সোনার দরবারে লাশ আর দাসের কারবার by ফারুক ওয়াসিফ

থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দী অবস্থায় নিহত
বাংলাদেশিদের দায় কে নেবে?
রানা প্লাজার লাশের মতো এই লাশগুলোও সব ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গলা-পচা ২৬টি লাশের মধ্যে ১০টি বাংলাদেশির, ১৬টি রোহিঙ্গাদের। ওই বন্দিশিবিরে দুজন জীবিত থাকাতেই হয়েছে সমস্যা। তাঁরাই জানিয়েছেন, লাশগুলোর অন্তত ১০টি বাংলাদেশি। এখন এদের পরিচয় বের করো রে, লাশ দেশে আনো রে, মিডিয়ার কাছে জবাবদিহি করতে করতে হয়রান হও রে! সেখানকার আরেকটি গণকবরে মেলে ৫০ জনের লাশ—ভাগ্যিস বলার মতো জীবিত কেউ ছিল না। যেহেতু এদের কতজন বাংলাদেশি আর কতজন রোহিঙ্গা, তা জানার উপায় নেই, সেহেতু সরকারেরও যেন দায় নেই। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই জঙ্গল থেকেই ৩৭ জন বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাদের ফিরিয়ে আনায় কত খরচ কত হুজ্জোত পোহাতে হলো সরকারকে! থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলের বন্দিশিবিরে কত বাংলাদেশি আটক বা নিহত হয়েছে, তার হিসাব চাপা থাকাই তাই ভালো! বঙ্গদেশে মাছের মায়ের পুত্রশোক করতে নেই।
রোহিঙ্গাদের নাহয় মিয়ানমার স্বীকারই করে না, তাই লাশ আনা বা বিচার করার বালাই তাদের নেই। বাংলাদেশও কি তার নাগরিকদের অস্বীকার করে বসে আছে? নইলে লাশ আনার ব্যবস্থা কই? তাই পাচার হওয়া বাবারা তোমরা এমনভাবে মারা যাও, যাতে লাশটাও না পাওয়া যায়, যদি পাওয়াও যায়, যাতে চেনা না যায়। আর যারা বেঁচে আছ, তারা কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার পাঠাও, আমরা উন্নয়ন করি। গত মাসে ভূমধ্যসাগরে ৯০০ জন যাত্রী নিয়ে শরণার্থীদের একটি জাহাজ ডুবে যায়। জীবিত উদ্ধার পায় মাত্র ২৮ জন, যাদের একজন বাংলাদেশি। বেশির ভাগই আরব ও আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষ। বাংলাদেশেও কি যুদ্ধ চলছে? তাহলে এ দেশের উদ্বাস্তু মানুষের লাশ কেন সীমান্তে, থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার জঙ্গলে, মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে, গ্রিক ও তুরস্কের পর্বত ও বরফের প্রান্তরে আর মহাসমুদ্রের পানিতে? জাতিসংঘের হিসাবে অভিবাসী শ্রমিক বাদেই গত ৩০ বছরে এ দেশের ১০ লাখের বেশি পুরুষ-নারী-শিশু পাচার হয়ে গেছে বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশি নারী ও শিশুদের বিপুল সরবরাহ চলে ভারত–পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে।
সোনার বাংলায় মানুষের চেয়ে সরকারের ভাবমূর্তি, আমলাদের বিলাস আর ডলারের বান্ডিল ও সোনার বারের কদর বেশি। তাই মাঝেমধ্যে সোনা আটক হলেও অবাধে মানুষ পাচার হয়। আশ্চর্য নয় মোটেই, প্রথম আলোর সোমবারের প্রথম পাতায় থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবরের খবরের পাশেই চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে ৪০টি সোনার বার আটকের খবর জ্বলজ্বল করছে।
অভিবাসন ও মানব পাচার নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটিং মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা প্রধান তাসনীম সিদ্দিকী। তাঁর কণ্ঠে আক্ষেপ ও হতাশা, ‘মানব পাচারের জালটা যখন ছোট ছিল, তখনই আমরা সরকারকে বলেছিলাম যে এটাকে ছোট অবস্থায় না
ধরলে পরে আর সামলানো যাবে না। প্রথমে কয়েকটা স্পট থেকে পাচার হতো, করত অল্প কয়েকটা দালাল। আন্তর্জাতিক দস্যু চক্র তখনো জড়িত ছিল না। কিন্তু দিনে দিনে এই জাল বিরাট হয়ে গেছে। জলবায়ু বিপন্ন এলাকা, যেমন যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, রাজশাহীর মতো জেলায় দালালেরা সক্রিয়। বছরের পর বছর ধরে আমরা সরকারকে বলেছি, ত্বরিত ব্যবস্থা নেন, কিন্তু তারা নির্বিকার।’
তাসনীম সিরাজগঞ্জ জেলায় রামরুর জরিপের তথ্য উদ্ধৃত করে বলছিলেন, ‘সিরাজগঞ্জের ছয় উপজেলায় গত বছরের প্রথম আট মাসে চার হাজারের বেশি মানুষ পাচার হয়। এদের মধ্যে প্রায় ৪০০ জন নিখোঁজ, ৭০ জনের মতো থাইল্যান্ডের কারাগারে আটক, নিহত ব্যক্তির সংখ্যাটার কোনো শুমার নেই।’ ডেইলি স্টার পত্রিকা জানাচ্ছে, আট বছরে সমুদ্রপথে কমপক্ষে আড়াই লাখ লোক পাচার হয়ে গেছে। এদের মধ্যে কত শত নির্যাতিত ও নিহত হয়েছে, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই।
বেকার বা অভাবী মানুষকে দালালেরা যখন বলেছে, ১০ হাজার টাকায় বিদেশ পাঠাবে, সঙ্গে সঙ্গে এরা রাজি হয়ে গেছে। অনেককেই জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। তারপর একদিন ফোন আসে, ‘আমি বন্দী, টাকা পাঠাও, নইলে সমুদ্রে ফেলে দেবে।’ এভাবে কারও কারও খোঁজ মিলেছে, অনেকেই থেকেছে নিখোঁজ। পাচার হওয়া কেউ কেউ দু-তিন বছর দাসত্ব খেটে কিছু টাকা জমিয়ে কাগজপত্র তৈরি করে বৈধ চাকরিও পেয়েছে, বাকিরা হারিয়ে গেছে অন্ধকার মাটির গহ্বরে।
ঝুঁকি তারা নেবে না কেন? কদিন আগেই ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক বেকার বাবা অক্ষমতার জ্বালায় দুই বাচ্চাসহ তার পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। প্রায়ই অভাবের জ্বালায় আত্মহত্যার খবর আসে। আইলা-সিডর বা খরাদুর্গত মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়নি। সোমবারেরই প্রথম আলোর সংবাদ, গত কয়েক বছরের মতো এবারও ধানের বাম্পার ফলন দিয়েও উৎপাদন খরচটাও পাচ্ছেন না কৃষক। এর আগে আমন, আলু ও সবজির দামও মার গেছে। হরতাল-অবরোধের ধাক্কাটা তাঁদের ওপর দিয়েই যায় বেশি। কিংবা জয়পুরহাটে কিডনি–বেচা মানুষের কথাই ধরুন। এ রকম দুর্দশায় পতিত ব্যক্তিদের কারও কাছে বিদেশে চাকরির প্রস্তাব এলে সে তো ঝুঁকি নেবেই। অভাবের যন্ত্রণায়, গরিব শ্রেণি থেকে সচ্ছল শ্রেণিতে উত্তরণের স্বপ্নে কিংবা ধারদেনা শোধের তাড়নায় অনেকেই দালালদের হাতে দেহ–প্রাণ সঁপে দেন। এ রকম মুফতে প্রাণ পাওয়া যায় যে দেশে, সেখানে তো দাস ব্যবসা হবেই। এসব ঠেকাতে না আছে সরকারের জনসচেতনতা কার্যক্রম, না আছে জোর পুলিশি তৎপরতা। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ডলার আসছে, জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। ভালোই তো!
তাসনীম সিদ্দিকী জানালেন, ‘সারা দেশ থেকেই অপহরণের মাধ্যমেও মানব পাচার চলছে। আমরা সরকারের কাছে কিছু দালালের একটা তালিকাও দিয়েছি। তাতেও সাড়া না পেয়ে ২৮-১২-২০১৪ তারিখে জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে রিট (ফাইল নম্বর ১২৩৯৬) করি। এর আদেশ পেয়েছি গত ১৫ মার্চ। এই রিটে আমরা স্বরাষ্ট্র, শ্রম, প্রবাসী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ পুলিশপ্রধান, জনশক্তি ব্যুরোর মহাপরিচালকসহ অনেকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেছি। উত্তর মেলেনি এখনো। সরকারি কর্তারা মুখে বলছেন, এরা জেনেশুনে গেছে, এদের বিষয়ে এত খবর কেন? আমি বলব, সরকার কোনোভাবেই নজর দেয়নি। কোনো দৃষ্টিপাতই করেনি। তারা এখন ফোনে মেসেজ দিচ্ছে, ‘অবৈধভাবে গেলে জান যাবে, বৈধভাবে গেলে টাকা পাবে’; এতেই কি দায় শেষ? আমরা সিভিল সমাজকেও বলেছি, যার যার এলাকায় খোঁজ করো কে কে হারাল। গত ১৮ ডিসেম্বর অনেকগুলো এনজিওর একসঙ্গে কালো ব্যাজ ধারণ করার কথা বলা হলেও কেউ কিছু করেনি। আমরা সবাই দোষী। সরকারকে দায়বদ্ধ করা দরকার ছিল। সেটা যেহেতু করা হয়নি, সেহেতু সরকার জানে যে কিছু না করলেও তারা পার পাবে।’
এখন এর সহজ সমাধান নেই। এর জন্য আন্তর্জাতিক যৌথ কমিশন গঠন করে জড়িত ব্যক্তিদের একযোগে দমনের দাবি করলেন তাসনীম। যেমন থাইল্যান্ডের মাছ ধরার ট্রলারগুলোয় ১৫ জনের কম শ্রমিক থাকলেই তাঁরা শ্রম আইনের বাইরে পড়ে যান। ওদের এই আইন বদলাতে হবে। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। এর জন্য বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশকে একযোগে কাজ করতে হবে। সবার আগে ধাক্কা দিতে হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দস্যুতন্ত্রকে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের কতিপয় সাংসদ ও গডফাদার অস্ত্র, মাদক ও মানব পাচারের রাজত্ব কায়েম করে বসেছেন। এদের সঙ্গে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশ। এদের মানুষ ধরার জাল ছিঁড়ে দিতে যে সদিচ্ছা ও দায়িত্ববোধ প্রয়োজন, তা কি সরকারের আছে? রানা প্লাজার নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ ও বিচারে আমরা সরকারকে পাইনি, তাজরীনের দায়ী মালিক এখন জামিনে মুক্ত। গত ছয় বছরে প্রবাস থেকে যে ১৪ হাজার অভিবাসী শ্রমিকের লাশ এল (প্রথম আলো, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪), তাদের দায়ও কেউ নেয়নি।
আমাদের বলার কিচ্ছু নেই। কারণ, আমরা নৈ–রাষ্ট্রের নৈ–নাগরিক। দেশে-বিদেশে আমরা পালন করছি অভূতপূর্ব হত্যাজয়ন্তী। আমাদের গরিবেরা মানুষ নয়, ‘দাস’। হাজার বছরের বাংলার ইতিহাসের একটা গৌরব ছিল; এ দেশে কখনো দাসপ্রথা ছিল না। একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের অর্জন, আমরা এখন দেশে ও বিদেশে বৈধ–অবৈধ পথে দাস রপ্তানি করে যাচ্ছি।
এক সহকর্মী সাংবাদিক এক বাবাকে পেয়েছিলেন, যাঁর এক সন্তান সিডরে, আরেক সন্তান আইলায় মারা গিয়েছিল। খুঁজলে হয়তো জানব, থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পচা লাশগুলোর কারও ভাইবোন হয়তো রানা প্লাজায় পিষ্ট অথবা তাজরীনে দগ্ধ। আর এদের বাবা–মা? নাহ, তারা আমাদের কেউ নয়!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.