সহপাঠী বন্ধুর মূল্যায়নঃমানবসেবার ব্রতই লোটে শেরিংকে তুলেছে এ পর্যায়ে by কাফি কামাল
ভুটানের
নতুন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র ডা. লোটে শেরিং।
দেশটির প্রথম দফা নির্বাচনে এগিয়ে রয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের পর
চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে মধ্য অক্টোবরে।
তবে প্রথম দফা নির্বাচনের পরই দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আলোচনায় উঠে এসেছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ২৮তম ব্যাচের এ শিক্ষার্থীর নাম। শিক্ষাজীবন শেষে থিম্পুর জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ন্যাশনাল রেফারেল হাসপাতালে ইউরোলজি কনসালটেন্ট হিসেবে যোগ দেন। ২০১৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি নবগঠিত রাজনৈতিক দল দ্রুক নিয়ামরূপ তসুগপা’য় (ডিএনটি) যোগ দেন। মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই ডা. লোটে শেরিং চলে আসেন দলটির শীর্ষপর্যায়ে। ১৫ই সেপ্টেম্বর ভুটানের প্রথম দফা নির্বাচনে জয়লাভ করে চমক সৃষ্টি করে ডা. লোটের দল ডিএনটি। দ্বিতীয় দফা ভোটের পর আগামী ১৮ই অক্টোবর জানা যাবে চূড়ান্ত ফলাফল। তবে প্রথম দফা ভোটের পরই দেশটির সম্ভাব্য নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আলোচনায় উঠে এসেছে ডা. লোটে শেরিংয়ের নাম।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ডা. লোটের সহপাঠীদের মধ্যে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন খুলনার ছেলে ডা. মো. আহসান হাবীব সাকির। বর্তমানে তিনি রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার। দেড় দশকের বন্ধুত্বের সুবাদে দৈনিক মানবজমিন-এর কাছে ডা. লোটে’র জীবনের নানাদিক তুলে ধরেছেন ডা. সাকির।
১৯৯১ সালের কথা। বাংলাদেশে তখন হাতেগোনা যে কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ছিল তার অন্যতম ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ। ডা. সাকির বলেন, ১৯৯১ সালে আমরা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জনে তখন বহু বিদেশি শিক্ষার্থী আসতেন বাংলাদেশে। নেপাল, ভুটান, ইরান, সুদান, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ থেকে স্কলারশিপ নিয়ে তারা এদেশে পড়তে আসতেন। সেবার ভুটান থেকে যে কয়েকজন এসেছিলেন তাদের একজন লোটে শেরিং, আমাদের লোটে। আমাদের দু’জনের হোস্টেল ছিল পাশাপাশি।
লোটে থাকতেন বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত হোস্টেলের ওয়েস্ট ব্লকের দোতলায়। মেডিকেলে ভর্তির মাধ্যমেই আমাদের পরিচয়। তবে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠার কারণ ছিল অন্য। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে আমাদের একাডেমিক ভবন ও হোস্টেলের দূরত্ব ছিল প্রায় আধা কিলোমিটার। আমরা হোস্টেল থেকে প্রায় একই সময়ে কলেজের উদ্দেশে রওনা দিতাম। ফিরতামও একই সময়ে। ফলে প্রায় দিনই আমরা একসঙ্গে আসা-যাওয়া করতাম। এই আসা-যাওয়ার পথে আমাদের মধ্যে অনেক গল্প হতো। সে তার দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে গল্প করতো। বাংলাদেশের প্রকৃতি, মানুষের আচার-ব্যবহার, আতিথেয়তা নিয়েও প্রকাশ করতো তার অনুভূতি। এভাবেই লোটের সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশের কয়েকজনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
শিক্ষাজীবনে খুব কঠোরভাবে সময়জ্ঞান মেনে চলতেন লোটে শেরিং। ডা. সাকির বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে লোটে ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেতেন। পড়াশোনা ও দৈনন্দিন কাজগুলো সম্পন্ন করতেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। তার সময়জ্ঞান ছিল প্রখর। কঠোরভাবে সময়জ্ঞান মেনে চলতেন। এক মুহূর্তে অযথা ব্যয় করতেন না। অলসতা কিংবা কোনো ধরনের বদ্যভ্যাস ছিল না তার জীবনে। শিক্ষাজীবনে তার একটি শখ ছিল বাগান করার। তার দেশ যেমন সুন্দর, সে রকম চিন্তাভাবনা করতেন। প্রতিদিনের পড়াশোনার কাজ প্রতিদিন শেষ করতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন খুবই বন্ধুবৎসল। তবে কথা বলতেন মেপে মেপে। পড়াশোনার পাশাপাশি টেবিল টেনিস ও ক্যারাম খেলতেন। ডা. সাকির বলেন, আমাদের সহপাঠী একটি প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হচ্ছেন এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। গৌরবের বিষয়। বিশেষ করে আমাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের জন্য, ম-২৮ ব্যাচের সহপাঠীদের জন্য গৌরবের বিষয়। আমি বিশ্বাস করি, পরিশ্রম, সততা ও কর্মঠ হওয়ার কারণেই সৃষ্টিকর্তা তাকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, লোটের মতো নিবেদিতপ্রাণ মানুষের হাত ধরে ভুটান তথা ভুটানের মানুষ সামগ্রিক উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে।
পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে অনার্স পেয়েছিলেন ডা. লোটে শেরিং। ডা. সাকির বলেন, পড়াশোনায় তিনি খুবই ভালো ছিলেন। এছাড়া বিদেশ থেকে যেসব শিক্ষার্থী আসতেন তারা বেশিরভাগই প্রি-মেডিকেল স্কুল কোর্স করে আসতেন। কাজেই মেডিকেল সম্পর্কে তারা আমাদের চেয়ে একটু বেশি জানতেন। বিশেষ করে বেসিক সাবজেক্টগুলোতে তারা ছিলেন এগিয়ে। বেসিক ক্লাসগুলোতে তার পারফরর্মেন্স থাকতো ভালো। কিন্তু লোটে শেরিং ছিলেন ব্যতিক্রমী। মেডিকেলের যেকোনো বিষয়ে গভীর, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর চিন্তা করতেন তিনি। বাংলাদেশে পড়তে এসেছিলেন পূর্ণ স্কলারশিপ নিয়ে। ফলে পরীক্ষায় খুবই ভালো রেজাল্ট করতেন।
আমাদের মেডিকেল থেকে কয়েকজন অনার্স (৮০ ভাগের বেশি নম্বর) পেয়েছিলেন লোটে শেরিং তাদের একজন। শুধু মেধাবীই নন, লোটে ছিলেন খুবই নম্র-ভদ্র স্বভাবের। ১৯৯৯ সালে এমবিবিএস পাসের পর জেনারেল সার্জারিতে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৩ সালে এফসিপিএস কোর্স সম্পন্ন করেন। লোটে বাচ্চাদের ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলেন। এমবিবিএস পড়ার সময় বলতেন, আমি একজন পেডিয়াট্রিশিয়ান হবো, বড় পেডিয়াট্রিশিয়ান। তবে এমবিবিএস কমপ্লিট করার পর লোটে সার্জারিতে ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাই হোক, এফসিপিএস সম্পন্নের পরেও লোটে প্রাকটিস করতেন বাংলাদেশের সার্জারির পথিকৃৎ খ্যাত প্রফেসর ডা. খাদেমুল ইসলামের অধীনে। এরপর লোটে সিঙ্গাপুরে গিয়ে ইউরোলজিতে একটি কোর্স করেন। প্রায় ১৫ বছর তার বাংলাদেশে অবস্থানকালে সব সময়ই অব্যাহত ছিল যোগাযোগ। ডা. লোটে সর্বশেষ ২০০৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
মানবসেবার ব্রতই ডা. লোটে শেরিংকে নিয়ে গেছে রাজনীতির মাঠে। পড়াশোনা অবস্থাতেই লোটে সব সময় চিন্তা করতেন মানবসেবার। কীভাবে মানুষকে সেবা দেয়া যায় এ নিয়ে ভাবতেন, আলোচনা করতেন। মানবসেবাটাই তার কাছে অগ্রাধিকার পেতো। বিয়ে করলে মানবসেবা বা জনসেবায় ব্যত্যয় হবে কিনা এমন চিন্তাভাবনা থেকে বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়েও আগ্রহ ছিল না তার। চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর নিজ দেশে ফিরে গিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। থিম্পুর জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ন্যাশনাল রেফারেল হাসপাতালে ইউরোলজি কনসালটেন্ট হিসেবে ২০০৬ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত চাকরি করেন। ২০১৩ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আসলে মানবসেবার ব্রতই তাকে নিয়ে গেছে রাজনীতির মাঠে। একজন চিকিৎসক থেকে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে বেশি মানুষকে সেবা দিতে পারবেন এমন ভাবনা থেকেই রাজনীতিতে যোগ দেন লোটে শেরিং। ভুটানের প্রথম দফা নির্বাচনে ভালো করেছে লোটে’র দল ডিএনটি। আমরা আশা করি, দ্বিতীয় দফার চূড়ান্ত ফলাফলেও তার দল বিজয়ী হবে। আগামীতে তিনি ভুটানের একজন সফল প্রধানমন্ত্রী হবেন- এ প্রত্যাশা করি।
লোটে শেরিংয়ের মতো পরিচ্ছন্ন মানসিকতার মানুষদের রাজনীতিতে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তার বন্ধু ডা. সাকির। তিনি বলেন, আমরা ১৫ বছরের বন্ধু। এ বন্ধুত্বের সুবাদে ব্যক্তি লোটের নানাদিক দেখেছি, জেনেছি। তার মতো একজন সৎ, কর্মঠ, শিক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন মানসিকতার মানুষ আমি কম দেখেছি। তার মতো মানুষদের দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করি। আমি বিশ্বাস করি, অদূর ভবিষ্যতে ডা. লোটের হাত ধরে আরো উন্নত হবে ভুটান। তার নেতৃত্বে ভুটানের জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নতি ঘটবে।
লোটে শেরিংয়ের হৃদয়ে বাংলাদেশের একটি বিশেষ অবস্থান আছে বলে বিশ্বাস করেন ডা. সাকির। তিনি বলেন, লোটের জীবনের সর্বোচ্চ সুন্দর ও সবচেয়ে উর্বর সময়টা কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। আমাদের সর্বোচ্চ আতিথেয়তা, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার পরিবেশে লোটের হৃদয় এবং চিন্তা-চেতনায় বাংলাদেশের একটি বিশেষ অবস্থান আছে।
আমরা আশা করি এবং বিশ্বাস করি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভুটানের সামগ্রিক অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বন্ধন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। কারণ তার মনে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ জায়গা আছে। ডা. সাকির বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামোগত সুবিধা, বিশেষ করে সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভুটান উপকৃত হতে পারে। আবার হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি রপ্তানি করে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতিতেও ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি বাংলাদেশের সঙ্গে তার দেশের সব ধরনের সম্পর্ক, বিশেষ করে দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোতে লোটে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে এটা সহপাঠী এবং বন্ধু হিসেবে আমি আশা ও বিশ্বাস করি।
উল্লেখ্য, ভুটানে দুই দফায় ভোট হয়। প্রথম দফায় ভোটাররা রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দেয়। যে দুই দল প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান পায় তারা পার্লামেন্টের ৪৭টি আসনে প্রার্থী দেয় এবং তখন দ্বিতীয় দফা ভোট হয়। এবারের প্রথম দফার ভোটে চারটি দল অংশ নেয় এবং প্রথম দফার মৌলিক নির্বাচনে বিস্ময়কর সাফল্য পায় ডা. লোটে শেরিংয়ের দল।
তবে প্রথম দফা নির্বাচনের পরই দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আলোচনায় উঠে এসেছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ২৮তম ব্যাচের এ শিক্ষার্থীর নাম। শিক্ষাজীবন শেষে থিম্পুর জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ন্যাশনাল রেফারেল হাসপাতালে ইউরোলজি কনসালটেন্ট হিসেবে যোগ দেন। ২০১৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি নবগঠিত রাজনৈতিক দল দ্রুক নিয়ামরূপ তসুগপা’য় (ডিএনটি) যোগ দেন। মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই ডা. লোটে শেরিং চলে আসেন দলটির শীর্ষপর্যায়ে। ১৫ই সেপ্টেম্বর ভুটানের প্রথম দফা নির্বাচনে জয়লাভ করে চমক সৃষ্টি করে ডা. লোটের দল ডিএনটি। দ্বিতীয় দফা ভোটের পর আগামী ১৮ই অক্টোবর জানা যাবে চূড়ান্ত ফলাফল। তবে প্রথম দফা ভোটের পরই দেশটির সম্ভাব্য নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আলোচনায় উঠে এসেছে ডা. লোটে শেরিংয়ের নাম।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ডা. লোটের সহপাঠীদের মধ্যে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন খুলনার ছেলে ডা. মো. আহসান হাবীব সাকির। বর্তমানে তিনি রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার। দেড় দশকের বন্ধুত্বের সুবাদে দৈনিক মানবজমিন-এর কাছে ডা. লোটে’র জীবনের নানাদিক তুলে ধরেছেন ডা. সাকির।
১৯৯১ সালের কথা। বাংলাদেশে তখন হাতেগোনা যে কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ছিল তার অন্যতম ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ। ডা. সাকির বলেন, ১৯৯১ সালে আমরা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জনে তখন বহু বিদেশি শিক্ষার্থী আসতেন বাংলাদেশে। নেপাল, ভুটান, ইরান, সুদান, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ থেকে স্কলারশিপ নিয়ে তারা এদেশে পড়তে আসতেন। সেবার ভুটান থেকে যে কয়েকজন এসেছিলেন তাদের একজন লোটে শেরিং, আমাদের লোটে। আমাদের দু’জনের হোস্টেল ছিল পাশাপাশি।
লোটে থাকতেন বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত হোস্টেলের ওয়েস্ট ব্লকের দোতলায়। মেডিকেলে ভর্তির মাধ্যমেই আমাদের পরিচয়। তবে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠার কারণ ছিল অন্য। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে আমাদের একাডেমিক ভবন ও হোস্টেলের দূরত্ব ছিল প্রায় আধা কিলোমিটার। আমরা হোস্টেল থেকে প্রায় একই সময়ে কলেজের উদ্দেশে রওনা দিতাম। ফিরতামও একই সময়ে। ফলে প্রায় দিনই আমরা একসঙ্গে আসা-যাওয়া করতাম। এই আসা-যাওয়ার পথে আমাদের মধ্যে অনেক গল্প হতো। সে তার দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে গল্প করতো। বাংলাদেশের প্রকৃতি, মানুষের আচার-ব্যবহার, আতিথেয়তা নিয়েও প্রকাশ করতো তার অনুভূতি। এভাবেই লোটের সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশের কয়েকজনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
শিক্ষাজীবনে খুব কঠোরভাবে সময়জ্ঞান মেনে চলতেন লোটে শেরিং। ডা. সাকির বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে লোটে ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেতেন। পড়াশোনা ও দৈনন্দিন কাজগুলো সম্পন্ন করতেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। তার সময়জ্ঞান ছিল প্রখর। কঠোরভাবে সময়জ্ঞান মেনে চলতেন। এক মুহূর্তে অযথা ব্যয় করতেন না। অলসতা কিংবা কোনো ধরনের বদ্যভ্যাস ছিল না তার জীবনে। শিক্ষাজীবনে তার একটি শখ ছিল বাগান করার। তার দেশ যেমন সুন্দর, সে রকম চিন্তাভাবনা করতেন। প্রতিদিনের পড়াশোনার কাজ প্রতিদিন শেষ করতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন খুবই বন্ধুবৎসল। তবে কথা বলতেন মেপে মেপে। পড়াশোনার পাশাপাশি টেবিল টেনিস ও ক্যারাম খেলতেন। ডা. সাকির বলেন, আমাদের সহপাঠী একটি প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হচ্ছেন এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। গৌরবের বিষয়। বিশেষ করে আমাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের জন্য, ম-২৮ ব্যাচের সহপাঠীদের জন্য গৌরবের বিষয়। আমি বিশ্বাস করি, পরিশ্রম, সততা ও কর্মঠ হওয়ার কারণেই সৃষ্টিকর্তা তাকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, লোটের মতো নিবেদিতপ্রাণ মানুষের হাত ধরে ভুটান তথা ভুটানের মানুষ সামগ্রিক উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে।
পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে অনার্স পেয়েছিলেন ডা. লোটে শেরিং। ডা. সাকির বলেন, পড়াশোনায় তিনি খুবই ভালো ছিলেন। এছাড়া বিদেশ থেকে যেসব শিক্ষার্থী আসতেন তারা বেশিরভাগই প্রি-মেডিকেল স্কুল কোর্স করে আসতেন। কাজেই মেডিকেল সম্পর্কে তারা আমাদের চেয়ে একটু বেশি জানতেন। বিশেষ করে বেসিক সাবজেক্টগুলোতে তারা ছিলেন এগিয়ে। বেসিক ক্লাসগুলোতে তার পারফরর্মেন্স থাকতো ভালো। কিন্তু লোটে শেরিং ছিলেন ব্যতিক্রমী। মেডিকেলের যেকোনো বিষয়ে গভীর, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর চিন্তা করতেন তিনি। বাংলাদেশে পড়তে এসেছিলেন পূর্ণ স্কলারশিপ নিয়ে। ফলে পরীক্ষায় খুবই ভালো রেজাল্ট করতেন।
আমাদের মেডিকেল থেকে কয়েকজন অনার্স (৮০ ভাগের বেশি নম্বর) পেয়েছিলেন লোটে শেরিং তাদের একজন। শুধু মেধাবীই নন, লোটে ছিলেন খুবই নম্র-ভদ্র স্বভাবের। ১৯৯৯ সালে এমবিবিএস পাসের পর জেনারেল সার্জারিতে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৩ সালে এফসিপিএস কোর্স সম্পন্ন করেন। লোটে বাচ্চাদের ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলেন। এমবিবিএস পড়ার সময় বলতেন, আমি একজন পেডিয়াট্রিশিয়ান হবো, বড় পেডিয়াট্রিশিয়ান। তবে এমবিবিএস কমপ্লিট করার পর লোটে সার্জারিতে ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাই হোক, এফসিপিএস সম্পন্নের পরেও লোটে প্রাকটিস করতেন বাংলাদেশের সার্জারির পথিকৃৎ খ্যাত প্রফেসর ডা. খাদেমুল ইসলামের অধীনে। এরপর লোটে সিঙ্গাপুরে গিয়ে ইউরোলজিতে একটি কোর্স করেন। প্রায় ১৫ বছর তার বাংলাদেশে অবস্থানকালে সব সময়ই অব্যাহত ছিল যোগাযোগ। ডা. লোটে সর্বশেষ ২০০৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
মানবসেবার ব্রতই ডা. লোটে শেরিংকে নিয়ে গেছে রাজনীতির মাঠে। পড়াশোনা অবস্থাতেই লোটে সব সময় চিন্তা করতেন মানবসেবার। কীভাবে মানুষকে সেবা দেয়া যায় এ নিয়ে ভাবতেন, আলোচনা করতেন। মানবসেবাটাই তার কাছে অগ্রাধিকার পেতো। বিয়ে করলে মানবসেবা বা জনসেবায় ব্যত্যয় হবে কিনা এমন চিন্তাভাবনা থেকে বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়েও আগ্রহ ছিল না তার। চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর নিজ দেশে ফিরে গিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। থিম্পুর জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ন্যাশনাল রেফারেল হাসপাতালে ইউরোলজি কনসালটেন্ট হিসেবে ২০০৬ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত চাকরি করেন। ২০১৩ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আসলে মানবসেবার ব্রতই তাকে নিয়ে গেছে রাজনীতির মাঠে। একজন চিকিৎসক থেকে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে বেশি মানুষকে সেবা দিতে পারবেন এমন ভাবনা থেকেই রাজনীতিতে যোগ দেন লোটে শেরিং। ভুটানের প্রথম দফা নির্বাচনে ভালো করেছে লোটে’র দল ডিএনটি। আমরা আশা করি, দ্বিতীয় দফার চূড়ান্ত ফলাফলেও তার দল বিজয়ী হবে। আগামীতে তিনি ভুটানের একজন সফল প্রধানমন্ত্রী হবেন- এ প্রত্যাশা করি।
লোটে শেরিংয়ের মতো পরিচ্ছন্ন মানসিকতার মানুষদের রাজনীতিতে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তার বন্ধু ডা. সাকির। তিনি বলেন, আমরা ১৫ বছরের বন্ধু। এ বন্ধুত্বের সুবাদে ব্যক্তি লোটের নানাদিক দেখেছি, জেনেছি। তার মতো একজন সৎ, কর্মঠ, শিক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন মানসিকতার মানুষ আমি কম দেখেছি। তার মতো মানুষদের দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করি। আমি বিশ্বাস করি, অদূর ভবিষ্যতে ডা. লোটের হাত ধরে আরো উন্নত হবে ভুটান। তার নেতৃত্বে ভুটানের জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নতি ঘটবে।
লোটে শেরিংয়ের হৃদয়ে বাংলাদেশের একটি বিশেষ অবস্থান আছে বলে বিশ্বাস করেন ডা. সাকির। তিনি বলেন, লোটের জীবনের সর্বোচ্চ সুন্দর ও সবচেয়ে উর্বর সময়টা কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। আমাদের সর্বোচ্চ আতিথেয়তা, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার পরিবেশে লোটের হৃদয় এবং চিন্তা-চেতনায় বাংলাদেশের একটি বিশেষ অবস্থান আছে।
আমরা আশা করি এবং বিশ্বাস করি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভুটানের সামগ্রিক অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বন্ধন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। কারণ তার মনে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ জায়গা আছে। ডা. সাকির বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামোগত সুবিধা, বিশেষ করে সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভুটান উপকৃত হতে পারে। আবার হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি রপ্তানি করে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতিতেও ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি বাংলাদেশের সঙ্গে তার দেশের সব ধরনের সম্পর্ক, বিশেষ করে দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোতে লোটে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে এটা সহপাঠী এবং বন্ধু হিসেবে আমি আশা ও বিশ্বাস করি।
উল্লেখ্য, ভুটানে দুই দফায় ভোট হয়। প্রথম দফায় ভোটাররা রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দেয়। যে দুই দল প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান পায় তারা পার্লামেন্টের ৪৭টি আসনে প্রার্থী দেয় এবং তখন দ্বিতীয় দফা ভোট হয়। এবারের প্রথম দফার ভোটে চারটি দল অংশ নেয় এবং প্রথম দফার মৌলিক নির্বাচনে বিস্ময়কর সাফল্য পায় ডা. লোটে শেরিংয়ের দল।
No comments