জেঁকে বসার আগেই দমন করতে হবে আইএসকে -সাক্ষাৎকারে: রবার্ট গিবসন by রাহীদ এজাজ
রবার্ট গিবসন |
ঢাকায় কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের শেষ প্রান্তে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। বাংলাদেশে তাঁর অভিজ্ঞতা ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
প্রথম আলো: দুই বিদেশি হত্যার পর বাংলাদেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি কীভাবে দেখেন?
রবার্ট গিবসন: বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস আছে। তবে এবারই প্রথম বিদেশিদের ওপর হামলা হচ্ছে, বিদেশিরা খুন হয়েছেন, যা লজ্জাজনক। পশ্চিমা নাগরিকসহ শিয়া ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর সম্প্রতি যেসব হামলা হয়েছে, তার সব কটির দায় স্বীকার করেছে আইএস এবং এটি উদ্বেগের। আমি আশা করব, ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাঝুঁকি থাকার বিষয়টি মেনে নিয়ে সরকার তা দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এরপর লোকজনকে এটা দেখাতে পারবে যে, কাজ ও বসবাসের জন্য বাংলাদেশ নিরাপদ। আইএস এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য সন্ত্রাসী সংগঠন, যা আল-কায়েদার উত্তরসূরি এবং পৃথিবীজুড়ে সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন আছে আইএসের প্রতি। কাজেই পুরো পৃথিবী যে ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, এটি আমাদের মেনে নিতে হবে। সেই সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে আইএসের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিষয়টিও। খিলাফত প্রতিষ্ঠা নয়, তাদের বৈশ্বিক উচ্চাভিলাষ প্রমাণিত হয়েছে বৈরুত, তিউনিস ও প্যারিসের নৃশংস হামলাগুলোতে। নিজেদের উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য আইএস পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে। তাই আমার বিশ্বাস, তৎপরতা চালানোর জন্য আইএস যেকোনো দেশকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে। এ ধরনের গোপন সংগঠনগুলোর লোকজন কোথায় আছে আপনিও জানবেন না। কিন্তু তাদের উপস্থিতির প্রমাণ আপনি দেখবেন এবং এটিও বুঝতে পারবেন যে বাংলাদেশে তাদের প্রয়োজনীয় সমর্থনও আছে। তাই জঙ্গি সংগঠনটি বাংলাদেশে জেঁকে বসার আগেই তাদেরকে আমাদের দমন করতে হবে।
প্রথম আলো: আইএসের বাংলাদেশে উপস্থিতি সম্পর্কে আপনাদের কাছে থাকা তথ্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
রবার্ট গিবসন: বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে আইএসের দায় স্বীকারের দাবি থেকেই এখানে তাদের উপস্থিতির প্রমাণ মেলে। কাজেই একটি শক্তি হিসেবে তাদের আবির্ভূত হওয়ার আভাস আছে। আমরা ফের ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা পশ্চিমা স্বার্থে আইএসের হামলা দেখতে চাই না। বাংলাদেশের সরকার, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আমাদের চমৎকার সম্পর্ক আছে এবং আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে, সেগুলো আমরা তাদের দিয়েছি।
প্রথম আলো: আপনারা আসলেই কি তথ্যগুলো দিয়েছেন?
রবার্ট গিবসন: অবশ্যই। আমাদের হাতে যেসব তথ্য ছিল, সবই আমরা সরকারকে দিয়েছি। কোনো কিছুই লুকিয়ে রাখিনি। যেহেতু এখানে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেই, তদন্ত চালানোর সামর্থ্যও আমাদের নেই। তা ছাড়া এসব আমাদের কাজও নয়। কাজটা করবে এখানকার গোয়েন্দা সংস্থা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে আমরা যে তথ্য দিয়েছি, তার ভিত্তিতে তারা কাজ করতে পারে।
প্রথম আলো: আপনারা তথ্য দিয়েছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে!
রবার্ট গিবসন: লোকজনের যে বিভ্রান্তি আছে সেটি বুঝতে পারি। আমরা বলতে পারি না, গুলশানের ‘ক’ নম্বর সড়কের ‘খ’ নম্বর বাড়িতে আইএস আছে। এটি বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা যে সক্রিয়, এ নিয়ে যে তথ্য আমরা তাদের দিয়েছি, সেটির ভিত্তিতে কাজ করা এখানকার সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব। আমি যখন তাদের ঠিকানাই জানি না, তাহলে দেওয়ার সুযোগ কোথায়!
প্রথম আলো: বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন দেশের শঙ্কা এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে জঙ্গিদের হত্যার হুমকি এ দেশের ব্যবসার পরিবেশের জন্য কি নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করছে?
রবার্ট গিবসন: এখনই এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হচ্ছে না। আমার ধারণা, শুরুতে এ বিষয়ে লোকজন বেশ সতর্ক ছিলেন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা জোরদারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং লোকজনও মেনে নিয়েছেন, ঠিক আছে ঝুঁকি হয়তো আছে, তবে এর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে আমাকে চলতে হবে। পৃথিবী যে প্রতিনিয়ত আরও জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, তা সবাই মানছেন। যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজেদের এবং ওই দেশগুলোর সমৃদ্ধির জন্য কাজ করছেন। আর ঝুঁকির কথা বিবেচনা করেই তাঁদের ব্যবসা করতে হয়। আর এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। কাজেই হোটেল, বিমানবন্দরসহ যেসব জায়গায় তাঁদের চলাফেরা করতে হয়, সেখানে তাঁদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে তাঁরা এখানে আসতে থাকবেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সামর্থ্য আছে কি না সেটি জরুরি।
প্রথম আলো: বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও বিরোধী নেতা-কর্মীদের হত্যা ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন কেমন?
রবার্ট গিবসন: কোনো মুক্ত সমাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের মতো বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্য নয়। প্রায় নিয়মিতভাবে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা বিষয়গুলো তুলেছি। আর আমাদেরকে সব অভিযোগের যথাযথ তদন্তের আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা ছাড়া আলোচিত গুমের ঘটনাগুলোর তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। কারা, কেন এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তা খুঁজে বের করা উচিত। এ ধরনের ঘটনাগুলোর সুরাহা না হওয়া গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয় না।
প্রথম আলো: আসন্ন পৌর নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কতটা পরিবর্তন আনবে?
রবার্ট গিবসন: ভোটাধিকারের মাধ্যমে লোকজনের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগের প্রেক্ষাপট থেকে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জড়িত সবাই কতটা গঠনমূলকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন, সেটিও দেখার আছে। সেই সঙ্গে নির্বাচনের জন্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং নির্ভয়ে ভোটে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টিতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো: গত এপ্রিলের তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তো সুখকর নয়?
রবার্ট গিবসন: ওই নির্বাচন নিয়ে নানা পর্যায়ে হতাশা আছে। তবে আমাদের হতাশা কয়েকটি বিষয়ে। এটি তো স্পষ্ট হয়েছে যে ভোটারদের অংশগ্রহণের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছিল। অথচ ভোটের পরিবেশ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির কাজটা নির্বাচন কমিশনের ছিল। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য আমাদের একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দরকার এবং এ বিষয়টিতে আমরা উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি।
প্রথম আলো: দেড় দশকের মধ্যে দুই দফায় বাংলাদেশে প্রথমে উপ-হাইকমিশনার ও পরে হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই সময়টাতে বাংলাদেশের পরিবর্তনটা কীভাবে দেখেন?
প্রথম আলো: ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের পরিবর্তন, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে পরিবর্তনের হাওয়া আমাকে বিস্মিত করে! ১৫ বছর আগে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ ছিল না, অভাব ছিল শিক্ষা ও সুপেয় পানির। জীবনের মৌলিক চাহিদা আর জীবনযাত্রা নিয়ে মানুষের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এবার এসে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখেছি স্বাস্থ্যকর পায়খানা, সুপেয় পানির প্রাচুর্য। সেই সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে লোকজনের সচেতনতা আমাকে অবাক করেছে। আমার মতো অনেকের কাছে বিরাট এই পরিবর্তন খুব সহজেই চোখে পড়বে এবং দেশের জন্য এ এক বিরাট অর্জন। দ্বিতীয়ত, আমি যখন ঢাকা ছেড়ে যাই, তখন এত দালানকোঠা ছিল না। এখন তো ঢাকায় আকাশছোঁয়া দালানের ছড়াছড়ি। দেশজুড়ে ব্যাপক উন্নয়নের তৎপরতাও চলছে। প্রতিবছর সাড়ে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট ভালো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি মনে করি, এই হার আরও বেশি হতে পারত। বারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ঘিরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হওয়া, রাজনৈতিক সংঘাত, হরতাল, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার মতো চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জিত হচ্ছে না। আমি যখন আবার বাংলাদেশে ফিরব, তখন হয়তো এ সমস্যাগুলো থাকবে না বলে আশা রাখি।
প্রথম আলো: দুই বিদেশি হত্যার পর বাংলাদেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি কীভাবে দেখেন?
রবার্ট গিবসন: বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস আছে। তবে এবারই প্রথম বিদেশিদের ওপর হামলা হচ্ছে, বিদেশিরা খুন হয়েছেন, যা লজ্জাজনক। পশ্চিমা নাগরিকসহ শিয়া ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর সম্প্রতি যেসব হামলা হয়েছে, তার সব কটির দায় স্বীকার করেছে আইএস এবং এটি উদ্বেগের। আমি আশা করব, ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাঝুঁকি থাকার বিষয়টি মেনে নিয়ে সরকার তা দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এরপর লোকজনকে এটা দেখাতে পারবে যে, কাজ ও বসবাসের জন্য বাংলাদেশ নিরাপদ। আইএস এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য সন্ত্রাসী সংগঠন, যা আল-কায়েদার উত্তরসূরি এবং পৃথিবীজুড়ে সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন আছে আইএসের প্রতি। কাজেই পুরো পৃথিবী যে ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, এটি আমাদের মেনে নিতে হবে। সেই সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে আইএসের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিষয়টিও। খিলাফত প্রতিষ্ঠা নয়, তাদের বৈশ্বিক উচ্চাভিলাষ প্রমাণিত হয়েছে বৈরুত, তিউনিস ও প্যারিসের নৃশংস হামলাগুলোতে। নিজেদের উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য আইএস পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে। তাই আমার বিশ্বাস, তৎপরতা চালানোর জন্য আইএস যেকোনো দেশকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে। এ ধরনের গোপন সংগঠনগুলোর লোকজন কোথায় আছে আপনিও জানবেন না। কিন্তু তাদের উপস্থিতির প্রমাণ আপনি দেখবেন এবং এটিও বুঝতে পারবেন যে বাংলাদেশে তাদের প্রয়োজনীয় সমর্থনও আছে। তাই জঙ্গি সংগঠনটি বাংলাদেশে জেঁকে বসার আগেই তাদেরকে আমাদের দমন করতে হবে।
প্রথম আলো: আইএসের বাংলাদেশে উপস্থিতি সম্পর্কে আপনাদের কাছে থাকা তথ্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
রবার্ট গিবসন: বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে আইএসের দায় স্বীকারের দাবি থেকেই এখানে তাদের উপস্থিতির প্রমাণ মেলে। কাজেই একটি শক্তি হিসেবে তাদের আবির্ভূত হওয়ার আভাস আছে। আমরা ফের ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা পশ্চিমা স্বার্থে আইএসের হামলা দেখতে চাই না। বাংলাদেশের সরকার, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আমাদের চমৎকার সম্পর্ক আছে এবং আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে, সেগুলো আমরা তাদের দিয়েছি।
প্রথম আলো: আপনারা আসলেই কি তথ্যগুলো দিয়েছেন?
রবার্ট গিবসন: অবশ্যই। আমাদের হাতে যেসব তথ্য ছিল, সবই আমরা সরকারকে দিয়েছি। কোনো কিছুই লুকিয়ে রাখিনি। যেহেতু এখানে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেই, তদন্ত চালানোর সামর্থ্যও আমাদের নেই। তা ছাড়া এসব আমাদের কাজও নয়। কাজটা করবে এখানকার গোয়েন্দা সংস্থা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে আমরা যে তথ্য দিয়েছি, তার ভিত্তিতে তারা কাজ করতে পারে।
প্রথম আলো: আপনারা তথ্য দিয়েছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে!
রবার্ট গিবসন: লোকজনের যে বিভ্রান্তি আছে সেটি বুঝতে পারি। আমরা বলতে পারি না, গুলশানের ‘ক’ নম্বর সড়কের ‘খ’ নম্বর বাড়িতে আইএস আছে। এটি বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা যে সক্রিয়, এ নিয়ে যে তথ্য আমরা তাদের দিয়েছি, সেটির ভিত্তিতে কাজ করা এখানকার সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব। আমি যখন তাদের ঠিকানাই জানি না, তাহলে দেওয়ার সুযোগ কোথায়!
প্রথম আলো: বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন দেশের শঙ্কা এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে জঙ্গিদের হত্যার হুমকি এ দেশের ব্যবসার পরিবেশের জন্য কি নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করছে?
রবার্ট গিবসন: এখনই এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হচ্ছে না। আমার ধারণা, শুরুতে এ বিষয়ে লোকজন বেশ সতর্ক ছিলেন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা জোরদারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং লোকজনও মেনে নিয়েছেন, ঠিক আছে ঝুঁকি হয়তো আছে, তবে এর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে আমাকে চলতে হবে। পৃথিবী যে প্রতিনিয়ত আরও জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, তা সবাই মানছেন। যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজেদের এবং ওই দেশগুলোর সমৃদ্ধির জন্য কাজ করছেন। আর ঝুঁকির কথা বিবেচনা করেই তাঁদের ব্যবসা করতে হয়। আর এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। কাজেই হোটেল, বিমানবন্দরসহ যেসব জায়গায় তাঁদের চলাফেরা করতে হয়, সেখানে তাঁদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে তাঁরা এখানে আসতে থাকবেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সামর্থ্য আছে কি না সেটি জরুরি।
প্রথম আলো: বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও বিরোধী নেতা-কর্মীদের হত্যা ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন কেমন?
রবার্ট গিবসন: কোনো মুক্ত সমাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের মতো বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্য নয়। প্রায় নিয়মিতভাবে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা বিষয়গুলো তুলেছি। আর আমাদেরকে সব অভিযোগের যথাযথ তদন্তের আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা ছাড়া আলোচিত গুমের ঘটনাগুলোর তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। কারা, কেন এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তা খুঁজে বের করা উচিত। এ ধরনের ঘটনাগুলোর সুরাহা না হওয়া গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয় না।
প্রথম আলো: আসন্ন পৌর নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কতটা পরিবর্তন আনবে?
রবার্ট গিবসন: ভোটাধিকারের মাধ্যমে লোকজনের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগের প্রেক্ষাপট থেকে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জড়িত সবাই কতটা গঠনমূলকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন, সেটিও দেখার আছে। সেই সঙ্গে নির্বাচনের জন্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং নির্ভয়ে ভোটে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টিতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো: গত এপ্রিলের তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তো সুখকর নয়?
রবার্ট গিবসন: ওই নির্বাচন নিয়ে নানা পর্যায়ে হতাশা আছে। তবে আমাদের হতাশা কয়েকটি বিষয়ে। এটি তো স্পষ্ট হয়েছে যে ভোটারদের অংশগ্রহণের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছিল। অথচ ভোটের পরিবেশ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির কাজটা নির্বাচন কমিশনের ছিল। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য আমাদের একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দরকার এবং এ বিষয়টিতে আমরা উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি।
প্রথম আলো: দেড় দশকের মধ্যে দুই দফায় বাংলাদেশে প্রথমে উপ-হাইকমিশনার ও পরে হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই সময়টাতে বাংলাদেশের পরিবর্তনটা কীভাবে দেখেন?
প্রথম আলো: ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের পরিবর্তন, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে পরিবর্তনের হাওয়া আমাকে বিস্মিত করে! ১৫ বছর আগে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ ছিল না, অভাব ছিল শিক্ষা ও সুপেয় পানির। জীবনের মৌলিক চাহিদা আর জীবনযাত্রা নিয়ে মানুষের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এবার এসে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখেছি স্বাস্থ্যকর পায়খানা, সুপেয় পানির প্রাচুর্য। সেই সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে লোকজনের সচেতনতা আমাকে অবাক করেছে। আমার মতো অনেকের কাছে বিরাট এই পরিবর্তন খুব সহজেই চোখে পড়বে এবং দেশের জন্য এ এক বিরাট অর্জন। দ্বিতীয়ত, আমি যখন ঢাকা ছেড়ে যাই, তখন এত দালানকোঠা ছিল না। এখন তো ঢাকায় আকাশছোঁয়া দালানের ছড়াছড়ি। দেশজুড়ে ব্যাপক উন্নয়নের তৎপরতাও চলছে। প্রতিবছর সাড়ে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট ভালো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি মনে করি, এই হার আরও বেশি হতে পারত। বারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ঘিরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হওয়া, রাজনৈতিক সংঘাত, হরতাল, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার মতো চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জিত হচ্ছে না। আমি যখন আবার বাংলাদেশে ফিরব, তখন হয়তো এ সমস্যাগুলো থাকবে না বলে আশা রাখি।
No comments