নাগা শান্তিচুক্তি কি সফল হবে! by কায়কোবাদ মিলন

নাগাল্যান্ডে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী এনএসসিএন (আইএস) গোষ্ঠীর সাথে সম্প্রতি চুক্তি স্বাক্ষর করল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৯৭ সালে ইসাক মুইভা গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের। সেটিই নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে ভারত সরকারের প্রথম সমঝোতা। এরপর ১৬ বছর ধরে ৮০ বারেরও বেশি আলোচনার টেবিলে বসেছে কেন্দ্র ও এনএসসিএন। ৩ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে প্রধানমন্ত্রী মোদির উপস্থিতিতেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
আইএস গোষ্ঠী যুদ্ধবিরতির পথে থাকলেও এনএসসিএন (খাপলাং) কিন্তু চুক্তিতে আসতে রাজি হয়নি। গত জুনে মনিপুরে সেনাবাহিনীর গাড়িবহরে ভয়াবহ হামলার পেছনে এরাই ছিল বলে সরকার দাবি করে। সেই প্রেক্ষাপটেই সবচেয়ে বড় নাগা বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির সাথে শান্তিচুক্তি করল কেন্দ্র। তবে আইএস গোষ্ঠীর মূল দাবি শান্তিচুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না জানা যায়নি। তাদের দীর্ঘ দিনের দাবি- মনিপুর, আসাম, অরুণাচল প্রদেশ অর্থাৎ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে নাগা অধ্যুষিত সব এলাকাকে একসাথে জুড়ে বৃহত্তর নাগাভূমি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকারি সূত্র বলছে, চুক্তির বিস্তারিত খুঁটিনাটি ও কার্যকর করার উপায় পরে প্রকাশ করা হবে। সে ব্যাপারে মূল ভূমিকা থাকবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অনিত ডোভালের।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুইভার উদ্দেশে বলেছেন, আমরা শুধু ক্ষত নিরাময় ও সমস্যা নিরসনের চেষ্টাই করব না; আপনাদের গৌরব, সম্মান পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় শরিক হবো। মুইভা বলেছেন, সরকার ও নাগারা ‘সম্পর্কের এক নতুন পর্বে’ পা রাখছে। তবে এখন থেকে বিরাট চ্যালেঞ্জও সামনে আসবে।
প্রসঙ্গত, সার্বভৌম ও স্বাধীন নাগাল্যান্ডের দাবিতে ১৯৮০ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এনএসসিএন গঠন করেন ইসাক সু, থুইলে, মুইভা ও এসএস খাপলাং। ১৯৮৮ সালে আলাদা গোষ্ঠী তৈরি করেন খাপলাং। অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষর হওয়ার পর এনএসসিএন (আইএস) প্রায় দেড় দশক ধরে সহিংস কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকলেও খাপলাং গোষ্ঠী সম্প্রতি ভারতীয় সেনার ওপর হামলা চালায়। পাল্টা ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে খাপলাং গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। এ অভিযানে ভারত ও মিয়ানমারের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি ঘটে। মিয়ানমার সুযোগ পেলে এই অপমানের শোধ যে তুলবে, এ কথা বলাই বাহুল্য।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ছয় দশক ধরে রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহে তৎপর নাগারা। ১৯৮৮ সালে খাপলাংয়ের নেতৃত্বে এনএসসিএন ভেঙে দুই টুকরো হলেও মূল সংগঠনের রাশ ছিল আইজ্যাক-মুইভা গোষ্ঠীর হাতেই। যুদ্ধবিরতির আগ পর্যন্ত এরা বহু বছর ধরে বিদেশে নাগাল্যান্ডের একটি নির্বাসিত সরকারও চালিয়ে আসছিল। আইজ্যাক সু অসুস্থ থাকায় দিল্লিতে অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি। অনুষ্ঠানে মুইভা প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, নাগারা চিরকাল মোদির স্টেটসম্যান সম্পর্কে মনে রাখবে।
ছয় দশক ধরে নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহিংসতায় আজ এটি ভারতের প্রধানতম গরিব রাজ্য। একই সাথে কেন্দ্রীয় সরকার নানা কালাকানুন প্রবর্তনের মাধ্যমে, সেনাবাহিনীকে প্রভূত ক্ষমতা দিয়ে নির্যাতন চালানোর ফলে অস্থিতিশীলতা যেমন বেড়ে যায় তেমনি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগও সেখানে হয়নি। যদিও ১৯৯৭ সালের যুদ্ধবিরতির পর ২০ লাখ অধিবাসী অধ্যুষিত নাগাল্যান্ডে সহিংসতার মাত্রা কমে। তবে গত জুনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটি অংশ মনিপুরে হামলা চালিয়ে ১৮ ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করলে বিশ্বব্যাপী তা আলোচনার ঝড় তোলে। ওই হত্যাকাণ্ডের রেশ ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনী মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বেশখানিকটা ঢুকে অভিযান চালালে তা-ও বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। অবশ্য একসময় এই খাপলাং গ্রুপকে মদদ দিত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার এখন যাদের সাথে শান্তিচুক্তি করল তাদের ঠেকাতেই খাপলাং গ্রুপকে মদদ দিত সরকার।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, পাকিস্তানের সাথে কারগিল যুদ্ধে এবং ১৯৯৭ সালে কাশ্মিরে অভিযান চালানোর সময় ছাড়া এত বড় বিপর্যয় আর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করতে হয়নি। একসাথে এত ভারতীয় সেনাসদস্যকে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে খাপলাং গং ভারত সরকারকে কী বার্তা দিতে চায়, তা-ও বলার অপেক্ষা রাখে না। সীমান্ত পেরিয়ে যেসব নাগা মিয়ানমারে বসবাসরত, তাদের সাথেও খাপলাং গ্রুপের সম্পর্ক মধুর। এ দিকে মনিপুরের সাথেও নাগাল্যান্ডের সম্পর্ক সুখকর নয়। নাগারা মনিপুর ও অরুণাচলকে নিয়ে যে বর্ধিত নাগাল্যান্ড প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী, মনিপুর সরকার স্বভাবতই তার ঘোর বিরোধী। স্বায়ত্তশাসিত নাগা কাউন্সিলে যোগ দেয়াকে মনিপুর পরাজয় বলেই মনে করে। পক্ষান্তরে নাগাল্যান্ডবাসী চায় পূর্ণ সার্বভৌমত্ব অথবা মনিপুরের ওপর কর্তৃত্ব করতে।
মোদির উপস্থিতিতে যে ঐতিহাসিক চুক্তি হলো তার পক্ষে-বিপক্ষে কোনো প্রতিক্রিয়া নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমায় লক্ষ করা যায়নি। চুক্তির প্রেক্ষাপটে খাপলাং কী কর্মসূচি দেবে কিংবা মেনে নেবে কি না, তা-ও নিশ্চিত করে জানা যাচ্ছে না। অভিজ্ঞ মহলের মতে, চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু এখনো ব্যাপক আলোচনার দাবি রাখে। নাগাল্যান্ডের ২০টি নাগা উপজাতি গ্রুপ ও মনিপুরের নাগাদের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনার পরই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে মন্তব্য করা যাবে। নাগাল্যান্ডে ব্যাপটিস্ট চার্চ খুবই প্রভাবশালী। যেকোনো সমঝোতার ক্ষেত্রে চার্চের অনুমোদন অপরিহার্য।
ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরই মোদি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতি ব্যাপক মনোযোগী হয়েছেন। এ অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়নে তিনি আগ্রহী। নাগাল্যান্ড হয়ে তিনি মিয়ানমারে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার করতে চান। মোদির এ অঞ্চলের ক্ষেত্রে স্লোগান হলো- ‘লুক ইস্ট, অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি। লক্ষ্য হলো- উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের প্রভাব বৃদ্ধি করা। মোদির মাথায় রয়েছে এ অঞ্চলে বিজেপির প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়টিও। এখন বিজেপির পাত্তাই নেই ওইসব এলাকায়। এর ফলে ভাগ্য ভালো হলে বিজেপিরাজ কায়েমের যে স্বপ্ন মোদি লালন করেন, তা এখানে বাস্তবায়নও হয়ে যেতে পারে।
মজার ব্যাপার হলো, প্রধানমন্ত্রী মোদির উপস্থিতিতে তার বাসভবনে নাগাল্যান্ড নিয়ে যে চুক্তি হলো, সে বৈঠকে নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী টি আর জেলিত্র্যাং ও ওই রাজ্যের একমাত্র লোকসভা সদস্য নেইফিউ রিও উপস্থিত ছিলেন না এবং চুক্তির বিশদ কিছু তারা জানেনও না। মোদির ভাগ্য ভালো, ওই দু’জনও চুক্তির প্রশংসা করেছেন। নাগাদের যে অংশের সাথে চুক্তি হলো, সেই গ্রুপের প্রধান নেতা ইশাম চিশি কিডনির চিকিৎসায় দীর্ঘ দিন দিল্লিতে অবস্থান করছেন। হুইলচেয়ারে বসেই তিনি চুক্তিতে সই করেন। নাগাল্যান্ডের বেশির ভাগ নাগরিকই চটজলদি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আর এই চুক্তির সাফল্য নির্ভর করে নাগাল্যান্ডের নাগাদের ওপর যেমন, তেমনি মনিপুরের নাগাদের ওপরও। যদিও নাগাল্যান্ডের অধিবাসীরা এটি বিশ্বাস করতে চান যে, এনএসসিএন (আইএস) চুক্তির মাধ্যমে তাদের প্রতারিত করবে না। উল্লেখ্য, নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রীর অনুরূপ নাগাল্যান্ড বিধানসভা ও সুশীলসমাজও পূর্ণাঙ্গ চুক্তিটি যাচাই করতে চান।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, নাগাল্যান্ডের সাথে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মোদি চীনকে শক্ত একটি বার্তা দিতে চান। কিন্তু এই বার্তার মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে নতুন করে কলহ সৃষ্টি হতে পারে তার আশঙ্কাও করছেন অনেকে। ভারতীয় গণমাধ্যমের আশঙ্কা- মনিপুর, অরুণাচল ও আসামের নাগা অধ্যুষিত অঞ্চলের সাথে নাগাল্যান্ডের একীভূতকরণের কোনো উদ্যোগ যদি মোদি গ্রহণের স্বপ্ন দেখে থাকেন, তা হবে বিপদের কারণ। কেননা এতে ওই অঞ্চলে উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা বাড়বে। যদিও চুক্তি স্বাক্ষরকারী এনএসসিএনের (আইএস) ব্যাপক প্রভাব রয়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। ফলে শান্তিচুক্তির কারণে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।
অরুণাচল, এ দেশের অংশবিশেষও নাগাল্যান্ডের সাথে যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান। সেই প্রদেশের অধিবাসী হলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজ্জিড এমপি। তিনি চুক্তির বিষয়বস্তু সম্পর্কে আশ্বস্ত করে বলেছেন, এর মাধ্যমে প্রতিবেশী কোনো রাজ্যের স্বার্থ ক্ষুণœ হবে না। কেন্দ্র কখনোই প্রতিবেশী রাজ্য আসাম, মনিপুর ও অরুণাচলের অধিবাসীর স্বার্থ ও সেন্টিমেন্টকে আঘাত করবে না। তবে যতভাবেই প্রতিশ্রুতি দেয়া হোক না কেন, এনএসসিএন (আইএস) যতই এই চুক্তিকে অনুমোদন দিক না কেন নাগা এলাকা পুনর্নির্ধারণ হতে হবে আলোচনার টেবিলেই। মিয়ানমারেও বহু নাগার বাস। তাদের বিষয়েও আলোচনা হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি অবশ্য বলেছেন, দীর্ঘ দিন ধরে নাগা সঙ্কট জিইয়ে রাখার মূলে রয়েছে ভুল বোঝাবুঝি। তবে নাগাদের অতীত ইতিহাসও পারস্পরিক সমঝোতায়। ফলে আলোচনার মাধ্যমে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি হ্রাস করা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য, ২০০৯-২০১৩ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে নাগাল্যান্ডে ১১ জন বিদ্রোহী নিহত হয়েছে। আর বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রতি বছর ওই সময়ে অন্তর্কোন্দলে নিহত হয়েছে সর্বাধিক ৫৫ জন।
নাগাল্যান্ডে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু। প্রায় ২০ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ৯০ ভাগই খ্রিষ্টান। ভারতের অপর দু’টি রাজ্য মেঘালয় ও মিজোরামেও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু। নাগাল্যান্ডের গ্রাম ও শহরের উভয় স্থানেই চার্চে প্রার্থনাকারীদের সংখ্যা ব্যাপক ও নিয়মিত। রাজধানী কোহিমা, ডিমাপুর ও মোকোক চাংয়ের আকাশ চার্চের গম্বুজে পরিপূর্ণ। খ্রিষ্টানদের মধ্যে নাগাল্যান্ডে আবার ব্যাপটিস্টদের সংখ্যা বেশি, শতকরা ৭৫ ভাগ। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপিতে ব্যাপটিস্টদের হার বেশি হলেও নাগাল্যান্ডের চেয়ে তা কম, শতকরা ৫৫ ভাগ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নাগাল্যান্ডে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রবর্তন হয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীরা সর্বপ্রাণবাদের ধারক ছিল। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা দেখলেন, এখানে ধর্মান্তরের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। তবে ওই অঞ্চলের মধ্যে নাগাল্যান্ডের অধিবাসীরাই খ্রিষ্ট ধর্মকে অতিমাত্রায় পছন্দ করে ফেলে। উল্লেখ্য, নাগাল্যান্ডে হিন্দু ও মুসলমানেরা সংখ্যালঘু। শতকরা হার যথাক্রমে ৭.৭ ও ১.৮।
নাগাল্যান্ডেও রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি গভর্নর সাংবিধানিক প্রধান। মূল ক্ষমতা বিধানসভার ও এর সদস্য সংখ্যা ৬০। মুখ্যমন্ত্রী সরকারের প্রধান। সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। নাগাল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট ৩৭টি আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসীন।
নাগাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। কারো মতে, নাগারা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত। তবে এরা মঙ্গোলিয়া, চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে নাগাল্যান্ডে এসেছে এর কোনো প্রামাণিক দলিল নেই। তবে নাগায় ১২২৮ সালের আগেও পর্বত ও কাছের এলাকায় গ্রামভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা হয়। অনেকের মতে, বার্মিজ শব্দ ‘নাকা’র অপভ্রংশ হলো নাগা। এই মত অধিকাংশের সমর্থন পাচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ইংরেজদের আগমনের আগে বার্মিজদের হাতে নাগারা প্রভূত নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ব্রিটিশ এসে নাগা পর্বতমালাসহ দক্ষিণ এশিয়া তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। ১৮৩২ সালে ক্যাপ্টেন জেনকিনস ও পেমবার্টন সর্বপ্রথম নাগাল্যান্ডে আসেন। ১৮৩৯ সাল থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে ইংরেজরা নাগাল্যান্ডে ১০ বার সামরিক অভিযান চালায়। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের যুদ্ধে বহু ইংরেজ সৈন্য ও নাগা নিহত হয়। ফলে পরস্পরের মধ্যে বহু চুক্তি ও সন্ধি হয়। উল্লেখ্য, ১৯৪০ সালে ইংরেজরা ব্রিটিশ ভারতের যে মানচিত্র প্রকাশ করে, তাতে নাগাল্যান্ড ও কোহিমাকে আসামের অংশ দেখায়।
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমায় আস্তানা গড়তে চেয়েছিল। মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে ঢোকার মাধ্যমে কোহিমায় আস্তানা গড়ে জাপান ভারতকে পদানত করতে চাইলেও ব্রিটিশ ও পাঞ্জাবিরা তা প্রতিহত করে এবং যুদ্ধে উভয়পক্ষের বহু সৈন্য হতাহত হয়।
নাগাল্যান্ডের সাথে মনিপুর ও আসামের বিরোধও পুরনো। সায়মন কমিশনকে নাগারা যে স্মারকলিপি দেয় তাতে উল্লেখ করা হয়, ওরা কখনো আমাদের পরাজিত করেনি এবং আমাদের শাসনও করেনি। স্মারকলিপিতে এরা আরো বলে, আমাদের আটটি অঞ্চল একটি আরেকটি থেকে পৃথক এবং প্রত্যেকেরই ভাষা পৃথক। ব্রিটিশরাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। ফলে আসাম ও মনিপুরের কোনো ভূমিকা নেই।
১৯৪৬ সালে ভারতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট জওয়াহেরলাল নেহরু স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গীকার করলেও নাগায় স্বাধীন থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করে। ভারত স্বাধীন হলে নাগারা আসামের অন্তর্ভুক্ত হয়। এলাকায় সহিংসতা ও বিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকে। বিদ্রোহ দমনে ১৯৫৫ সালে ভারত সরকার নাগাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। পরে নাগাদের সাথে সরকারের অনেক চুক্তি হয়। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর নাগাল্যান্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজ্য ঘোষিত হয়। এরপর নির্বাচন হলেও নানা কারণে রাজ্যে অশান্তি বিরাজ করতে থাকে এবং ১৯৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নাগাল্যান্ডে সরাসরি রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করেন। ২০১২ সালে নাগাল্যান্ডের বিশিষ্ট রাজনীতিকেরা রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
kaikobadmilan1955@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.