তোপের মুখে আমার পিতা by তাহমিমা আনাম
বেশ
কয়েকটি ভিডিও ও ছবিতে চোখ বুলিয়েছি আমি। প্রথমটির শিরোনাম ‘স্বীকারোক্তি’।
সেখানে দেখা যাচ্ছে, একটি পত্রিকার সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে বেশ লম্বা চওড়া
বক্তৃতা দিচ্ছেন একজন টক-শো উপস্থাপক। আরও নীচে রয়েছে একটি ছবি। সেখানে
আমি দেখলাম, এই লোকটির কুশপুত্তলিকা দাহ করছে একদল মানুষ। আরেকটি ছবি ছিল
এমন। ফটোশপকৃত ছবিটিতে এ লোকটির মাথার সঙ্গে শিং লাগানো হয়েছে। এরপর আছে
সংবাদ। তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা কেবল বাড়ছে - ৩০, ৪০, ৭০...। সর্বশেষ,
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একটি বিবৃতি: এই সম্পাদকের উচিৎ পদত্যাগ করা ও
বিচারের মুখোমুখি হওয়া।
এই সম্পাদক হলেন আমার পিতা, মাহফুজ আনাম। আর পত্রিকাটি হলো দ্য ডেইলি স্টার, ইংরেজি ভাষার যে পত্রিকাটি তিনি ২৫ বছর আগে সহ-প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমার বাবা একসময় কৌতুক করে বলতেন, তার একটি ইচ্ছা ছিল, আইসক্রিমের দোকান দেয়া। কিন্তু তার বদলে ৪১ বছর বয়সে তিনি জাতিসংঘের ক্যারিয়ার ছেড়ে এলেন একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠার জন্য।
আমার বয়স তখন ১৫। ওই সময় আমরা থাইল্যান্ডে থাকতাম। শিগগিরই, বাক্সপেটরা গুছিয়ে আমরা ফিরে গেলাম আমাদের আদি শহর ঢাকায়। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকাটির জন্ম। সবে তখন প্রেসিডেন্ট এইচ. এম. এরশাদের সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটেছে। গণতন্ত্রের এ সূচনালগ্নে আমার পিতা বাংলাদেশে ফিরতে পেরেছিলেন। যে দেশটিকে তিনি ২০ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীন করতে সাহায্য করেছিলেন, সে দেশের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালন করতে তিনি ফিরেছিলেন। পত্রিকার সম্পাদকের কার্যভার গ্রহণের মাসকয়েকের মধ্যেই, বিরোধী দলের প্রতি সমঝোতার হাত বাড়াতে ও দ্বিদলীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হওয়ায় আমার বাবা প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের সমালোচনা করলেন। এরপর, পার্লামেন্ট বয়কট করা ও প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে হরতালের আশ্রয় নেওয়ায় তিনি বিরোধী দলেরও নিন্দা জানালেন। গভীরভাবে বিভাজিত তখনকার রাজনৈতিক পরিবেশে, তিনি স্বাধীন সাংবাদিকতার একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। বৃহত্তর মঙ্গলের পক্ষে থাকতে ব্যর্থ হলেই, তিনি উভয় দলের কড়া সমালোচনা করে যাচ্ছিলেন।
দেশের সর্বাধিক পঠিত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা হয়ে উঠে দ্য ডেইলি স্টার। সঙ্গে আছে বাংলা ভাষার একটি সহ-প্রকাশনা - প্রথম আলো। একসঙ্গে, এ দু’টি পত্রিকা দেশের স্বাধীন প্রিন্ট মিডিয়ার একটি বড় শক্তি। একনায়কতন্ত্রের অবসানের পর বাংলাদেশের গণমাধ্যম তুলনামূলক যে স্বাধীনতা ভোগ করে, তার সত্যায়ন এ দু’টি পত্রিকা। এটি গর্ব করার মতো একটি বিষয় এ অঞ্চলে, যেখানে সাংবাদিকরা নিয়মিতই কারাবরণ করেন, গুম হয়ে যান।
কিন্তু এরপরও, আমার বাবা রাষ্ট্রের শক্তিশালী কাঠামো থেকে মুক্ত নন। সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা, সেনাবাহিনী, পুলিশ - সব প্রতিষ্ঠান, যাদের কাছ থেকে তিনি স্বচ্ছতা দাবি করে আসছেন, তাদের কাছ থেকেই চাপের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। তবে এ বিষয়গুলো ২০০৭ সালের চেয়ে কখনই এত বড় পরিসরে ছিল না। তখন জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে গিয়ে সেনাসমর্থিত একটি তত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতা দখল করে ছিল। এ সময়কালে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ট্রান্সক্রিপ্ট, অডিওটেপ ও ভিডিও আকারে গণমাধ্যমে খবর পাঠাতো। সেখানে অনেক মানুষকে সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করতে দেখা যায়। এ কর্মকর্তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রয়েছেন। এ প্রতিবেদনগুলো স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এরপরও অন্যসব গণমাধ্যমের মতো ডেইলি স্টারও সেসব সংবাদ প্রকাশ করেছিল। ২০০৭ সালের জুলাইয়ে, হাসিনাকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে প্রায় ১১ মাস আটক রাখা হয়।
যখন সামরিক শাসনের অবসান ঘটে, যেসব স্বাক্ষীরা হাসিনাকে অভিযুক্ত করেছিলেন, তারা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন। তারা দাবি করেন, তাদের কাছ থেকে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি নেয়া হয়েছিল। এ বিষয়গুলো ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি, নির্দিষ্ট সময় পরে, অর্থাৎ ৩রা ফেব্রুয়ারি, যুক্তি-উপাত্ত দিয়ে যাচাই ব্যতিরেকে ওই সংবাদ প্রকাশের সিদ্ধান্তের জন্য দু:খপ্রকাশ করেন আমার বাবা। ডেইলি স্টারের ২৫ তম বার্ষিকী উপলক্ষে তিনি একটি টক-শো অনুষ্ঠানে গিয়ে এসব বলেন।
পরেরদিন সকালে, আকাশ-বাতাসে কেবল ভেসে বেড়াচ্ছে তার ‘স্বীকারোক্তি’। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ আমার পিতাকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে গ্রেপ্তারের দাবি জানালেন। তার অভিযোগ, শেখ হাসিনার বন্দিত্বের জন্য আমার পিতাই দায়ী। এরপর থেকে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে আমার পিতার বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক ফৌজদারি মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের হলো।
ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোকে রাষ্ট্র কর্তৃক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার এটি সর্বশেষ একটি অধ্যায় মাত্র। ২০১৫ সালের মার্চে, নিষিদ্ধ ইসলামি গোষ্ঠী হিজবুত তাহরিরের নিয়োগসংক্রান্ত একটি পোস্টারের ছবি প্রকাশ করে ডেইলি স্টার। ছবির ক্যাপশন ছিল: ‘কুৎসিত মস্তক উঁচু করছে সন্ত্রাসবাদ’। হাসিনা পার্লামেন্টে বললেন, এই ছবি প্রকাশ করে পত্রিকাটি ‘মৌলবাদীদের প্রচারে সাহায্য করেছে’। তিনি আরও বলেন, এ ছবি যারা প্রকাশ করেছে, রাষ্ট্র তাদের ‘বিরুদ্ধে ব্যবস্থা’ নেবে। আগস্টে টেলিকম খাত থেকে হঠাত করে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়, এ নির্দেশ দিয়েছিল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।
এখন আবার এসব। সন্দেহ নেই, যাচাই-বাছাই করার অযোগ্য প্রতিবেদন কারান্তরীন ব্যক্তিদের ‘স্বীকারোক্তি’র ভিত্তিতে প্রকাশ করা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিৎ, যদিও এ চর্চা বাংলাদেশে খুবই সাধারণ। এটি হতে পারতো দেশের সাংবাদিকতা চর্চা পর্যালোচনা করার দারুণ একটি সুযোগ। তার পরিবর্তে, এ সুযোগের অপব্যবহার করে রাষ্ট্র মুক্তমত চেপে ধরার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করেছে। যখন এ ধরণের কিছু এমন কারও সঙ্গে ঘটে, যাকে আপনি ভালোবাসেন, তখন তার নিরাপত্তা ব্যতিত অন্য কিছুর ওপর মনোনিবেশ করা কঠিন। তারপরও, আমার পিতার ওপর যে হয়রানি চলছে, তা কেবল এক ব্যক্তির ওপর সরকারের ক্রোধের বিষয় নয়; বরং এটি হলো বাংলাদেশের স্বাধীন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ ও সমালোচনার জায়গা সঙ্কুচিত করার একটি বিষয়।
হাসিনা এবার নিজেই প্রকাশ্যে বলেছেন যে, তিনিও তার গ্রেপ্তারের পেছনে আমার পিতার হাত থাকার গুজব বিশ্বাস করেন। যে গোয়েন্দা টাস্কফোর্স ওই স্বীকারোক্তি আদায় করেছিল, বা যে বিচারিক প্রক্রিয়ায় হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, অথবা যে কর্মকর্তারা তার গ্রেপ্তারের পেছনে দায়ী ছিল, তাদের বিষয়ে তদন্ত না করে, সরকার রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে একটি সংবাদপত্রের ওপর।
ওইদিন আমি লন্ডনে থাকা অবস্থায়, আমার বাবা আমাকে একটি টেক্সট মেসেজ পাঠান। তিনি লিখেছেন, ‘১৭০০ কোটি ডলারের মামলা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। দেশের মোট বাজেটের চেয়েও এটি বেশি।’ এ শব্দগুলোর পেছনে তার হাসির শব্দ আমি শুনতে পাই। আমি এ হাসির পেছনের দুঃখটাও বুঝতে পারি।
আমার জানতে ইচ্ছে করে, আমি এখন যেমন বোধ করছি, এমনটা কি তিনিও বোধ করেছিলেন ১৯৫৮ সালে, যখন তার পিতাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী হওয়ার দায়ে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক একনায়কতান্ত্রিক সরকার গ্রেপ্তার করেছিল। আমার দাদা কারাগারে চার বছর কাটিয়েছিলেন। যখন তার স্বাস্থ্যের এতটাই অবনতি হয় যে কর্তৃপক্ষ ভয় পেয়ে যায় কারাগারেই হয়তো তিনি মারা যাবেন, তখনই কেবল তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
এক বছর আগে, ব্লগার ও মুক্তমতের পক্ষের অ্যাক্টিভিস্ট অভিজিৎ রায়কে একুশে বই মেলা থেকে ফেরার পথে হত্যা করা হয়। তখন আমরা ওই সহিংস চরমপন্থীদের ভয় পেতে থাকি, যারা রাস্তায় আমাদের লেখকদের হত্যা করছিল। এখন, খোদ রাষ্ট্রকেই ভয় হয়, যে রাষ্ট্র রাজনৈতিক ভিন্নমতালম্বীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করছে। এক অহেতুক আতঙ্কগ্রস্থ (প্যারানয়েড) সরকার ও সহিংস চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হুমকির মাঝে পড়ে শেষ পর্যন্ত ভুক্তভোগী হলো মুক্ত গণমাধ্যম।
আমি এখন ওই আইসক্রিম দোকানটার স্বপ্ন দেখি, দেখি তার মিষ্টি কোমলতাকে। স্বপ্ন দেখি অন্য এক জীবন, যেটি হয়তো আমাদের হতো। অবশ্যই, এ স্বপ্ন কখনই বাস্তব হয়ে উঠার নয়। রক্তে মিশে আছে ভিন্নমত। এবং গল্পটার মর্মার্থ এখন অবশ্যই বুঝতে হবে। আমার পিতার সবচেয়ে খারাপ কিছু হওয়ার আশঙ্কা করি আমি। তবে, তার জন্য সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে, ব্যক্তিগতভাবে। তার এ যন্ত্রণার জন্য তার প্রিয় দেশ আরেকটু দীন হয়ে উঠবে।
[তাহমিমা আনাম একজন লেখিকা ও নৃবিজ্ঞানী। তিনি ‘অ্যা গোল্ডেন এইজ’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। এছাড়া তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসের একজন কন্ট্রিবিউটিং অপিনিয়ন রাইটার। তার আরেকটি পরিচয়, তিনি বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের কন্যা। উপরের লেখাটি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তার নিবন্ধের অনুবাদ। ভাষান্তর: নাজমুল আহসান।]
এই সম্পাদক হলেন আমার পিতা, মাহফুজ আনাম। আর পত্রিকাটি হলো দ্য ডেইলি স্টার, ইংরেজি ভাষার যে পত্রিকাটি তিনি ২৫ বছর আগে সহ-প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমার বাবা একসময় কৌতুক করে বলতেন, তার একটি ইচ্ছা ছিল, আইসক্রিমের দোকান দেয়া। কিন্তু তার বদলে ৪১ বছর বয়সে তিনি জাতিসংঘের ক্যারিয়ার ছেড়ে এলেন একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠার জন্য।
আমার বয়স তখন ১৫। ওই সময় আমরা থাইল্যান্ডে থাকতাম। শিগগিরই, বাক্সপেটরা গুছিয়ে আমরা ফিরে গেলাম আমাদের আদি শহর ঢাকায়। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকাটির জন্ম। সবে তখন প্রেসিডেন্ট এইচ. এম. এরশাদের সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটেছে। গণতন্ত্রের এ সূচনালগ্নে আমার পিতা বাংলাদেশে ফিরতে পেরেছিলেন। যে দেশটিকে তিনি ২০ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীন করতে সাহায্য করেছিলেন, সে দেশের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালন করতে তিনি ফিরেছিলেন। পত্রিকার সম্পাদকের কার্যভার গ্রহণের মাসকয়েকের মধ্যেই, বিরোধী দলের প্রতি সমঝোতার হাত বাড়াতে ও দ্বিদলীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হওয়ায় আমার বাবা প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের সমালোচনা করলেন। এরপর, পার্লামেন্ট বয়কট করা ও প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে হরতালের আশ্রয় নেওয়ায় তিনি বিরোধী দলেরও নিন্দা জানালেন। গভীরভাবে বিভাজিত তখনকার রাজনৈতিক পরিবেশে, তিনি স্বাধীন সাংবাদিকতার একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। বৃহত্তর মঙ্গলের পক্ষে থাকতে ব্যর্থ হলেই, তিনি উভয় দলের কড়া সমালোচনা করে যাচ্ছিলেন।
দেশের সর্বাধিক পঠিত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা হয়ে উঠে দ্য ডেইলি স্টার। সঙ্গে আছে বাংলা ভাষার একটি সহ-প্রকাশনা - প্রথম আলো। একসঙ্গে, এ দু’টি পত্রিকা দেশের স্বাধীন প্রিন্ট মিডিয়ার একটি বড় শক্তি। একনায়কতন্ত্রের অবসানের পর বাংলাদেশের গণমাধ্যম তুলনামূলক যে স্বাধীনতা ভোগ করে, তার সত্যায়ন এ দু’টি পত্রিকা। এটি গর্ব করার মতো একটি বিষয় এ অঞ্চলে, যেখানে সাংবাদিকরা নিয়মিতই কারাবরণ করেন, গুম হয়ে যান।
কিন্তু এরপরও, আমার বাবা রাষ্ট্রের শক্তিশালী কাঠামো থেকে মুক্ত নন। সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা, সেনাবাহিনী, পুলিশ - সব প্রতিষ্ঠান, যাদের কাছ থেকে তিনি স্বচ্ছতা দাবি করে আসছেন, তাদের কাছ থেকেই চাপের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। তবে এ বিষয়গুলো ২০০৭ সালের চেয়ে কখনই এত বড় পরিসরে ছিল না। তখন জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে গিয়ে সেনাসমর্থিত একটি তত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতা দখল করে ছিল। এ সময়কালে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ট্রান্সক্রিপ্ট, অডিওটেপ ও ভিডিও আকারে গণমাধ্যমে খবর পাঠাতো। সেখানে অনেক মানুষকে সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করতে দেখা যায়। এ কর্মকর্তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রয়েছেন। এ প্রতিবেদনগুলো স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এরপরও অন্যসব গণমাধ্যমের মতো ডেইলি স্টারও সেসব সংবাদ প্রকাশ করেছিল। ২০০৭ সালের জুলাইয়ে, হাসিনাকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে প্রায় ১১ মাস আটক রাখা হয়।
যখন সামরিক শাসনের অবসান ঘটে, যেসব স্বাক্ষীরা হাসিনাকে অভিযুক্ত করেছিলেন, তারা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন। তারা দাবি করেন, তাদের কাছ থেকে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি নেয়া হয়েছিল। এ বিষয়গুলো ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি, নির্দিষ্ট সময় পরে, অর্থাৎ ৩রা ফেব্রুয়ারি, যুক্তি-উপাত্ত দিয়ে যাচাই ব্যতিরেকে ওই সংবাদ প্রকাশের সিদ্ধান্তের জন্য দু:খপ্রকাশ করেন আমার বাবা। ডেইলি স্টারের ২৫ তম বার্ষিকী উপলক্ষে তিনি একটি টক-শো অনুষ্ঠানে গিয়ে এসব বলেন।
পরেরদিন সকালে, আকাশ-বাতাসে কেবল ভেসে বেড়াচ্ছে তার ‘স্বীকারোক্তি’। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ আমার পিতাকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে গ্রেপ্তারের দাবি জানালেন। তার অভিযোগ, শেখ হাসিনার বন্দিত্বের জন্য আমার পিতাই দায়ী। এরপর থেকে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে আমার পিতার বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক ফৌজদারি মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের হলো।
ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোকে রাষ্ট্র কর্তৃক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার এটি সর্বশেষ একটি অধ্যায় মাত্র। ২০১৫ সালের মার্চে, নিষিদ্ধ ইসলামি গোষ্ঠী হিজবুত তাহরিরের নিয়োগসংক্রান্ত একটি পোস্টারের ছবি প্রকাশ করে ডেইলি স্টার। ছবির ক্যাপশন ছিল: ‘কুৎসিত মস্তক উঁচু করছে সন্ত্রাসবাদ’। হাসিনা পার্লামেন্টে বললেন, এই ছবি প্রকাশ করে পত্রিকাটি ‘মৌলবাদীদের প্রচারে সাহায্য করেছে’। তিনি আরও বলেন, এ ছবি যারা প্রকাশ করেছে, রাষ্ট্র তাদের ‘বিরুদ্ধে ব্যবস্থা’ নেবে। আগস্টে টেলিকম খাত থেকে হঠাত করে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়, এ নির্দেশ দিয়েছিল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।
এখন আবার এসব। সন্দেহ নেই, যাচাই-বাছাই করার অযোগ্য প্রতিবেদন কারান্তরীন ব্যক্তিদের ‘স্বীকারোক্তি’র ভিত্তিতে প্রকাশ করা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিৎ, যদিও এ চর্চা বাংলাদেশে খুবই সাধারণ। এটি হতে পারতো দেশের সাংবাদিকতা চর্চা পর্যালোচনা করার দারুণ একটি সুযোগ। তার পরিবর্তে, এ সুযোগের অপব্যবহার করে রাষ্ট্র মুক্তমত চেপে ধরার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করেছে। যখন এ ধরণের কিছু এমন কারও সঙ্গে ঘটে, যাকে আপনি ভালোবাসেন, তখন তার নিরাপত্তা ব্যতিত অন্য কিছুর ওপর মনোনিবেশ করা কঠিন। তারপরও, আমার পিতার ওপর যে হয়রানি চলছে, তা কেবল এক ব্যক্তির ওপর সরকারের ক্রোধের বিষয় নয়; বরং এটি হলো বাংলাদেশের স্বাধীন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ ও সমালোচনার জায়গা সঙ্কুচিত করার একটি বিষয়।
হাসিনা এবার নিজেই প্রকাশ্যে বলেছেন যে, তিনিও তার গ্রেপ্তারের পেছনে আমার পিতার হাত থাকার গুজব বিশ্বাস করেন। যে গোয়েন্দা টাস্কফোর্স ওই স্বীকারোক্তি আদায় করেছিল, বা যে বিচারিক প্রক্রিয়ায় হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, অথবা যে কর্মকর্তারা তার গ্রেপ্তারের পেছনে দায়ী ছিল, তাদের বিষয়ে তদন্ত না করে, সরকার রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে একটি সংবাদপত্রের ওপর।
ওইদিন আমি লন্ডনে থাকা অবস্থায়, আমার বাবা আমাকে একটি টেক্সট মেসেজ পাঠান। তিনি লিখেছেন, ‘১৭০০ কোটি ডলারের মামলা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। দেশের মোট বাজেটের চেয়েও এটি বেশি।’ এ শব্দগুলোর পেছনে তার হাসির শব্দ আমি শুনতে পাই। আমি এ হাসির পেছনের দুঃখটাও বুঝতে পারি।
আমার জানতে ইচ্ছে করে, আমি এখন যেমন বোধ করছি, এমনটা কি তিনিও বোধ করেছিলেন ১৯৫৮ সালে, যখন তার পিতাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী হওয়ার দায়ে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক একনায়কতান্ত্রিক সরকার গ্রেপ্তার করেছিল। আমার দাদা কারাগারে চার বছর কাটিয়েছিলেন। যখন তার স্বাস্থ্যের এতটাই অবনতি হয় যে কর্তৃপক্ষ ভয় পেয়ে যায় কারাগারেই হয়তো তিনি মারা যাবেন, তখনই কেবল তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
এক বছর আগে, ব্লগার ও মুক্তমতের পক্ষের অ্যাক্টিভিস্ট অভিজিৎ রায়কে একুশে বই মেলা থেকে ফেরার পথে হত্যা করা হয়। তখন আমরা ওই সহিংস চরমপন্থীদের ভয় পেতে থাকি, যারা রাস্তায় আমাদের লেখকদের হত্যা করছিল। এখন, খোদ রাষ্ট্রকেই ভয় হয়, যে রাষ্ট্র রাজনৈতিক ভিন্নমতালম্বীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করছে। এক অহেতুক আতঙ্কগ্রস্থ (প্যারানয়েড) সরকার ও সহিংস চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হুমকির মাঝে পড়ে শেষ পর্যন্ত ভুক্তভোগী হলো মুক্ত গণমাধ্যম।
আমি এখন ওই আইসক্রিম দোকানটার স্বপ্ন দেখি, দেখি তার মিষ্টি কোমলতাকে। স্বপ্ন দেখি অন্য এক জীবন, যেটি হয়তো আমাদের হতো। অবশ্যই, এ স্বপ্ন কখনই বাস্তব হয়ে উঠার নয়। রক্তে মিশে আছে ভিন্নমত। এবং গল্পটার মর্মার্থ এখন অবশ্যই বুঝতে হবে। আমার পিতার সবচেয়ে খারাপ কিছু হওয়ার আশঙ্কা করি আমি। তবে, তার জন্য সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে, ব্যক্তিগতভাবে। তার এ যন্ত্রণার জন্য তার প্রিয় দেশ আরেকটু দীন হয়ে উঠবে।
[তাহমিমা আনাম একজন লেখিকা ও নৃবিজ্ঞানী। তিনি ‘অ্যা গোল্ডেন এইজ’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। এছাড়া তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসের একজন কন্ট্রিবিউটিং অপিনিয়ন রাইটার। তার আরেকটি পরিচয়, তিনি বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের কন্যা। উপরের লেখাটি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তার নিবন্ধের অনুবাদ। ভাষান্তর: নাজমুল আহসান।]
No comments