সিনহার বই নিয়ে বাহাস
সাবেক
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার লেখা বই নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক
অঙ্গনে। এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের
এবং বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।
এস কে সিনহার লেখা-‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল’, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ শীর্ষক বইটি এরই মধ্যে বিপুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী সাবেক এই প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, ক্ষমতাসীন সরকারই তাকে পদত্যাগে এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তিনি (বিচারপতি সিনহা) সাবেক হয়ে গেছেন। সাবেক হওয়ার অন্তর্জ্বালা আছে।
কী পরিস্থিতিতে সাবেক হয়েছেন তা সবাই জানে। বই লিখে মনগড়া কথা বলবেন বিদেশে বসে, সেটা নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজন আছে? এখন বইতে যা লিখেছেন, তখন তা বলার সৎ সাহস একজন বিচারপতির কেন ছিল না? এখন বিদায় নিয়ে কেন পুরানো কথা নতুন করে বলছেন, যা খুশি তাই বলছেন। এখন বিদেশে বসে আপন মনে ভুতুড়ে কথা ছাপছেন। এটা আমাদের ও দেশের মানুষের বিশ্বাস করতে হবে? বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন।
অন্যদিকে, বিএনপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেছেন, এস কে সিনহার বক্তব্যে পরিষ্কার বন্দুকের নলের মুখে সরকার বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণে নিয়েই সাজানো মামলায় রায় দিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি করে এক নম্বর মিশন কার্যকর করেছে। এখন দুই নম্বর মিশন কার্যকর করতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ১০ই অক্টোবর দেয়া হবে। নির্বাচনের আগে এ মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা সুপরিকল্পিত নীলনকশারই অংশ।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই শীর্ষ স্থানীয় নেতার মন্তব্য ছাড়াও এস কে সিনহার বইটি নিয়ে তোলপাড় তৈরি হয়েছে দেশে-বিদেশে। নানা সংবাদ মাধ্যমে এ নিয়ে রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকার দিয়েও খোলামেলা কথা বলেছেন বিচারপতি সিনহা। ৬১০ পৃষ্ঠার বইয়ে কী লিখেছেন তিনি? খোঁজ করছেন আগ্রহী পাঠক। আত্মজীবনীর ঢঙে লেখা বইটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পর্ব বিচার বিভাগ থেকে তার বিদায় পর্বটি। এ বইয়ের শুরুতে বিচারপতি সিনহা লিখেছেন, বিচার বিভাগ একটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং এর স্বাধীনতা একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পূর্বশর্ত।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আবির্ভূত বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে গণতন্ত্রকে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় নীতির একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এবং সংবিধান নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক্করণ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। ১৯৭৪ সাল থেকে বিচার বিভাগের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার বয়ানের পর এস কে সিনহা ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর সৃষ্ট পরিস্থিতির ব্যাপারে আলোকপাত করেন।
তিনি লিখেছেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সর্বসম্মত রায়ে শাসন ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রবণতা সম্পর্কে দেয়া পর্যবেক্ষণ সাধারণ নাগরিক এবং সুশীল সমাজের প্রশংসা পায়। দেশি এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ রায়। তবে ধারাবাহিকভাবে দুঃখজনক ও অভূতপূর্ব কিছু ঘটনা ঘটে যা বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করে। রায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলে সংসদ একটি প্রস্তাব পাস করে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা সংসদে তার সমালোচনায় মুখর হন। এস কে সিনহা লিখেছেন, ২০১৭ সালে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে ঐতিহাসিক এক রায় দেয়ার পর বর্তমান সরকার আমাকে পদত্যাগ করতে এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে। ওই সময় তাকে বাসভবনে আটকে রাখা হয় এবং আইনজীবী ও বিচারপতিদেরকে তার সঙ্গে দেখা করতে বাধা দেয়া হয় বলেও অভিযোগ করেছেন এস কে সিনহা। কীভাবে তাকে ছুটিতে যাওয়ার, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এবং বিদেশে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বইতে সে ব্যাপারেও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এস কে সিনহা।
তিনি একটি দিনের কথা তুলে ধরে লিখেছেন, অসম্পন্ন কাজ শেষ করার জন্য ২০১৭ সালের ২রা অক্টোবর আমি কোর্টে এলাম। সকাল সাড়ে ১১টায় আমার ব্যক্তিগত সচিব আনিসুর রহমান আমাকে জানালেন যে, দুপুর ১২টায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান একটি গোয়েন্দা সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা। আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। তিনি সময়মতো এলেন এবং আমার কাছে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে তার একজন অফিসারের সঙ্গে কেন খারাপ ব্যবহার করেছি তা জানতে চাইলেন। তার বডি ল্যাংগুয়েজ ও আমাকে সরাসরি যেভাবে চার্জ করছেন তাতে হতবাক হয়ে গেলাম।
তিনি এমনভাবে কথা বলছেন যে, আমি তার অধীনস্থ কোনো কর্মচারী। আমি ভাবলাম, এই অফিসার কীভাবে একজন প্রধান বিচারপতিকে চার্জ করার এমন সাহস পেলেন। তিনি আমাকে বললেন, আমার জানা উচিত যে, আমার দেয়া ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর বিএনপি এতটাই খুশি হয়েছে যে, তারা নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেছে। তারা টেক্সট মেসেজ বিনিময় করেছে যে, তারা শিগগিরই ক্ষমতায় আসছে।
আমি জবাবে তাকে বললাম, কে ক্ষমতায় আসবে সেটা আমার কোনো বিবেচনার বিষয় নয়। এতে যদি কেউ আহত হন তাহলে সেটা তার দুর্বলতায় প্রকাশ পায়। এবং এই দুর্বলতা হলো সরকারের। তিনি আমাকে আরো বললেন, তিনি এবং প্রধানমন্ত্রীর মাঝখানে কেউ নেই। তিনি যা বলবেন তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য হিসেবে আমার নেয়া উচিত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসরণ করেছেন। এরপর তিনি বললেন, ‘স্যার, ২০১৮ সালের ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত আপনি চার মাসের ছুটি নেন’। আমি তার এ প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালাম এবং তার কাছে জানতে চাইলাম, তিনি কোন্ ক্ষমতায় আমাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন। তারপর বললাম, আমি ড. গওহর রিজভীর সঙ্গে কথা বলেছি এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলে কিছু করবো না।
তিনি বললেন, প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। আমি তাকে বললাম, ঈদুল আজহার দিনে প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন যে, যা ঘটেছে তা নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন। এ কথা শুনে গোয়েন্দা কর্মকর্তা একটু ঝাঁকুনি খেলেন বলে মনে হলো। তারপর তিনি আমাকে বললেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। এ কথা শুনে আমি চিৎকার করে বললাম ‘কী! আপনি আপনার সীমা অতিক্রম করছেন। এভাবে কথা বলার ক্ষমতা আপনাকে কে দিয়েছে?’ জবাবে তিনি বললেন, প্রমাণ ছাড়া তিনি কিছু বলেননি। আমি বললাম যে, তার দুঃসাহস দেখে আমি বিস্মিত। এরপর তিনি আমার অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন।
যদিও আমি আমার ধৈর্য ও সাহস দেখিয়েছি ঐ কর্মকর্তার প্রতি, একই সময়ে আমি এটাও অনুধাবন করি যে, এই ‘শক্তিধর মানুষটির’ সঙ্গে লড়াই করতে পারব না। তার কাছে আছে একটি অস্ত্র ও পার্স। আমার তো এর কিছুই নেই। আমার শক্তি সহকর্মী বিচারকরা। কিন্তু তারাও এখন আমার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছেন।
আমাকে খবর জানানো হয়েছে যে, সাদা পোশাকে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা পুরো সুপ্রিম কোর্ট ভবন দখলে নিয়েছেন। আমার কর্মকর্তারা আতঙ্কে কাঁপছেন। পরের দিন, আমি জানতে পারলাম যে, আদালতের আইটি সেকশনের ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তারা সিসিটিভিতে থাকা গোয়েন্দা কর্মকর্তার ভিডিও সরিয়ে ফেলেছেন। আমার সচিব আনিস আমাকে অনুরোধ করলেন যাতে আমি এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নিই, যাতে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়।
আমি তার শরীরের ভাষা অনুধাবন করতে পারলাম যে, তারা বিপুল পরিমাণে সমস্যা মোকাবিলা করছে। কিন্তু তার সবটা আমাকে জানাচ্ছে না। আমি বুঝতে পেরেছি যে, সব বিচারক আমার বিরুদ্ধে চলে গেছেন এবং যদি প্রশাসন আমার প্রতি পুরোপুরি শত্রুতাপূর্ণ অবস্থানে চলে যায় তাহলে আমি কীভাবে টিকে থাকবো? কোনো বিকল্প খুঁজে না পেয়ে বিচার বিভাগের স্বার্থের কথা চিন্তা করে তিন মাসের পরিবর্তে আমি এক মাসের ছুটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি জানতে পারলাম আমার ছুটির আবেদনপত্র প্রস্তুত করেছে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সাধারণত আমার আবেদনপত্র তৈরি করে দেন আমার সচিব। কিন্তু এ সময় তিনি ছিলেন প্রচণ্ড কড়া পাহারায়। ওই আবেদনে স্বাক্ষর করে আমি দুপুরের দিকে বাসার উদ্দেশে অফিস ছাড়লাম।
বাসায় ফিরেই জানতে পারলাম, আমার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ সময় পুরো গৃহবন্দির মতো পরিবেশে আমাকে রাখা হয়। বাইরের কেউ আমার বাসায় প্রবেশ করতে পারেন না। পরের দিন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্যরা। কিন্তু তাদের অনুমতি দেয়া হয়নি। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেসব আত্মীয় এসেছিলেন তাদেরকে গেটে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের ছবি তোলা হয়েছে।
তারপরেই তাদের কেউ কেউ প্রবেশ করতে পেরেছেন। একদিন আমার বাড়ির একজন হেলপার তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩রা অক্টোবর। এদিন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফোন করে আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি হাসপাতালে ভর্তি হতে চাই কি-না। কিন্তু আমি হাসপাতালে যেতে চাইনি। তাকে বললাম, আমি অসুস্থ নই। ফলে হাসপাতালে যাবো না। আমি একজন অসুস্থ মানুষ হিসেবে নিজেকে দেখাতে চাই না। ওই মুহূর্তের পর থেকে বিএসএমএমইউয়ের একজন অর্থোপেডিক ও একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ গোয়েন্দাদের নির্দেশনামতো আমার বাসভবনে এলেন। তাদের মধ্যে আমি কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর সজল ব্যানার্জির নাম মনে করতে পারছি। আমি দেখলাম তারা খালি হাতে এসেছেন। এমন কি তারা স্টেথেটিস্কোপ পর্যন্ত আনেননি সঙ্গে। আমি তাদের সঙ্গে কৌতুক করলাম। বললাম, মৌলিক যন্ত্রপাতি ছাড়া কেন তারা একজন রোগী দেখতে এসেছেন। আমার দিকে তারা অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলেন।
বাসায় আমার কোনো কাজ ছিল না। তাই আমি তাদের সঙ্গে একসঙ্গে চা ও কফি পান করতে করতে কয়েক ঘণ্টা আলাপ করলাম। তারা এসময় তাদের অসহায়ত্বের কথা জানালেন। আমি তাদের বললাম, প্রধান বিচারপতি যেখানে ভয় পাচ্ছেন না তখন তারা কেন এমন করছেন। সমস্যা তো প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে, তাদের নয়।
এ কথা শুনে তারা মাথা নিচু করলেন। কোনো কথা বললেন না। তাদের জন্য আমার মায়া হলো, কারণ তারা কোনো কারণ ছাড়াই তাদের মূল্যবান সময়ের অনেকটা আমার বাসায় বসে কাটালেন। একদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। তার সাক্ষাতের কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। আমি রেগে গেলাম এবং তাকে বললাম, ভণ্ড হবেন না। যা বলার সুস্পষ্ট করে বলুন।
এইভাবে বিচার বিভাগ চলতে পারে না। এই বার্তাটি পৌঁছে দেবেন প্রধানমন্ত্রীকে। জবাবে আইনমন্ত্রী বললেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বার্তাটি পৌঁছে দেবেন। যখন আমার ভাতিজা উত্তরা থেকে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলো তাকে গেটে আটক রাখা হলো তিন ঘণ্টা, আমার বাসভবনে তাকে প্রবেশ করতে দেয়া হলো না। আমার একজন স্টাফ তার মোবাইল ফোন নম্বর দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। আমি আইনমন্ত্রীকে এসব বিষয় তুলে ধরে বললাম, তার লোকজন এসব কী করছে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো।
এস কে সিনহা আরো লিখেছেন, ২০১৭ সালের ৫ই অক্টোবর। সময় রাত প্রায় ১০টা। আমার সচিব আনিস আমাকে জানালেন যে, বাসভবনে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ওই সময় আমি শুতে যাচ্ছিলাম। এমন অসময়ে সাক্ষাতে আসা বন্ধ করলাম আমি। কিন্তু ওই অফিসার আমার সচিবকে অনুরোধ করেন যে, তিনি মাত্র অল্প কয়েক মিনিটের জন্য আসতে চান। শেষ পর্যন্ত তাকে আমি অনুমতি দিলাম। রাত সাড়ে ১০টার দিকে এলেন ওই অফিসার।
তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি যেহেতু বিদেশে যেতে চেয়েছি তাহলে কেন আমি যাইনি? আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে আমি কোথাও যাবো না। আমি জানতে পারলাম, প্রধানমন্ত্রী ফিরবেন ৭ই অক্টোবর। কিন্তু ওই অফিসার আমাকে বললেন, ২০১৭ সালের ৬ই অক্টোবরের মধ্যে আমাকে দেশ ত্যাগ করতেই হবে। তিনিই আমাকে টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবেন। তার প্রস্তাব আমি মানলাম না। তিনি আমার বাসভবন ত্যাগ করলেন। তবে বলে গেলেন, অবশ্যই আমাকে ৭ই অক্টোবর বা ৮ই অক্টোবর দেশ ছাড়তেই হবে।
এই অসন্তোষজনক আলোচনার পর ড. গওহর রিজভী আমাকে ফোন করলেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তার আমার বাসায় আসার কথা তাকে জানালেন আমার স্ত্রী। আমি গওহর রিজভীর কাছে জানতে চাইলাম, অপ্রত্যাশিত এসব ঘটনা কেন ঘটছে। যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার সব শুনে তিনি বিস্মিত হলেন এবং আমাকে বললেন, তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন ৬ই অক্টোবর। তিনি যথারীতি এলেন। তাকে আমি জানালাম, তিনি আমার ঘুম নষ্ট করেছেন।
কিন্তু গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন অন্যকথা। জবাবে তিনি (গওহর রিজভী) আমাকে বললেন, আমার কাছে পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী যে বার্তা দিয়েছেন তা নিয়ে যোগাযোগ করছেন তিনি। আমাকে দেশ ছাড়ার জন্য যে চাপ দেয়া হয়েছে তা শুনে তিনি বললেন, ওই অফিসার আমাকে যা বলেছেন তা মিথ্যা। আমি তাকে বললাম, বিচার বিভাগ এভাবে চলতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি সাক্ষাতের আয়োজন করতে তাকে অনুরোধ করলাম। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফিরে গিয়ে তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি বৈঠক আয়োজন করবেন। তারপর ড. গওহর রিজভী আমাকে আর কিছুই জানাননি।
ওবায়দুল কাদেরও আমাকে আশ্বস্ত করেছেন এমন একটি সাক্ষাতের বিষয়ে। কিন্তু পরে তারা দুজনই নীরব হয়ে গেছেন। তারা অসহায় এটা বুঝতে পারলাম। তাই তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করার ইচ্ছা করলো না। তাদেরকে বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিলাম।
এস কে সিনহা তার বইয়ে আরো লিখেছেন, আমি অনুধাবন করতে পারলাম গোয়েন্দা কর্মকর্তা যা বলেছেন তা যথার্থ এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনামতোই তিনি কাজ করছেন। আইনমন্ত্রীও আমাকে কিছু জানাননি। একপর্যায়ে আমি দেখলাম, আমার ফোন কেউই ধরছেন না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছি।
এমনকি কাউকে যখন আলোচনার জন্য পাঠাই, তারা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কোনো সাহস দেখায় না। তারা তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। যদি কেউ আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে, তাদেরকে গেটে এমন উপায়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় যে, তাতে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এমন সব পরিস্থিতিতে আমি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। প্রথমে আমি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
২০১৭ সালের ৫ই অক্টোবর সিঙ্গাপুর থেকে জি নিউজের একজন সাংবাদিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন ফোনে। জানতে চান আমার পরিস্থিতি। বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করিনি তার কাছে। কিন্তু তাকে বলেছি, আমাদের বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন নয়। সব সময়, এমন কি জটিল সময়গুলোতে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছি।
এস কে সিনহার লেখা-‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল’, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ শীর্ষক বইটি এরই মধ্যে বিপুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী সাবেক এই প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, ক্ষমতাসীন সরকারই তাকে পদত্যাগে এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তিনি (বিচারপতি সিনহা) সাবেক হয়ে গেছেন। সাবেক হওয়ার অন্তর্জ্বালা আছে।
কী পরিস্থিতিতে সাবেক হয়েছেন তা সবাই জানে। বই লিখে মনগড়া কথা বলবেন বিদেশে বসে, সেটা নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজন আছে? এখন বইতে যা লিখেছেন, তখন তা বলার সৎ সাহস একজন বিচারপতির কেন ছিল না? এখন বিদায় নিয়ে কেন পুরানো কথা নতুন করে বলছেন, যা খুশি তাই বলছেন। এখন বিদেশে বসে আপন মনে ভুতুড়ে কথা ছাপছেন। এটা আমাদের ও দেশের মানুষের বিশ্বাস করতে হবে? বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন।
অন্যদিকে, বিএনপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেছেন, এস কে সিনহার বক্তব্যে পরিষ্কার বন্দুকের নলের মুখে সরকার বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণে নিয়েই সাজানো মামলায় রায় দিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি করে এক নম্বর মিশন কার্যকর করেছে। এখন দুই নম্বর মিশন কার্যকর করতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ১০ই অক্টোবর দেয়া হবে। নির্বাচনের আগে এ মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা সুপরিকল্পিত নীলনকশারই অংশ।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই শীর্ষ স্থানীয় নেতার মন্তব্য ছাড়াও এস কে সিনহার বইটি নিয়ে তোলপাড় তৈরি হয়েছে দেশে-বিদেশে। নানা সংবাদ মাধ্যমে এ নিয়ে রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকার দিয়েও খোলামেলা কথা বলেছেন বিচারপতি সিনহা। ৬১০ পৃষ্ঠার বইয়ে কী লিখেছেন তিনি? খোঁজ করছেন আগ্রহী পাঠক। আত্মজীবনীর ঢঙে লেখা বইটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পর্ব বিচার বিভাগ থেকে তার বিদায় পর্বটি। এ বইয়ের শুরুতে বিচারপতি সিনহা লিখেছেন, বিচার বিভাগ একটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং এর স্বাধীনতা একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পূর্বশর্ত।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আবির্ভূত বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে গণতন্ত্রকে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় নীতির একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এবং সংবিধান নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক্করণ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। ১৯৭৪ সাল থেকে বিচার বিভাগের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার বয়ানের পর এস কে সিনহা ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর সৃষ্ট পরিস্থিতির ব্যাপারে আলোকপাত করেন।
তিনি লিখেছেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সর্বসম্মত রায়ে শাসন ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রবণতা সম্পর্কে দেয়া পর্যবেক্ষণ সাধারণ নাগরিক এবং সুশীল সমাজের প্রশংসা পায়। দেশি এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ রায়। তবে ধারাবাহিকভাবে দুঃখজনক ও অভূতপূর্ব কিছু ঘটনা ঘটে যা বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করে। রায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলে সংসদ একটি প্রস্তাব পাস করে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা সংসদে তার সমালোচনায় মুখর হন। এস কে সিনহা লিখেছেন, ২০১৭ সালে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে ঐতিহাসিক এক রায় দেয়ার পর বর্তমান সরকার আমাকে পদত্যাগ করতে এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে। ওই সময় তাকে বাসভবনে আটকে রাখা হয় এবং আইনজীবী ও বিচারপতিদেরকে তার সঙ্গে দেখা করতে বাধা দেয়া হয় বলেও অভিযোগ করেছেন এস কে সিনহা। কীভাবে তাকে ছুটিতে যাওয়ার, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এবং বিদেশে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বইতে সে ব্যাপারেও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এস কে সিনহা।
তিনি একটি দিনের কথা তুলে ধরে লিখেছেন, অসম্পন্ন কাজ শেষ করার জন্য ২০১৭ সালের ২রা অক্টোবর আমি কোর্টে এলাম। সকাল সাড়ে ১১টায় আমার ব্যক্তিগত সচিব আনিসুর রহমান আমাকে জানালেন যে, দুপুর ১২টায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান একটি গোয়েন্দা সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা। আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। তিনি সময়মতো এলেন এবং আমার কাছে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে তার একজন অফিসারের সঙ্গে কেন খারাপ ব্যবহার করেছি তা জানতে চাইলেন। তার বডি ল্যাংগুয়েজ ও আমাকে সরাসরি যেভাবে চার্জ করছেন তাতে হতবাক হয়ে গেলাম।
তিনি এমনভাবে কথা বলছেন যে, আমি তার অধীনস্থ কোনো কর্মচারী। আমি ভাবলাম, এই অফিসার কীভাবে একজন প্রধান বিচারপতিকে চার্জ করার এমন সাহস পেলেন। তিনি আমাকে বললেন, আমার জানা উচিত যে, আমার দেয়া ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর বিএনপি এতটাই খুশি হয়েছে যে, তারা নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেছে। তারা টেক্সট মেসেজ বিনিময় করেছে যে, তারা শিগগিরই ক্ষমতায় আসছে।
আমি জবাবে তাকে বললাম, কে ক্ষমতায় আসবে সেটা আমার কোনো বিবেচনার বিষয় নয়। এতে যদি কেউ আহত হন তাহলে সেটা তার দুর্বলতায় প্রকাশ পায়। এবং এই দুর্বলতা হলো সরকারের। তিনি আমাকে আরো বললেন, তিনি এবং প্রধানমন্ত্রীর মাঝখানে কেউ নেই। তিনি যা বলবেন তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য হিসেবে আমার নেয়া উচিত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসরণ করেছেন। এরপর তিনি বললেন, ‘স্যার, ২০১৮ সালের ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত আপনি চার মাসের ছুটি নেন’। আমি তার এ প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালাম এবং তার কাছে জানতে চাইলাম, তিনি কোন্ ক্ষমতায় আমাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন। তারপর বললাম, আমি ড. গওহর রিজভীর সঙ্গে কথা বলেছি এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলে কিছু করবো না।
তিনি বললেন, প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। আমি তাকে বললাম, ঈদুল আজহার দিনে প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন যে, যা ঘটেছে তা নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন। এ কথা শুনে গোয়েন্দা কর্মকর্তা একটু ঝাঁকুনি খেলেন বলে মনে হলো। তারপর তিনি আমাকে বললেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। এ কথা শুনে আমি চিৎকার করে বললাম ‘কী! আপনি আপনার সীমা অতিক্রম করছেন। এভাবে কথা বলার ক্ষমতা আপনাকে কে দিয়েছে?’ জবাবে তিনি বললেন, প্রমাণ ছাড়া তিনি কিছু বলেননি। আমি বললাম যে, তার দুঃসাহস দেখে আমি বিস্মিত। এরপর তিনি আমার অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন।
যদিও আমি আমার ধৈর্য ও সাহস দেখিয়েছি ঐ কর্মকর্তার প্রতি, একই সময়ে আমি এটাও অনুধাবন করি যে, এই ‘শক্তিধর মানুষটির’ সঙ্গে লড়াই করতে পারব না। তার কাছে আছে একটি অস্ত্র ও পার্স। আমার তো এর কিছুই নেই। আমার শক্তি সহকর্মী বিচারকরা। কিন্তু তারাও এখন আমার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছেন।
আমাকে খবর জানানো হয়েছে যে, সাদা পোশাকে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা পুরো সুপ্রিম কোর্ট ভবন দখলে নিয়েছেন। আমার কর্মকর্তারা আতঙ্কে কাঁপছেন। পরের দিন, আমি জানতে পারলাম যে, আদালতের আইটি সেকশনের ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তারা সিসিটিভিতে থাকা গোয়েন্দা কর্মকর্তার ভিডিও সরিয়ে ফেলেছেন। আমার সচিব আনিস আমাকে অনুরোধ করলেন যাতে আমি এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নিই, যাতে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়।
আমি তার শরীরের ভাষা অনুধাবন করতে পারলাম যে, তারা বিপুল পরিমাণে সমস্যা মোকাবিলা করছে। কিন্তু তার সবটা আমাকে জানাচ্ছে না। আমি বুঝতে পেরেছি যে, সব বিচারক আমার বিরুদ্ধে চলে গেছেন এবং যদি প্রশাসন আমার প্রতি পুরোপুরি শত্রুতাপূর্ণ অবস্থানে চলে যায় তাহলে আমি কীভাবে টিকে থাকবো? কোনো বিকল্প খুঁজে না পেয়ে বিচার বিভাগের স্বার্থের কথা চিন্তা করে তিন মাসের পরিবর্তে আমি এক মাসের ছুটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি জানতে পারলাম আমার ছুটির আবেদনপত্র প্রস্তুত করেছে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সাধারণত আমার আবেদনপত্র তৈরি করে দেন আমার সচিব। কিন্তু এ সময় তিনি ছিলেন প্রচণ্ড কড়া পাহারায়। ওই আবেদনে স্বাক্ষর করে আমি দুপুরের দিকে বাসার উদ্দেশে অফিস ছাড়লাম।
বাসায় ফিরেই জানতে পারলাম, আমার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ সময় পুরো গৃহবন্দির মতো পরিবেশে আমাকে রাখা হয়। বাইরের কেউ আমার বাসায় প্রবেশ করতে পারেন না। পরের দিন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্যরা। কিন্তু তাদের অনুমতি দেয়া হয়নি। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেসব আত্মীয় এসেছিলেন তাদেরকে গেটে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের ছবি তোলা হয়েছে।
তারপরেই তাদের কেউ কেউ প্রবেশ করতে পেরেছেন। একদিন আমার বাড়ির একজন হেলপার তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩রা অক্টোবর। এদিন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফোন করে আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি হাসপাতালে ভর্তি হতে চাই কি-না। কিন্তু আমি হাসপাতালে যেতে চাইনি। তাকে বললাম, আমি অসুস্থ নই। ফলে হাসপাতালে যাবো না। আমি একজন অসুস্থ মানুষ হিসেবে নিজেকে দেখাতে চাই না। ওই মুহূর্তের পর থেকে বিএসএমএমইউয়ের একজন অর্থোপেডিক ও একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ গোয়েন্দাদের নির্দেশনামতো আমার বাসভবনে এলেন। তাদের মধ্যে আমি কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর সজল ব্যানার্জির নাম মনে করতে পারছি। আমি দেখলাম তারা খালি হাতে এসেছেন। এমন কি তারা স্টেথেটিস্কোপ পর্যন্ত আনেননি সঙ্গে। আমি তাদের সঙ্গে কৌতুক করলাম। বললাম, মৌলিক যন্ত্রপাতি ছাড়া কেন তারা একজন রোগী দেখতে এসেছেন। আমার দিকে তারা অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলেন।
বাসায় আমার কোনো কাজ ছিল না। তাই আমি তাদের সঙ্গে একসঙ্গে চা ও কফি পান করতে করতে কয়েক ঘণ্টা আলাপ করলাম। তারা এসময় তাদের অসহায়ত্বের কথা জানালেন। আমি তাদের বললাম, প্রধান বিচারপতি যেখানে ভয় পাচ্ছেন না তখন তারা কেন এমন করছেন। সমস্যা তো প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে, তাদের নয়।
এ কথা শুনে তারা মাথা নিচু করলেন। কোনো কথা বললেন না। তাদের জন্য আমার মায়া হলো, কারণ তারা কোনো কারণ ছাড়াই তাদের মূল্যবান সময়ের অনেকটা আমার বাসায় বসে কাটালেন। একদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। তার সাক্ষাতের কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। আমি রেগে গেলাম এবং তাকে বললাম, ভণ্ড হবেন না। যা বলার সুস্পষ্ট করে বলুন।
এইভাবে বিচার বিভাগ চলতে পারে না। এই বার্তাটি পৌঁছে দেবেন প্রধানমন্ত্রীকে। জবাবে আইনমন্ত্রী বললেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বার্তাটি পৌঁছে দেবেন। যখন আমার ভাতিজা উত্তরা থেকে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলো তাকে গেটে আটক রাখা হলো তিন ঘণ্টা, আমার বাসভবনে তাকে প্রবেশ করতে দেয়া হলো না। আমার একজন স্টাফ তার মোবাইল ফোন নম্বর দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। আমি আইনমন্ত্রীকে এসব বিষয় তুলে ধরে বললাম, তার লোকজন এসব কী করছে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো।
এস কে সিনহা আরো লিখেছেন, ২০১৭ সালের ৫ই অক্টোবর। সময় রাত প্রায় ১০টা। আমার সচিব আনিস আমাকে জানালেন যে, বাসভবনে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ওই সময় আমি শুতে যাচ্ছিলাম। এমন অসময়ে সাক্ষাতে আসা বন্ধ করলাম আমি। কিন্তু ওই অফিসার আমার সচিবকে অনুরোধ করেন যে, তিনি মাত্র অল্প কয়েক মিনিটের জন্য আসতে চান। শেষ পর্যন্ত তাকে আমি অনুমতি দিলাম। রাত সাড়ে ১০টার দিকে এলেন ওই অফিসার।
তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি যেহেতু বিদেশে যেতে চেয়েছি তাহলে কেন আমি যাইনি? আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে আমি কোথাও যাবো না। আমি জানতে পারলাম, প্রধানমন্ত্রী ফিরবেন ৭ই অক্টোবর। কিন্তু ওই অফিসার আমাকে বললেন, ২০১৭ সালের ৬ই অক্টোবরের মধ্যে আমাকে দেশ ত্যাগ করতেই হবে। তিনিই আমাকে টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবেন। তার প্রস্তাব আমি মানলাম না। তিনি আমার বাসভবন ত্যাগ করলেন। তবে বলে গেলেন, অবশ্যই আমাকে ৭ই অক্টোবর বা ৮ই অক্টোবর দেশ ছাড়তেই হবে।
এই অসন্তোষজনক আলোচনার পর ড. গওহর রিজভী আমাকে ফোন করলেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তার আমার বাসায় আসার কথা তাকে জানালেন আমার স্ত্রী। আমি গওহর রিজভীর কাছে জানতে চাইলাম, অপ্রত্যাশিত এসব ঘটনা কেন ঘটছে। যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার সব শুনে তিনি বিস্মিত হলেন এবং আমাকে বললেন, তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন ৬ই অক্টোবর। তিনি যথারীতি এলেন। তাকে আমি জানালাম, তিনি আমার ঘুম নষ্ট করেছেন।
কিন্তু গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন অন্যকথা। জবাবে তিনি (গওহর রিজভী) আমাকে বললেন, আমার কাছে পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী যে বার্তা দিয়েছেন তা নিয়ে যোগাযোগ করছেন তিনি। আমাকে দেশ ছাড়ার জন্য যে চাপ দেয়া হয়েছে তা শুনে তিনি বললেন, ওই অফিসার আমাকে যা বলেছেন তা মিথ্যা। আমি তাকে বললাম, বিচার বিভাগ এভাবে চলতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি সাক্ষাতের আয়োজন করতে তাকে অনুরোধ করলাম। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফিরে গিয়ে তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি বৈঠক আয়োজন করবেন। তারপর ড. গওহর রিজভী আমাকে আর কিছুই জানাননি।
ওবায়দুল কাদেরও আমাকে আশ্বস্ত করেছেন এমন একটি সাক্ষাতের বিষয়ে। কিন্তু পরে তারা দুজনই নীরব হয়ে গেছেন। তারা অসহায় এটা বুঝতে পারলাম। তাই তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করার ইচ্ছা করলো না। তাদেরকে বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিলাম।
এস কে সিনহা তার বইয়ে আরো লিখেছেন, আমি অনুধাবন করতে পারলাম গোয়েন্দা কর্মকর্তা যা বলেছেন তা যথার্থ এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনামতোই তিনি কাজ করছেন। আইনমন্ত্রীও আমাকে কিছু জানাননি। একপর্যায়ে আমি দেখলাম, আমার ফোন কেউই ধরছেন না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছি।
এমনকি কাউকে যখন আলোচনার জন্য পাঠাই, তারা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কোনো সাহস দেখায় না। তারা তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। যদি কেউ আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে, তাদেরকে গেটে এমন উপায়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় যে, তাতে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এমন সব পরিস্থিতিতে আমি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। প্রথমে আমি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
২০১৭ সালের ৫ই অক্টোবর সিঙ্গাপুর থেকে জি নিউজের একজন সাংবাদিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন ফোনে। জানতে চান আমার পরিস্থিতি। বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করিনি তার কাছে। কিন্তু তাকে বলেছি, আমাদের বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন নয়। সব সময়, এমন কি জটিল সময়গুলোতে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছি।
No comments