মাযহাব কেন মানতে হবে by মুহাম্মাদুল্লাহ আরমান
হযরত
মুআয বিন জাবাল রাযি.-এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম যখন তাকে ইয়ামানের উদ্দেশে পাঠান, তখন নবীজী তাকে জিজ্ঞাসা
করেন, মুয়ায! তোমার কাছে কোনো দীনী সমস্যা আসলে তার সমাধান তুমি কীভাবে
করবে? উত্তরে মুয়ায বলেন, আল্লাহর কিতাব দ্বারা। রাসূল জিজ্ঞাসা করলেন, যদি
তুমি কুরআনে সমাধান না পাও? মুয়ায বলেন, আল্লাহর রাসূলের হাদীস দ্বারা।
নবীজী আবার প্রশ্ন করলেন, যদি তুমি হাদীসেও সমাধান না পাও তাহলে কী করবে?
মুয়ায উত্তর দেন, আমি আমার চিন্তাশক্তি দ্বারা ইজতিহাদ করব এবং ইজতিহাদ
করার ক্ষেত্রে আমি কোনো ত্রুটি করবো না। মুয়াযের উত্তর শুনে রাসূূূূূূূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বুকে মৃদু আঘাত করে বলেন, সমস্ত
প্রশংসা ওই আল্লাহর জন্য যিনি তার রাসূলের প্রতিনিধিকে এমন বোধ ও বুদ্ধি
দান করেছেন যার ওপর রাসূল সন্তুষ্ট। (হাদীসটি হাসান। ইবনুল কায়্যিম রহ.
এটিকে সহীহ বলেছেন।Ñ সুনানে আবু দাউদ ২/৫০৫)
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। জীবনের খুঁটিনাটি সব বিষয়ের সমাধান ইসলামে আছে। পবিত্র কুরআন এবং হাদীস শরীয়তের প্রধান দুই উৎস। তবে জীবনের সব সমস্যার সমাধান সরাসরি কুরআন এবং হাদীসে নেই। আর সব সমস্যার সমাধান যে কুরআন-হাদীসে সরাসরি নেই, সে বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন, যা ওপরের হাদীস থেকে স্পষ্ট। এখন যদি কেউ বলেÑ ‘আল্লাহ এক, রাসূল এক, কুরআন এক; মাযহাব কেন চারটা? আমরা মাযহাব মানি না, কারও ইজতিহাদ মানি না; সব সমস্যার সমাধান আমরা কুরআন এবং হাদীস থেকেই নেব। কীসের আবু হানীফা, কীসের শাফী...।’ এ জাতীয় কথা নিতান্ত বোকামি ছাড়া কিছুই নয়।
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাযি.-এর কাছে এক লোক এসে কিছু প্রশ্ন করে বলল, আমাকে কুরআন থেকে এগুলোর সমাধান দিন। প্রতিউত্তরে ইমরান রাযি. বললেন, ‘তুমি একটা আহমক। যোহর নামাযের চার রাকাতে কিরাত আস্তে পড়তে হয়, এই কথা তুমি কুরআন থেকে বের করতে পারবে?...।’ (আল ইসরাইলিয়্যাত ওয়াল মাওযুআত, পৃ: ৪৬)
এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, সবকিছুর সমাধান সরাসরি কুরআন এবং হাদীস থেকে আশা করা বোকামি। তাই আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর অনুসরণ করো, অনুসরণ করো রাসূলের এবং অনুসরণ করো তাদের যারা তোমাদের মধ্যে বিচারক, ফকীহ ও আলেম।’ (সূরা নিসা : ৫৯) এই আয়তের শেষের অংশে যাকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে আল্লাহ তাকে ‘উলিল আমর’ শব্দে ব্যক্ত করেছেন। আর ‘উলিল আমরের’ ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি., জাবের বিন আবদুল্লাহ রাযি., হাসান বসরী, মুজাহিদ ও যাহ্হাক রহ. বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যারা আলেম এবং ফকীহ তাদের অনুসরণ করা। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, কান্ধলবী ২/২৪০)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, কোনো মাসআলার সমাধান যদি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বাণীতে না পাওয়া যায় তাহলে তার সমাধানের জন্য মুজতাহিদ ফকীহর শরণাপন্ন হতে হবে। এভাবেই কিয়ামত পর্যন্ত দীন টিকে থাকবে। আর সে জন্যই উলামায়ে কেরামকে আল্লাহর রাসূল নবীদের ওয়ারিস বলেছেন। উদ্দেশ্য একটাই, নবীর অনুপস্থিতিতে উলামায়ে কেরামই দীনের হাল ধরবেন। নতুন নতুন সমস্যার সমাধান দেবেন। এখন কেউ যদি বলে, কারও তাকলীদ করা যাবে না, মাযহাব মানা যাবে না, শুধু কুরআন-হাদীসই মানা যাবে; তাহলে তো ইসলাম ধর্মই একটা অসম্পূর্ণ ধর্ম হয়ে যায়! কারণ কুরআন হাদীসে তো সরাসরি সব সমস্যার সমাধান নেই! বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করছি।
পবিত্র কুরআনে যে সকল আয়াত আহকাম ও বিধি-বিধান সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে তার সংখ্যা হলো ৫০০। এই ৫০০ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষের জীবনের বিভিন্ন বিধি-বিধান বর্ণনা করেছেন। তেমনি হাদীসের মধ্যেও সব হাদীস আহকামের না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস সংখ্যা তাকরার ছাড়া মাত্র ৪৪০০টি। যদিও সনদের ভিন্নতা, তাকরার হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের উক্তি এবং তাবেঈনের ফতোয়াসহ হাদীসের সংখ্যা লাখ লাখ। কিন্তু মূল হাদীস চার হাজার চারশই। ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ বিন হুসাইন বাগদাদী বলেন, ‘তাকরার ছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস সংখ্যা চার হাজার চারশ।’ এ ব্যাপারে সুফয়ান সাওরী, ইমাম শে’াবা, ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল কাত্তান, আবদুর রহমান বিন মাহদী, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.-এর মতো হাদীসের ইমামগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন। (তাওযীহুল আফকার, পৃ: ৬৩, মিশর থেকে প্রককাশিত)
এই ৪৪০০ হাদীসের মধ্যে আহকামের হাদীস মাত্র ১১০০। এ সম্পর্কে ইমাম আবু দাউদ রহ. বর্ণনা করেন যে, ইয়াহইয় বিন সাঈদ আল কাত্তান এবং আবদুর রহমান বিন মাহদীর নিকট আহকামের হাদীস ৮০০টি, আবদুল্লাহ বিন মুবারকের নিকট ৯০০। আর ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন, আহকামের হাদীস ১১০০। (রেসালায়ে ইমাম আবু দাউদ, পৃ: ৫-৬, মিশর থেকে প্রকাশিতÑ ১৩৬৯হি.)। এখানে ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর মতটি বেশি সঠিক। কারণ তিনি অন্য তিনজনের চেয়ে ফিকহ ও ইজতিহাদের দিক দিয়ে অগ্রগামী। (দেখুন, ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ: ১৬৪, করাচী; আবদুর রশীদ নোমানী রহ.)
ওপরের পুরো পর্যালোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, কুরআন এবং হাদীস মিলিয়ে আহকামের আয়াত এবং হাদীস হচ্ছে মাত্র ১৬০০। এখন এই ১৬০০ আয়াত ও হাদীস থেকে আমরা আমাদের জীবনের কয়টা সমস্যার সমাধান নিতে পারব? ১৬শ, ৩২শ, কিংবা সর্বোচ্ছ ৪৮শ? আচ্ছা, মানুষের জীবনের সমস্যা ও পুরো ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কি এই ৪৮০০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ? এর মাধ্যমে কি পুরো ইসলামী জীবন ব্যবস্থার রূপরেখা এবং দৈনন্দিন জীবনে মানুষের প্রত্যেকটি দীনি সমস্যার সমাধান পেশ করা সম্ভব? কখনোই সম্ভব না। জীবনের সব ক্ষেত্র মিলিয়ে দৈনন্দিন জীবনে মানুষ প্রায় লক্ষাধিক মাসআলার মুখোমুখি। হয়তো সব মাসআলা সবসময় লাগে না। তাহলে এটা কীভাবে বলা সম্ভব যে, আমরা সব সমস্যার সমাধান কুরআন এবং হাদীস থেকে নেব। মাযহাব মানার দরকার নেই! তাকলীদের প্রয়োজন নেই!
ইসলামী অর্থনীতি, ব্যাংকিং, বীমা, এমএলএম, হুন্ডি, শেয়ার বাজার, মুদ্রানীতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা এবং বাজার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন এমন নিত্যনতুন সমস্যা মানুষের সামনে আসছে; যার সমাধান কিংবা সমাধানের মূলনীতি মাযহাবের ইমামগণ বহু আগেই রেখে গেছেন এবং এর জন্য তারা অনুকূল পরিবেশও পেয়েছেন। অথচ এসবের সমাধান সরাসরি কুরআন-হাদীসে নেই। যারা মাযহাব মানবেন না বলে অঙ্গীকার করে বসে আছেন তারা নিত্যনতুন সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে করবেন? হয় মাযহাব মানতে হবে না হয় নিজেরাই ইজতিহাদ করতে হবে। কিন্তু ইজতেহাদ যে করবেন সেই সুযোগ ও যোগ্যতা তো থাকতে হবে! আচ্ছা ধরে নিলাম যোগ্যতা আছে, ইজতিহাদও করলেন। এখন সেই ইজতিহাদকৃত মাসআলা অন্যের জন্য মানা জরুরি কি না? যদি বলেন জরুরি তাহলে তাদের সেই পুরনো কথায় ফিরে যেতে হয়! ‘সব সমাধান কুরআন-হাদীস থেকে নেব, কারও তাকলীদ ও ইজতিহাদ মানি না!’ যদি কুরআন-হাদীসের বাইরে গিয়ে ইমাম আবু হানীফাকে মানা না যায় তাহলে তাদেরই বা কেন মানতে হবে? তাই অনৈক্যর পথে না গিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ফেকহে ইসলামী ও মাযহাব অনুসরণ এমন এক বাস্তবতা যা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্যই আরবের সালাফী আলেমগণ মাযহাবের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও বলেন, সাধারণ মানুষকে কোনো না কোনো ইমামের মাযহাব মেনে চলতে হবে। শায়খ মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহাব নজদী, আবদুল আযীয বিন আবদুল্লাহ বিন বায, সালেহ আল উসাইমিন, মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম আলে শায়খ প্রমুখ এই সিদ্ধান্তই দিয়েছেন। কারণ একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে কুরআন-হাদীস থেকে আহকাম বের করে কখনোই আমল করা সম্ভব নয়। কারও না কারও কাছ থেকে তাকে সমাধান নিতেই হবে। আর এটাই তো মাযহাব। মাযহাব মানার অর্থ কুরআন-হাদীসের বাইরে যাওয়া নয়, বরং কুরআন-হাদীস অনুযায়ী সঠিক ও নির্ভুলভাবে আমল করার পথ সুগম করা।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। জীবনের খুঁটিনাটি সব বিষয়ের সমাধান ইসলামে আছে। পবিত্র কুরআন এবং হাদীস শরীয়তের প্রধান দুই উৎস। তবে জীবনের সব সমস্যার সমাধান সরাসরি কুরআন এবং হাদীসে নেই। আর সব সমস্যার সমাধান যে কুরআন-হাদীসে সরাসরি নেই, সে বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন, যা ওপরের হাদীস থেকে স্পষ্ট। এখন যদি কেউ বলেÑ ‘আল্লাহ এক, রাসূল এক, কুরআন এক; মাযহাব কেন চারটা? আমরা মাযহাব মানি না, কারও ইজতিহাদ মানি না; সব সমস্যার সমাধান আমরা কুরআন এবং হাদীস থেকেই নেব। কীসের আবু হানীফা, কীসের শাফী...।’ এ জাতীয় কথা নিতান্ত বোকামি ছাড়া কিছুই নয়।
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাযি.-এর কাছে এক লোক এসে কিছু প্রশ্ন করে বলল, আমাকে কুরআন থেকে এগুলোর সমাধান দিন। প্রতিউত্তরে ইমরান রাযি. বললেন, ‘তুমি একটা আহমক। যোহর নামাযের চার রাকাতে কিরাত আস্তে পড়তে হয়, এই কথা তুমি কুরআন থেকে বের করতে পারবে?...।’ (আল ইসরাইলিয়্যাত ওয়াল মাওযুআত, পৃ: ৪৬)
এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, সবকিছুর সমাধান সরাসরি কুরআন এবং হাদীস থেকে আশা করা বোকামি। তাই আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর অনুসরণ করো, অনুসরণ করো রাসূলের এবং অনুসরণ করো তাদের যারা তোমাদের মধ্যে বিচারক, ফকীহ ও আলেম।’ (সূরা নিসা : ৫৯) এই আয়তের শেষের অংশে যাকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে আল্লাহ তাকে ‘উলিল আমর’ শব্দে ব্যক্ত করেছেন। আর ‘উলিল আমরের’ ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি., জাবের বিন আবদুল্লাহ রাযি., হাসান বসরী, মুজাহিদ ও যাহ্হাক রহ. বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যারা আলেম এবং ফকীহ তাদের অনুসরণ করা। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, কান্ধলবী ২/২৪০)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, কোনো মাসআলার সমাধান যদি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বাণীতে না পাওয়া যায় তাহলে তার সমাধানের জন্য মুজতাহিদ ফকীহর শরণাপন্ন হতে হবে। এভাবেই কিয়ামত পর্যন্ত দীন টিকে থাকবে। আর সে জন্যই উলামায়ে কেরামকে আল্লাহর রাসূল নবীদের ওয়ারিস বলেছেন। উদ্দেশ্য একটাই, নবীর অনুপস্থিতিতে উলামায়ে কেরামই দীনের হাল ধরবেন। নতুন নতুন সমস্যার সমাধান দেবেন। এখন কেউ যদি বলে, কারও তাকলীদ করা যাবে না, মাযহাব মানা যাবে না, শুধু কুরআন-হাদীসই মানা যাবে; তাহলে তো ইসলাম ধর্মই একটা অসম্পূর্ণ ধর্ম হয়ে যায়! কারণ কুরআন হাদীসে তো সরাসরি সব সমস্যার সমাধান নেই! বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করছি।
পবিত্র কুরআনে যে সকল আয়াত আহকাম ও বিধি-বিধান সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে তার সংখ্যা হলো ৫০০। এই ৫০০ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষের জীবনের বিভিন্ন বিধি-বিধান বর্ণনা করেছেন। তেমনি হাদীসের মধ্যেও সব হাদীস আহকামের না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস সংখ্যা তাকরার ছাড়া মাত্র ৪৪০০টি। যদিও সনদের ভিন্নতা, তাকরার হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের উক্তি এবং তাবেঈনের ফতোয়াসহ হাদীসের সংখ্যা লাখ লাখ। কিন্তু মূল হাদীস চার হাজার চারশই। ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ বিন হুসাইন বাগদাদী বলেন, ‘তাকরার ছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস সংখ্যা চার হাজার চারশ।’ এ ব্যাপারে সুফয়ান সাওরী, ইমাম শে’াবা, ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল কাত্তান, আবদুর রহমান বিন মাহদী, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.-এর মতো হাদীসের ইমামগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন। (তাওযীহুল আফকার, পৃ: ৬৩, মিশর থেকে প্রককাশিত)
এই ৪৪০০ হাদীসের মধ্যে আহকামের হাদীস মাত্র ১১০০। এ সম্পর্কে ইমাম আবু দাউদ রহ. বর্ণনা করেন যে, ইয়াহইয় বিন সাঈদ আল কাত্তান এবং আবদুর রহমান বিন মাহদীর নিকট আহকামের হাদীস ৮০০টি, আবদুল্লাহ বিন মুবারকের নিকট ৯০০। আর ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন, আহকামের হাদীস ১১০০। (রেসালায়ে ইমাম আবু দাউদ, পৃ: ৫-৬, মিশর থেকে প্রকাশিতÑ ১৩৬৯হি.)। এখানে ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর মতটি বেশি সঠিক। কারণ তিনি অন্য তিনজনের চেয়ে ফিকহ ও ইজতিহাদের দিক দিয়ে অগ্রগামী। (দেখুন, ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ: ১৬৪, করাচী; আবদুর রশীদ নোমানী রহ.)
ওপরের পুরো পর্যালোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, কুরআন এবং হাদীস মিলিয়ে আহকামের আয়াত এবং হাদীস হচ্ছে মাত্র ১৬০০। এখন এই ১৬০০ আয়াত ও হাদীস থেকে আমরা আমাদের জীবনের কয়টা সমস্যার সমাধান নিতে পারব? ১৬শ, ৩২শ, কিংবা সর্বোচ্ছ ৪৮শ? আচ্ছা, মানুষের জীবনের সমস্যা ও পুরো ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কি এই ৪৮০০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ? এর মাধ্যমে কি পুরো ইসলামী জীবন ব্যবস্থার রূপরেখা এবং দৈনন্দিন জীবনে মানুষের প্রত্যেকটি দীনি সমস্যার সমাধান পেশ করা সম্ভব? কখনোই সম্ভব না। জীবনের সব ক্ষেত্র মিলিয়ে দৈনন্দিন জীবনে মানুষ প্রায় লক্ষাধিক মাসআলার মুখোমুখি। হয়তো সব মাসআলা সবসময় লাগে না। তাহলে এটা কীভাবে বলা সম্ভব যে, আমরা সব সমস্যার সমাধান কুরআন এবং হাদীস থেকে নেব। মাযহাব মানার দরকার নেই! তাকলীদের প্রয়োজন নেই!
ইসলামী অর্থনীতি, ব্যাংকিং, বীমা, এমএলএম, হুন্ডি, শেয়ার বাজার, মুদ্রানীতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা এবং বাজার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন এমন নিত্যনতুন সমস্যা মানুষের সামনে আসছে; যার সমাধান কিংবা সমাধানের মূলনীতি মাযহাবের ইমামগণ বহু আগেই রেখে গেছেন এবং এর জন্য তারা অনুকূল পরিবেশও পেয়েছেন। অথচ এসবের সমাধান সরাসরি কুরআন-হাদীসে নেই। যারা মাযহাব মানবেন না বলে অঙ্গীকার করে বসে আছেন তারা নিত্যনতুন সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে করবেন? হয় মাযহাব মানতে হবে না হয় নিজেরাই ইজতিহাদ করতে হবে। কিন্তু ইজতেহাদ যে করবেন সেই সুযোগ ও যোগ্যতা তো থাকতে হবে! আচ্ছা ধরে নিলাম যোগ্যতা আছে, ইজতিহাদও করলেন। এখন সেই ইজতিহাদকৃত মাসআলা অন্যের জন্য মানা জরুরি কি না? যদি বলেন জরুরি তাহলে তাদের সেই পুরনো কথায় ফিরে যেতে হয়! ‘সব সমাধান কুরআন-হাদীস থেকে নেব, কারও তাকলীদ ও ইজতিহাদ মানি না!’ যদি কুরআন-হাদীসের বাইরে গিয়ে ইমাম আবু হানীফাকে মানা না যায় তাহলে তাদেরই বা কেন মানতে হবে? তাই অনৈক্যর পথে না গিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ফেকহে ইসলামী ও মাযহাব অনুসরণ এমন এক বাস্তবতা যা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্যই আরবের সালাফী আলেমগণ মাযহাবের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও বলেন, সাধারণ মানুষকে কোনো না কোনো ইমামের মাযহাব মেনে চলতে হবে। শায়খ মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহাব নজদী, আবদুল আযীয বিন আবদুল্লাহ বিন বায, সালেহ আল উসাইমিন, মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম আলে শায়খ প্রমুখ এই সিদ্ধান্তই দিয়েছেন। কারণ একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে কুরআন-হাদীস থেকে আহকাম বের করে কখনোই আমল করা সম্ভব নয়। কারও না কারও কাছ থেকে তাকে সমাধান নিতেই হবে। আর এটাই তো মাযহাব। মাযহাব মানার অর্থ কুরআন-হাদীসের বাইরে যাওয়া নয়, বরং কুরআন-হাদীস অনুযায়ী সঠিক ও নির্ভুলভাবে আমল করার পথ সুগম করা।
No comments