রাসীরা টোকেন কিংবা রশিদ দিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে। কৃষক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ী, সরকারী বেসরকারী অফিসিয়ালস কেউই সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে অস্ত্র সমর্পন করে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা। আর ঐদিনই প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শত শত উপজাতি পতাকা উত্তোলন করে অস্ত্র সমর্পন অনুষ্ঠানকে ধিক্কার জানান।
তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ঢাকায় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবীতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রণ্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হয়। শুরু হয় সন্তু ও প্রসীতের নেতৃত্বে দুই সংগঠনের আধিপত্য রক্ষার লড়াই। দ্বিমুখী,পাল্টা-পাল্টি হামলা। ২০১০ সালের ১০ই এপ্রিল জেএসএস ভেঙ্গে সুধা সিন্দু খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় জেএসএস (এমএন) গ্রুপ। এবার শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘাত। কখনো জেএসএস-ইউপিডিএফ আবার কখনো জেএসএস (সন্তু)- জেএসএস (এমএন)। কখনো কখনো নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংশ্লিষ্টরা জানান, চুক্তির পর গত ২১ বছরে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর দ্বন্ধে ৮ শতাধিক খুন হয় এবং ১৫শ’ গুম হয়েছে। এছাড়া এসব সংগঠনগুলোর পৃথক অংগসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, যুব সমিতি, মহিলা সমিতি ও গণতান্ত্রিক যুবফোরামসহ একাধিক শাখার সংগঠন রয়েছে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হাতে রয়েছে, এম-১৬, একে-৫৬, একে-৪৭, উজি গান, জি- থ্রি, মার্ক ফোর এলএমজি, এসএমজি ও রকেট লাঞ্চারসহ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত, পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বেড়েই চলেছে। চুক্তির আগে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন জেএসএসকে চাঁদা দিলে ব্যবসা- বাণিজ্য নির্বিঘ্নে করা যেতো।
কিন্তু চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে এসব সংগঠনের নামে ব্যাপক চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, এমন কোন সেক্টর নেই যেখান থেকে সন্ত্রাসীরা চাঁদা আদায় করছে না। তবে সবচেয়ে বেশি চাঁদা আদায় করা হয় বনজ সম্পদ ও উন্নয়ন প্রকল্প থেকে। এছাড়াও যানবাহন, বিভিন্ন টোল কেন্দ্র,বাজার ডাক, ফসলের জমি, জুম চাষ, গবাদিপশু এমনকি চাকরিজীবিদেরও বার্ষিক চাঁদা দিতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে চলাচলকারী প্রতিটি যানবাহনের মালিক, ব্যবসায়ি ও ঠিকাদাররা একাধিক সংগঠনকে ডিসেম্বর মাসে বাৎসরিক চাঁদা দিয়ে পরবর্তী বছরের টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন বিদেশী দাতা গোষ্ঠী ও সংস্থা এবং এনজিওদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে।
চাঁদা না দিলে অপহরণের শিকার হতে হয় । সূত্র মতে, ট্রাক, বাস বা কোষ্টার প্রতিটি বাৎসরিক চাঁদা হিসাবে সংগঠনগুলোকে ৬ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা, জীপ ২ থেকে ৩ হাজার টাকা, বেবিটেক্সি ১ থেকে ১৫শ টাকা, রিক্সা ২শ ও ৩শ, ব্যবসায়িক পাশ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, বড় সাইজের বাঁশ প্রতি হাজার ৪শ থেকে ৬ শ, উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে স্কুল,কলেজ ও মাদ্রাসা ১০% থেকে ১৫%, রাস্তা, সেতু কালভার্ট ও বিল্ডিং জেএসএস ১০%, কড়ই কাঠ, গর্জন, চাপালিশ ও সেগুন প্রতি ঘনফুট ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকা, প্রতিটি শ্রেণীর গোলকাঠ ফুট প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা, কলা, আদা হলুদ, সবজি, ধান ও চাল ভর্তি প্রতি ট্রাক ৪শ থেকে ৬শ টাকা, প্রতিটি বাছুর ৫০ টাকা থেকে ৭৫ টাকা, ষাড় বা গরু ১শ থেকে ১৫০ টাকা, ছাগল ৪০টাকা থেকে ৫০ টাকা,রাইচ মিল ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা করে আদায় করছে। এছাড়াও কৃষক ও জুম চাষীদের একর হিসাব করে চাঁদা দিতে হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব উপজাতী চাকরিজীবী রয়েছেন তাদেরকেও বার্ষিক হারে চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে-মৌসুমী চাঁদা। যেমন-বৈসাবি উপলক্ষে পাহাড়ে ব্যাপক চাঁদাবাজি হয়।
কিছুদিন আগে সমাপ্ত হওয়া সংসদ ও উপজেলা নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনী খরচের জন্য বিপুল অংকের চাঁদা আদায় করা হয়েছে। আবার নির্বাচনে হেরে গিয়েও নির্বাচনী ক্ষয়ক্ষতি ওঠানের জন্য চিঠি দিয়ে নতুন করে চাঁদাবাজি করা হয়েছে। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি বছর প্রায় ৩শত কোটি টাকারও বেশি চাঁদা আদায় হচ্ছে। সশস্ত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন পদ্ধতিতে চাঁদা আদায় করে থাকে। চাঁদা আদায় করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৬টি উপজেলা ছাড়াও ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে তাদের রয়েছে কালেক্টর। স্থানীয়রা জানান,সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিলে পরবর্তীতে অপহরণসহ বড় ধরনের বিপদে পড়তে হয়। ফলে অনেকে নিরবে-নিভৃতে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পাহাড়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে এটা সবাই জানে। তবে কেউ অভিযোগ করছে না। যেখানে অভিযোগ পাচ্ছে প্রশাসন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। প্রশাসন চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। ধরাও পড়ছে। সাধারণ মানুষ ঘুরে দাঁড়ালে এবং প্রশাসনকে সহযোগিতা করলে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীরা পালাতে বাধ্য হবে বলে জানান তিনি।
পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিষয়টি আমলে নিয়ে তৎপর রয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, এখানকার সশস্ত্র গ্রুপগুলো অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। পাহাড়কে অশান্ত করতে তারা সবসময় তৎপর থাকে। নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে একে অপরকে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ দেয়।
এতে প্রাণহানি ও ভোগান্তির শিকার হন নিরীহ মানুষ। ভয়ে ও নিরাপত্তাহীনতায় তটস্থ থাকেন তারা। গত কয়েক মাসে প্রায় অর্ধশত হত্যকান্ডের ঘটনা ঘটে পার্বত্য জেলাগুলোতে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শান্তিচুক্তির আওতায় সেনাবাহিনী এরইমধ্যে অনেক ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা।
যেসব এলাকা থেকে ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হচ্ছে সেসব এলাকায় রাতারাতি আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সশস্ত্র গ্রুপগুলো ওইসব এলাকা দখল ও পাল্টা দখলের খেলায় মেতে উঠছে। এতে বাড়ছে খুনোখুনি, চাঁদাবাজি আর অপহরণ ধর্ষণের মতো ঘটনা। সংশ্লিষ্টরা জানান, পার্বত্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ২৪০টি নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি একটি ব্রিগেড সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে চারটি ব্রিগেড কাজ করছে। এগুলো রয়েছে-রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও গুইমারায়। ২০০৮ সালে কাপ্তাই থেকে ব্রিগেডটি সরিয়ে নেয়া হয়। ফলে অরক্ষিত এ অঞ্চলের সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ হয়ে পড়েছে নিরাপত্তাহীন। এ অবস্থায় প্রত্যাহার করা ক্যাম্পগুলো পূণঃস্থাপন করা হলে শান্তি ও নিরাপত্তায় সহায়ক হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। রাঙ্গামাটি শহরের বাসিন্দা শামসুদ্দিন মানবজমিনকে জানান, আগে এখানে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করতে পারলেও এখন পরিস্থিতি খুবই খারাপ। যে কোন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে। সন্ধ্যা নামার আগেই বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু সেখানেও যে খুব নিরাপদ তা নয়।
শহরের তুলনায় প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে অবস্থা আরও বেশি খারাপ। দূর্গম এলাকা হওয়ায় সেসব জায়গা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তিনি বলেন, যেসব সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেসব জায়গা দখল করে নিয়েছে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। সেখানে তৈরি করছে নিজেদের আধিপত্য। এতে বাড়ছে চাঁদাবাজি আর খুনোখুনি। তিনি নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে প্রত্যাহার করা সেনাক্যাম্পগুলো আবারও স্থাপনের দাবি জানান। স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ে প্রতিযোগিতা করে চলছে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর চাঁদাবাজি। এসব সংগঠন সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতে শান্তিপ্রিয় পার্বত্যবাসির জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সন্ত্রাসীরা টোকেন কিংবা রশিদ দিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে। কৃষক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ী, সরকারী বেসরকারী অফিসিয়ালস কেউই সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে অস্ত্র সমর্পন করে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা। আর ঐদিনই প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শত শত উপজাতি পতাকা উত্তোলন করে অস্ত্র সমর্পন অনুষ্ঠানকে ধিক্কার জানান।
তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ঢাকায় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবীতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রণ্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হয়। শুরু হয় সন্তু ও প্রসীতের নেতৃত্বে দুই সংগঠনের আধিপত্য রক্ষার লড়াই। দ্বিমুখী,পাল্টা-পাল্টি হামলা। ২০১০ সালের ১০ই এপ্রিল জেএসএস ভেঙ্গে সুধা সিন্দু খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় জেএসএস (এমএন) গ্রুপ। এবার শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘাত। কখনো জেএসএস-ইউপিডিএফ আবার কখনো জেএসএস (সন্তু)- জেএসএস (এমএন)। কখনো কখনো নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংশ্লিষ্টরা জানান, চুক্তির পর গত ২১ বছরে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর দ্বন্ধে ৮ শতাধিক খুন হয় এবং ১৫শ’ গুম হয়েছে। এছাড়া এসব সংগঠনগুলোর পৃথক অংগসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, যুব সমিতি, মহিলা সমিতি ও গণতান্ত্রিক যুবফোরামসহ একাধিক শাখার সংগঠন রয়েছে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হাতে রয়েছে, এম-১৬, একে-৫৬, একে-৪৭, উজি গান, জি- থ্রি, মার্ক ফোর এলএমজি, এসএমজি ও রকেট লাঞ্চারসহ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত, পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বেড়েই চলেছে। চুক্তির আগে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন জেএসএসকে চাঁদা দিলে ব্যবসা- বাণিজ্য নির্বিঘ্নে করা যেতো।
কিন্তু চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে এসব সংগঠনের নামে ব্যাপক চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, এমন কোন সেক্টর নেই যেখান থেকে সন্ত্রাসীরা চাঁদা আদায় করছে না। তবে সবচেয়ে বেশি চাঁদা আদায় করা হয় বনজ সম্পদ ও উন্নয়ন প্রকল্প থেকে। এছাড়াও যানবাহন, বিভিন্ন টোল কেন্দ্র,বাজার ডাক, ফসলের জমি, জুম চাষ, গবাদিপশু এমনকি চাকরিজীবিদেরও বার্ষিক চাঁদা দিতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে চলাচলকারী প্রতিটি যানবাহনের মালিক, ব্যবসায়ি ও ঠিকাদাররা একাধিক সংগঠনকে ডিসেম্বর মাসে বাৎসরিক চাঁদা দিয়ে পরবর্তী বছরের টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন বিদেশী দাতা গোষ্ঠী ও সংস্থা এবং এনজিওদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে।
চাঁদা না দিলে অপহরণের শিকার হতে হয় । সূত্র মতে, ট্রাক, বাস বা কোষ্টার প্রতিটি বাৎসরিক চাঁদা হিসাবে সংগঠনগুলোকে ৬ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা, জীপ ২ থেকে ৩ হাজার টাকা, বেবিটেক্সি ১ থেকে ১৫শ টাকা, রিক্সা ২শ ও ৩শ, ব্যবসায়িক পাশ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, বড় সাইজের বাঁশ প্রতি হাজার ৪শ থেকে ৬ শ, উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে স্কুল,কলেজ ও মাদ্রাসা ১০% থেকে ১৫%, রাস্তা, সেতু কালভার্ট ও বিল্ডিং জেএসএস ১০%, কড়ই কাঠ, গর্জন, চাপালিশ ও সেগুন প্রতি ঘনফুট ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকা, প্রতিটি শ্রেণীর গোলকাঠ ফুট প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা, কলা, আদা হলুদ, সবজি, ধান ও চাল ভর্তি প্রতি ট্রাক ৪শ থেকে ৬শ টাকা, প্রতিটি বাছুর ৫০ টাকা থেকে ৭৫ টাকা, ষাড় বা গরু ১শ থেকে ১৫০ টাকা, ছাগল ৪০টাকা থেকে ৫০ টাকা,রাইচ মিল ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা করে আদায় করছে। এছাড়াও কৃষক ও জুম চাষীদের একর হিসাব করে চাঁদা দিতে হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব উপজাতী চাকরিজীবী রয়েছেন তাদেরকেও বার্ষিক হারে চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে-মৌসুমী চাঁদা। যেমন-বৈসাবি উপলক্ষে পাহাড়ে ব্যাপক চাঁদাবাজি হয়।
কিছুদিন আগে সমাপ্ত হওয়া সংসদ ও উপজেলা নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনী খরচের জন্য বিপুল অংকের চাঁদা আদায় করা হয়েছে। আবার নির্বাচনে হেরে গিয়েও নির্বাচনী ক্ষয়ক্ষতি ওঠানের জন্য চিঠি দিয়ে নতুন করে চাঁদাবাজি করা হয়েছে। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি বছর প্রায় ৩শত কোটি টাকারও বেশি চাঁদা আদায় হচ্ছে। সশস্ত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন পদ্ধতিতে চাঁদা আদায় করে থাকে। চাঁদা আদায় করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৬টি উপজেলা ছাড়াও ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে তাদের রয়েছে কালেক্টর। স্থানীয়রা জানান,সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিলে পরবর্তীতে অপহরণসহ বড় ধরনের বিপদে পড়তে হয়। ফলে অনেকে নিরবে-নিভৃতে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পাহাড়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে এটা সবাই জানে। তবে কেউ অভিযোগ করছে না। যেখানে অভিযোগ পাচ্ছে প্রশাসন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। প্রশাসন চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। ধরাও পড়ছে। সাধারণ মানুষ ঘুরে দাঁড়ালে এবং প্রশাসনকে সহযোগিতা করলে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীরা পালাতে বাধ্য হবে বলে জানান তিনি।
No comments