আমরা ওপরে উঠছি, না নিচে নামছি? by সোহরাব হাসান
হাজারো
বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতায় আকীর্ণ বাংলাদেশ। একই বাংলাদেশে দুই বিপরীতধর্মী
পাচার আমাদের ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এবং এই কাণ্ডটি
তখনই ঘটছে, যখন ‘শোষণমুক্ত বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠায় অবিচল আওয়ামী লীগ
ক্ষমতায়। বিএনপি বা জাতীয় পার্টির আমলে এমনটি হলে আমরা তাদের শোষকশ্রেণির
প্রতিভূ ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী বলে আচ্ছা করে গাল দিতাম। এখন কী বলব? মাস খানেক আগে সমুদ্রপথে হাজার হাজার বাংলাদেশি নাগরিকের পাচার হওয়ার ঘটনা
নিয়ে কেবল দেশের ভেতরে নয়, বহির্বিশ্বেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও
সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে অধিকাংশ পাচার হওয়া মানুষ রোহিঙ্গা বলে দায়
এড়ানোর চেষ্টা চলছিল। পরবর্তী সময়ে সরকার কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও পাচার হয়ে
যাওয়া সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। অনেকে ফিরে এসেছেন, অনেকে ফিরে
আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। অনেকে হারিয়ে গেছেন চিরতরে।
মালয়েশিয়া থেকে সদ্য ফিরে আসা সিরাজগঞ্জের আল আমিন সরকার নামের একজন যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, তা মর্মস্পর্শী। তিনি বলেছেন, ট্রলারে ওঠার পর থেকে থাইল্যান্ডে পৌঁছানো পর্যন্ত দুই মাসে অসুস্থ হওয়ার কারণে সাগরে ফেলে দেওয়া হয় ৭০ জনকে। শুধু পানি খেতে চাওয়ার অপরাধে একজনকে চোখের নিমেষে গলা কেটে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতনের লোভ দেখিয়ে তাঁকে স্থানীয় দুই দালাল নিয়ে গিয়েছিল। টেকনাফ থেকে ৪৭০ জনকে নিয়ে ট্রলার যাত্রা শুরু করলেও কতজন ফিরেছেন, জানা যায়নি।
এই যে দালালদের খপ্পরে পড়ে হাজার হাজার তরুণ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন; তাঁরা কি জানেন না সেখানে জীবন কতটা অনিশ্চিত ও যন্ত্রণাকাতর? জানেন। কিন্তু তাঁরা নিরুপায়। বিদেশে গিয়ে তাঁরা অমানুষিক পরিশ্রমের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করেন। তারপরও তাঁরা দুর্গম মরু কিংবা তরঙ্গসংকুল সমুদ্রপথে পাড়ি জমান। দেশে কর্মসংস্থান নেই। সামাজিক ব্যবসায় নাম লেখাবেন, সেই পুঁজি বা শিক্ষাও নেই।
ইদানীং বাংলাদেশে আরেক ধরনের পাচার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। অর্থ বা সম্পদ পাচার। ইংরেজিতে বলে ক্যাপিটাল ফ্লাইট। মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাচার হয় কাজ না পেয়ে, জীবন ধারণের সংস্থান করতে না পেরে। আর অর্থ পাচার হয় আরও উন্নত, আরও নিশ্চিত, আরও সুখী জীবনের আশায়। সেটি তাঁরাই পারেন, যাঁরা বৈধ-অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। কিন্তু সেই সম্পদ কেন তাঁরা দেশে না রেখে বিদেশে রাখছেন? দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে বিনিয়োগ করছেন? একজন ব্যাংকার কাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষককে প্রশ্নটি করেছিলাম। জবাবে তিনি বললেন, পুঁজির পাচার বিশ্বব্যাপী প্রবণতা হলেও সেই সব দেশে গিয়ে তা পুঞ্জীভূত হয়, যেসব দেশে রাজনৈতিক স্থিতি আছে, সামাজিক সহনশীলতা আছে, যেসব দেশে আইনের শাসন সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। আইন যেখানে আওয়ামী লগি–বিএনপি বিচার করে না। এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়ের ওপর চড়াও হয় না। সেই সব দেশে রাজনৈতিক কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের বারোটা বাজানো হয় না। আর সেই সব দেশ থেকেই পুঁজি পাচার হয়, যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা লেগে থাকে, যেখানে বিনিয়োগ করতে নানা রকম আইনি বাধার পাশাপাশি ঘুষ–দুর্নীতি–মাস্তানি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেই সব দেশ থেকে অধিক পুঁজি পাচার হয়, যেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙ্গুর। এর সব কটি উপসর্গই বাংলাদেশে বিদ্যমান। তদুপরি আছে অবকাঠামোগত সমস্যা, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জমির সমস্যা। আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।
পৃথিবীর দুই শ্রেণির মানুষের প্রকৃত অর্থে কোনো দেশ নেই। প্রথম শ্রেণি হলো অতি ধনবান; তাঁদের জন্য সব দেশের দরজা খোলা। নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করলে একজন ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারী চাইলে পৃথিবীর যেকোনো দেশের পারমানেন্ট রেসিডেন্ট বা নাগরিক হতে পারবেন। হচ্ছেনও অনেকে।
রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। দুই দলের শীর্ষ নেত্রীর মধ্যে কথাবার্তাও হয় না (২০১৩ সালের অক্টোবরে তাঁদের মধ্যকার শেষ টেলিফোন সংলাপটির কথা স্মরণ করুন)। কিন্তু বিদেশে বিনিয়োগ কিংবা অর্থ পাচারে দুই দলের মধ্যে অদ্ভুত মিল রয়েছে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা কানাডায় বাড়ি (ম্যানশন) কিনেছেন। আরেক নেতা, যিনি বর্তমানে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী, লন্ডন ও মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ করেছেন। আওয়ামী লীগের আরও অনেকে তো বিদেশে বিনিয়োগ করছেন।... বিএনপি সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রী সিঙ্গাপুরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। তাঁর ছেলে শ্রীলঙ্কায় বেসরকারি বন্দর নির্মাণেও বিনিয়োগ করেছেন। বিএনপি আমলের আরেক মন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন। (ডেইলি স্টার, ২২ জুন ২০১৫)। আর এই যে বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে, তার সব হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকে নেই। কেননা, বেশির ভাগ অর্থই যাচ্ছে অবৈধ উপায়ে, হুন্ডির মাধ্যমে।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিদেশিদের প্রতি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাবেন, আর সরকারের ও দলের কেউ কেউ বিদেশে বিনিয়োগ করবেন, বাড়ি কিনবেন—এটি আত্মপ্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। বিদেশে অর্থ পাচার ও বিনিয়োগকারীর তালিকায় আরও আছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। আছেন সাবেক আমলারা।
আমাদের অর্থনৈতিক নীতির লক্ষ্যই হলো কতিপয়ের হাতে পুঁজি ও সম্পদ পুঞ্জীভূত করা। লাখ লাখ মানুষকে ন্যূনতম মৌলিক অধিকার তথা খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে ধনীকে আরও ধনী করার সুযোগ দেওয়া। ধনবানদের দল বিএনপি-জাতীয় পার্টি তো এই নীতি নেবেই। কিন্তু ‘গরিবের দল’ আওয়ামী লীগও ব্যতিক্রম কিছু করেনি। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া যেসব কল্যাণমুখী কর্মসূচি নিয়েছিলেন, গরিব মানুষের জন্য নিরাপত্তার জাল তৈরি করেছিলেন, তা এখন দলীয় নেতা-কর্মীদের আখের গোছানো কিংবা বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশটির ওপর গরিষ্ঠসংখ্যক দরিদ্র মানুষের কোনো হক নেই।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডে ৪ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে; ২০১৩ সালে যার পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা, ২০১২ সালে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা।
গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি জানাচ্ছে, ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল—এই ১০ বছর বাংলাদেশ থেকে মোট পাচার হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পাচার হয়েছে ২০০৬ সালে ২০ হাজার ৮০২ কোটি টাকা, এরপর ২০০৭ সালে ১৯ হাজার কোটি টাকা, ২০১০ সালে পাচারের পরিমাণ কমে ৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা হলেও ২০১২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। গত বছর সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে অন্যান্য দেশেও। এই ধারা চলতে থাকলে অর্থ পাচারেও আওয়ামী লীগ বিএপির আমলকে ছাড়িয়ে যাবে।
গ্লোবাল ফিন্যান্স ইন্টেগ্রিটি যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, যখন দেশে মোটামুটি রাজনৈতিক স্থিতি থাকে, তখন বিদেশে অর্থ পাচার কমে যায়। আবার যখন অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তখন পাচার হয়ে যাওয়া অর্থের পরিমাণ বাড়ে। একই সঙ্গে কমে যায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনবিষয়ক আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৫ শতাংশ। আগের বছর ছিল ১৬০ কোটি, চলতি বছর ১৫৩ কোটি ডলার। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী বলেছেন, আঙ্কটাডের এ তথ্য ঠিক নয়। তাঁর দাবি, বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ২০০ কোটি ডলার। তাঁর কথা যদি সত্যও ধরে নিই, ১৬ কোটি মানুষের কিংবা বছরে ৩ লাখ কোটি টাকা বাজেটের দেশে ২০০ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কি আত্মপ্রসাদ লাভের সুযোগ আছে? প্রতিবেশী মিয়ানমারে যদি ৮০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ হয়ে থাকে, নেপালে ও পাকিস্তানেও যদি বিনিয়োগ বেড়ে থাকে, বাংলাদেশে কমার কারণ কী? নিশ্চয়ই আমাদের নীতি, পরিকল্পনা ও উদ্যোগে ঘটাতি আছে। বর্তমান বিনিয়োগ বোর্ড দায়িত্ব নেওয়ার পর লন্ডন, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যে লাখ লাখ টাকা খরচ করে রোড শো করল, তাতে কী লাভ হলো? বিনিয়োগ বোর্ডের এই অবিমৃশ্যকারী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা কেবল বিরোধী দলই করছে না, ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফও একহাত নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। পেশাদার, দক্ষ, পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের নিয়ে বিনিয়োগ বোর্ড ঢেলে সাজাতে হবে।
তাইরে-নাইরে করে যাঁরা সাড়ে ছয় বছর পার করেছেন, তাঁরা কবে ঢেলে সাজাবেন? আর এই অব্যবস্থা ও অদক্ষতা কেবল বিনিয়োগ বোর্ডে নয়, ব্যাংক-বিমাসহ প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে। দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও কারখানা মুখ থুবড়ে পড়েছে। কেবল প্রবাসী শ্রমিকদের উচ্চ রেমিট্যান্স কিংবা তৈরি পোশাক রপ্তানির নগদ টাকা কোনো দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত দিতে পারে না। আমাদের নেতা-নেত্রীরা যতই উন্নয়নের গল্প শোনান না কেন, সত্যিকার উন্নয়ন থেকে আমরা অনেক দূরে আছি।
বিনিয়োগে স্থবিরতা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের লুটপাট কিংবা দেশের অর্থ ও সম্পদ বিদেশে পাচার হওয়ার ঘটনায় আমাদের মনে এই প্রশ্নটি বড় করে দেখা দেয় যে দেশের অর্থনীতি কি সত্যি সত্যি এগোচ্ছে? আমরা কি ওপরে উঠছি, না নিচে নামছি? বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে যে সক্ষমতা ও সুশাসন প্রয়োজন, তা কি আমরা অর্জন করতে পেরেছি?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
মালয়েশিয়া থেকে সদ্য ফিরে আসা সিরাজগঞ্জের আল আমিন সরকার নামের একজন যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, তা মর্মস্পর্শী। তিনি বলেছেন, ট্রলারে ওঠার পর থেকে থাইল্যান্ডে পৌঁছানো পর্যন্ত দুই মাসে অসুস্থ হওয়ার কারণে সাগরে ফেলে দেওয়া হয় ৭০ জনকে। শুধু পানি খেতে চাওয়ার অপরাধে একজনকে চোখের নিমেষে গলা কেটে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতনের লোভ দেখিয়ে তাঁকে স্থানীয় দুই দালাল নিয়ে গিয়েছিল। টেকনাফ থেকে ৪৭০ জনকে নিয়ে ট্রলার যাত্রা শুরু করলেও কতজন ফিরেছেন, জানা যায়নি।
এই যে দালালদের খপ্পরে পড়ে হাজার হাজার তরুণ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন; তাঁরা কি জানেন না সেখানে জীবন কতটা অনিশ্চিত ও যন্ত্রণাকাতর? জানেন। কিন্তু তাঁরা নিরুপায়। বিদেশে গিয়ে তাঁরা অমানুষিক পরিশ্রমের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করেন। তারপরও তাঁরা দুর্গম মরু কিংবা তরঙ্গসংকুল সমুদ্রপথে পাড়ি জমান। দেশে কর্মসংস্থান নেই। সামাজিক ব্যবসায় নাম লেখাবেন, সেই পুঁজি বা শিক্ষাও নেই।
ইদানীং বাংলাদেশে আরেক ধরনের পাচার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। অর্থ বা সম্পদ পাচার। ইংরেজিতে বলে ক্যাপিটাল ফ্লাইট। মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাচার হয় কাজ না পেয়ে, জীবন ধারণের সংস্থান করতে না পেরে। আর অর্থ পাচার হয় আরও উন্নত, আরও নিশ্চিত, আরও সুখী জীবনের আশায়। সেটি তাঁরাই পারেন, যাঁরা বৈধ-অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। কিন্তু সেই সম্পদ কেন তাঁরা দেশে না রেখে বিদেশে রাখছেন? দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে বিনিয়োগ করছেন? একজন ব্যাংকার কাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষককে প্রশ্নটি করেছিলাম। জবাবে তিনি বললেন, পুঁজির পাচার বিশ্বব্যাপী প্রবণতা হলেও সেই সব দেশে গিয়ে তা পুঞ্জীভূত হয়, যেসব দেশে রাজনৈতিক স্থিতি আছে, সামাজিক সহনশীলতা আছে, যেসব দেশে আইনের শাসন সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। আইন যেখানে আওয়ামী লগি–বিএনপি বিচার করে না। এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়ের ওপর চড়াও হয় না। সেই সব দেশে রাজনৈতিক কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের বারোটা বাজানো হয় না। আর সেই সব দেশ থেকেই পুঁজি পাচার হয়, যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা লেগে থাকে, যেখানে বিনিয়োগ করতে নানা রকম আইনি বাধার পাশাপাশি ঘুষ–দুর্নীতি–মাস্তানি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেই সব দেশ থেকে অধিক পুঁজি পাচার হয়, যেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙ্গুর। এর সব কটি উপসর্গই বাংলাদেশে বিদ্যমান। তদুপরি আছে অবকাঠামোগত সমস্যা, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জমির সমস্যা। আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।
পৃথিবীর দুই শ্রেণির মানুষের প্রকৃত অর্থে কোনো দেশ নেই। প্রথম শ্রেণি হলো অতি ধনবান; তাঁদের জন্য সব দেশের দরজা খোলা। নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করলে একজন ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারী চাইলে পৃথিবীর যেকোনো দেশের পারমানেন্ট রেসিডেন্ট বা নাগরিক হতে পারবেন। হচ্ছেনও অনেকে।
রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। দুই দলের শীর্ষ নেত্রীর মধ্যে কথাবার্তাও হয় না (২০১৩ সালের অক্টোবরে তাঁদের মধ্যকার শেষ টেলিফোন সংলাপটির কথা স্মরণ করুন)। কিন্তু বিদেশে বিনিয়োগ কিংবা অর্থ পাচারে দুই দলের মধ্যে অদ্ভুত মিল রয়েছে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা কানাডায় বাড়ি (ম্যানশন) কিনেছেন। আরেক নেতা, যিনি বর্তমানে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী, লন্ডন ও মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ করেছেন। আওয়ামী লীগের আরও অনেকে তো বিদেশে বিনিয়োগ করছেন।... বিএনপি সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রী সিঙ্গাপুরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। তাঁর ছেলে শ্রীলঙ্কায় বেসরকারি বন্দর নির্মাণেও বিনিয়োগ করেছেন। বিএনপি আমলের আরেক মন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন। (ডেইলি স্টার, ২২ জুন ২০১৫)। আর এই যে বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে, তার সব হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকে নেই। কেননা, বেশির ভাগ অর্থই যাচ্ছে অবৈধ উপায়ে, হুন্ডির মাধ্যমে।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিদেশিদের প্রতি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাবেন, আর সরকারের ও দলের কেউ কেউ বিদেশে বিনিয়োগ করবেন, বাড়ি কিনবেন—এটি আত্মপ্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। বিদেশে অর্থ পাচার ও বিনিয়োগকারীর তালিকায় আরও আছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। আছেন সাবেক আমলারা।
আমাদের অর্থনৈতিক নীতির লক্ষ্যই হলো কতিপয়ের হাতে পুঁজি ও সম্পদ পুঞ্জীভূত করা। লাখ লাখ মানুষকে ন্যূনতম মৌলিক অধিকার তথা খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে ধনীকে আরও ধনী করার সুযোগ দেওয়া। ধনবানদের দল বিএনপি-জাতীয় পার্টি তো এই নীতি নেবেই। কিন্তু ‘গরিবের দল’ আওয়ামী লীগও ব্যতিক্রম কিছু করেনি। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া যেসব কল্যাণমুখী কর্মসূচি নিয়েছিলেন, গরিব মানুষের জন্য নিরাপত্তার জাল তৈরি করেছিলেন, তা এখন দলীয় নেতা-কর্মীদের আখের গোছানো কিংবা বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশটির ওপর গরিষ্ঠসংখ্যক দরিদ্র মানুষের কোনো হক নেই।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডে ৪ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে; ২০১৩ সালে যার পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা, ২০১২ সালে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা।
গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি জানাচ্ছে, ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল—এই ১০ বছর বাংলাদেশ থেকে মোট পাচার হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পাচার হয়েছে ২০০৬ সালে ২০ হাজার ৮০২ কোটি টাকা, এরপর ২০০৭ সালে ১৯ হাজার কোটি টাকা, ২০১০ সালে পাচারের পরিমাণ কমে ৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা হলেও ২০১২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। গত বছর সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে অন্যান্য দেশেও। এই ধারা চলতে থাকলে অর্থ পাচারেও আওয়ামী লীগ বিএপির আমলকে ছাড়িয়ে যাবে।
গ্লোবাল ফিন্যান্স ইন্টেগ্রিটি যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, যখন দেশে মোটামুটি রাজনৈতিক স্থিতি থাকে, তখন বিদেশে অর্থ পাচার কমে যায়। আবার যখন অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তখন পাচার হয়ে যাওয়া অর্থের পরিমাণ বাড়ে। একই সঙ্গে কমে যায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনবিষয়ক আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৫ শতাংশ। আগের বছর ছিল ১৬০ কোটি, চলতি বছর ১৫৩ কোটি ডলার। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী বলেছেন, আঙ্কটাডের এ তথ্য ঠিক নয়। তাঁর দাবি, বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ২০০ কোটি ডলার। তাঁর কথা যদি সত্যও ধরে নিই, ১৬ কোটি মানুষের কিংবা বছরে ৩ লাখ কোটি টাকা বাজেটের দেশে ২০০ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কি আত্মপ্রসাদ লাভের সুযোগ আছে? প্রতিবেশী মিয়ানমারে যদি ৮০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ হয়ে থাকে, নেপালে ও পাকিস্তানেও যদি বিনিয়োগ বেড়ে থাকে, বাংলাদেশে কমার কারণ কী? নিশ্চয়ই আমাদের নীতি, পরিকল্পনা ও উদ্যোগে ঘটাতি আছে। বর্তমান বিনিয়োগ বোর্ড দায়িত্ব নেওয়ার পর লন্ডন, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যে লাখ লাখ টাকা খরচ করে রোড শো করল, তাতে কী লাভ হলো? বিনিয়োগ বোর্ডের এই অবিমৃশ্যকারী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা কেবল বিরোধী দলই করছে না, ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফও একহাত নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। পেশাদার, দক্ষ, পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের নিয়ে বিনিয়োগ বোর্ড ঢেলে সাজাতে হবে।
তাইরে-নাইরে করে যাঁরা সাড়ে ছয় বছর পার করেছেন, তাঁরা কবে ঢেলে সাজাবেন? আর এই অব্যবস্থা ও অদক্ষতা কেবল বিনিয়োগ বোর্ডে নয়, ব্যাংক-বিমাসহ প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে। দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও কারখানা মুখ থুবড়ে পড়েছে। কেবল প্রবাসী শ্রমিকদের উচ্চ রেমিট্যান্স কিংবা তৈরি পোশাক রপ্তানির নগদ টাকা কোনো দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত দিতে পারে না। আমাদের নেতা-নেত্রীরা যতই উন্নয়নের গল্প শোনান না কেন, সত্যিকার উন্নয়ন থেকে আমরা অনেক দূরে আছি।
বিনিয়োগে স্থবিরতা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের লুটপাট কিংবা দেশের অর্থ ও সম্পদ বিদেশে পাচার হওয়ার ঘটনায় আমাদের মনে এই প্রশ্নটি বড় করে দেখা দেয় যে দেশের অর্থনীতি কি সত্যি সত্যি এগোচ্ছে? আমরা কি ওপরে উঠছি, না নিচে নামছি? বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে যে সক্ষমতা ও সুশাসন প্রয়োজন, তা কি আমরা অর্জন করতে পেরেছি?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments