এত দিন কোথায় ছিলেন?
প্রায় পাঁচ বছর ধরে সরকারবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে থাকার পর সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো এখন আবার সরকারি বাহিনীর দখলে এসেছে। পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের সমর্থন পাওয়া সরকারবিরোধী জোটের এখন লেজ গুটিয়ে পিছু হটা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। তাদের অধিকাংশ সেই পথটাই বেছে নিয়ে সরকারের সরবরাহ করা সবুজ বাসের আরোহী হয়ে আলেপ্পো ছেড়ে চলে গেছে। তবে পেছনে রেখে গেছে বিধ্বস্ত এক শহর আর অবরুদ্ধ নগরবাসীকে, যাদের জীবন এখন সম্ভবত গত পাঁচ বছরের ‘মুক্ত’ জীবনের চেয়েও আরও বেশি অনিশ্চিত। ধারণা করা যায়, নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়া সেখানে আবারও ধীরে শুরু হবে এবং গৃহযুদ্ধ-পূর্ব স্বাভাবিকতায় ফিরে যেতে কয়েক দশক লেগে যাবে। তবে সেই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই আলেপ্পোর পতন নিয়ে হাহাকার আর কান্নার রোল এখন বিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে শোনা যাচ্ছে। সেই হাহাকার আবার বেশ কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দিচ্ছে, সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার তাড়না থেকে এই লেখার অবতারণা। আলেপ্পোতে গত পাঁচ বছরে আসলে কী হচ্ছিল? শহরটিতে তথাকথিত ‘আরব বসন্তের’ হাওয়া এসে লেগেছিল উত্তর আফ্রিকায় সেই প্রক্রিয়ার সূচনার অল্প কিছুদিন পর। আরব বসন্তকে তথাকথিত এ কারণে উল্লেখ করতে হয় যে বসন্তকালটা আরব বিশ্বের দেশগুলোর জন্য উর্বরা কিংবা সুসময়ের আগমন বার্তা বয়ে আনা সময় হিসেবে বিবেচিত নয়, যেভাবে বসন্তকালকে দেখা হয় পশ্চিমের দেশগুলোতে। ফলে আরব বিশ্বে সূচনা হওয়া আন্দোলনের নামকরণ পশ্চিম করে নিয়েছিল নিজের পছন্দমাফিক, বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে যার ছিল না তেমন কোনো সম্পর্ক। আরব বিশ্বে পরিবর্তনের বার্তাবাহক হাওয়া বয়ে যাওয়ার সেই প্রক্রিয়ার সূত্র ধরে সিরিয়ায়ও একসময় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি সোচ্চার হয়ে ওঠে।
পশ্চিম যেন সেই অপেক্ষাতেই ছিল। আর তাই দেখা যায়, সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পোর রাজপথে নেমে আসা তরুণদের পেছনে সব রকম মদদ জোগাতে সক্রিয়ভাবে যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা হচ্ছেন পশ্চিমের সেই সব দেশের নেতারা—লিবিয়ায় যাঁরা আগুন ধরিয়ে দিয়ে দেশটিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছেন, ইরাকের ভবিষ্যৎকে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে যাঁরা করে তুলেছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং আফগানিস্তানে যাঁদের আগমনে কপাল পুড়ছে দেশের মানুষের। বিশ্বের পরাক্রমশালী সেই সব নেতা আলেপ্পোর প্রতিবাদ–বিক্ষোভ এবং সেই বিক্ষোভ দমনে নেওয়া সরকারের কঠোর পদক্ষেপকে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব আরও বিস্তৃত করার সুযোগ হিসেবে গণ্য করে অস্ত্র আর যোদ্ধার ঢালাও চালান দিয়ে সেখানে তৈরি করে দেন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। আর পশ্চিমের সে রকম মদদে উৎসাহিত হয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের ধর্মান্ধ উন্মাদেরাও ধর্মযুদ্ধের আগমন বার্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে আড্ডা গেড়েছিল জিহাদের সেই অভয়ারণ্যে। ফলে একসময় দেশের সেই অংশটি সিরিয়ার সরকারের হাতছাড়া হয়ে যায় এবং সেখানে গড়ে ওঠে নিজস্ব এক উদ্ভট প্রশাসন, শত্রু বধের সব রকম শিক্ষা যে প্রশাসন অবরুদ্ধ নগরবাসীকে দিতে শুরু করে। সে রকম ধর্মযুদ্ধের বহমান সেই বাতাসে আন্দোলিত হতে থাকা আলেপ্পো এবং বিদ্রোহীকবলিত সিরিয়ার অন্য কয়েকটি শহরে গত পাঁচ বছরে শত্রু নিধনের নামে চালানো হয়েছে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, যে হত্যাযজ্ঞে শামিল হতে শিশুদেরও বিদ্রোহীরা অনুপ্রাণিত করেছিল, যার পরিণতিতে ভিডিও ফুটেজে রাইফেলধারী অপ্রাপ্তবয়স্কদের দেখা গেছে হাত আর চোখ বাঁধা শত্রুপক্ষের সৈনিকদের তাক করে গুলি ছুড়তে, দেখা গেছে জিহাদি জন নামের এক উন্মাদকে ছুরি হাতে জীবন্ত মানুষের কল্লা কেটে নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়তে, দেখেছি আমরা ধর্মীয় উন্মাদনায় নেশাগ্রস্ত এক পাগলকে সিরিয়ার নিহত সৈনিকের কলজে ছিঁড়ে নিয়ে তা চিবিয়ে খেতে। আরও দেখা গেছে প্রাচীন সভ্যতার অমূল্য সব নিদর্শন বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে, অন্য ধর্মের মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করতে। আর এই সবকিছুর মধ্যেও জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সামান্থা পাওয়ারের মতো স্বঘোষিত মানবাধিকারের সন্তদের আমরা দেখেছি নিশ্চুপ বসে থেকে জাবর কেটে যেতে, যেন নিজের সাঙাতেরা ভুল কিছু করছে না বরং সব নষ্টের গোড়া হচ্ছেন আসাদ আর তাঁর মিত্ররা। তবে দাবার ঘুঁটি উল্টে যেতেই এখন কেবল আড়মোড়া ভেঙেই নয়, বরং মাজা খাঁড়া করে দাঁড়িয়ে আবারও তাঁরা গাইতে শুরু করেছেন মানবাধিকার রসাতলে যাওয়ার হাহাকার তুলে গাওয়া বুক চাপড়ানো গান। সিরিয়া নিয়ে অন্তঃপ্রাণ এই সন্তদের কিন্তু বিশ্বের নানা প্রান্তে আরও যেসব মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায় না। যেন কিছুই হচ্ছে না এঁদেরই কল্যাণে মগের মুলুকে পরিণত হওয়া দেশ লিবিয়ায়; ইয়েমেনে সৌদি আরবের নির্বিচার বোমাবর্ষণ করে যাওয়া যেন হচ্ছে দেশটির জন্মগত অধিকার; চৌদ্দপুরুষের বসবাসের ভূমি থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে চারদিকটা কাঁটাতারের বেড়ায় ঘিরে ফেলে ‘মালিকের প্রবেশ নিষেধ’ নোটিশ সেখানে সেঁটে দেওয়া যেন ইহুদিদের জন্য হচ্ছে স্বয়ং ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া এমন এক গ্যারান্টি, যা নিয়ে কথা বলতে নেই। অন্যদিকে সিরিয়া নিজের শিবিরের কিংবা নিজেদের দখলে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হওয়া একটি দেশ বলেই সিরিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে এত উৎকণ্ঠা, এত মায়াকান্না এদের। এবার দেখা যাক চোখের জল ফেলা সেই সব ‘মানবাধিকার রক্ষাকারী’দের নিজেদের ঠিক করে নেওয়া আইনের চোখে কীভাবে দেখা যায় আলেপ্পোকে। ইরাক কিংবা ইয়েমেনের মতো ধর্মীয় বিভাজনের বড় দাগে ভাগ করে নিয়ে সিরিয়ার দিকে আলোকপাত করার সুযোগ খুব একটা নেই।
ধর্ম সিরিয়ার রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি, যেমনটা তা করে আসছে ইরাক, বাহরাইন এমনকি সৌদি আরবে। দেশের সংখ্যালঘু আলাভি সম্প্রদায়, শিয়াদের দূরসম্পর্কীয় জ্ঞাতি ভাই হিসেবে যাদের ধরে নেওয়া যায়, গত চার দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মূলত এদের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলেও শিয়া ও সুন্নিদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশও এদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলায় প্রথমে হাফেজ আল-আসাদ এবং তাঁর মৃত্যুতে পুত্র বাশার আল-আসাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে শক্ত হাতে দেশ শাসন করে যাওয়া। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সেখানেও নিয়মিত ঘটে চললেও বন্দীদের উলঙ্গ করে নিয়ে সেলফিতে তাদের ছবি তুলে সেই সব ছবি বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করার মতো জংলি তৃপ্তি ভোগের খবর অবশ্য সিরিয়া থেকে পাওয়া যায়নি, যেমনটা আমরা পেয়েছিলাম ইরাকের আবু গারাইব বন্দিশালা মার্কিনদের কবজায় আসার পর। এসব কিছুর বাইরে আরও যা বলতে হয় তা হলো, আলেপ্পো হচ্ছে সিরিয়ারই একটি শহর, যে শহরের ওপর রয়েছে দেশটির সরকারের সব রকম অধিকার। শহরটির কিছু মানুষের রাজপথে নেমে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন কোনো অবস্থাতেই এ রকম বোঝায় না যে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এদের লেলিয়ে দেওয়ার অধিকার অন্য কোনো দেশ কিংবা গোষ্ঠীকে সেই পদক্ষেপ দিচ্ছে। সে রকম উদ্ভট অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হলে ঠিক এমনটাও বোঝাতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব শহরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণের আগেই তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-শোভাযাত্রা হতে দেখা যাচ্ছে, সেই সব শহরের ভিন্নমত পোষণকারীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে এদের লেলিয়ে দেওয়ার অধিকারও বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের আছে। যুদ্ধ, যুদ্ধের পরিণতিতে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চালানো খুনখারাবি সব দেশেই সাধারণ মানুষের জীবন সংকটাপন্ন করে তোলে। সে রকম সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে শুরুতেই যা প্রয়োজন তা হলো ঘৃণার মোড়ক থেকে মানুষকে বের করে নিয়ে আসা। যুদ্ধের বদলে যুদ্ধের হুংকার তুলে যাওয়ায় সমস্যার সমাধান নেই। সমাধান নেই পক্ষপাতমূলকভাবে চোখের জল ফেলে যাওয়ার মধ্যেও। লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া—এরা সবাই সেই প্রমাণ আমাদের সামনে রেখে গেলেও আমাদের জীবন যেন বাধা পড়ে আছে সেই একই চক্রে, যেখানে আমরা সবাই পরে আছি রং-চশমা এবং জগৎকে দেখছি সেই রং-চশমার রঙের ফাঁক দিয়ে। ফলে দেখেও না দেখার ভান করে মটকা মেরে পড়ে থেকেছি নিজের দলের একদল মানুষকে তরতরিয়ে মানবতার সিঁড়ির ধাপ পার হয়ে নিচে নেমে যেতে দেখেও। আর এদেরই পরাজয়ে এখন আমাদের কারও চোখে আসছে জল, কেউ করছি হাহাকার। অবাক হয়ে তাই ভাবতে হয়, এত দিন কোথায় ছিল মানবতার জন্য কান্না, কিংবা মানুষের অবমাননায় আকাশ বিদীর্ণ করে তোলা আর্তনাদ?
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments