দক্ষিণ এশিয়ায় টাকা ও পেশিশক্তির বিস্তার ঘটেছে -বিশেষ সাক্ষাৎকারে : সীতারাম ইয়েচুরি by সোহরাব হাসান ও প্রতীক বর্ধন
সীতারাম
ইয়েচুরি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্ক্সিস্ট) সাধারণ সম্পাদক। তাঁর
জন্ম ১৯৫২ সালে। ইয়েচুরি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে
স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে
ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থায় তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। সম্প্রতি ইয়েচুরি
মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক সেমিনারে ঢাকায় এলে তাঁর এই
সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও প্রতীক বর্ধন
প্রথম আলো : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফর থেকে আমরা কী প্রত্যাশা করতে পারি?
সীতারাম ইয়েচুরি : ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করবেন, এটা ভালো কথা। আমরা আশা করি, এই সফরের কারণে দেশ দুটির মধ্যকার আন্তসম্পর্ক ও সহযোগিতা আরও বাড়বে। আমরা সিপিএমের পক্ষ থেকে সফরটিকে খুবই মূল্যবান মনে করি। যাক, শেষমেশ স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়ে গেছে, এতে আমরা খুশি। এর আগে মনমোহন সিংয়ের সরকার এই বিল পেশ করেছিল, তখন বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস এর বিরোধিতা করেছিল। এখন আবার বিজেপিই এই বিল পেশ করেছে। এবার সবাই এ বিষয়ে একমত ছিল।
প্রথম আলো : সীমান্ত চুক্তি তো হলো, কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টনের কী হবে?
সীতারাম ইয়েচুরি : তিস্তার পানি বণ্টনের আলোচনায় আমরা সিপিএমের পক্ষ থেকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। মনমোহন সিং যখন ঢাকা সফরে এসেছিলেন, তখনই এটা হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কথা ছিল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে ঢাকায় আসবেন। কিন্তু তিনি শেষ মুহূর্তে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সেবার তিস্তা চুক্তি হয়নি। এই চুক্তির ভাগ্যে কী আছে, তা আমরা জানি না। কোনো বিষয়ে মতানৈক্য থাকলে বসে আলোচনা করে তার সমাধান বের করতে হবে। সমাধানের পথে এগোতে হবে, এটাই আমাদের কথা।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতীয় প্রদেশ, যেমন: পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় অন্য দল ক্ষমতায় আছে, বিজেপি নয়। বিজেপির তো নিজস্ব রাজনীতি আছে। সে ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নে কোনো সমস্যা দেখা দিতে পারে কি?
সীতারাম ইয়েচুরি : দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন কীভাবে হবে, তা নির্ভর করবে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার ওপর। তবে আমরা সে পথে আছি বলেই মনে হয়। কিন্তু কিছু সমস্যাও আছে, বিশেষ করে ভারতে। বিজেপি অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রচারণা শুরু করেছিল। স্থল সীমান্ত চুক্তির মতো দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ রক্ষা হয় এমন কিছু করতে আমরা তাদের চাপ দেব। তবে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থানের সঙ্গে আমরা একমত নই।
প্রথম আলো : ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মারা পড়ছে। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব?
সীতারাম ইয়েচুরি : এটা খুবই বড় সমস্যা, মানবিক সমস্যা। কারণ যা-ই হোক না কেন, প্রচুর মানুষ এমন অবৈধভাবে আসা-যাওয়া করে। দুই দেশের স্বার্থেই এটা হ্রাস করতে হবে।
প্রথম আলো : নির্বাচনের আগে ও পরে বিজেপির অবস্থানে বড় ধরনের পার্থক্য লক্ষ করেন কি?
সীতারাম ইয়েচুরি : হ্যাঁ, নির্বাচনের আগে তারা স্থল সীমান্ত চুক্তির বিরোধী ছিল, এখন তারা এর পক্ষে।
প্রথম আলো : ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও কি তেমন পরিবর্তন দেখছেন?
সীতারাম ইয়েচুরি : অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তারা এমন করছে। যেমন তারা অনেক বিষয়েই শক্তিশালী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেগুলো কীভাবে সরকারি নীতি হিসেবে গৃহীত হবে, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমরা সংসদে এগুলোর বিরোধিতা করছি, ফলে তাদের পক্ষে এটা করা সহজ হবে না। আমাদের দৃষ্টিতে যেটা ভারতীয় জনগণের স্বার্থবিরোধী মনে হবে, আমরা সেটার বিরোধিতা করব। ফলে বিজেপিকেও বিরোধীদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে হবে।
প্রথম আলো : ভারতীয় রাজনীতিতে এখন বামফ্রন্টের অবস্থা কী?
সীতারাম ইয়েচুরি : আমরা সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছি পশ্চিমবঙ্গে। কেরালায়ও আমরা কিছুটা ধাক্কা খেয়েছি, তবে সেখানে আমরা তা কাটিয়ে উঠতে পারব। পশ্চিমবঙ্গে পতনের কারণ ত্রিমুখী। প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের কিছু ভুল ছিল, কিছু প্রশাসনিক ভুল ছিল আর কিছু সাংগঠনিক দুর্বলতাও ছিল। আমরা সেগুলো চিহ্নিত করেছি, সংশোধনের চেষ্টাও আমরা করছি। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের স্লোগান হচ্ছে, প্রথমত আমাদের জনপ্রিয়তা কমার কারণগুলো বন্ধ করতে হবে। জনপ্রিয়তা কমা শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। সে বছরের লোকসভা ও ২০১০ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে এটা শুরু হয়। কারণ চিহ্নিত করে আমাদের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে হবে, এরপর তা পুনর্নির্মাণ করতে হবে। সর্বশেষ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ২০০৯ সালের পর এই প্রথম আমাদের ভোট কমেনি। এমনকি লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় আমাদের ভোট কিছু বেড়েছেও। তবে সময় লাগবে। কারণ পশ্চিমবঙ্গে আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ হয়েছে। এই পাঁচ বছরে আমাদের প্রায় ৫০০ কর্মী মারা গেছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী বাড়িতেই থাকতে পারছে না। হাজার হাজার কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো : সংসদে এখন বামদের প্রতিনিধিত্ব খুবই দুর্বল?
সীতারাম ইয়েচুরি : লোকসভায় সিপিএমের ১১ জন ও রাজ্যসভায় নয়জন সাংসদ আছে। আর দুই কক্ষেই একজন করে সিপিআইয়ের আছে দুজন সদস্য। এই হচ্ছে সংসদে বামদের প্রতিনিধিত্ব। স্বাধীনতার পর এটাই সর্বনিম্ন।
প্রথম আলো : বামপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তারা শুধু ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
সীতারাম ইয়েচুরি : না, এখন ব্যাপারটা ঘুরে গেছে। আগে আমাদের বামফ্রন্টে চারটি দল ছিল, এখন আছে ছয়টি। খুব শিগগির বাম শক্তিকে আরও ঐক্যবদ্ধ দেখবেন।
প্রথম আলো : কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি? অন্তত সাম্প্রদায়িকতা ঠেকানোর লক্ষ্যে?
সীতারাম ইয়েচুরি : না, কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের নীতিগত ঐক্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ইস্যুভিত্তিক ঐক্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেমন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষার দাবিতে আমরা একতাবদ্ধ হতে পারি। আবার জনগণের সুস্পষ্ট দাবিতেও আমরা একতাবদ্ধ হতে পারি, যেমন ভূমি অধিগ্রহণ আইন। এ অবস্থায় বামপন্থীদের অনেক কিছু করার আছে। ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা ও ভূমি অধিগ্রহণ বিলের ক্ষেত্রে কংগ্রেসসহ বিরোধীরা একত্র হয়েছে, এটা সরকারকে প্রতিহত করবে। এসব ছাড়া বিজেপি সংসদীয় রীতিনীতিও পায়ে মাড়াচ্ছে। তারা সংসদকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
প্রথম আলো : আপনারা তো সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও লড়ছেন। কিন্তু ভারতে তো বর্তমানে একটি সাম্প্রদায়িক সরকার ক্ষমতায়, সে ক্ষেত্রে এই লড়াইয়ে কীভাবে সফল হবেন?
সীতারাম ইয়েচুরি : উপায় একটাই, জনগণের সমর্থন। একই সঙ্গে আমাদের দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে হবে। বাম দলগুলোর ঐক্যও আমরা শক্তিশালী করতে চাই। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমরা সব বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে আহ্বান জানাব, আসুন ভারতকে এই সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত থেকে বাঁচাই। একই সঙ্গে আমরা তাদের অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধেও কথা বলব, এই অর্থনৈতিক নীতি আমাদের জনগণের কাঁধে বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো থাকলে কি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে?
সীতারাম ইয়েচুরি : সেটা হওয়া উচিত নয়। অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক যা-ই হোক না কেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উন্নয়ন হতেই হবে। আর অন্য প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রেও আমরা মনে করি, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হওয়া উচিত। আমাদের মধ্যে বিতর্ক থাকতে পারে, সেটা আলোচনা করা যেতে পারে। আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে হবে, নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
প্রথম আলো : পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী বলবেন?
সীতারাম ইয়েচুরি : একই কথা প্রযোজ্য। ভারতের ধারণা হচ্ছে, পাকিস্তান ভারতে সন্ত্রাসবাদ রপ্তানি করে। পাকিস্তান বলছে, তারা সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়েছে। ফলে তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করে। কিন্তু আমাদের গোয়েন্দা তথ্যানুসারে, তারা সেটা করে যাচ্ছে। পাকিস্তানের কিছু জায়গায় এই সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে। আমরা চাই পাকিস্তান এটা বন্ধ করুক।
প্রথম আলো : মোদি সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো। আপনার দৃষ্টিতে তাঁর সফলতা বা ব্যর্থতা?
সীতারাম ইয়েচুরি : গত এক বছরে জনগণের ওপর চাপ বেড়েছে। সরকার তার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি। এই বিবেচনায় তারা জনগণের আস্থার বরখেলাপ করেছে, এটা প্রতারণা। তারা গত সরকারের যেসব সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল, সেগুলোই তারা এখন বাস্তবায়ন করছে। আক্রমণটা তিন ক্ষেত্রে হচ্ছে। প্রথমত, তারা মনমোহন সিং সরকারের অর্থনৈতিক নীতি আরও কট্টরভাবে অনুসরণ করছে। এর অর্থ হচ্ছে জনগণের ওপর আরও বোঝা চাপানো। অসমতা বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, তারা আরএসএসের রাজনৈতিক অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। তৃতীয়ত, তারা কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েমের পথে হাঁটছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা যথাযথ সংসদীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই সংসদে ৫০টি বিল পাস করেছে। এটা খুব বিপজ্জনক।
প্রথম আলো : কিন্তু গত এক বছরে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসেনি।
সীতারাম ইয়েচুরি : এটা বলা যায় হানিমুন পিরিয়ড। কোনো সরকারের প্রথম বছরে দুর্নীতির অভিযোগ আসে না। গত কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধেও কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে সাত বছরের মাথায়।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের বর্তমান গণতন্ত্রকে কীভাবে দেখছেন?
সীতারাম ইয়েচুরি : দেখুন, আমি এটাকে আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখি। বাংলাদেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে সেটা এই অঞ্চলের জন্যই ভালো। আমরা শুধু আশা করতে পারি, আপনারা এই সংগ্রামে জয়ী হবেন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে কে শাসন করবে, সেটা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের জনগণ। সে বিষয়ে ভারতের বা সিপিএমের কিছু বলার নেই। আমরা সব রকম হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে।
প্রথম আলো : দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার নানা দেশ, যেমন মালদ্বীপ ও থাইল্যান্ডেও গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছে। তো এই বিষয়কে কীভাবে দেখছেন?
সীতারাম ইয়েচুরি : এই অঞ্চলে টাকা ও পেশিশক্তির বিস্তার ঘটেছে, আমরা সেটা মোকাবিলার চেষ্টা করছি। আমরা চাই বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্থিতিশীল ও সুরক্ষিত হোক। আমি মনে করি, উপমহাদেশে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে লড়তে পারে শুধু বামেরাই। সমস্যা কিছু আছে, কিন্তু সমস্যা ও সুযোগ হাত ধরাধরি করে আসে। চীনা এক প্রবাদ আছে এ রকম: প্রতিটি সংকটের সঙ্গে সুযোগও আসে। আমরা সেই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। আমরা নিজেদের আরও শক্তিশালী করতে চেষ্টা করছি।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
সীতারাম ইয়েচুরি : আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফর থেকে আমরা কী প্রত্যাশা করতে পারি?
সীতারাম ইয়েচুরি : ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করবেন, এটা ভালো কথা। আমরা আশা করি, এই সফরের কারণে দেশ দুটির মধ্যকার আন্তসম্পর্ক ও সহযোগিতা আরও বাড়বে। আমরা সিপিএমের পক্ষ থেকে সফরটিকে খুবই মূল্যবান মনে করি। যাক, শেষমেশ স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়ে গেছে, এতে আমরা খুশি। এর আগে মনমোহন সিংয়ের সরকার এই বিল পেশ করেছিল, তখন বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস এর বিরোধিতা করেছিল। এখন আবার বিজেপিই এই বিল পেশ করেছে। এবার সবাই এ বিষয়ে একমত ছিল।
প্রথম আলো : সীমান্ত চুক্তি তো হলো, কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টনের কী হবে?
সীতারাম ইয়েচুরি : তিস্তার পানি বণ্টনের আলোচনায় আমরা সিপিএমের পক্ষ থেকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। মনমোহন সিং যখন ঢাকা সফরে এসেছিলেন, তখনই এটা হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কথা ছিল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে ঢাকায় আসবেন। কিন্তু তিনি শেষ মুহূর্তে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সেবার তিস্তা চুক্তি হয়নি। এই চুক্তির ভাগ্যে কী আছে, তা আমরা জানি না। কোনো বিষয়ে মতানৈক্য থাকলে বসে আলোচনা করে তার সমাধান বের করতে হবে। সমাধানের পথে এগোতে হবে, এটাই আমাদের কথা।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতীয় প্রদেশ, যেমন: পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় অন্য দল ক্ষমতায় আছে, বিজেপি নয়। বিজেপির তো নিজস্ব রাজনীতি আছে। সে ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নে কোনো সমস্যা দেখা দিতে পারে কি?
সীতারাম ইয়েচুরি : দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন কীভাবে হবে, তা নির্ভর করবে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার ওপর। তবে আমরা সে পথে আছি বলেই মনে হয়। কিন্তু কিছু সমস্যাও আছে, বিশেষ করে ভারতে। বিজেপি অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রচারণা শুরু করেছিল। স্থল সীমান্ত চুক্তির মতো দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ রক্ষা হয় এমন কিছু করতে আমরা তাদের চাপ দেব। তবে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থানের সঙ্গে আমরা একমত নই।
প্রথম আলো : ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মারা পড়ছে। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব?
সীতারাম ইয়েচুরি : এটা খুবই বড় সমস্যা, মানবিক সমস্যা। কারণ যা-ই হোক না কেন, প্রচুর মানুষ এমন অবৈধভাবে আসা-যাওয়া করে। দুই দেশের স্বার্থেই এটা হ্রাস করতে হবে।
প্রথম আলো : নির্বাচনের আগে ও পরে বিজেপির অবস্থানে বড় ধরনের পার্থক্য লক্ষ করেন কি?
সীতারাম ইয়েচুরি : হ্যাঁ, নির্বাচনের আগে তারা স্থল সীমান্ত চুক্তির বিরোধী ছিল, এখন তারা এর পক্ষে।
প্রথম আলো : ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও কি তেমন পরিবর্তন দেখছেন?
সীতারাম ইয়েচুরি : অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তারা এমন করছে। যেমন তারা অনেক বিষয়েই শক্তিশালী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেগুলো কীভাবে সরকারি নীতি হিসেবে গৃহীত হবে, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমরা সংসদে এগুলোর বিরোধিতা করছি, ফলে তাদের পক্ষে এটা করা সহজ হবে না। আমাদের দৃষ্টিতে যেটা ভারতীয় জনগণের স্বার্থবিরোধী মনে হবে, আমরা সেটার বিরোধিতা করব। ফলে বিজেপিকেও বিরোধীদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে হবে।
প্রথম আলো : ভারতীয় রাজনীতিতে এখন বামফ্রন্টের অবস্থা কী?
সীতারাম ইয়েচুরি : আমরা সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছি পশ্চিমবঙ্গে। কেরালায়ও আমরা কিছুটা ধাক্কা খেয়েছি, তবে সেখানে আমরা তা কাটিয়ে উঠতে পারব। পশ্চিমবঙ্গে পতনের কারণ ত্রিমুখী। প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের কিছু ভুল ছিল, কিছু প্রশাসনিক ভুল ছিল আর কিছু সাংগঠনিক দুর্বলতাও ছিল। আমরা সেগুলো চিহ্নিত করেছি, সংশোধনের চেষ্টাও আমরা করছি। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের স্লোগান হচ্ছে, প্রথমত আমাদের জনপ্রিয়তা কমার কারণগুলো বন্ধ করতে হবে। জনপ্রিয়তা কমা শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। সে বছরের লোকসভা ও ২০১০ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে এটা শুরু হয়। কারণ চিহ্নিত করে আমাদের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে হবে, এরপর তা পুনর্নির্মাণ করতে হবে। সর্বশেষ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ২০০৯ সালের পর এই প্রথম আমাদের ভোট কমেনি। এমনকি লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় আমাদের ভোট কিছু বেড়েছেও। তবে সময় লাগবে। কারণ পশ্চিমবঙ্গে আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ হয়েছে। এই পাঁচ বছরে আমাদের প্রায় ৫০০ কর্মী মারা গেছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী বাড়িতেই থাকতে পারছে না। হাজার হাজার কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো : সংসদে এখন বামদের প্রতিনিধিত্ব খুবই দুর্বল?
সীতারাম ইয়েচুরি : লোকসভায় সিপিএমের ১১ জন ও রাজ্যসভায় নয়জন সাংসদ আছে। আর দুই কক্ষেই একজন করে সিপিআইয়ের আছে দুজন সদস্য। এই হচ্ছে সংসদে বামদের প্রতিনিধিত্ব। স্বাধীনতার পর এটাই সর্বনিম্ন।
প্রথম আলো : বামপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তারা শুধু ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
সীতারাম ইয়েচুরি : না, এখন ব্যাপারটা ঘুরে গেছে। আগে আমাদের বামফ্রন্টে চারটি দল ছিল, এখন আছে ছয়টি। খুব শিগগির বাম শক্তিকে আরও ঐক্যবদ্ধ দেখবেন।
প্রথম আলো : কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি? অন্তত সাম্প্রদায়িকতা ঠেকানোর লক্ষ্যে?
সীতারাম ইয়েচুরি : না, কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের নীতিগত ঐক্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ইস্যুভিত্তিক ঐক্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেমন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষার দাবিতে আমরা একতাবদ্ধ হতে পারি। আবার জনগণের সুস্পষ্ট দাবিতেও আমরা একতাবদ্ধ হতে পারি, যেমন ভূমি অধিগ্রহণ আইন। এ অবস্থায় বামপন্থীদের অনেক কিছু করার আছে। ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা ও ভূমি অধিগ্রহণ বিলের ক্ষেত্রে কংগ্রেসসহ বিরোধীরা একত্র হয়েছে, এটা সরকারকে প্রতিহত করবে। এসব ছাড়া বিজেপি সংসদীয় রীতিনীতিও পায়ে মাড়াচ্ছে। তারা সংসদকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
প্রথম আলো : আপনারা তো সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও লড়ছেন। কিন্তু ভারতে তো বর্তমানে একটি সাম্প্রদায়িক সরকার ক্ষমতায়, সে ক্ষেত্রে এই লড়াইয়ে কীভাবে সফল হবেন?
সীতারাম ইয়েচুরি : উপায় একটাই, জনগণের সমর্থন। একই সঙ্গে আমাদের দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে হবে। বাম দলগুলোর ঐক্যও আমরা শক্তিশালী করতে চাই। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমরা সব বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে আহ্বান জানাব, আসুন ভারতকে এই সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত থেকে বাঁচাই। একই সঙ্গে আমরা তাদের অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধেও কথা বলব, এই অর্থনৈতিক নীতি আমাদের জনগণের কাঁধে বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো থাকলে কি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে?
সীতারাম ইয়েচুরি : সেটা হওয়া উচিত নয়। অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক যা-ই হোক না কেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উন্নয়ন হতেই হবে। আর অন্য প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রেও আমরা মনে করি, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হওয়া উচিত। আমাদের মধ্যে বিতর্ক থাকতে পারে, সেটা আলোচনা করা যেতে পারে। আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে হবে, নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
প্রথম আলো : পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী বলবেন?
সীতারাম ইয়েচুরি : একই কথা প্রযোজ্য। ভারতের ধারণা হচ্ছে, পাকিস্তান ভারতে সন্ত্রাসবাদ রপ্তানি করে। পাকিস্তান বলছে, তারা সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়েছে। ফলে তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করে। কিন্তু আমাদের গোয়েন্দা তথ্যানুসারে, তারা সেটা করে যাচ্ছে। পাকিস্তানের কিছু জায়গায় এই সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে। আমরা চাই পাকিস্তান এটা বন্ধ করুক।
প্রথম আলো : মোদি সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো। আপনার দৃষ্টিতে তাঁর সফলতা বা ব্যর্থতা?
সীতারাম ইয়েচুরি : গত এক বছরে জনগণের ওপর চাপ বেড়েছে। সরকার তার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি। এই বিবেচনায় তারা জনগণের আস্থার বরখেলাপ করেছে, এটা প্রতারণা। তারা গত সরকারের যেসব সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল, সেগুলোই তারা এখন বাস্তবায়ন করছে। আক্রমণটা তিন ক্ষেত্রে হচ্ছে। প্রথমত, তারা মনমোহন সিং সরকারের অর্থনৈতিক নীতি আরও কট্টরভাবে অনুসরণ করছে। এর অর্থ হচ্ছে জনগণের ওপর আরও বোঝা চাপানো। অসমতা বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, তারা আরএসএসের রাজনৈতিক অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। তৃতীয়ত, তারা কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েমের পথে হাঁটছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা যথাযথ সংসদীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই সংসদে ৫০টি বিল পাস করেছে। এটা খুব বিপজ্জনক।
প্রথম আলো : কিন্তু গত এক বছরে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসেনি।
সীতারাম ইয়েচুরি : এটা বলা যায় হানিমুন পিরিয়ড। কোনো সরকারের প্রথম বছরে দুর্নীতির অভিযোগ আসে না। গত কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধেও কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে সাত বছরের মাথায়।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের বর্তমান গণতন্ত্রকে কীভাবে দেখছেন?
সীতারাম ইয়েচুরি : দেখুন, আমি এটাকে আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখি। বাংলাদেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে সেটা এই অঞ্চলের জন্যই ভালো। আমরা শুধু আশা করতে পারি, আপনারা এই সংগ্রামে জয়ী হবেন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে কে শাসন করবে, সেটা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের জনগণ। সে বিষয়ে ভারতের বা সিপিএমের কিছু বলার নেই। আমরা সব রকম হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে।
প্রথম আলো : দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার নানা দেশ, যেমন মালদ্বীপ ও থাইল্যান্ডেও গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছে। তো এই বিষয়কে কীভাবে দেখছেন?
সীতারাম ইয়েচুরি : এই অঞ্চলে টাকা ও পেশিশক্তির বিস্তার ঘটেছে, আমরা সেটা মোকাবিলার চেষ্টা করছি। আমরা চাই বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্থিতিশীল ও সুরক্ষিত হোক। আমি মনে করি, উপমহাদেশে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে লড়তে পারে শুধু বামেরাই। সমস্যা কিছু আছে, কিন্তু সমস্যা ও সুযোগ হাত ধরাধরি করে আসে। চীনা এক প্রবাদ আছে এ রকম: প্রতিটি সংকটের সঙ্গে সুযোগও আসে। আমরা সেই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। আমরা নিজেদের আরও শক্তিশালী করতে চেষ্টা করছি।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
সীতারাম ইয়েচুরি : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments