তালিকা থেকে বাদ পড়াদের বাংলাদেশে পাঠানোর হুমকি
নাগরিক
তালিকা (এনআরসি) থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ঘোষণা
দিয়েছেন ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির জেনারেল সেক্রেটারি রাম মাধব। তিনি
বলেছেন, এসব অবৈধ বাংলাদেশি আসামে ভোটাধিকার পাবেন না। বিজেপি এই
প্রথমবারের মতো স্পষ্টভাবে এমনটা ঘোষণা করলো। বিজেপির অত্যন্ত প্রভাবশালী
নেতা রাম মাধব। তাকে নিয়ে বিবিসি লিখেছে, রাম মাধব বিজেপির নিছক একজন
সাধারণ সম্পাদক মাত্র নন- দলের কাশ্মীর নীতি থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব
ভারতের নীতি, সবই তিনি দেখাশোনো করেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের
সঙ্গে বিজেপির প্রধান সেতুও তিনি।
বিজেপির পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও দলের বাংলাদেশ বিষয়ক নীতি ও কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয় রাম মাধবের নির্দেশে। বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের বা এইচটি ইমাম, জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদ কিংবা জাকের পার্টির নেতা আমির ফয়সল মুজাদ্দেদি- দিল্লিতে যারাই আসুন না কেন, রাম মাধবের সঙ্গে তারা দেখা করবেন ধরেই নেয়া যায়। দিল্লিতে রাম মাধব ‘ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’ নামে যে থিঙ্কট্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত, বাংলাদেশের নেতা-মন্ত্রী-নীতি নির্ধারকরাও সেখানে নিয়মিতই বিভিন্ন আলোচনাসভা বা সেমিনারে যোগ দিয়ে থাকেন। এ কারণেই রাম মাধব যখন এনআরসি থেকে বাদ পড়া লোকজনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলেন, সেটাকে আলাদা গুরুত্ব দিতে হয়।
রাম মাধবের পাশাপাশি আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল বলেছেন, অবৈধ বাংলাদেশি শুধু আসামের সমস্যা নয়। এমন বাংলাদেশি ভারতের সর্বত্রই আছে। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিজার ও দিল্লি মেট্রোপলিটন শহরগুলোও অবৈধ অভিবাসীদের কারণে নরক যন্ত্রণা সইছে। তাই সব রাজ্যে এনআরসি নিশ্চিত করা উচিত। সোমবার ‘এনআরসি: ডিফেন্ডিং দ্য বর্ডারস, সিকিউরিং দ্য কালচার’ শীর্ষক সেমিনারে এমন মন্তব্য করেছেন বিজেপির এই দু’নেতা। এ খবর দিয়েছে স্টার অনলাইন ও বিবিসি। এতে বলা হয়েছে, ভারতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আসামের নাগরিকত্ব বিষয়ক এনআরসি ইস্যুতে প্রচারণা জোরালো করেছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এ ইস্যুতে তারা আসাম থেকে সারা দেশের রাজ্যগুলোতে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চায়।
ওই সেমিনারে আরো বক্তব্য রাখেন বিজেপির জেনারেল সেক্রেটারি রাম মাধন। তিনি বলেন, এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা থেকে যেসব মানুষ বাদ পড়েছেন তারা আসামে ভোটাধিকার পাবেন না এবং তাদেরকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এনআরসির অধীনে সব অবৈধ অভিবাসীকে আটক করা নিশ্চিত করা হবে। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ভোটার তালিকা থেকে অবৈধ অভিবাসীদের নাম বাতিল করা বা মুছে ফেলা। তারপর সরকারের তরফ থেকে তারা যেসব সুযোগ সুবিধা পায় তার সবকিছু থেকে তাদের বঞ্চিত করা। তারপরই তাদের ফেরত পাঠানো হবে।
সেমিনারে সর্বানন্দ সনোয়াল বলেন, ভারতের জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক রাজ্য অধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করছে। বিদেশি অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের দেশে প্রবেশ করে হুমকি সৃষ্টি করছে। তারা আমাদের সম্পদ থেকে তারা খাবার খাচ্ছে এবং আমাদের অধিকার তারা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এটা আমাদের জন্য একটি বিগ চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের জবাব আমার মনে হয়, সব রাজ্যের জন্য এনআরসি অত্যাবশ্যকীয়। প্রতিটি রাজ্যের এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত।
তিনি মনে করেন সব রাজ্যে আসামের মতো এনআরসি নেয়া হলে তা হবে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে। ওই সেমিনারে রাম মাধন ও বিনয় সহস্রবুদ্ধের মতো বিজেপির সিনিয়র অন্য নেতাদের উপস্থিতিতে আসামে এনআরসি তালিকা চূড়ান্ত করা হলে যদি আসাম থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা অন্য রাজ্যগুলোতে ছড়িয়ে পড়েন তাহলে কি ঘটবে তা তুলে ধরেন। উল্লেখ্য, ভারতে ১৯৫১ সালে প্রথম আসাম রাজ্যে এনআরসি প্রস্তুত করা হয়। তারপর থেকে এ তালিকা নবায়ন করা হচ্ছে। বিজেপি প্রধান অমিত শাহ দলের জাতীয় পর্যায়ের নির্বাহীদের উদ্দেশে একদিন আগে একটি বিবৃতি দেন। তাতে আসামে এনআরসির বিরোধীতা করার জন্য তিনি বিরোধী দলগুলোর সমালোচনা করেন। তিনি এদিন বলেন, বেশ কিছু শহরে অবৈধ অভিবাসী ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শনাক্তকরণ কর্মসূচি এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে। তার বক্তব্যের একদিন পরেই আসামের মুখ্যমন্ত্রী সব রাজ্যে এনআরসির প্রস্তাব রাখলেন।
রোববার বিজেপির জাতীয় নির্বাহীদের বৈঠকে একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব পাস হয়। এতে আসামে এনআরসি চর্চা করার পক্ষে সুপারিশ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার অধীনে তা আগ্রাসীভাবে বাস্তবায়নের জন্য সর্বানন্দ সনোয়ালের প্রশংসা করা হয় তাতে।
গত ৩০শে জুলাই আসামের চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা প্রকাশ হয়। সেই তালিকার কথা তুলে ধরে সর্বানন্দ সনোয়াল বলেন, ওই তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন ৪০ লাখ মানুষ্ তারা আবার নাগরিকত্ব দাবি করে আবেদন করতে পারেন, তাদের আপত্তির কথা জানাতে পারেন। তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ, প্রতিজন খাঁটি ভারতীয় নাগরিকের বিষয়ে সরকার যত্নশীল, তাদেরকে এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিনতউ এত বিপুলসংখ্যক মানুষ কীভাবে এনআরসি থেকে বাদ পড়লেন তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। এ বিষয়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কাজ করতে গিয়ে এখানে-ওখানে ভুলত্রুটি হতেই পারে। তাই আবেদন ও আপত্তির প্রেক্ষিতে সরকার বাদ যাওয়া ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব সংশোধনের কাজ করে যাচ্ছে। এমন আবেদন বা আপত্তি যাচাই করা হচ্ছে। যদি কারো নাম এনআরসিতে না থাকে তার মানে এটা নয় যে তিনি বিদেশী বলে চিহ্নিত হবে।
সর্বানন্দ সনোয়াল আরো বলেন, সীমান্তকে যতক্ষণ নিরাপদ করা না যাবে ততদিন পর্যন্ত অভিবাসী সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এক্ষেত্রে অতীতে সীমান্তকে সিল করে দিয়েছিল কংগ্রেস পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকার। কিন্তু তারা ভুল পথে গিয়েছিল। কারণ, ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত বিষয়ক কোনো চুক্তি ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের অধীনে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত সিল করে দেয়া হচ্ছে।
ওই সেমিনারে রাম মাধব বলেন, ১৯৫০-৫১ সাল পর্যন্ত তখনকার জওয়াহারলাল নেহরু নেতৃত্বাধীন সরকার অভিবাসন বিষয়ক আইন করেছে। তাতে আসামে অবৈধ মানুষদের বের করে দেয়ার কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে তাতে। একই রকম পদক্ষেপ যখন বর্তমান সরকার নিয়েছে তখন তা নিয়ে হইচই শুরু করেছে কংগ্রেস পার্টি। অতীতের সরকার রাজনৈতিক কারণে এ বিষয়ে হাত দেয়নি। তিনি আরো বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবৈধ অভিবাসী ইস্যুতে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। তিনি এর বিরোধিতা করছেন। তিনি এখন অবস্থান নিয়েছেন অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষে। তিনি বলেন, বর্তমানে আসামের ২৭টি জেলার মধ্যে কমপক্ষে ১১টিকে বলা হয় অনুপ্রবেশকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ। এটা আসামের সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। রাম মাধব আরো বলেন, এনআরসি আধুনিকায়ন করা হচ্ছে পক্ষপাতহীন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে যেসব হিন্দু, পারসি, শিখ, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নির্যাতিত হচ্ছেন তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছে ভারত। তাদের প্রতি বিজেপি সরকারের প্রতিশ্রুতি আছে। যেসব মানুষ বিপদে পড়েন তাদেরকে সব সময়ই স্বাগত জানায় ভারত।
বিবিসি লিখেছে, রাম মাধব ওই সেমিনারে বলেছেন, এখানে আমাদের পরিকল্পনা হলো তিনটে ‘ডি’- ডিটেক্ট, ডিলিট ও ডিপোর্ট। অর্থাৎ প্রথম ধাপে অবৈধ বিদেশি কারা, তাদের শনাক্ত করা হবে (ডিটেক্ট)- যেটা এখন চলছে। তারপর ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া ও বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া শুরু হবে (ডিলিট)। আর তারপর আমরা তাদের বাংলাদেশে ডিপোর্ট করবো!
এর আগে বিজেপির শীর্ষ স্তরের কোনো নেতাই এত স্পষ্টভাবে এনআরসি থেকে বাদ-পড়া লোকজনকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলেননি।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল মন্তব্য করেন, অবৈধ বিদেশিদের খুঁজতে আসামের পর এবার সারা ভারতেই এনআরসি প্রক্রিয়া চালু করা উচিত।
রাম মাধব যখন ডিপোর্ট করার কথা বলেন, মুখ্যমন্ত্রী সনোয়াল-সমেত সভায় উপস্থিত বিজেপির শীর্ষ নেতারা ও শ্রোতা-দর্শকরা টেবিল চাপড়ে ও তুমুল করতালিতে সেই মন্তব্যকে স্বাগত জানান। বস্তুত রাম মাধব ‘অবৈধ বিদেশি’দের যেভাবে বাংলাদেশে ডিপোর্ট করার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে পরিষ্কার বিজেপির মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক ভাবনাচিন্তা হয়েছে।
তিনি বলেন, অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, বাংলাদেশ আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ, সেখানে কীভাবে আপনি এই লোকগুলোকে ডিপোর্ট করবেন? আরে, বন্ধু তো আপনাদের সবাই- তাই বলে কি তাদের যে সব লোকজন অবৈধভাবে এখানে আছেন তাদের কি ফেরত পাঠানো যাবে না? আরে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের দিকেই তাকান না। বাংলাদেশ নিজেরাই তো লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সে দেশের সঙ্গে সক্রিয় আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছে। সৌদি আরবও সে দেশে থাকা অবৈধ পাকিস্তানি, বাংলাদেশি বা ভারতীয়দের মাঝে মাঝেই ফেরত পাঠায়। কাজেই ডিপোর্ট করার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই।
ভারত সরকার বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিষয়টি ঠিকই ‘কূটনৈতিক দক্ষতায় ম্যানেজ করে নিতে পারবে’ বলেও তিনি দাবি করেন।
বস্তুত এটা যে তার কোনো ব্যক্তিগত দাবি নয়, বরং বিজেপির ‘সুচিন্তিত মতামত’, সেটাও তিনি সোমবার সভার পর একান্ত আলোচনায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তবে এনআরসি থেকে যারা বাদ পড়বেন, তাদের বাংলাদেশে ডিপোর্ট করাটা ভারত সরকারেরও নীতি কিনা- দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্টতই এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার এ বিষয়ে বিবিসির এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা এনআরসি প্রক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলছি। তিনি বলেন, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পরিচালিত এই প্রক্রিয়া যে এখনো শেষ হয়নি এবং খসড়ায় যাদের নাম বাদ পড়েছে তারা যে নিজেদের ভারতীয় নাগরিক প্রমাণ করার আরো অনেক সুযোগ পাবেন সেটাও বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু আমাদের বলার নেই।
তার কথা থেকে এটা পরিষ্কার, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বাংলাদেশে ডিপোর্ট করার কথা পরিষ্কার করে বললেও ভারত সরকার এখনই এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাইছে না।
ভারতে জুলাই মাসের শেষে আসামের জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি)-র যে দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে রাজ্যের প্রায় চল্লিশ লাখ বাসিন্দার নাম বাদ পড়েছে।
সরকার যদিও বলছে, এরা সবাই আবার আপিল করার বা নথিপত্র জমা দেয়ার সুযোগ পাবেন। তারপরেও যদি এনআরসি-তে তাদের নাম না-ওঠে, তাহলেও তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে বা শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টে যাওয়ার অবকাশ থাকবে।
কিন্তু এই সব প্রক্রিয়ার শেষেও আসামের বেশ কয়েক লাখ লোক অবৈধ বিদেশি হিসেবেই চিহ্নিত হবেন বলে ধরে নেয়া হচ্ছে।
বিজেপি এই লোকজনদেরই এখন বাংলাদেশে পাঠানোর কথা বলছে- যদিও বাংলাদেশ সরকার অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছে তারা এদের বাংলাদেশি নাগরিক বলে মনে করে না, আর তাই তাদের ফিরিয়ে নেয়ারও কোনো প্রশ্ন নেই।
বিজেপির পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও দলের বাংলাদেশ বিষয়ক নীতি ও কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয় রাম মাধবের নির্দেশে। বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের বা এইচটি ইমাম, জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদ কিংবা জাকের পার্টির নেতা আমির ফয়সল মুজাদ্দেদি- দিল্লিতে যারাই আসুন না কেন, রাম মাধবের সঙ্গে তারা দেখা করবেন ধরেই নেয়া যায়। দিল্লিতে রাম মাধব ‘ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’ নামে যে থিঙ্কট্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত, বাংলাদেশের নেতা-মন্ত্রী-নীতি নির্ধারকরাও সেখানে নিয়মিতই বিভিন্ন আলোচনাসভা বা সেমিনারে যোগ দিয়ে থাকেন। এ কারণেই রাম মাধব যখন এনআরসি থেকে বাদ পড়া লোকজনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলেন, সেটাকে আলাদা গুরুত্ব দিতে হয়।
রাম মাধবের পাশাপাশি আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল বলেছেন, অবৈধ বাংলাদেশি শুধু আসামের সমস্যা নয়। এমন বাংলাদেশি ভারতের সর্বত্রই আছে। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিজার ও দিল্লি মেট্রোপলিটন শহরগুলোও অবৈধ অভিবাসীদের কারণে নরক যন্ত্রণা সইছে। তাই সব রাজ্যে এনআরসি নিশ্চিত করা উচিত। সোমবার ‘এনআরসি: ডিফেন্ডিং দ্য বর্ডারস, সিকিউরিং দ্য কালচার’ শীর্ষক সেমিনারে এমন মন্তব্য করেছেন বিজেপির এই দু’নেতা। এ খবর দিয়েছে স্টার অনলাইন ও বিবিসি। এতে বলা হয়েছে, ভারতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আসামের নাগরিকত্ব বিষয়ক এনআরসি ইস্যুতে প্রচারণা জোরালো করেছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এ ইস্যুতে তারা আসাম থেকে সারা দেশের রাজ্যগুলোতে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চায়।
ওই সেমিনারে আরো বক্তব্য রাখেন বিজেপির জেনারেল সেক্রেটারি রাম মাধন। তিনি বলেন, এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা থেকে যেসব মানুষ বাদ পড়েছেন তারা আসামে ভোটাধিকার পাবেন না এবং তাদেরকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এনআরসির অধীনে সব অবৈধ অভিবাসীকে আটক করা নিশ্চিত করা হবে। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ভোটার তালিকা থেকে অবৈধ অভিবাসীদের নাম বাতিল করা বা মুছে ফেলা। তারপর সরকারের তরফ থেকে তারা যেসব সুযোগ সুবিধা পায় তার সবকিছু থেকে তাদের বঞ্চিত করা। তারপরই তাদের ফেরত পাঠানো হবে।
সেমিনারে সর্বানন্দ সনোয়াল বলেন, ভারতের জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক রাজ্য অধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করছে। বিদেশি অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের দেশে প্রবেশ করে হুমকি সৃষ্টি করছে। তারা আমাদের সম্পদ থেকে তারা খাবার খাচ্ছে এবং আমাদের অধিকার তারা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এটা আমাদের জন্য একটি বিগ চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের জবাব আমার মনে হয়, সব রাজ্যের জন্য এনআরসি অত্যাবশ্যকীয়। প্রতিটি রাজ্যের এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত।
তিনি মনে করেন সব রাজ্যে আসামের মতো এনআরসি নেয়া হলে তা হবে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে। ওই সেমিনারে রাম মাধন ও বিনয় সহস্রবুদ্ধের মতো বিজেপির সিনিয়র অন্য নেতাদের উপস্থিতিতে আসামে এনআরসি তালিকা চূড়ান্ত করা হলে যদি আসাম থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা অন্য রাজ্যগুলোতে ছড়িয়ে পড়েন তাহলে কি ঘটবে তা তুলে ধরেন। উল্লেখ্য, ভারতে ১৯৫১ সালে প্রথম আসাম রাজ্যে এনআরসি প্রস্তুত করা হয়। তারপর থেকে এ তালিকা নবায়ন করা হচ্ছে। বিজেপি প্রধান অমিত শাহ দলের জাতীয় পর্যায়ের নির্বাহীদের উদ্দেশে একদিন আগে একটি বিবৃতি দেন। তাতে আসামে এনআরসির বিরোধীতা করার জন্য তিনি বিরোধী দলগুলোর সমালোচনা করেন। তিনি এদিন বলেন, বেশ কিছু শহরে অবৈধ অভিবাসী ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শনাক্তকরণ কর্মসূচি এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে। তার বক্তব্যের একদিন পরেই আসামের মুখ্যমন্ত্রী সব রাজ্যে এনআরসির প্রস্তাব রাখলেন।
রোববার বিজেপির জাতীয় নির্বাহীদের বৈঠকে একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব পাস হয়। এতে আসামে এনআরসি চর্চা করার পক্ষে সুপারিশ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার অধীনে তা আগ্রাসীভাবে বাস্তবায়নের জন্য সর্বানন্দ সনোয়ালের প্রশংসা করা হয় তাতে।
গত ৩০শে জুলাই আসামের চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা প্রকাশ হয়। সেই তালিকার কথা তুলে ধরে সর্বানন্দ সনোয়াল বলেন, ওই তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন ৪০ লাখ মানুষ্ তারা আবার নাগরিকত্ব দাবি করে আবেদন করতে পারেন, তাদের আপত্তির কথা জানাতে পারেন। তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ, প্রতিজন খাঁটি ভারতীয় নাগরিকের বিষয়ে সরকার যত্নশীল, তাদেরকে এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিনতউ এত বিপুলসংখ্যক মানুষ কীভাবে এনআরসি থেকে বাদ পড়লেন তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। এ বিষয়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কাজ করতে গিয়ে এখানে-ওখানে ভুলত্রুটি হতেই পারে। তাই আবেদন ও আপত্তির প্রেক্ষিতে সরকার বাদ যাওয়া ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব সংশোধনের কাজ করে যাচ্ছে। এমন আবেদন বা আপত্তি যাচাই করা হচ্ছে। যদি কারো নাম এনআরসিতে না থাকে তার মানে এটা নয় যে তিনি বিদেশী বলে চিহ্নিত হবে।
সর্বানন্দ সনোয়াল আরো বলেন, সীমান্তকে যতক্ষণ নিরাপদ করা না যাবে ততদিন পর্যন্ত অভিবাসী সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এক্ষেত্রে অতীতে সীমান্তকে সিল করে দিয়েছিল কংগ্রেস পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকার। কিন্তু তারা ভুল পথে গিয়েছিল। কারণ, ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত বিষয়ক কোনো চুক্তি ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের অধীনে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত সিল করে দেয়া হচ্ছে।
ওই সেমিনারে রাম মাধব বলেন, ১৯৫০-৫১ সাল পর্যন্ত তখনকার জওয়াহারলাল নেহরু নেতৃত্বাধীন সরকার অভিবাসন বিষয়ক আইন করেছে। তাতে আসামে অবৈধ মানুষদের বের করে দেয়ার কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে তাতে। একই রকম পদক্ষেপ যখন বর্তমান সরকার নিয়েছে তখন তা নিয়ে হইচই শুরু করেছে কংগ্রেস পার্টি। অতীতের সরকার রাজনৈতিক কারণে এ বিষয়ে হাত দেয়নি। তিনি আরো বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবৈধ অভিবাসী ইস্যুতে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। তিনি এর বিরোধিতা করছেন। তিনি এখন অবস্থান নিয়েছেন অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষে। তিনি বলেন, বর্তমানে আসামের ২৭টি জেলার মধ্যে কমপক্ষে ১১টিকে বলা হয় অনুপ্রবেশকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ। এটা আসামের সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। রাম মাধব আরো বলেন, এনআরসি আধুনিকায়ন করা হচ্ছে পক্ষপাতহীন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে যেসব হিন্দু, পারসি, শিখ, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নির্যাতিত হচ্ছেন তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছে ভারত। তাদের প্রতি বিজেপি সরকারের প্রতিশ্রুতি আছে। যেসব মানুষ বিপদে পড়েন তাদেরকে সব সময়ই স্বাগত জানায় ভারত।
বিবিসি লিখেছে, রাম মাধব ওই সেমিনারে বলেছেন, এখানে আমাদের পরিকল্পনা হলো তিনটে ‘ডি’- ডিটেক্ট, ডিলিট ও ডিপোর্ট। অর্থাৎ প্রথম ধাপে অবৈধ বিদেশি কারা, তাদের শনাক্ত করা হবে (ডিটেক্ট)- যেটা এখন চলছে। তারপর ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া ও বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া শুরু হবে (ডিলিট)। আর তারপর আমরা তাদের বাংলাদেশে ডিপোর্ট করবো!
এর আগে বিজেপির শীর্ষ স্তরের কোনো নেতাই এত স্পষ্টভাবে এনআরসি থেকে বাদ-পড়া লোকজনকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলেননি।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল মন্তব্য করেন, অবৈধ বিদেশিদের খুঁজতে আসামের পর এবার সারা ভারতেই এনআরসি প্রক্রিয়া চালু করা উচিত।
রাম মাধব যখন ডিপোর্ট করার কথা বলেন, মুখ্যমন্ত্রী সনোয়াল-সমেত সভায় উপস্থিত বিজেপির শীর্ষ নেতারা ও শ্রোতা-দর্শকরা টেবিল চাপড়ে ও তুমুল করতালিতে সেই মন্তব্যকে স্বাগত জানান। বস্তুত রাম মাধব ‘অবৈধ বিদেশি’দের যেভাবে বাংলাদেশে ডিপোর্ট করার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে পরিষ্কার বিজেপির মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক ভাবনাচিন্তা হয়েছে।
তিনি বলেন, অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, বাংলাদেশ আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ, সেখানে কীভাবে আপনি এই লোকগুলোকে ডিপোর্ট করবেন? আরে, বন্ধু তো আপনাদের সবাই- তাই বলে কি তাদের যে সব লোকজন অবৈধভাবে এখানে আছেন তাদের কি ফেরত পাঠানো যাবে না? আরে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের দিকেই তাকান না। বাংলাদেশ নিজেরাই তো লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সে দেশের সঙ্গে সক্রিয় আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছে। সৌদি আরবও সে দেশে থাকা অবৈধ পাকিস্তানি, বাংলাদেশি বা ভারতীয়দের মাঝে মাঝেই ফেরত পাঠায়। কাজেই ডিপোর্ট করার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই।
ভারত সরকার বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিষয়টি ঠিকই ‘কূটনৈতিক দক্ষতায় ম্যানেজ করে নিতে পারবে’ বলেও তিনি দাবি করেন।
বস্তুত এটা যে তার কোনো ব্যক্তিগত দাবি নয়, বরং বিজেপির ‘সুচিন্তিত মতামত’, সেটাও তিনি সোমবার সভার পর একান্ত আলোচনায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তবে এনআরসি থেকে যারা বাদ পড়বেন, তাদের বাংলাদেশে ডিপোর্ট করাটা ভারত সরকারেরও নীতি কিনা- দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্টতই এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার এ বিষয়ে বিবিসির এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা এনআরসি প্রক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলছি। তিনি বলেন, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পরিচালিত এই প্রক্রিয়া যে এখনো শেষ হয়নি এবং খসড়ায় যাদের নাম বাদ পড়েছে তারা যে নিজেদের ভারতীয় নাগরিক প্রমাণ করার আরো অনেক সুযোগ পাবেন সেটাও বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু আমাদের বলার নেই।
তার কথা থেকে এটা পরিষ্কার, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বাংলাদেশে ডিপোর্ট করার কথা পরিষ্কার করে বললেও ভারত সরকার এখনই এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাইছে না।
ভারতে জুলাই মাসের শেষে আসামের জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি)-র যে দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে রাজ্যের প্রায় চল্লিশ লাখ বাসিন্দার নাম বাদ পড়েছে।
সরকার যদিও বলছে, এরা সবাই আবার আপিল করার বা নথিপত্র জমা দেয়ার সুযোগ পাবেন। তারপরেও যদি এনআরসি-তে তাদের নাম না-ওঠে, তাহলেও তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে বা শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টে যাওয়ার অবকাশ থাকবে।
কিন্তু এই সব প্রক্রিয়ার শেষেও আসামের বেশ কয়েক লাখ লোক অবৈধ বিদেশি হিসেবেই চিহ্নিত হবেন বলে ধরে নেয়া হচ্ছে।
বিজেপি এই লোকজনদেরই এখন বাংলাদেশে পাঠানোর কথা বলছে- যদিও বাংলাদেশ সরকার অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছে তারা এদের বাংলাদেশি নাগরিক বলে মনে করে না, আর তাই তাদের ফিরিয়ে নেয়ারও কোনো প্রশ্ন নেই।
No comments