ত্বকীর জবানবন্দি by ড. সফিউদ্দিন আহমদ
দেখতে
দেখতে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ছয় বছর পেরিয়ে গেল। ত্বকী হত্যার পর
আমি নারায়ণগঞ্জে পাঁচটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে
আমার পাশেই ছিলেন ত্বকীর বাবা। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের আদর্শিক
মেলবন্ধন। সাংগঠনিক কাজে তিনি আমার রায়পুরার বাড়িতে গিয়েছেন। একজন আদর্শিক
সাথী হিসেবে আমি তাকে যতোটুকু জেনেছি তিনি একজন সুসংস্কৃত, পরিমার্জিত ও
নন্দিত মানুষ, সব সময়ই তার মুখে হাসি লেগেই থাকতো। তবে ত্বকী হত্যার পর
যদিও আমার মনে হয়েছে প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড এক বিধ্বস্ত প্রান্তর।
অথবা সুনামিতে ক্ষত-বিক্ষত এক বিবর্ণ ছবি।
এরপরও তিনি বিভ্রান্ত বা আদর্শচ্যুত হন নি।
একদিন মানুষের শত্রু ছিল সাপ, বাঘ, সিংহ, হিংস্র জন্তু ও ভয়াল প্রকৃতি। আজ মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রু মানুষ। এইমাত্র যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে তার জন্য এক ফোঁটা দুধ বরাদ্দ নেই- কিন্তু তাকে হত্যা করার জন্য রয়েছে লক্ষ কোটি ডলার পাউন্ডের অস্ত্র। আজ মানুষের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা মানুষকে হত্যা করার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র আবিষ্কার। যুদ্ধোন্মাদ রক্তপাগল এই নরঘাতক মানুষকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ- ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিবাইছে তব আলো,/তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?’
ত্বকীকে নিয়ে কোনো দার্শনিকতার প্রয়োজন নেই। তার কবিতার মাধ্যমেই জনান্তিকে সে যে জবানবন্দি দিয়ে গেছে- এই জবানবন্দিতেই পুরো ত্বকীকে খুঁজে পাওয়া যাবে এবং তার বাবার লেখাটিও তার জীবনের মূল আকর। প্রথমেই আমি বলবো যে, হয়তো পারিবারিক আবহ বিশেষ করে তার আদর্শিক বাবা ও মা’র চিন্তা-চেতনার অভিযোজনায়ই ছোটকাল থেকেই তার মনে জীবন, জগৎ, বৈশ্বিক বলয়, দেশ, মাটি ও মানুষ, বিশ্বপ্রকৃতি এবং শোষণ-পেষণ ও নির্যাতন সম্বন্ধে একটা জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসার উৎসারণ ঘটেছিল। আর এমনটি ছিল বলেই তার মৃত্যুর মাত্র ক’দিন আগে তার কলম থেকে বের হলো-
আমি প্রস্তর হয়ে মরলাম উদ্ভিদ হতে
উদ্ভিদ হয়ে মরি, তো উত্থিত প্রাণে
মানুষ হয়ে উঠলাম পরে, যখন সত্য উদ্ভাসিত হলো
ভয় কিসের? দ্বিধা কেন মৃত্যুতে?
একজন কিশোরের এই ভাবনা, এই চিন্তা বিশ্বের তাবৎ দর্শন, জীবন-জগৎ ও বিবর্তন-আবর্তনকে উতরিয়ে, সমস্ত দর্শনকে উজিয়ে আমাদের বিস্মিত ও স্তম্ভিত করে দেয়। মনে মনে ভাবি এ কী কোন অলৌকিক বাণী! এ দর্শনের পাঠ সে কোথায় পেলো? কেউ কী কল্পনা করতে পারেন যে এ দর্শন কোনো এক কিশোরের!
কিশোর ত্বকী যে বয়সে নিহত হয়েছে এ সময়টা ছিল কল্পনার, রঙিন কাঁচ দিয়ে রঙিন পৃথিবীকে দেখার। এ বয়সের পৃথিবীটা গানময়, প্রাণময়, আনন্দময়, প্রজাপতির রঙিন পাখায় ভর করা এবং আকাশে লক্ষ তারার দেয়ালি উৎসবে মেতে ওঠা, ফুল নিয়ে পাখি নিয়ে মাতোয়ারা হওয়া। কিন্তু না, কিশোর ত্বকী কল্পনার রঙিন কাঁচ দিয়ে পৃথিবী দেখে নি। সে দেখেছে- খুন, সন্ত্রাস, হত্যা, শোষণ, নির্যাতন, অন্যায় ও অত্যাচার এবং দেখেছে, ‘জননী মাগিছে ভিক্ষা ঘরে ঢেকে রেখে ছেলের লাশ।’ সমাজের এই দৃশ্য ত্বকীকে চকিত করে। সে উঁকি দিয়ে তাকায় সময়ের ঘড়ির কাঁটার দিকে। মিথ্যে হয়ে যায় তার কাছে ‘মানুষ মানুষের জন্য’। মানুষের এই দানবীয় হুঙ্কার ও পৈশাচিক কাণ্ড দেখে এই কিশোর চিৎকার করে।
কার্ল মার্কস শ্রেণি চরিত্রের কথা বলেছেন। ঘাতকশ্রেণির ঘাতকেরা চিরদিনই ঘাতক এবং তারা একই শ্রেণির। হিটলার, আলবদর, আলশামস, রাজাকার আর সকল নরখেকো নরঘাতক শ্রেণি চরিত্র হিসেবে তারা একই। এরা দেবোপম গোবিন্দদেব, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সোমেন চন্দ ও ত্বকীকে একই পদ্ধতিতে হত্যা করে। এরা নির্মম, নিষ্ঠুর, এরা ক্ষুধার্ত কুকুর। এদের হাতে কারো রক্ষা নেই। ওরা জান্তব পশু। রক্তের খেলায়, রক্তের হোলি-উৎসবে ওরা মেতে ওঠে। কিশোর কবি ত্বকী এ বিষয়টি ভালো করেই উপলব্ধি করেছিল। তার রক্তকণিকার প্রবাহে, প্রাণের স্পন্দনে এ চেতনা চন্ চন্ স্পন্দনে স্পন্দিত হয়ে উঠেছে।
ত্বকীর কবিতা যতোই পড়ি ততোই আমি বিস্মিত হই তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনা এবং তীক্ষ্ণ ও তীব্র সমাজ সচেতনতা বোধে। মুগ্ধতায় ভরে দেয় আমাকে বাণী বিন্যাস, শব্দ প্রয়োগ ও বক্তব্যের ওজস্বিতায়। তার কবিতা পড়লে মনে হয় সে তার বয়সকে ছাড়িয়ে অনেকটাই সামনে এগিয়ে গেছে এবং পরিণত ফুল ও ফল দেয়ার সময় এসেছে।
এখানে একটি বিষয় আমাকে বলতে হচ্ছে যে, আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দীর উত্তরণে এসেছি। কিন্তু আমাদের সন্তানদের, আমাদের শিক্ষার্থীদের কেন জানি এখনো পুরোপুরিভাবে মৃত্তিকাস্পর্শী ও শিকড় সন্ধানী করে তুলতে পারি নি। কেনো জানি এখনো তাদের দেশ, সমাজ, মাটি ও মানুষ এবং জীবন জিজ্ঞাসা ও আত্মজিজ্ঞাসায়, উৎসের সন্ধানে, স্বরূপের সন্ধানে ও আত্মপরিচয়ে অনুসন্ধিৎসু করে তুলতে পারি নি। এ ব্যর্থতা আমাদেরই। আমরা যারা শিক্ষক এবং কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী। আমরা তো আমাদের মহিমান্বিত অতীত ও গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে এবং আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমাদের শিক্ষার্থী তথা আমাদের আজকের প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারি নি। এবং এক ধরনের ঔপন্যাসিক ও কল্পলোক আমাদের সন্তান ও শিক্ষার্থীদের তাদের কল্পকাহিনীতে আকাশে উড়িয়ে ও দূরায়ন বাসনার নৌকায় ভাসিয়ে মৃত্তিকাবিচ্যুত ও শিকড়বিহীন করে নেশায় মাতোয়ারা করে তুলছে। এবং তারা শেষ পর্যন্ত টানেলে আশ্রয় নেয়- হিরোইন ও মাদকাসক্ত হয়ে যায়।
আমাকে বিস্মিত করে ত্বকীর দেশ, সমাজ, মানুষ ও স্বদেশ চিন্তা এবং মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার ভাবনা। এ সাধারণ কথা নয় যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দী পরও আজকের এই কিশোর মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নতুন করে ভাবছে। ত্বকীর শিকড় মহিমান্বিত অতীত আর গৌরবোজ্জ্বল বাংলাদেশের হৃদয়ে প্রোথিত। ত্বকীর মন-মানসের গভীরতায়- বলা যায় মুক্তিযুদ্ধ তার হৃদস্পন্দনে, আত্মার গভীরে, রক্তকণিকার প্রবাহে ও প্রাণের স্তরে স্তরে। আর এসব কিছুরই মূল আকর তার বাবা-মা ও পারিবারিক ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক আবহ। আমি বিস্মিত হই কিশোর ত্বকী যখন বলে, ‘সবারই আদর্শ হবে বাংলাদেশের সেইসব সন্তান/যাঁরা যুদ্ধের ডাক দিয়েছিল,/ যাঁরা অপেক্ষায় আছে আজো একটি বিচারের-/একটি বিচার/ যা শেষ করার জন্যে তাঁরা/যুদ্ধের সেই সব নায়কেরা/ডাক দিয়ে যায়-/জাতির জন্যে, জেগে ওঠার জন্যে/ওই জাতির জন্যে; যারা ধ্বংসের মধ্যেও/নতুন জীবনের ডাক দিয়ে যায়;/ তুমি কি শুনতে পাও/সেই সব শহীদদের কণ্ঠস্বর?’
ত্বকী প্রত্যয়ী, আশাবাদী। সে জানে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তের বদলে, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্তের বদলে ক্ষুধাহীন, শ্রেণিহীন, শোষণহীন এক নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। সামনে ওই নতুন সূর্য উঠবে। এই ত্বকীর আশাবাদ, ‘অবশ্যই বাংলাদেশ জেগে উঠবে/সামনের উজ্জ্বল দিন/মেঘমুক্ত আকাশ/আমার রূপসী বাংলাদেশ/কোথায় আর সব/যাঁরা ধাবমান/যাঁরা পেছনেও নেতৃত্বে থাকে /যাঁরা ভয়ের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে/তাঁরা অপেক্ষায় আছে,/তুমি ফিরে এসো, /ফিরে এসো সেখান থেকে/ফিরে এসো /আমার বাংলাদেশ।’
ত্বকীর কবিতাগুলো ভালো করে পড়লেই উপলব্ধি করা যাবে যে, তার কবিতায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে একটি প্রতিবাদী চেতনা এবং সমাজ প্রগতি ও সমস্ত প্রতিবন্ধকতা থেকে মানুষের মুক্তি। কবিতাকে ত্বকী বিলাসী আর্টের চর্চা করেনি অথবা কলাকৈবল্যবাদীদের মতো ‘কেবলই স্বপন করেছি বপন পবনে’ এমন নয়। তার কবিতার অন্তরের উদ্ভাস বিশ্লেষণ করলেই আমরা দেখতে পাবো- সেখানে একটা দৈশিক ও সামাজিক উপযোগিতা আছে। আমরা বলবো কল্পনা থেকে নয়- ত্বকীর কবিতায় যে তীব্র তীক্ষ্ণ সমাজ সচেতনতা তা আদর্শিক চেতনার আত্মস্থতা থেকে। কারণ বাবা-মা’র আদর্শের বুনন তার হৃদয়তন্ত্রিতে। কাজেই এ জমিনে প্রগতির ফসল, সাম্যের ফসল ও মানবমুক্তির ফসল ফলবেই। শ্রমে-ঘামে সিক্ত মানুষের মিছিল ও প্রগতির পতাকা হাতে জনতার মিছিল সামনে যাবেই।
আমাকে মুগ্ধতায় ভরে দেয় ত্বকীর কবিতার বিষয়বস্তু, শিরোনাম, প্রতীক, উপমা, উদাহরণ ও উৎপ্রেক্ষা, তার বাণীবিন্যাস ও চিত্রকল্প। তার কবিতা পড়লে কখনো বোঝা যায় না যে, এক কিশোরের লেখা। সে মিতবাক, প্রমিত ও সংযমিত। আর তার ধ্যানে ও জ্ঞানে, ভাব ও মনন-পরিমণ্ডলে দ্রবীভূত হয়ে আছে মানুষ, বাংলাদেশ ও স্বাদেশিক চেতনা-।
ত্বকীর মধ্যে জেগে উঠেছিল বিশ্ব-বোধ ও বৈশ্বিক চেতনা। মানুষে মানুষে যে ভেদাভেদের দুর্গ- এ দুর্গ ভেঙে মানুষকে একই কাতারে দাঁড়াতে হবে। ভুলে যেতে হবে এই ভেদাভেদ-বৈষম্য। নজরুল যেমন এক মোহনায় দাঁড়িয়ে এক মিলনের গান গাওয়ার কথা বলেছেন- তেমনি কিশোর ত্বকীও বলেছে- ‘সমগ্র মানবজাতি আজ এক কাতারে দাঁড়াবে-/হিংসা বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে,/ জলাঞ্জলি দিয়ে হিসেব কষা,/ ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান-/ বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।’
ত্বকীর ‘কারা সেই রাজহাঁস’ কবিতাটি আমাদের হৃদয়কেও ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করে। মনে পড়ে তমসা তীরে নিষ্ঠুর ব্যাধ ক্রৌঞ্চ পাখির বুকে তীর নিক্ষেপ করেছিল- ক্রৌঞ্চপাখির বিদীর্ণ বক্ষ থেকে টপটপ করে পড়েছিল রক্তের ফেঁাঁটা। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে বাল্মীকির কণ্ঠ থেকে বের হয়ে আসে অলৌকিক ছন্দ ও কাব্যবাণী- তেমনি আমাদের সমাজে খুন, হত্যা, লাশের মিছিল দেখে ত্বকীর হৃদয়ও ক্ষতাক্ত ও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে।
তার বাবার জবানীতে- ‘বন্ধুবান্ধব- হইহুল্লোড় খুব একটা পছন্দ করতো না। বন্ধু তেমন একটা ছিলও না। বন্ধু বলতে হয়তো আমিই ছিলাম। কারণ ওর যা বলার, যতটুকু বলার প্রয়োজন বোধ করতো, আমার সঙ্গেই করতো। কারো বিরুদ্ধে কখনো অভিযোগ ছিল না। বন্ধু, পরিজন, শিক্ষক কারো সম্পর্কে কখনো কোনো অভিযোগ করেনি। কেউ দুঃখ পাবে, এমন আচরণ ছিল ওর নীতি ও রীতিবিরুদ্ধ। দূরের বা অপছন্দের কেউ হলেও না। ছিল স্বল্প ও মৃদুভাষী। প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছে ছিল। বলেছিলাম, এ-লেভেল শেষে দেশের বাইরে চলে যাও। পড়াশোনা শেষ করে ফিরে এসো। ও দেশের বাইরে যেতে চাইতো না। মাকে বলতো, দেশে থেকে কি লেখাপড়া হবে না? দেশের পড়াশোনা কি এতই খারাপ যে বাইরে যেতেই হবে? আমি শুনে বললাম, বাইরে যাওয়াটা দোষের কিছু না। আমাদের সামনের যে মানুষগুলো রয়েছেন, তারা সবাই তো বাইরে গিয়েছেন, বিশ্ব ঘুরেছেন। বাইরে না গেলে ভেতরটাকে ঠিক জানা যায় না। ভেতরটা ভালো করে জানার জন্য, বোঝার জন্য হলেও বাহিরটাকে জানার প্রয়োজন পড়ে। আমার সঙ্গে কিছুই বললো না। পরে মাকে বললো, তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না, থাকতে পারবো না।’
ত্বকীর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বিস্মিত হই। দু’চোখ দিয়ে সে মহাবিশ্বকে, দূর নাক্ষত্রিক জগৎকে দেখে নিতে চায়। এ চোখের সঙ্গে একমাত্র তুলনা মেলে র্যাঁবোর। ত্বকী আর র্যাঁবোর চোখে কি দুরন্ত চাহনি, কী দুরন্ত আহ্বান ও অনালোকিত-অনালোচিত এবং অচেনা জগতের ভাষা। ত্বকীর চোখে যেনো কল্পনা ও আগুনের স্ফূরণ আবার কখনো সংগ্রামের বিজয় উল্লাসের ঝলক।
ত্বকীরা সব সময়ই দুশমনের দুর্জয় দুর্গ ভেঙে, কালের করাল প্রহরাকে উত্তরণে সমসাময়িককে পেছনে ফেলে যায় বলেই সাম্প্রদায়িক চণ্ডশক্তি, কালের বৃত্তে বন্দি রক্ষণশীলরা, প্রথাবদ্ধ ও প্রগতির প্রতিরোধকারীরা ত্বকীদের সহ্য করতে পারে না। আর তাই তাদের হত্যা করে রক্তের হোলি-উৎসবে মেতে ওঠে। অবশ্যি হত্যার পরও ত্বকীরা কালোত্তীর্ণ হয়ে বেঁচে থাকে মানুষের মনে, প্রাণে ও রক্তকণিকার স্পন্দনে। তাই ত্বকীদের নিমন্ত্রণ- কালে কালে, লোকে লোকে, আলোকে আলোকে।
ত্বকীর এই নির্মম হত্যার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্মরণে এসেছে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী ও সোমেন চন্দকে। আমি বার বার দেখি একই অভিযোজনায় তারা দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে উচ্চারণ করছেন-
‘ও আমার দেশের মাটি
তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।’
ড. সফিউদ্দিন আহমদ: শিক্ষাবিদ, লেখক,
সভাপতি: বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
এরপরও তিনি বিভ্রান্ত বা আদর্শচ্যুত হন নি।
একদিন মানুষের শত্রু ছিল সাপ, বাঘ, সিংহ, হিংস্র জন্তু ও ভয়াল প্রকৃতি। আজ মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রু মানুষ। এইমাত্র যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে তার জন্য এক ফোঁটা দুধ বরাদ্দ নেই- কিন্তু তাকে হত্যা করার জন্য রয়েছে লক্ষ কোটি ডলার পাউন্ডের অস্ত্র। আজ মানুষের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা মানুষকে হত্যা করার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র আবিষ্কার। যুদ্ধোন্মাদ রক্তপাগল এই নরঘাতক মানুষকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ- ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিবাইছে তব আলো,/তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?’
ত্বকীকে নিয়ে কোনো দার্শনিকতার প্রয়োজন নেই। তার কবিতার মাধ্যমেই জনান্তিকে সে যে জবানবন্দি দিয়ে গেছে- এই জবানবন্দিতেই পুরো ত্বকীকে খুঁজে পাওয়া যাবে এবং তার বাবার লেখাটিও তার জীবনের মূল আকর। প্রথমেই আমি বলবো যে, হয়তো পারিবারিক আবহ বিশেষ করে তার আদর্শিক বাবা ও মা’র চিন্তা-চেতনার অভিযোজনায়ই ছোটকাল থেকেই তার মনে জীবন, জগৎ, বৈশ্বিক বলয়, দেশ, মাটি ও মানুষ, বিশ্বপ্রকৃতি এবং শোষণ-পেষণ ও নির্যাতন সম্বন্ধে একটা জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসার উৎসারণ ঘটেছিল। আর এমনটি ছিল বলেই তার মৃত্যুর মাত্র ক’দিন আগে তার কলম থেকে বের হলো-
আমি প্রস্তর হয়ে মরলাম উদ্ভিদ হতে
উদ্ভিদ হয়ে মরি, তো উত্থিত প্রাণে
মানুষ হয়ে উঠলাম পরে, যখন সত্য উদ্ভাসিত হলো
ভয় কিসের? দ্বিধা কেন মৃত্যুতে?
একজন কিশোরের এই ভাবনা, এই চিন্তা বিশ্বের তাবৎ দর্শন, জীবন-জগৎ ও বিবর্তন-আবর্তনকে উতরিয়ে, সমস্ত দর্শনকে উজিয়ে আমাদের বিস্মিত ও স্তম্ভিত করে দেয়। মনে মনে ভাবি এ কী কোন অলৌকিক বাণী! এ দর্শনের পাঠ সে কোথায় পেলো? কেউ কী কল্পনা করতে পারেন যে এ দর্শন কোনো এক কিশোরের!
কিশোর ত্বকী যে বয়সে নিহত হয়েছে এ সময়টা ছিল কল্পনার, রঙিন কাঁচ দিয়ে রঙিন পৃথিবীকে দেখার। এ বয়সের পৃথিবীটা গানময়, প্রাণময়, আনন্দময়, প্রজাপতির রঙিন পাখায় ভর করা এবং আকাশে লক্ষ তারার দেয়ালি উৎসবে মেতে ওঠা, ফুল নিয়ে পাখি নিয়ে মাতোয়ারা হওয়া। কিন্তু না, কিশোর ত্বকী কল্পনার রঙিন কাঁচ দিয়ে পৃথিবী দেখে নি। সে দেখেছে- খুন, সন্ত্রাস, হত্যা, শোষণ, নির্যাতন, অন্যায় ও অত্যাচার এবং দেখেছে, ‘জননী মাগিছে ভিক্ষা ঘরে ঢেকে রেখে ছেলের লাশ।’ সমাজের এই দৃশ্য ত্বকীকে চকিত করে। সে উঁকি দিয়ে তাকায় সময়ের ঘড়ির কাঁটার দিকে। মিথ্যে হয়ে যায় তার কাছে ‘মানুষ মানুষের জন্য’। মানুষের এই দানবীয় হুঙ্কার ও পৈশাচিক কাণ্ড দেখে এই কিশোর চিৎকার করে।
কার্ল মার্কস শ্রেণি চরিত্রের কথা বলেছেন। ঘাতকশ্রেণির ঘাতকেরা চিরদিনই ঘাতক এবং তারা একই শ্রেণির। হিটলার, আলবদর, আলশামস, রাজাকার আর সকল নরখেকো নরঘাতক শ্রেণি চরিত্র হিসেবে তারা একই। এরা দেবোপম গোবিন্দদেব, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সোমেন চন্দ ও ত্বকীকে একই পদ্ধতিতে হত্যা করে। এরা নির্মম, নিষ্ঠুর, এরা ক্ষুধার্ত কুকুর। এদের হাতে কারো রক্ষা নেই। ওরা জান্তব পশু। রক্তের খেলায়, রক্তের হোলি-উৎসবে ওরা মেতে ওঠে। কিশোর কবি ত্বকী এ বিষয়টি ভালো করেই উপলব্ধি করেছিল। তার রক্তকণিকার প্রবাহে, প্রাণের স্পন্দনে এ চেতনা চন্ চন্ স্পন্দনে স্পন্দিত হয়ে উঠেছে।
ত্বকীর কবিতা যতোই পড়ি ততোই আমি বিস্মিত হই তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনা এবং তীক্ষ্ণ ও তীব্র সমাজ সচেতনতা বোধে। মুগ্ধতায় ভরে দেয় আমাকে বাণী বিন্যাস, শব্দ প্রয়োগ ও বক্তব্যের ওজস্বিতায়। তার কবিতা পড়লে মনে হয় সে তার বয়সকে ছাড়িয়ে অনেকটাই সামনে এগিয়ে গেছে এবং পরিণত ফুল ও ফল দেয়ার সময় এসেছে।
এখানে একটি বিষয় আমাকে বলতে হচ্ছে যে, আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দীর উত্তরণে এসেছি। কিন্তু আমাদের সন্তানদের, আমাদের শিক্ষার্থীদের কেন জানি এখনো পুরোপুরিভাবে মৃত্তিকাস্পর্শী ও শিকড় সন্ধানী করে তুলতে পারি নি। কেনো জানি এখনো তাদের দেশ, সমাজ, মাটি ও মানুষ এবং জীবন জিজ্ঞাসা ও আত্মজিজ্ঞাসায়, উৎসের সন্ধানে, স্বরূপের সন্ধানে ও আত্মপরিচয়ে অনুসন্ধিৎসু করে তুলতে পারি নি। এ ব্যর্থতা আমাদেরই। আমরা যারা শিক্ষক এবং কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী। আমরা তো আমাদের মহিমান্বিত অতীত ও গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে এবং আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমাদের শিক্ষার্থী তথা আমাদের আজকের প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারি নি। এবং এক ধরনের ঔপন্যাসিক ও কল্পলোক আমাদের সন্তান ও শিক্ষার্থীদের তাদের কল্পকাহিনীতে আকাশে উড়িয়ে ও দূরায়ন বাসনার নৌকায় ভাসিয়ে মৃত্তিকাবিচ্যুত ও শিকড়বিহীন করে নেশায় মাতোয়ারা করে তুলছে। এবং তারা শেষ পর্যন্ত টানেলে আশ্রয় নেয়- হিরোইন ও মাদকাসক্ত হয়ে যায়।
আমাকে বিস্মিত করে ত্বকীর দেশ, সমাজ, মানুষ ও স্বদেশ চিন্তা এবং মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার ভাবনা। এ সাধারণ কথা নয় যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দী পরও আজকের এই কিশোর মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নতুন করে ভাবছে। ত্বকীর শিকড় মহিমান্বিত অতীত আর গৌরবোজ্জ্বল বাংলাদেশের হৃদয়ে প্রোথিত। ত্বকীর মন-মানসের গভীরতায়- বলা যায় মুক্তিযুদ্ধ তার হৃদস্পন্দনে, আত্মার গভীরে, রক্তকণিকার প্রবাহে ও প্রাণের স্তরে স্তরে। আর এসব কিছুরই মূল আকর তার বাবা-মা ও পারিবারিক ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক আবহ। আমি বিস্মিত হই কিশোর ত্বকী যখন বলে, ‘সবারই আদর্শ হবে বাংলাদেশের সেইসব সন্তান/যাঁরা যুদ্ধের ডাক দিয়েছিল,/ যাঁরা অপেক্ষায় আছে আজো একটি বিচারের-/একটি বিচার/ যা শেষ করার জন্যে তাঁরা/যুদ্ধের সেই সব নায়কেরা/ডাক দিয়ে যায়-/জাতির জন্যে, জেগে ওঠার জন্যে/ওই জাতির জন্যে; যারা ধ্বংসের মধ্যেও/নতুন জীবনের ডাক দিয়ে যায়;/ তুমি কি শুনতে পাও/সেই সব শহীদদের কণ্ঠস্বর?’
ত্বকী প্রত্যয়ী, আশাবাদী। সে জানে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তের বদলে, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্তের বদলে ক্ষুধাহীন, শ্রেণিহীন, শোষণহীন এক নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। সামনে ওই নতুন সূর্য উঠবে। এই ত্বকীর আশাবাদ, ‘অবশ্যই বাংলাদেশ জেগে উঠবে/সামনের উজ্জ্বল দিন/মেঘমুক্ত আকাশ/আমার রূপসী বাংলাদেশ/কোথায় আর সব/যাঁরা ধাবমান/যাঁরা পেছনেও নেতৃত্বে থাকে /যাঁরা ভয়ের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে/তাঁরা অপেক্ষায় আছে,/তুমি ফিরে এসো, /ফিরে এসো সেখান থেকে/ফিরে এসো /আমার বাংলাদেশ।’
ত্বকীর কবিতাগুলো ভালো করে পড়লেই উপলব্ধি করা যাবে যে, তার কবিতায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে একটি প্রতিবাদী চেতনা এবং সমাজ প্রগতি ও সমস্ত প্রতিবন্ধকতা থেকে মানুষের মুক্তি। কবিতাকে ত্বকী বিলাসী আর্টের চর্চা করেনি অথবা কলাকৈবল্যবাদীদের মতো ‘কেবলই স্বপন করেছি বপন পবনে’ এমন নয়। তার কবিতার অন্তরের উদ্ভাস বিশ্লেষণ করলেই আমরা দেখতে পাবো- সেখানে একটা দৈশিক ও সামাজিক উপযোগিতা আছে। আমরা বলবো কল্পনা থেকে নয়- ত্বকীর কবিতায় যে তীব্র তীক্ষ্ণ সমাজ সচেতনতা তা আদর্শিক চেতনার আত্মস্থতা থেকে। কারণ বাবা-মা’র আদর্শের বুনন তার হৃদয়তন্ত্রিতে। কাজেই এ জমিনে প্রগতির ফসল, সাম্যের ফসল ও মানবমুক্তির ফসল ফলবেই। শ্রমে-ঘামে সিক্ত মানুষের মিছিল ও প্রগতির পতাকা হাতে জনতার মিছিল সামনে যাবেই।
আমাকে মুগ্ধতায় ভরে দেয় ত্বকীর কবিতার বিষয়বস্তু, শিরোনাম, প্রতীক, উপমা, উদাহরণ ও উৎপ্রেক্ষা, তার বাণীবিন্যাস ও চিত্রকল্প। তার কবিতা পড়লে কখনো বোঝা যায় না যে, এক কিশোরের লেখা। সে মিতবাক, প্রমিত ও সংযমিত। আর তার ধ্যানে ও জ্ঞানে, ভাব ও মনন-পরিমণ্ডলে দ্রবীভূত হয়ে আছে মানুষ, বাংলাদেশ ও স্বাদেশিক চেতনা-।
ত্বকীর মধ্যে জেগে উঠেছিল বিশ্ব-বোধ ও বৈশ্বিক চেতনা। মানুষে মানুষে যে ভেদাভেদের দুর্গ- এ দুর্গ ভেঙে মানুষকে একই কাতারে দাঁড়াতে হবে। ভুলে যেতে হবে এই ভেদাভেদ-বৈষম্য। নজরুল যেমন এক মোহনায় দাঁড়িয়ে এক মিলনের গান গাওয়ার কথা বলেছেন- তেমনি কিশোর ত্বকীও বলেছে- ‘সমগ্র মানবজাতি আজ এক কাতারে দাঁড়াবে-/হিংসা বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে,/ জলাঞ্জলি দিয়ে হিসেব কষা,/ ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান-/ বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।’
ত্বকীর ‘কারা সেই রাজহাঁস’ কবিতাটি আমাদের হৃদয়কেও ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করে। মনে পড়ে তমসা তীরে নিষ্ঠুর ব্যাধ ক্রৌঞ্চ পাখির বুকে তীর নিক্ষেপ করেছিল- ক্রৌঞ্চপাখির বিদীর্ণ বক্ষ থেকে টপটপ করে পড়েছিল রক্তের ফেঁাঁটা। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে বাল্মীকির কণ্ঠ থেকে বের হয়ে আসে অলৌকিক ছন্দ ও কাব্যবাণী- তেমনি আমাদের সমাজে খুন, হত্যা, লাশের মিছিল দেখে ত্বকীর হৃদয়ও ক্ষতাক্ত ও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে।
তার বাবার জবানীতে- ‘বন্ধুবান্ধব- হইহুল্লোড় খুব একটা পছন্দ করতো না। বন্ধু তেমন একটা ছিলও না। বন্ধু বলতে হয়তো আমিই ছিলাম। কারণ ওর যা বলার, যতটুকু বলার প্রয়োজন বোধ করতো, আমার সঙ্গেই করতো। কারো বিরুদ্ধে কখনো অভিযোগ ছিল না। বন্ধু, পরিজন, শিক্ষক কারো সম্পর্কে কখনো কোনো অভিযোগ করেনি। কেউ দুঃখ পাবে, এমন আচরণ ছিল ওর নীতি ও রীতিবিরুদ্ধ। দূরের বা অপছন্দের কেউ হলেও না। ছিল স্বল্প ও মৃদুভাষী। প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছে ছিল। বলেছিলাম, এ-লেভেল শেষে দেশের বাইরে চলে যাও। পড়াশোনা শেষ করে ফিরে এসো। ও দেশের বাইরে যেতে চাইতো না। মাকে বলতো, দেশে থেকে কি লেখাপড়া হবে না? দেশের পড়াশোনা কি এতই খারাপ যে বাইরে যেতেই হবে? আমি শুনে বললাম, বাইরে যাওয়াটা দোষের কিছু না। আমাদের সামনের যে মানুষগুলো রয়েছেন, তারা সবাই তো বাইরে গিয়েছেন, বিশ্ব ঘুরেছেন। বাইরে না গেলে ভেতরটাকে ঠিক জানা যায় না। ভেতরটা ভালো করে জানার জন্য, বোঝার জন্য হলেও বাহিরটাকে জানার প্রয়োজন পড়ে। আমার সঙ্গে কিছুই বললো না। পরে মাকে বললো, তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না, থাকতে পারবো না।’
ত্বকীর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বিস্মিত হই। দু’চোখ দিয়ে সে মহাবিশ্বকে, দূর নাক্ষত্রিক জগৎকে দেখে নিতে চায়। এ চোখের সঙ্গে একমাত্র তুলনা মেলে র্যাঁবোর। ত্বকী আর র্যাঁবোর চোখে কি দুরন্ত চাহনি, কী দুরন্ত আহ্বান ও অনালোকিত-অনালোচিত এবং অচেনা জগতের ভাষা। ত্বকীর চোখে যেনো কল্পনা ও আগুনের স্ফূরণ আবার কখনো সংগ্রামের বিজয় উল্লাসের ঝলক।
ত্বকীরা সব সময়ই দুশমনের দুর্জয় দুর্গ ভেঙে, কালের করাল প্রহরাকে উত্তরণে সমসাময়িককে পেছনে ফেলে যায় বলেই সাম্প্রদায়িক চণ্ডশক্তি, কালের বৃত্তে বন্দি রক্ষণশীলরা, প্রথাবদ্ধ ও প্রগতির প্রতিরোধকারীরা ত্বকীদের সহ্য করতে পারে না। আর তাই তাদের হত্যা করে রক্তের হোলি-উৎসবে মেতে ওঠে। অবশ্যি হত্যার পরও ত্বকীরা কালোত্তীর্ণ হয়ে বেঁচে থাকে মানুষের মনে, প্রাণে ও রক্তকণিকার স্পন্দনে। তাই ত্বকীদের নিমন্ত্রণ- কালে কালে, লোকে লোকে, আলোকে আলোকে।
ত্বকীর এই নির্মম হত্যার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্মরণে এসেছে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী ও সোমেন চন্দকে। আমি বার বার দেখি একই অভিযোজনায় তারা দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে উচ্চারণ করছেন-
‘ও আমার দেশের মাটি
তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।’
ড. সফিউদ্দিন আহমদ: শিক্ষাবিদ, লেখক,
সভাপতি: বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
No comments