কনগ্র্যাচুলেশন by পরিতোষ পাল
ভারতের
লোকসভায় স্থল সীমান্ত চুক্তিসংক্রান্ত বিল পাসের ঐতিহাসিক মুহূর্তে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা
জানিয়েছেন প্রতিবেশী দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এক টুইট বার্তায়
মোদি নিজেই সেটি প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে
আমার কথা হয়েছে এবং দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর মুহূর্তে
আমি বাংলাদেশের জনগণকে আমার শুভেচ্ছা (কনগ্র্যাচুলেশন) জানিয়েছি। এদিকে,
বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে নরেন্দ মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর
মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তিটি সই হয়। চুক্তিটি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অল্প
দিনের মধ্যে অনুমোদন করিয়ে নিলেও ভারত তা করেনি। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
এবং সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে সংসদে এর অনুমোদন পেতে এত দিন অপেক্ষায় থাকতে
হয়েছে বাংলাদেশকে। অবশেষে সব বাধা অতিক্রম করে গত ৬ই মার্চ নরেন্দ্র মোদি
সরকার চুক্তিটি বাস্তবায়নে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এ সংক্রান্ত সংবিধান
সংশোধন বিল উত্থাপন করে। অত্যন্ত প্রাণবন্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে ওই দিনই
সর্বসম্মতভাবে বিলটি অনুমোদন করেন রাজ্যসভার সদস্যরা। গতকাল এটি লোকসভায়
উত্থাপিত হয়। ওই বিল উত্থাপন এবং আগের দিনে রাজ্যসভায় এটি পাসের প্রতিবাদে
গতকাল আসামে ১০ ঘণ্টার বন্ধ-এর ডাক দেয় বিল বিরোধী পক্ষ। কিন্তু তাতে তেমন
প্রভাব পড়েনি। ওই বন্ধ চলাকালেই বিলের বিস্তর আলোচনা চালিয়ে যান লোকসভার
সদস্যরা। সেই আলোচনা ধারাবাহিকতায় আসে বহুল প্রতীক্ষিত সেই ক্ষণ। রাজ্যসভার
মতোই কণ্ঠ ভোটে সর্বসম্মতভাবে লোকসভার সদস্যরা বিলটিতে চূড়ান্ত অনুমোদন
দেন। অবসান ঘটে ৪১ বছরের অপেক্ষার। সেই মুহূর্তকে ল্যান্ডমার্ক বলছেন
ভারতের কিং নরেন্দ্র মোদি। সত্যিই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জন্য এটি
‘ল্যান্ডমার্ক ওকেশন’। ওই মুহূর্তে প্রচণ্ডভাবে উচ্ছ্বসিত ছিলেন ভারতের
প্রধানমন্ত্রী। তার ওই উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটে পরপর ৯টি টুইট বার্তায়।
প্রথমে তিনি বলেন, আজ পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হওয়ার মধ্য
দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছানোর দ্বার উন্মুক্ত
হলো। দ্বিতীয় টুইট বার্তায় মোদির মন্তব্য- প্রতিবেশীদের সঙ্গে গঠনমূলক
সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় এটি আমাদের দেশের সামগ্রিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। তৃতীয়
বার্তায় তিনি ঐতিহাসিক ওই বিল পাসে সহযোগিতার জন্য তার দেশের সব রাজনৈতিক
দলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। একই সঙ্গে আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম,
ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নাগরিকদেরও ধন্যবাদ জানান। চতুর্থ বার্তায়
তিনি বলেন, স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ সীমান্ত এবং এর উন্নত ব্যবস্থাপনা ও
সমন্বয়ে আজকের সিদ্ধান্ত অবদান রাখবে। একই সঙ্গে এর ফলে সীমান্তে আরও
নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পঞ্চম বার্তায় মোদি তার দৃঢ় আশাবাদ
ব্যক্ত করেন। বলেন, পাসকৃত সংশোধনী বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত স্থায়ীভাবে
নির্ধারণ নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে বহুদিন ধরে ঝুলে থাকা সীমান্ত ইস্যুগুলোর
সুরাহাও সম্ভব হবে। ৬ষ্ঠ টুইট বার্তায় তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা এবং
বাংলাদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানানোর বিষয়টি প্রকাশ করেন। সপ্তম টুইট
বার্তায় মোদি বিলটি পাসে সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য এনডিএ জোটের দলগুলোর
প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, এসবের ফলেই ভারত-বাংলাদেশ
স্থল সীমান্ত চুক্তির সমাধান রচিত হয়েছে। অষ্টম বার্তায় ভারতের
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সোনিয়া জি, খারগে জি, জয়ললিতা জি, ইয়েচুরি জি, মায়াবতী
জি, মুলায়ম সিং জি, নবীন বাবু ও সারদ জাদব জির সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি।
নবম ও সর্বশেষ টুইটবার্তায় তিনি সংবিধান সংশোধন বিলে সমর্থন প্রধানকারী সব
সংসদ সদস্যকে ধন্যবাদ জানান। সেখানে তিনি আশা করেন- এটি বাংলাদেশের সঙ্গে
সমপর্কে ‘নতুন অধ্যায়’র সূচনা করবে।
ভারতের লোকসভায় ঐতিহাসিক বিল পাস
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ৪১ বছরের ব্যবধানে এ দুটি দেশের সীমান্ত চিহ্নিতকরণ বিষয়ক বিল পাস হয়েছে ভারতের লোকসভায়। এর ফলে এ চুক্তি বাস্তবায়নের পথে আর কোন বাধাই রইলো না। এখন প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জী বিলে স্বাক্ষর করলেই তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটবে। বিলটিকে ঐতিহাসিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে। গতকাল লোকসভায় বিল নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশের কাছে রোড কানেকটিভিটি, সড়ক, রেল ও নৌপথ ব্যবহারের সুবিধার দাবি তোলেন বিজেপির এমপি সুরেন্দ্রর সিং আলুওয়ালিয়া। তিনি আবেগঘন এক বক্তব্যে ভারত সরকারের কাছে এ চুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশের কাছে কিছু চাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পর ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে পরবর্তীতে যেসব চুক্তি করবে তার মধ্যে যেন এগুলো রাখা হয়। রাজ্যসভার মতোই গতকাল লোকসভাতেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত সীমান্ত চুক্তি কার্যকর সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধন বিল সর্বসম্মতিতে পাস হয়েছে। বাংলাদেশের কাছে এই সহমতের বার্তাটি দিতেই লোকসভার সদস্যদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। এদিন দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ধরে বিতর্কের পর সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় ৩৩১ সংসদ সদস্যদের সমর্থনে বিলটি সভায় সর্বসম্মতিতে পাস হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সভায় উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় বিলটি প্রত্যাহারের জন্য আসাম ইউনাইটেড ডেমোক্রাটিক ফ্রন্টের সংসদ সদস্য বদরুদ্দিন আজমল দাবি জানালেও পরে ভোটাভুটির সময় তিনি আর আপত্তি জানাননি। বুধবারই সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিলটি ১৮০ জনের সমর্থনে সর্বসম্মতিতে পাস হয়েছে। এদিন সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভা ও রাজ্যসভায় গৃহীত বিলটি কোনরকম পরিবর্তন ছাড়াই পাস হওয়ায় দীর্ঘ ৪১ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত স্থায়ীভাবে চিহ্নিত হওয়ার পথে প্রায় সব বাধাই দূর হয়ে গেছে। এখন ভারতের ৫০ শতাংশ রাজ্যের সমর্থন পাওয়ার পর প্রেসিডেন্টের অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই চুক্তি কার্যকর হবে। গতকাল ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ১১৯তম সংবিধান সংশোধন বিলটি লোকসভায় পেশ করেন। তিনি বিলটি সভায় পেশ করতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন। সেই সঙ্গে তিনি এই বিল আনার ক্ষেত্রে ভারতের পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ভূমিকারও প্রশংসা করেন। তবে বিলটি নিয়ে লোকসভায় এদিন প্রবল বিতর্ক হয়েছে। এদিনের বিল নিয়ে আলোচনায় প্রায় সকলেই এই বিলকে ঐতিহাসিক বলে চিহ্নিত করেন। দুই দেশের সম্পর্ক এর ফলে আরও শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি ভারতের জাতীয় স্বার্থও রক্ষিত হবে বলে সদস্যরা মতপ্রকাশ করেন। একই সঙ্গে কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি ট্রানজিট, এনার্জিসহ সব ধরনের সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভারতকে ভূমিকা রাখার আবেদন জানান। সভাতে অনেক সদস্যই ছিটমহলে যেভাবে দীর্ঘ সময় ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে সে ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে সংসদের দুই সভায় সংবিধান সংশোধনী বিলটি পাস হওয়ার ফলে ছিটমহলের বাসিন্দারা নাগরিকত্ব লাভ করবেন দীর্ঘ ৬৮ বছরের ব্যবধানে। ছিটমহলবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য ভারত সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ৩৮৫০ কোটি রুপির আর্থিক সাহায্যের দাবি মেনে নিয়েছেন বলে সভায় জানানো হয়। সভায় আলোচনাকালে তৃণমূল কংগ্রেসের সুগত বসু দুই দেশের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে কখনও রবীন্দ্রনাথ কখনও জীবনানন্দ দাসের কবিতা তুলে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, এই বিল পাস হওয়ার ফলে সীমান্ত স্থায়ীভাবে সুরক্ষিত হবে। এর ফলে অনুপ্রবেশ ও চোরাচালানের মতো সমস্যার সমাধান হবে। সিপিআইএমের মহম্মদ সেলিম অন্নদা শঙ্কর রায়ের কবিতা উল্লেখ করে বলেন, এই ঐতিহাসিক বিলের মাধ্যমে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। তিনি দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নদীর পানি বণ্টন সমস্যা, ট্রানজিট সমস্যার সুরাহা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। আসামের মুখ্যমন্ত্রীর পুত্র সংসদ সদস্য গৌরব গগৈ সভায় কেন ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমান সীমান্ত চুক্তি করেছিলেন তার কারণ ব্যাখ্যা করে তথ্যসহ জানান যে, এই চুক্তির ফলে অচিহ্নিত সীমান্ত যেমন চিহ্নিত হবে তেমনি অপদখলীয় জমির সমস্যার সমাধান হবে। এ দিনটিকে গৌরবের বলে তিনি চিহ্নিত করেন। তবে আসামের দুই বিজেপি সংসদ সদস্য আসামের জমি হারানোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আসাম থেকে বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠানোর যে প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী প্রচারকালে দিয়েছিলেন সে কথাও তারা স্মরণ করিয়ে দেন। কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী বিতর্কে অংশ নিয়ে বিল নিয়ে গোপনীয়তার অভিযোগ করেন। অন্যদিকে ডিএমকের এক সংসদ সদস্য বেরুবাড়িকে এই বিলের অন্তর্ভুক্ত না করায় আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তবে সদস্যদের এসব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রথমেই সদস্যদের কাছে অনুরোধ রাখেন- বাংলাদেশের কাছে ভাল বার্তা দেবার স্বার্থে কোনও সদস্য যেন বিলটির বিরোধিতা না করেন। এর পরেই তিনি জানান, সরকার বিল নিয়ে কোনও গোপনীয়তা করেনি। বরং ১৯৭৪ সালের চুক্তি ও মনমোহন সিং স্বাক্ষরিত প্রটোকল হুবহু সংসদে পেশ করার জন্য বিলে রাখা হয়েছে। স্ট্যান্ডিং কমিটির সুপারিশের পরেও বিল পেশে বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংসদের সময়ের অভাবের কথা উল্লেখ করেন। তবে তিনি জানান, এ সময়ের মধ্যে সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পুনর্বাসন প্যাকেজ চূড়ান্ত করেছেন। বেরুবাড়ি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা রয়েছে। আদালতের বিচারাধীন বলে তিনি এই বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। এক সদস্যের তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন প্রসঙ্গে তোলা প্রশ্নের উত্তরে সুষমা স্বরাজ জানান, এ গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা চলছে। খুব দ্রুতই এগুলোর সমাধান সম্ভব হবে বলে তিনি জানান। প্রতিবেশী সম্পর্কে বড় ভাই সুলভ ঔদ্ধত্যের মনোভাব না দেখানোর কথা এক সংসদ সদস্য উল্লেখ করায় সুষমা বলেন, ভারত বড় দেশের রোগেন্ট মনোভাব নিয়ে চলছে না। বরং এলডারলি ভাইয়ের মনোভাব নিয়েই চলছে। দার্জিলিংয়ের বিজেপির সংসদ সদস্য সুরেন্দ্রর সিং আলুওয়ালিয়া বাংলায় ভাষণ দেন লোকসভায়। তিনি এদিন আবেগপূর্ণ ভাষায় বক্তব্য রাখেন। বলেন, এ বিল পাস হওয়ার পর বাংলাদেশের উচিত ভারতকে ট্রানজিট ইস্যু দেয়া। তিনি বলেন- আমার দাবি আমাদেরকে একসেস টু রোড (ট্রানজিট), আমাদের এন্টায়ার নর্থইস্ট শিলিগুড়ি ঘুরে যেতে হয়। কিন্তু আমরা যদি ঢাকা হয়ে যাই তাহলে অনেক কাছে পড়ে যায়। আমরা শিলচর যাওয়ার জন্য বা আগরতলা যাওয়ার জন্য আমাদেরকে শিলচর হয়ে আগরতলা যেতে হয়। আমরা ঢাকা হয়ে আরামে যেতে পারি। আমরা যদি এই রোড কানেকটিভিটিটা পাই, রোড একসেসটা, রেল একসেসটা পাই তারপর আমরা যদি রিভার একসেসটা পাই, যা থেকে আমরা সি- লিংক পাই- এ ব্যবস্থাটা আমি আমার মাধ্যমে দাবি করি সরকারের কাছ থেকে। সরকার নিশ্চয়ই চুক্তি সই করার পর নিশ্চয় পরবর্তীকালে উনারা নতুন কিছু চুক্তি করবেন, সেই চুক্তির মধ্যে যদি এই বিষয়গুলো রাখা যায়। ওদিকে গতকাল লোকসভায় বিলটি পাস হওয়ার খবরে দুই দেশের মধ্যে অবস্থিত ছিটমহলগুলোর অধিবাসীরা আনন্দে ফেটে পড়েন। তারা এই প্রথম কোন দেশের নাগরিকত্ব পেতে যাচ্ছেন। তারাও জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার পাবেন। পাবেন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নাগরিক সব অধিকার। এ আনন্দে তারা মিষ্টি বিতরণ করেন। এ এক অন্যরকম দৃশ্য ছিটমহলগুলোর।
ভারতের লোকসভায় ঐতিহাসিক বিল পাস
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ৪১ বছরের ব্যবধানে এ দুটি দেশের সীমান্ত চিহ্নিতকরণ বিষয়ক বিল পাস হয়েছে ভারতের লোকসভায়। এর ফলে এ চুক্তি বাস্তবায়নের পথে আর কোন বাধাই রইলো না। এখন প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জী বিলে স্বাক্ষর করলেই তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটবে। বিলটিকে ঐতিহাসিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে। গতকাল লোকসভায় বিল নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশের কাছে রোড কানেকটিভিটি, সড়ক, রেল ও নৌপথ ব্যবহারের সুবিধার দাবি তোলেন বিজেপির এমপি সুরেন্দ্রর সিং আলুওয়ালিয়া। তিনি আবেগঘন এক বক্তব্যে ভারত সরকারের কাছে এ চুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশের কাছে কিছু চাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পর ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে পরবর্তীতে যেসব চুক্তি করবে তার মধ্যে যেন এগুলো রাখা হয়। রাজ্যসভার মতোই গতকাল লোকসভাতেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত সীমান্ত চুক্তি কার্যকর সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধন বিল সর্বসম্মতিতে পাস হয়েছে। বাংলাদেশের কাছে এই সহমতের বার্তাটি দিতেই লোকসভার সদস্যদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। এদিন দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ধরে বিতর্কের পর সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় ৩৩১ সংসদ সদস্যদের সমর্থনে বিলটি সভায় সর্বসম্মতিতে পাস হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সভায় উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় বিলটি প্রত্যাহারের জন্য আসাম ইউনাইটেড ডেমোক্রাটিক ফ্রন্টের সংসদ সদস্য বদরুদ্দিন আজমল দাবি জানালেও পরে ভোটাভুটির সময় তিনি আর আপত্তি জানাননি। বুধবারই সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিলটি ১৮০ জনের সমর্থনে সর্বসম্মতিতে পাস হয়েছে। এদিন সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভা ও রাজ্যসভায় গৃহীত বিলটি কোনরকম পরিবর্তন ছাড়াই পাস হওয়ায় দীর্ঘ ৪১ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত স্থায়ীভাবে চিহ্নিত হওয়ার পথে প্রায় সব বাধাই দূর হয়ে গেছে। এখন ভারতের ৫০ শতাংশ রাজ্যের সমর্থন পাওয়ার পর প্রেসিডেন্টের অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই চুক্তি কার্যকর হবে। গতকাল ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ১১৯তম সংবিধান সংশোধন বিলটি লোকসভায় পেশ করেন। তিনি বিলটি সভায় পেশ করতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন। সেই সঙ্গে তিনি এই বিল আনার ক্ষেত্রে ভারতের পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ভূমিকারও প্রশংসা করেন। তবে বিলটি নিয়ে লোকসভায় এদিন প্রবল বিতর্ক হয়েছে। এদিনের বিল নিয়ে আলোচনায় প্রায় সকলেই এই বিলকে ঐতিহাসিক বলে চিহ্নিত করেন। দুই দেশের সম্পর্ক এর ফলে আরও শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি ভারতের জাতীয় স্বার্থও রক্ষিত হবে বলে সদস্যরা মতপ্রকাশ করেন। একই সঙ্গে কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি ট্রানজিট, এনার্জিসহ সব ধরনের সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভারতকে ভূমিকা রাখার আবেদন জানান। সভাতে অনেক সদস্যই ছিটমহলে যেভাবে দীর্ঘ সময় ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে সে ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে সংসদের দুই সভায় সংবিধান সংশোধনী বিলটি পাস হওয়ার ফলে ছিটমহলের বাসিন্দারা নাগরিকত্ব লাভ করবেন দীর্ঘ ৬৮ বছরের ব্যবধানে। ছিটমহলবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য ভারত সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ৩৮৫০ কোটি রুপির আর্থিক সাহায্যের দাবি মেনে নিয়েছেন বলে সভায় জানানো হয়। সভায় আলোচনাকালে তৃণমূল কংগ্রেসের সুগত বসু দুই দেশের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে কখনও রবীন্দ্রনাথ কখনও জীবনানন্দ দাসের কবিতা তুলে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, এই বিল পাস হওয়ার ফলে সীমান্ত স্থায়ীভাবে সুরক্ষিত হবে। এর ফলে অনুপ্রবেশ ও চোরাচালানের মতো সমস্যার সমাধান হবে। সিপিআইএমের মহম্মদ সেলিম অন্নদা শঙ্কর রায়ের কবিতা উল্লেখ করে বলেন, এই ঐতিহাসিক বিলের মাধ্যমে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। তিনি দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নদীর পানি বণ্টন সমস্যা, ট্রানজিট সমস্যার সুরাহা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। আসামের মুখ্যমন্ত্রীর পুত্র সংসদ সদস্য গৌরব গগৈ সভায় কেন ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমান সীমান্ত চুক্তি করেছিলেন তার কারণ ব্যাখ্যা করে তথ্যসহ জানান যে, এই চুক্তির ফলে অচিহ্নিত সীমান্ত যেমন চিহ্নিত হবে তেমনি অপদখলীয় জমির সমস্যার সমাধান হবে। এ দিনটিকে গৌরবের বলে তিনি চিহ্নিত করেন। তবে আসামের দুই বিজেপি সংসদ সদস্য আসামের জমি হারানোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আসাম থেকে বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠানোর যে প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী প্রচারকালে দিয়েছিলেন সে কথাও তারা স্মরণ করিয়ে দেন। কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী বিতর্কে অংশ নিয়ে বিল নিয়ে গোপনীয়তার অভিযোগ করেন। অন্যদিকে ডিএমকের এক সংসদ সদস্য বেরুবাড়িকে এই বিলের অন্তর্ভুক্ত না করায় আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তবে সদস্যদের এসব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রথমেই সদস্যদের কাছে অনুরোধ রাখেন- বাংলাদেশের কাছে ভাল বার্তা দেবার স্বার্থে কোনও সদস্য যেন বিলটির বিরোধিতা না করেন। এর পরেই তিনি জানান, সরকার বিল নিয়ে কোনও গোপনীয়তা করেনি। বরং ১৯৭৪ সালের চুক্তি ও মনমোহন সিং স্বাক্ষরিত প্রটোকল হুবহু সংসদে পেশ করার জন্য বিলে রাখা হয়েছে। স্ট্যান্ডিং কমিটির সুপারিশের পরেও বিল পেশে বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংসদের সময়ের অভাবের কথা উল্লেখ করেন। তবে তিনি জানান, এ সময়ের মধ্যে সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পুনর্বাসন প্যাকেজ চূড়ান্ত করেছেন। বেরুবাড়ি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা রয়েছে। আদালতের বিচারাধীন বলে তিনি এই বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। এক সদস্যের তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন প্রসঙ্গে তোলা প্রশ্নের উত্তরে সুষমা স্বরাজ জানান, এ গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা চলছে। খুব দ্রুতই এগুলোর সমাধান সম্ভব হবে বলে তিনি জানান। প্রতিবেশী সম্পর্কে বড় ভাই সুলভ ঔদ্ধত্যের মনোভাব না দেখানোর কথা এক সংসদ সদস্য উল্লেখ করায় সুষমা বলেন, ভারত বড় দেশের রোগেন্ট মনোভাব নিয়ে চলছে না। বরং এলডারলি ভাইয়ের মনোভাব নিয়েই চলছে। দার্জিলিংয়ের বিজেপির সংসদ সদস্য সুরেন্দ্রর সিং আলুওয়ালিয়া বাংলায় ভাষণ দেন লোকসভায়। তিনি এদিন আবেগপূর্ণ ভাষায় বক্তব্য রাখেন। বলেন, এ বিল পাস হওয়ার পর বাংলাদেশের উচিত ভারতকে ট্রানজিট ইস্যু দেয়া। তিনি বলেন- আমার দাবি আমাদেরকে একসেস টু রোড (ট্রানজিট), আমাদের এন্টায়ার নর্থইস্ট শিলিগুড়ি ঘুরে যেতে হয়। কিন্তু আমরা যদি ঢাকা হয়ে যাই তাহলে অনেক কাছে পড়ে যায়। আমরা শিলচর যাওয়ার জন্য বা আগরতলা যাওয়ার জন্য আমাদেরকে শিলচর হয়ে আগরতলা যেতে হয়। আমরা ঢাকা হয়ে আরামে যেতে পারি। আমরা যদি এই রোড কানেকটিভিটিটা পাই, রোড একসেসটা, রেল একসেসটা পাই তারপর আমরা যদি রিভার একসেসটা পাই, যা থেকে আমরা সি- লিংক পাই- এ ব্যবস্থাটা আমি আমার মাধ্যমে দাবি করি সরকারের কাছ থেকে। সরকার নিশ্চয়ই চুক্তি সই করার পর নিশ্চয় পরবর্তীকালে উনারা নতুন কিছু চুক্তি করবেন, সেই চুক্তির মধ্যে যদি এই বিষয়গুলো রাখা যায়। ওদিকে গতকাল লোকসভায় বিলটি পাস হওয়ার খবরে দুই দেশের মধ্যে অবস্থিত ছিটমহলগুলোর অধিবাসীরা আনন্দে ফেটে পড়েন। তারা এই প্রথম কোন দেশের নাগরিকত্ব পেতে যাচ্ছেন। তারাও জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার পাবেন। পাবেন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নাগরিক সব অধিকার। এ আনন্দে তারা মিষ্টি বিতরণ করেন। এ এক অন্যরকম দৃশ্য ছিটমহলগুলোর।
No comments