উবারের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় by জিয়া চৌধুরী ও শাহনেওয়াজ বাবলু
তিন
বছরেরও বেশি সময় ধরে চালু রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ‘রাইড শেয়ারিং
সার্ভিস অ্যাপ’। মোটরসাইকেল ও গাড়িতে নগরীর বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াতে
শুরুর দিকে এসব অ্যাপ স্বস্তি দিলেও এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত
২৩শে এপ্রিল রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লাবণ্য নিহত হলে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর
নানা অনিয়ম ও সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ওই ঘটনায় শিক্ষার্থীকে বহনকারী
‘উবার মোটো’র চালক নিজের তথ্য গোপন করে রাইড শেয়ারিং অ্যাপে নিবন্ধন করেন
বলে জানান, ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব
কুমার সরকার। গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, উবার চালক সুমন
হাসপাতালে যে ঠিকানা দিয়েছিলেন সে ঠিকানা ছিল ভুয়া। এমনকি যে ঠিকানা দিয়ে
বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে সেই ঠিকানায়ও তাকে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া উবার অফিসে যে ঠিকানা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন সেটিও ভুয়া। তিনি বলেন, উবারের অফিসে ভুয়া ঠিকানা দিয়ে রাইডাররা নিবন্ধন করে সড়কে রাইড শেয়ারিং করার অনুমতি পায়।
রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো কোন রকম যাচাই বাছাই ছাড়া চালকদের অনুমতি দিচ্ছে। এসব চালকদের মধ্যে অনেকেই দক্ষ চালক না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাদক সেবন করে। নারীদের বাইকে তুলে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অযথা ব্রেক ধরে। আরোহীদের জন্য নিম্নমানের হেলমেট দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, চালক সুমন ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করায় তাকে খুঁজে পেতে পুলিশকে বেগ পেতে হয়েছে। তাকে আটক করতে পুলিশের অনেক সময়ও লেগেছে। উবার কর্তৃপক্ষও প্রথম দিকে কোন সহযোগিতা করেনি বলেও অভিযোগ করেন বিপ্লব কুমার সরকার। এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যের সূত্র ধরে মানবজমিন গত দুই দিন ধরে রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান উবারের নানা অনিয়ম বিষয়ে খোঁজ নেয়া শুরু করে। অন্তত ৫০ জন চালক ও যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে।
অনুসন্ধানে দেখা যায় ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা ২০১৭’র বেশিরভাগ নিয়ম মানছে না রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান উবার ও তাদের অধীনে থাকা চালকরা। অন্যের ড্রাইভিং লাইসেন্সে নিবন্ধন, ভুল ঠিকানায় নিবন্ধন, মোটরসাইকেল ও গাড়ি চালনায় অভিজ্ঞতা না থাকা, পরীক্ষা না করেই যাকে-তাকে নিবন্ধনের সুযোগ করে দেয়া, যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা না নেয়াসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে উবারের বিরুদ্ধে। রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানটির চালকরাই মানবজমিনকে এসব অভিযোগের কথা বলেছেন। অনেকে বলছেন এখন কিছুটা কড়াকড়ি করা হলেও শুরুর দিকে যারা ভুয়া কাজগপত্র ও তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করেছেন তারা প্রতিষ্ঠানটির সুনাম নষ্ট করছে। এছাড়া কাঙ্খিত গন্তব্যে না যেতে চাওয়া, একই দুরত্বে অন্য কোম্পানির চেয়ে দ্বিগুন ভাড়া নেয়া ও বিভিন্ন অভিযোগে তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। মাগুরা থেকে ঢাকায় আসা কামরুল ইসলাম(ছদ্মনাম) মাস তিনেক হয় উবারে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন।
নগরীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে মানুষকে পৌঁছে দেন। তিনি গতকাল মানবজমিনকে জানান, নিজের মোটরসাইকেল ও ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও উবার তাকে নিবন্ধন করেছে। সেক্ষেত্রে অন্য আরেকজনের নামে নিবন্ধন নিতে হয়েছে তাকে। অনেক দিন ধরে বেকার জীবনযাপন করায়, বাধ্য হয়ে অনিয়ম করেই উবারে নিবন্ধন করতে হয়েছে বলেও দাবি করেন কামরুল। তিনি বলেন, আমি ভুল কাগজপত্র দিয়ে নিবন্ধন করলেও উবার এজন্য কোন অংশে কম দায়ী নয়। এর আগে কখনো মোটরসাইকেল চালনার অভিজ্ঞতা না থাকলেও শুধুমাত্র রাইডার বাড়ানো ও নিজেদের মুনাফার জন্য উবার এরকম শ’ শ’ তরুণদের নিবন্ধন করাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। আরেকজন চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উবারের ধানমন্ডি অফিস থেকে তিনি নিবন্ধন নিয়েছেন। ড্রাইভিং পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা বা কাগজপত্র যাচাইয়ের কোন বালাই নেই বলেও জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন চালক।
‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা ২০১৭’র অনুচ্ছেদ ক: রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পরিচালনার শর্তাবলী’র ৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের ব্যবহৃত মোটরযানের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন: রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ফিটনেস সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ইনসিওরেন্স ও এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট ইত্যাদি হালনাগাদ থাকতে হবে। তবে, বেশিরভাগ মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে এমন নিয়ম মানা হচ্ছে না। কেন নিয়ম মানা হচ্ছে না জানতে চাইলে বেশ কয়েকজন চালক বলেন, এসব বিষয়ে উবারের তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা শুধু নিবন্ধন করাতে চায়, যত বেশি নিবন্ধন তত বেশি মুনাফা। এছাড়া নীতিমালার ক অনুচ্ছেদের আট ধারায় বলা আছে, নির্ধারিত স্ট্যান্ড/অনুমোদিত পার্কিং স্ট্যান্ড ব্যতীত কোন রাইড শেয়ারিং মোটরযান যাত্রী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রাস্তায় যেখানে-সেখানে অপেক্ষমান থাকতে পারবে না অর্থাৎ যাত্রী উঠানামা ব্যতীত এরূপ মোটরযানকে সর্বদা চলাচলরত অবস্থায় থাকতে হবে। এই নিয়মের কোন ধরনের তোয়াক্কাই করছে না উবার মোটোর চালকরা। যেখানে-সেখানে পার্কিং, মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে যানজট বাড়াচ্ছে এসব চালকরা। তাদের কারণে ট্রাফিক পুলিশের মামলার হারও আগের চেয়ে বেড়েছে।
১০ নম্বর ধারায় উল্লেখিত মোটরযান লাইসেন্স প্রাপ্তির এক বছর সময় অতিক্রান্ত না হলে রাইড শেয়ায়িং সার্ভিসে কেউ নিবন্ধন না পাওয়ার কথা থাকলেও এক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না। উবার মোটোর বেশিরভাগ মোটরসাইকেলই নতুন করে কেনা এবং অনেকে ঢাকার বাইরে থেকে এসে নতুন মোটরসাইকেল কিনে কাজে নেমে পড়ছেন। নীতিমালার অনুচ্ছেদ ‘খ’র ৫ ধারায় বলা আছে, বিআরটিএ’র ওয়েবসাইট ও রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের অ্যাপসে অভিযোগ দায়ের ও নিষ্পত্তির গতিবিধি অনুসরণের সুবিধাসহ সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে। অভিযোগে বলা হয়, বিআরটিএ ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এসব বিষয়ে অনলাইনে অবহিত করে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ শুধু দুঃখ প্রকাশ করে দায় সারে বলে দাবি করেন অনেক অভিযোগকারী। একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক নারী জানান, একবার মোটরবাইকে সেবা নিলে আমাকে চালক নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করে।
পরে, অভিযোগ করলেও উবার থেকে তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একবার শুধু আমার সঙ্গে মেইলে যোগাযোগ করে বলা হয়েছিল তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এরপর কোন ব্যবস্থার বিষয়ে আমাকে জানানো হয়নি। এছাড়া, নীতিমালার অনুচ্ছেদ ‘ছ’-এ ধূমপান ও মাদকাসক্ত কেউ রাইড শেয়ারিংয়ে নিবন্ধন নিতে পারবে না বলেও উল্লেখ থাকলেও উবার তাদের নিবন্ধন দেয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে কোন প্রশ্ন ও পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়নি। পাশাপাশি, নির্দিষ্ট দুরত্বে অন্য অ্যাপের চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশি ভাড়া কাটা, ক্রেডিট কার্ড সংযুক্ত করলে যাত্রা শুরুর আগেই টাকা কেটে নেয়া, রাইডাররা বার বার ট্রিপ ক্যান্সেল করে দিলেও রাইডারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলেও অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী। এছাড়া চালকের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে। বেশিরভাগ ড্রাইভারের রাজধানীর পথঘাট সম্পর্কে ধারণা নেই। আর শহরের অলিগলি না চেনার পাশাপাশি গ্রাম ও শহরে রাইডের গতিবিধি না বুঝেই নিজেদের ইচ্ছেমতো রাইড দেয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন যাত্রীরা। একাধিক সূত্র জানায়, অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ারিং পাঠাও-উবারে একই দূরুত্বে সময়ের সঙ্গে ওঠানামা করছে ভাড়ার পরিমাণ। নির্দেশিত ভাড়ার তুলনায় বেশ বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে যাত্রীদের।
উবারে পাঁচ কিলোমিটার দুরুত্বে প্রথম দিন যেখানে ১৮০ টাকা ভাড়া গুণতে হয়েছে যাত্রীদের, পরেরদিন একই দূরুত্বের পথে সেই ভাড়া ২৭৫ টাকা। কিন্তু উবার কল করার সময় সম্ভাব্য ভাড়া দেখানো হয়েছিল ১৭১ টাকা। এমন সব অভিযোগের বর্ণনা দিয়ে উবারের ফেসবুক পেজে আপত্তি জানাচ্ছেন অনেক গ্রাহক। তবে এতে উবার কর্তৃপক্ষ এবং চালকদের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। মো. আশরাফুল ইসলাম নামে একজন যাত্রী মানবজমিনকে বলেন, মিরপুর সাত নম্বর থেকে নাবিস্কোতে প্রতিদিন যাতায়াত করি। সকাল আটটায় ভাড়া আসে ২৩০ টাকা আর রাতে ফেরার সময় ভাড়া লাগে ১২০ টাকা। এমন পার্থক্যের বিষয়ে উবাররে বক্তব্য সকালে ডিমান্ড বেশি থাকে। আমার কথা হলো, তাহলে সিএনজি আর উবারের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কিনা? আবার কোন কোন রাইডার আছেন যাদের নামে রাইড শেয়ারিংয়ের কোন ডকুমেন্ট বা লাইসেন্স নেই। দেখা গেছে গাড়ির লাইসেন্স এবং ডকুমেন্ট রয়েছে একজনের নামে আর রাইডার আরেকজন।
নামে প্রকাশে অনিচ্ছুক এমনই এক রাইডার বলেন, আমি এই পেশায় এসেছি প্রায় ছয় মাস হলো। আমার কোন মোটরবাইক নেই। এক বড় ভাইয়ের মোটরবাইক এবং তার নামে রাইড শেয়ার কোম্পানির সব কাগজপত্র রয়েছে। আমি তার নাম করে এটা ব্যবহার করছি। এমন সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে উবারের বাংলাদেশে থাকা একাধিক অফিসে যোগাযোগ করা হলে কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন না বলে জানান। কোন অভিযোগ থাকলে উবারের সেন্ট্রাল মেইলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানটি। উবারের নানা অনিয়ম নিয়ে বিআরটিএ’তে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বেশ কিছু অনিয়মের বিষয়ে তারা অবগত বলে জানান। তবে নানা জটিলতায় এসব ব্যাপারে উবারকে তাগাদা দিলেও কোন সুফল মিলছে না বলেও দাবি এই কর্মকর্তার।
এছাড়া উবার অফিসে যে ঠিকানা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন সেটিও ভুয়া। তিনি বলেন, উবারের অফিসে ভুয়া ঠিকানা দিয়ে রাইডাররা নিবন্ধন করে সড়কে রাইড শেয়ারিং করার অনুমতি পায়।
রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো কোন রকম যাচাই বাছাই ছাড়া চালকদের অনুমতি দিচ্ছে। এসব চালকদের মধ্যে অনেকেই দক্ষ চালক না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাদক সেবন করে। নারীদের বাইকে তুলে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অযথা ব্রেক ধরে। আরোহীদের জন্য নিম্নমানের হেলমেট দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, চালক সুমন ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করায় তাকে খুঁজে পেতে পুলিশকে বেগ পেতে হয়েছে। তাকে আটক করতে পুলিশের অনেক সময়ও লেগেছে। উবার কর্তৃপক্ষও প্রথম দিকে কোন সহযোগিতা করেনি বলেও অভিযোগ করেন বিপ্লব কুমার সরকার। এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যের সূত্র ধরে মানবজমিন গত দুই দিন ধরে রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান উবারের নানা অনিয়ম বিষয়ে খোঁজ নেয়া শুরু করে। অন্তত ৫০ জন চালক ও যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে।
অনুসন্ধানে দেখা যায় ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা ২০১৭’র বেশিরভাগ নিয়ম মানছে না রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান উবার ও তাদের অধীনে থাকা চালকরা। অন্যের ড্রাইভিং লাইসেন্সে নিবন্ধন, ভুল ঠিকানায় নিবন্ধন, মোটরসাইকেল ও গাড়ি চালনায় অভিজ্ঞতা না থাকা, পরীক্ষা না করেই যাকে-তাকে নিবন্ধনের সুযোগ করে দেয়া, যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা না নেয়াসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে উবারের বিরুদ্ধে। রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানটির চালকরাই মানবজমিনকে এসব অভিযোগের কথা বলেছেন। অনেকে বলছেন এখন কিছুটা কড়াকড়ি করা হলেও শুরুর দিকে যারা ভুয়া কাজগপত্র ও তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করেছেন তারা প্রতিষ্ঠানটির সুনাম নষ্ট করছে। এছাড়া কাঙ্খিত গন্তব্যে না যেতে চাওয়া, একই দুরত্বে অন্য কোম্পানির চেয়ে দ্বিগুন ভাড়া নেয়া ও বিভিন্ন অভিযোগে তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। মাগুরা থেকে ঢাকায় আসা কামরুল ইসলাম(ছদ্মনাম) মাস তিনেক হয় উবারে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন।
নগরীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে মানুষকে পৌঁছে দেন। তিনি গতকাল মানবজমিনকে জানান, নিজের মোটরসাইকেল ও ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও উবার তাকে নিবন্ধন করেছে। সেক্ষেত্রে অন্য আরেকজনের নামে নিবন্ধন নিতে হয়েছে তাকে। অনেক দিন ধরে বেকার জীবনযাপন করায়, বাধ্য হয়ে অনিয়ম করেই উবারে নিবন্ধন করতে হয়েছে বলেও দাবি করেন কামরুল। তিনি বলেন, আমি ভুল কাগজপত্র দিয়ে নিবন্ধন করলেও উবার এজন্য কোন অংশে কম দায়ী নয়। এর আগে কখনো মোটরসাইকেল চালনার অভিজ্ঞতা না থাকলেও শুধুমাত্র রাইডার বাড়ানো ও নিজেদের মুনাফার জন্য উবার এরকম শ’ শ’ তরুণদের নিবন্ধন করাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। আরেকজন চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উবারের ধানমন্ডি অফিস থেকে তিনি নিবন্ধন নিয়েছেন। ড্রাইভিং পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা বা কাগজপত্র যাচাইয়ের কোন বালাই নেই বলেও জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন চালক।
‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা ২০১৭’র অনুচ্ছেদ ক: রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পরিচালনার শর্তাবলী’র ৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের ব্যবহৃত মোটরযানের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন: রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ফিটনেস সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ইনসিওরেন্স ও এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট ইত্যাদি হালনাগাদ থাকতে হবে। তবে, বেশিরভাগ মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে এমন নিয়ম মানা হচ্ছে না। কেন নিয়ম মানা হচ্ছে না জানতে চাইলে বেশ কয়েকজন চালক বলেন, এসব বিষয়ে উবারের তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা শুধু নিবন্ধন করাতে চায়, যত বেশি নিবন্ধন তত বেশি মুনাফা। এছাড়া নীতিমালার ক অনুচ্ছেদের আট ধারায় বলা আছে, নির্ধারিত স্ট্যান্ড/অনুমোদিত পার্কিং স্ট্যান্ড ব্যতীত কোন রাইড শেয়ারিং মোটরযান যাত্রী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রাস্তায় যেখানে-সেখানে অপেক্ষমান থাকতে পারবে না অর্থাৎ যাত্রী উঠানামা ব্যতীত এরূপ মোটরযানকে সর্বদা চলাচলরত অবস্থায় থাকতে হবে। এই নিয়মের কোন ধরনের তোয়াক্কাই করছে না উবার মোটোর চালকরা। যেখানে-সেখানে পার্কিং, মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে যানজট বাড়াচ্ছে এসব চালকরা। তাদের কারণে ট্রাফিক পুলিশের মামলার হারও আগের চেয়ে বেড়েছে।
১০ নম্বর ধারায় উল্লেখিত মোটরযান লাইসেন্স প্রাপ্তির এক বছর সময় অতিক্রান্ত না হলে রাইড শেয়ায়িং সার্ভিসে কেউ নিবন্ধন না পাওয়ার কথা থাকলেও এক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না। উবার মোটোর বেশিরভাগ মোটরসাইকেলই নতুন করে কেনা এবং অনেকে ঢাকার বাইরে থেকে এসে নতুন মোটরসাইকেল কিনে কাজে নেমে পড়ছেন। নীতিমালার অনুচ্ছেদ ‘খ’র ৫ ধারায় বলা আছে, বিআরটিএ’র ওয়েবসাইট ও রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের অ্যাপসে অভিযোগ দায়ের ও নিষ্পত্তির গতিবিধি অনুসরণের সুবিধাসহ সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে। অভিযোগে বলা হয়, বিআরটিএ ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এসব বিষয়ে অনলাইনে অবহিত করে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ শুধু দুঃখ প্রকাশ করে দায় সারে বলে দাবি করেন অনেক অভিযোগকারী। একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক নারী জানান, একবার মোটরবাইকে সেবা নিলে আমাকে চালক নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করে।
পরে, অভিযোগ করলেও উবার থেকে তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একবার শুধু আমার সঙ্গে মেইলে যোগাযোগ করে বলা হয়েছিল তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এরপর কোন ব্যবস্থার বিষয়ে আমাকে জানানো হয়নি। এছাড়া, নীতিমালার অনুচ্ছেদ ‘ছ’-এ ধূমপান ও মাদকাসক্ত কেউ রাইড শেয়ারিংয়ে নিবন্ধন নিতে পারবে না বলেও উল্লেখ থাকলেও উবার তাদের নিবন্ধন দেয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে কোন প্রশ্ন ও পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়নি। পাশাপাশি, নির্দিষ্ট দুরত্বে অন্য অ্যাপের চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশি ভাড়া কাটা, ক্রেডিট কার্ড সংযুক্ত করলে যাত্রা শুরুর আগেই টাকা কেটে নেয়া, রাইডাররা বার বার ট্রিপ ক্যান্সেল করে দিলেও রাইডারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলেও অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী। এছাড়া চালকের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে। বেশিরভাগ ড্রাইভারের রাজধানীর পথঘাট সম্পর্কে ধারণা নেই। আর শহরের অলিগলি না চেনার পাশাপাশি গ্রাম ও শহরে রাইডের গতিবিধি না বুঝেই নিজেদের ইচ্ছেমতো রাইড দেয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন যাত্রীরা। একাধিক সূত্র জানায়, অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ারিং পাঠাও-উবারে একই দূরুত্বে সময়ের সঙ্গে ওঠানামা করছে ভাড়ার পরিমাণ। নির্দেশিত ভাড়ার তুলনায় বেশ বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে যাত্রীদের।
উবারে পাঁচ কিলোমিটার দুরুত্বে প্রথম দিন যেখানে ১৮০ টাকা ভাড়া গুণতে হয়েছে যাত্রীদের, পরেরদিন একই দূরুত্বের পথে সেই ভাড়া ২৭৫ টাকা। কিন্তু উবার কল করার সময় সম্ভাব্য ভাড়া দেখানো হয়েছিল ১৭১ টাকা। এমন সব অভিযোগের বর্ণনা দিয়ে উবারের ফেসবুক পেজে আপত্তি জানাচ্ছেন অনেক গ্রাহক। তবে এতে উবার কর্তৃপক্ষ এবং চালকদের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। মো. আশরাফুল ইসলাম নামে একজন যাত্রী মানবজমিনকে বলেন, মিরপুর সাত নম্বর থেকে নাবিস্কোতে প্রতিদিন যাতায়াত করি। সকাল আটটায় ভাড়া আসে ২৩০ টাকা আর রাতে ফেরার সময় ভাড়া লাগে ১২০ টাকা। এমন পার্থক্যের বিষয়ে উবাররে বক্তব্য সকালে ডিমান্ড বেশি থাকে। আমার কথা হলো, তাহলে সিএনজি আর উবারের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কিনা? আবার কোন কোন রাইডার আছেন যাদের নামে রাইড শেয়ারিংয়ের কোন ডকুমেন্ট বা লাইসেন্স নেই। দেখা গেছে গাড়ির লাইসেন্স এবং ডকুমেন্ট রয়েছে একজনের নামে আর রাইডার আরেকজন।
নামে প্রকাশে অনিচ্ছুক এমনই এক রাইডার বলেন, আমি এই পেশায় এসেছি প্রায় ছয় মাস হলো। আমার কোন মোটরবাইক নেই। এক বড় ভাইয়ের মোটরবাইক এবং তার নামে রাইড শেয়ার কোম্পানির সব কাগজপত্র রয়েছে। আমি তার নাম করে এটা ব্যবহার করছি। এমন সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে উবারের বাংলাদেশে থাকা একাধিক অফিসে যোগাযোগ করা হলে কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন না বলে জানান। কোন অভিযোগ থাকলে উবারের সেন্ট্রাল মেইলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানটি। উবারের নানা অনিয়ম নিয়ে বিআরটিএ’তে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বেশ কিছু অনিয়মের বিষয়ে তারা অবগত বলে জানান। তবে নানা জটিলতায় এসব ব্যাপারে উবারকে তাগাদা দিলেও কোন সুফল মিলছে না বলেও দাবি এই কর্মকর্তার।
No comments