অন্ধ-আনুগত্য গণতন্ত্রের অলংকার নয় by মাহমুদুর রহমান মান্না
৩ অক্টোবর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত কার্যকরী কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাধারণত নতুন কমিটির সদস্যদের পরস্পর পরিচিতি অনুষ্ঠানের মতো হয় এটা। একটা সফল সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যে কমিটি গঠিত হয়, এর অব্যবহিত পরই হয়ে থাকে এ সভা। এতে আনন্দঘন পরিবেশ থাকে, হাসি উচ্ছলতা থাকে, রাজনীতিও থাকে, সে খুব গভীর নয়। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে, রাজনীতির মেজাজ বদলেছে, রাজনীতি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস হয়েছে। ফলে নতুন কমিটির সভায় আনন্দ হয়তো থাকছে, কিন্তু রাজনীতিও থাকছে। এবং সেটা খুব হালকা মাপের নয়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এবারের সভা একেবারে অব্যবহিত পরে অনুষ্ঠিত না হলেও খুব বিলম্ব করেও হয়নি। দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল আগে থেকেই একটি ইস্যু হয়ে গিয়েছিলেন, যাঁকে কেন্দ্র করে পরিবেশটা বেশ খানিকটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। একজন তো এত দূর বলেছিলেন যে আব্দুল জলিলকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হবে।
জনাব জলিল তাঁর পুত্রকে লিংকনস ইন-এ ভর্তি করানোর জন্য সপরিবার লন্ডন গিয়েছিলেন। সেখানে বাংলা টিভিকে তিনি একটি সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে রীতিমতো ঝড় তুলে দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই কমিটির সভায় বিষয়টি প্রথমেই গুরুত্বের সঙ্গে এসেছিল। সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নাসিম, বর্তমান দুজন সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন নেতা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আব্দুল জলিলের শাস্তি দাবি করেন। মজার ব্যাপার, সভার আগে যে তিনজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম সাজেদা চৌধুরী, বেগম মতিয়া চৌধুরী ও ওবায়দুল কাদের বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, তাঁরা এই সভায় নিশ্চুপ ছিলেন।
দেশব্যাপী প্রায় সবাই নিশ্চিত ছিলেন, আব্দুল জলিলের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সদ্য আমেরিকায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন থেকে ফেরত আসা দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, আপনারা তো অনেক নিন্দা করেছেন তাঁর কথার; আর শাস্তির দরকার কী?
না, আমার বলাটা হয়তো পুরোপুরি ঠিক হলো না। সবাই অবাক হয়েছেন তা বোধহয় নয়। সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদেরেরা বোধহয় অবাক হননি। হলে তো তাঁরা কথা বলতেন। তাঁরা বোধহয় জানতেন, নেত্রী কী করবেন। নাসিম সাহেবরা জানতেন না। তাই নেত্রী সমাপনী বক্তৃতা দেওয়ার সময়ও মো. নাসিম উঠে দাঁড়িয়ে আবারও আব্দুল জলিলের শাস্তি দাবি করেন। দু-একজন আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে জলিল সাহেব প্রকাশ্যে যেভাবে নেত্রীর বিরোধিতা করেছেন, তার শাস্তি না দিলে দলের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। তাঁদের কথার জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, জলিল সাহেব তো প্রকাশ্যে আমার বিরোধিতা করেছেন। অনেকে যে পেছনে, ড্রইংরুমে বসে সব সময় আমার সমালোচনা করেন।
শেখ হাসিনা এই বলে সভা শেষ করেন যে বিষয়টি আমার ওপর ছেড়ে দিন। প্রয়োজনে আমি পরে ব্যবস্থা নেব। কেউ কেউ অন্তত একটা শোকজ নোটিশ দেওয়ার কথা বলেন। নেত্রী তাও নাকচ করে দেন। অচিন্ত্যপূর্ব নয়? আমি মাননীয় সভানেত্রীকে এ জন্য একটা ধন্যবাদ জানাতে চাই।
লন্ডনে জলিল সাহেব কী এমন কথা বললেন, যা নিয়ে এমন দেশকাঁপানো ঝড় উঠে গেল? এমন তো নয় যে জলিল সাহেব এই প্রথম কথা বললেন। এর আগেও তিনি পার্লামেন্টে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিয়েছেন, সংবাদপত্রে সাক্ষাত্কার দিয়েছেন, যেখানে তিনি মন্ত্রিসভা এবং দলের নবগঠিত কমিটি নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন। তখন কিন্তু কেউ এমন ঝড় তোলেননি।
আব্দুল জলিল এর আগে যেসব কথা তুলেছিলেন, এর মধ্যে দুটি বিষয় ছিল প্রণিধানযোগ্য।
এক. সামরিক বাহিনীর যাঁরা এক-এগারোর হোতা ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে; দুই. মন্ত্রিসভা ও নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিকে তিনি নবরত্ন আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, এঁরা দেশ ও দল—দুটিকেই ডোবাবে। নয় মাসে সরকারের সাফল্য বলতে কিছু নেই।
অভিযোগ দুটিই গুরুতর এবং মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল। প্রেসিডিয়াম এবং কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতাই মনে করেন, এক-এগারোর হোতারা মূলত ক্ষমতা দখলকারী। আবার অনেকে মনে করেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের হাত থেকে বাঁচার জন্য এক-এগারোর বিকল্প ছিল না। এই সেদিনও নিউইয়র্কে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রীর তনয় সজীব ওয়াজেদ জয় এক-এগারোর প্রশংসা করেন। আব্দুল জলিলের প্রথম অভিযোগ নিয়ে আলোচনার অবকাশ এখানে নেই (এ নিয়ে আলাদা একটি লেখার ইচ্ছা আমার আছে)। দ্বিতীয় অভিযোগটি আলোচনার দাবি রাখে। এটা এমন একটা অভিযোগ, যার প্রতি ব্যাপক সমর্থন থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ দল ও দেশে বঞ্চিতের সংখ্যাই বেশি।
আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ ক্ষমতা এককভাবে তাঁরই। এর আগের বারও এভাবেই মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। তখন কিন্তু এত কথা ওঠেনি। কেন? কারণ, তখন যা হয়েছিল সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু এবার যা হয়েছে তা প্রত্যাশিত ছিল না। এ মন্ত্রিসভা কি এর চেয়ে ভালো হতে পারত না? নিশ্চয়ই পারত। কিন্তু সেই আরও ভালোর সীমা কত দূর, সেটা বলা যাবে না। আব্দুল জলিল মনে করেন, এ মন্ত্রিসভা যোগ্য নয়। তারা ব্যর্থ হবে। তা তিনি মনে করতেই পারেন। এ কথার জবাব ইতিহাস দেবে। আর দেবেন শেখ হাসিনা। একটা সফল, সুশাসন পরিচালনার মাধ্যমেই তিনি এ সংশয়ের জবাব দিতে পারবেন। এ দায়িত্ব এককভাবে তাঁরই।
এ ক্ষেত্রে একটা কথা তাঁর এখন থেকেই ভাবা উচিত। জলিল সাহেব যে বলেছেন, এই কয় মাসে সরকারের কোনো সাফল্য নেই, মানুষ কিন্তু সে রকমটি মনে করে। ইতিমধ্যে চিনির দাম কমাতে পারেনি সরকার, চালের দামও বাড়তে শুরু করেছে; অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম তো আগেই বেড়েছে। ভয়াবহভাবে বেড়েছে টেন্ডারবাজি, প্রতিদিন সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে সেই সব খবর। পটুয়াখালীর গণধর্ষণ এবং তার ভিডিও টেপ ধারণ নিয়ে বিদেশি দূতাবাস উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
পার্টির নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নটিও এখানে বিবেচনার দাবিদার। কেমন হয়েছে নতুন কমিটি? আবার একই রকম জবাব আসবে পর্যবেক্ষক মহল থেকে: অভিজ্ঞ ও প্রবীণ নেতাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ভোয়ার ইকবাল বাহার চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাত্কালে শেখ হাসিনা অবশ্য বলেছেন, তিনি সিনিয়রদের রেখেছেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর চেয়ারম্যান হিসেবে, যেটা তাঁর বিবেচনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা ঠিক। এবারের সংসদে স্থায়ী কমিটিগুলোকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা যে পার্টির মূল নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়েছেন, সে কথাও ঠিক।
এ ছাড়া সভানেত্রী যে বলেছেন, পার্টির অভিজ্ঞ ও সিনিয়র নেতাদের কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি, তাও মনে হয় খানিকটা ভুলে যাওয়া থেকে উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকেই এবার বাদ পড়েছেন, যাঁরা পঞ্চাশ-ষাটের কোঠায়। তাঁদের অনেকে এমনকি নমিনেশনও পাননি।
আব্দুল জলিলের শেষ কথায় আসি, যেটা নিয়ে এত হুলস্থূল হয়ে গেল। অবশ্য জলিল যে ঠিক কী কথা লন্ডনের ওই টিভিকে বলেছেন, তা নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুলও নিশ্চিত নন। এখানে যেভাবে পত্রিকায় এসেছে, আমি তারই ভিত্তিতে বলছি। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, আব্দুল জলিল বিগত সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, এ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করেছিল আওয়ামী লীগ। এটা একটা সমঝোতার নির্বাচন।
প্রথমেই বলা দরকার, পত্রিকায় যেভাবে খবরটা এসেছে, তা দলের জন্য বিব্রতকর হয়েছে। জলিল সাহেব এর আগেও তাঁর কথা বলেছেন। সেখানে তিনি এও বলেছেন, যত দিন জীবিত থাকবেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ করবেন। সে ক্ষেত্রে এ রকম একটি সাক্ষাত্কার তাঁর দেওয়া উচিত হয়নি। এতে বিরোধী দলের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু বিরোধী দল এটাকে নিয়ে যে হইচই করছে, তা কতটা যৌক্তিক?
২০০৮ সালে যে নির্বাচন হলো, সেটা কি একটা জাতীয় মতৈক্যের বা সমঝোতার ফসল নয়? বেশ কয়েকবার আওয়ামী লীগ, ১৪ দল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বসেনি? বিএনপি, জামায়াত বসেনি। সবাই মিলে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারে রাজি হয়ে নির্বাচনে যায়নি? এই সংস্কার তো আওয়ামী লীগই চেয়েছিল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেটি করার চেষ্টা করছিল। এবং সামগ্রিক প্রক্রিয়ার পেছনে সামরিক বাহিনী তো ছিলই। বিএনপি এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছিল, না পেরে শেষ পর্যন্ত তাদেরও রাজি হতে হয়েছিল।
অন্যায় হয় যদি তিনি বলেন, এই যে নির্বাচনের ফল, যাতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেল, সেটি এই আঁতাতের ফসল। তাহলে সত্যিই তো জনাব জলিলও বা এমপি থাকেন কীভাবে। সে ক্ষেত্রে জলিল সাহেবকে যে ক্ষমা করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা, তা শুধু তাঁর অতীত ভূমিকার কথা স্মরণ করেই।
জলিল সাহেবের যে কথাটা দলের জন্য বিব্রতকর, সেটা হলো ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে দলের দহরম-মহরম নিয়ে কথা তোলা। এ কথা সবাই জানেন, ডিজিএফআই-ই তখন ছিল মূল ক্ষমতার অধিকারী। ব্যক্তিগত বা দলীয় কারণে অনেকে তাদের সঙ্গে কথা বলে থাকতেই পারেন। দলীয় নেত্রীর মুক্তির কথা চিন্তা করে পুরো প্রেসিডিয়ামও বৈঠক করে থাকতে পারে তাদের সঙ্গে। বিএনপি বসেনি তাদের সঙ্গে? বেগম জিয়া বা তাঁর সন্তান তারেক রহমান কি এমনি এমনি মুক্তি পেয়েছেন? কথা বলতে হয়নি? তাঁদের একটি গ্রুপ তো ডিজিএফআইয়ের কথায় দলই ভেঙে ফেলেছিল।
শেখ হাসিনা যে এসব নিয়ে বেশি দূর এগোননি, তা সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই। তিনি জানেন, অনেক দূর যেতে হবে তাঁকে। অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ তাঁর সামনে। দলের মধ্যে অটুট ঐক্য দরকার। দরকার জাতীয় ঐক্যের।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিক, কলাম লেখক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এবারের সভা একেবারে অব্যবহিত পরে অনুষ্ঠিত না হলেও খুব বিলম্ব করেও হয়নি। দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল আগে থেকেই একটি ইস্যু হয়ে গিয়েছিলেন, যাঁকে কেন্দ্র করে পরিবেশটা বেশ খানিকটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। একজন তো এত দূর বলেছিলেন যে আব্দুল জলিলকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হবে।
জনাব জলিল তাঁর পুত্রকে লিংকনস ইন-এ ভর্তি করানোর জন্য সপরিবার লন্ডন গিয়েছিলেন। সেখানে বাংলা টিভিকে তিনি একটি সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে রীতিমতো ঝড় তুলে দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই কমিটির সভায় বিষয়টি প্রথমেই গুরুত্বের সঙ্গে এসেছিল। সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নাসিম, বর্তমান দুজন সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন নেতা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আব্দুল জলিলের শাস্তি দাবি করেন। মজার ব্যাপার, সভার আগে যে তিনজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম সাজেদা চৌধুরী, বেগম মতিয়া চৌধুরী ও ওবায়দুল কাদের বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, তাঁরা এই সভায় নিশ্চুপ ছিলেন।
দেশব্যাপী প্রায় সবাই নিশ্চিত ছিলেন, আব্দুল জলিলের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সদ্য আমেরিকায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন থেকে ফেরত আসা দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, আপনারা তো অনেক নিন্দা করেছেন তাঁর কথার; আর শাস্তির দরকার কী?
না, আমার বলাটা হয়তো পুরোপুরি ঠিক হলো না। সবাই অবাক হয়েছেন তা বোধহয় নয়। সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদেরেরা বোধহয় অবাক হননি। হলে তো তাঁরা কথা বলতেন। তাঁরা বোধহয় জানতেন, নেত্রী কী করবেন। নাসিম সাহেবরা জানতেন না। তাই নেত্রী সমাপনী বক্তৃতা দেওয়ার সময়ও মো. নাসিম উঠে দাঁড়িয়ে আবারও আব্দুল জলিলের শাস্তি দাবি করেন। দু-একজন আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে জলিল সাহেব প্রকাশ্যে যেভাবে নেত্রীর বিরোধিতা করেছেন, তার শাস্তি না দিলে দলের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। তাঁদের কথার জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, জলিল সাহেব তো প্রকাশ্যে আমার বিরোধিতা করেছেন। অনেকে যে পেছনে, ড্রইংরুমে বসে সব সময় আমার সমালোচনা করেন।
শেখ হাসিনা এই বলে সভা শেষ করেন যে বিষয়টি আমার ওপর ছেড়ে দিন। প্রয়োজনে আমি পরে ব্যবস্থা নেব। কেউ কেউ অন্তত একটা শোকজ নোটিশ দেওয়ার কথা বলেন। নেত্রী তাও নাকচ করে দেন। অচিন্ত্যপূর্ব নয়? আমি মাননীয় সভানেত্রীকে এ জন্য একটা ধন্যবাদ জানাতে চাই।
লন্ডনে জলিল সাহেব কী এমন কথা বললেন, যা নিয়ে এমন দেশকাঁপানো ঝড় উঠে গেল? এমন তো নয় যে জলিল সাহেব এই প্রথম কথা বললেন। এর আগেও তিনি পার্লামেন্টে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিয়েছেন, সংবাদপত্রে সাক্ষাত্কার দিয়েছেন, যেখানে তিনি মন্ত্রিসভা এবং দলের নবগঠিত কমিটি নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন। তখন কিন্তু কেউ এমন ঝড় তোলেননি।
আব্দুল জলিল এর আগে যেসব কথা তুলেছিলেন, এর মধ্যে দুটি বিষয় ছিল প্রণিধানযোগ্য।
এক. সামরিক বাহিনীর যাঁরা এক-এগারোর হোতা ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে; দুই. মন্ত্রিসভা ও নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিকে তিনি নবরত্ন আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, এঁরা দেশ ও দল—দুটিকেই ডোবাবে। নয় মাসে সরকারের সাফল্য বলতে কিছু নেই।
অভিযোগ দুটিই গুরুতর এবং মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল। প্রেসিডিয়াম এবং কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতাই মনে করেন, এক-এগারোর হোতারা মূলত ক্ষমতা দখলকারী। আবার অনেকে মনে করেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের হাত থেকে বাঁচার জন্য এক-এগারোর বিকল্প ছিল না। এই সেদিনও নিউইয়র্কে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রীর তনয় সজীব ওয়াজেদ জয় এক-এগারোর প্রশংসা করেন। আব্দুল জলিলের প্রথম অভিযোগ নিয়ে আলোচনার অবকাশ এখানে নেই (এ নিয়ে আলাদা একটি লেখার ইচ্ছা আমার আছে)। দ্বিতীয় অভিযোগটি আলোচনার দাবি রাখে। এটা এমন একটা অভিযোগ, যার প্রতি ব্যাপক সমর্থন থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ দল ও দেশে বঞ্চিতের সংখ্যাই বেশি।
আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ ক্ষমতা এককভাবে তাঁরই। এর আগের বারও এভাবেই মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। তখন কিন্তু এত কথা ওঠেনি। কেন? কারণ, তখন যা হয়েছিল সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু এবার যা হয়েছে তা প্রত্যাশিত ছিল না। এ মন্ত্রিসভা কি এর চেয়ে ভালো হতে পারত না? নিশ্চয়ই পারত। কিন্তু সেই আরও ভালোর সীমা কত দূর, সেটা বলা যাবে না। আব্দুল জলিল মনে করেন, এ মন্ত্রিসভা যোগ্য নয়। তারা ব্যর্থ হবে। তা তিনি মনে করতেই পারেন। এ কথার জবাব ইতিহাস দেবে। আর দেবেন শেখ হাসিনা। একটা সফল, সুশাসন পরিচালনার মাধ্যমেই তিনি এ সংশয়ের জবাব দিতে পারবেন। এ দায়িত্ব এককভাবে তাঁরই।
এ ক্ষেত্রে একটা কথা তাঁর এখন থেকেই ভাবা উচিত। জলিল সাহেব যে বলেছেন, এই কয় মাসে সরকারের কোনো সাফল্য নেই, মানুষ কিন্তু সে রকমটি মনে করে। ইতিমধ্যে চিনির দাম কমাতে পারেনি সরকার, চালের দামও বাড়তে শুরু করেছে; অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম তো আগেই বেড়েছে। ভয়াবহভাবে বেড়েছে টেন্ডারবাজি, প্রতিদিন সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে সেই সব খবর। পটুয়াখালীর গণধর্ষণ এবং তার ভিডিও টেপ ধারণ নিয়ে বিদেশি দূতাবাস উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
পার্টির নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নটিও এখানে বিবেচনার দাবিদার। কেমন হয়েছে নতুন কমিটি? আবার একই রকম জবাব আসবে পর্যবেক্ষক মহল থেকে: অভিজ্ঞ ও প্রবীণ নেতাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ভোয়ার ইকবাল বাহার চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাত্কালে শেখ হাসিনা অবশ্য বলেছেন, তিনি সিনিয়রদের রেখেছেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর চেয়ারম্যান হিসেবে, যেটা তাঁর বিবেচনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা ঠিক। এবারের সংসদে স্থায়ী কমিটিগুলোকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা যে পার্টির মূল নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়েছেন, সে কথাও ঠিক।
এ ছাড়া সভানেত্রী যে বলেছেন, পার্টির অভিজ্ঞ ও সিনিয়র নেতাদের কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি, তাও মনে হয় খানিকটা ভুলে যাওয়া থেকে উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকেই এবার বাদ পড়েছেন, যাঁরা পঞ্চাশ-ষাটের কোঠায়। তাঁদের অনেকে এমনকি নমিনেশনও পাননি।
আব্দুল জলিলের শেষ কথায় আসি, যেটা নিয়ে এত হুলস্থূল হয়ে গেল। অবশ্য জলিল যে ঠিক কী কথা লন্ডনের ওই টিভিকে বলেছেন, তা নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুলও নিশ্চিত নন। এখানে যেভাবে পত্রিকায় এসেছে, আমি তারই ভিত্তিতে বলছি। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, আব্দুল জলিল বিগত সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, এ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করেছিল আওয়ামী লীগ। এটা একটা সমঝোতার নির্বাচন।
প্রথমেই বলা দরকার, পত্রিকায় যেভাবে খবরটা এসেছে, তা দলের জন্য বিব্রতকর হয়েছে। জলিল সাহেব এর আগেও তাঁর কথা বলেছেন। সেখানে তিনি এও বলেছেন, যত দিন জীবিত থাকবেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ করবেন। সে ক্ষেত্রে এ রকম একটি সাক্ষাত্কার তাঁর দেওয়া উচিত হয়নি। এতে বিরোধী দলের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু বিরোধী দল এটাকে নিয়ে যে হইচই করছে, তা কতটা যৌক্তিক?
২০০৮ সালে যে নির্বাচন হলো, সেটা কি একটা জাতীয় মতৈক্যের বা সমঝোতার ফসল নয়? বেশ কয়েকবার আওয়ামী লীগ, ১৪ দল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বসেনি? বিএনপি, জামায়াত বসেনি। সবাই মিলে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারে রাজি হয়ে নির্বাচনে যায়নি? এই সংস্কার তো আওয়ামী লীগই চেয়েছিল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেটি করার চেষ্টা করছিল। এবং সামগ্রিক প্রক্রিয়ার পেছনে সামরিক বাহিনী তো ছিলই। বিএনপি এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছিল, না পেরে শেষ পর্যন্ত তাদেরও রাজি হতে হয়েছিল।
অন্যায় হয় যদি তিনি বলেন, এই যে নির্বাচনের ফল, যাতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেল, সেটি এই আঁতাতের ফসল। তাহলে সত্যিই তো জনাব জলিলও বা এমপি থাকেন কীভাবে। সে ক্ষেত্রে জলিল সাহেবকে যে ক্ষমা করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা, তা শুধু তাঁর অতীত ভূমিকার কথা স্মরণ করেই।
জলিল সাহেবের যে কথাটা দলের জন্য বিব্রতকর, সেটা হলো ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে দলের দহরম-মহরম নিয়ে কথা তোলা। এ কথা সবাই জানেন, ডিজিএফআই-ই তখন ছিল মূল ক্ষমতার অধিকারী। ব্যক্তিগত বা দলীয় কারণে অনেকে তাদের সঙ্গে কথা বলে থাকতেই পারেন। দলীয় নেত্রীর মুক্তির কথা চিন্তা করে পুরো প্রেসিডিয়ামও বৈঠক করে থাকতে পারে তাদের সঙ্গে। বিএনপি বসেনি তাদের সঙ্গে? বেগম জিয়া বা তাঁর সন্তান তারেক রহমান কি এমনি এমনি মুক্তি পেয়েছেন? কথা বলতে হয়নি? তাঁদের একটি গ্রুপ তো ডিজিএফআইয়ের কথায় দলই ভেঙে ফেলেছিল।
শেখ হাসিনা যে এসব নিয়ে বেশি দূর এগোননি, তা সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই। তিনি জানেন, অনেক দূর যেতে হবে তাঁকে। অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ তাঁর সামনে। দলের মধ্যে অটুট ঐক্য দরকার। দরকার জাতীয় ঐক্যের।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিক, কলাম লেখক
No comments