থাইল্যান্ডের গণকবর, কক্সবাজারে উৎকণ্ঠা-কান্না থেমে নেই পাচার by রাসেল চৌধুরী
গত
বছরের ১৪ই ফেব্রুয়ারি রাতে নৌকায় করে মালয়েশিয়াগামী জাহাজে উঠেন উখিয়ার
জালিয়াপালং ইউনিয়নের ডেইলপাড়া গ্রামের মৃত নূর আহমদের ছেলে আবদুস সালাম
(৩৫)। কিন্তু ১৪ মাসেও তার কোন হদিস পায়নি তার পরিবার। মেরিন ড্রাইভ
সড়কসংলগ্ন পেঁচারদ্বীপের বাসিন্দা আলমগীরের ছেলে ছৈয়দ আলম (৩২)। সাত মাস
আগে দালালরা তাকে নৌকায় করে থাইল্যান্ড পাচার করে দেয়। কিন্তু গত সাত মাসেও
তার কোন খোঁজ পায়নি পরিবার। উখিয়ার সোনারপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ
ইসমাঈল (২৫)। ৫ মাস ধরে খোঁজ নেই। সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া গিয়ে আবদুস
সালাম, ছৈয়দ আলম ও ইসমাঈলের পরিবারের এই হাহাকারই শুধু নয়- কান্না,
উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ ও হাহাকার চলছে কক্সবাজার সদর, শহর, রামু উখিয়া ও টেকনাফের
বিভিন্ন এলাকায়। ভাগ্য ফেরাতে এসব মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গবাদিপশুর মতো
গাদাগাদি করে নৌযানে উত্তাল সাগর পাড়ি দেয়। অবৈধ পথে রওনা দিয়ে মালয়েশিয়ায়
পৌঁছানোই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
জানা গেছে, ঝুঁকি আর অমানবিক নির্যাতন সয়ে স্বপ্নের মালয়েশিয়া যাত্রা নতুন কোন ঘটনা নয়। গত ৩ বছর ধরে চলে আসছে এসব ঘটনা। এ সময়ে সাগরে ট্রলার ডুবিতে পাচ শতাধিক মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে দুই হাজারেরও বেশি। পাচারকারীর গুলিতে নিহতও হয়েছে অনেকই। উদ্ধার হয়েছে ২৯৪৫ জন যাত্রী। আর একই সময়ে মানব পাচার আইনে মামলা হয়েছে ৩০৬টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৫৩১ জনকে। এদের মধ্যে আটক হয়েছে ৪৭৭ জন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে থাইল্যান্ডে গণকবরে বাংলাদেশী লোকজনের লাশ উদ্ধারের ঘটনা।
উপকূলের পাঁচ হাজারেরও বেশি শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধের কোন খোঁজ নেই। আবার অনেককে অপহরণ করেই নিয়ে যাওয়া হয় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। সেখানে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ই তাদের উদ্দেশ্য। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের আর মালয়েশিয়ায় পৌঁছা হয় না। হয় দালালদের নির্যাতনে মাঝ দরিয়াতেই মারা পড়ে, নয়তো ঠাঁই হয় থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে। পাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার বদলে তাদের সেখানে বন্দি করে। তাদের হত্যার হুমকি দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করে মোটা অঙ্কের টাকা। তবে টাকা দিলেও অনেক সময় মুক্তি মেলে না। তাদের হত্যা করে কবর দেয়া হয় গহিন বনেই। আর থাইল্যান্ডের গহিন বনে একের পর এক গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় কক্সবাজার উপকূলের নিখোঁজ এই পাঁচ হাজারেরও বেশি পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২০১২ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ১৩২ জন অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় আটক করে ৮৬ জন পাচারকারীর দলের সদস্যকে। এ ব্যাপারে ১৭৭ জনকে আসামি করে ২৭টি মামলা লিপিবদ্ধ করা হয়।
২০১৩ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ১০২৮ জন অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় আটক করে ১১৩ জন পাচারকারীর দলের সদস্যকে। এ ব্যাপারে ৪২৭ জনকে আসামি করে ৮১টি মামলা লিপিবদ্ধ করা হয়।
২০১৪ সালের ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ২৩৫ জন অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় আটক করে ৬৩ জন পাচারকারীর দলের সদস্যকে। এ ব্যাপারে ১৯০ জনকে আসামি করে ৫৮টি মামলা করা হয়।
পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী সূত্র জানায়, গত ২রা এপ্রিল রাতে মালয়েশিয়াগামীদের উদ্ধার করতে গিয়ে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিনড্রাইভ সড়কের রামু উপজেলার হিমছড়ি পাহাড়ে বন্যহাতির আক্রমণে ১৭ বিজিবির সদস্য ল্যান্স নায়েক হাবিবুর রহমান নিহত হয়।
এ বছরের ২৯শে জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেলের খোদাইবাড়ি পয়েন্টে দেড়শ যাত্রী নিয়ে এফভি ইদ্রিস নামে একটি ট্রলার ডুবে যায়। সন্ধ্যা নাগাদ ডুবে যাওয়া ট্রলারসহ ৪২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এক দিন পর শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টায় কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও স্থানীয়রা যৌথ অভিযান চালিয়ে ৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। একইদিন বিকালে ১ জনের মৃতদেহ ও তারপরের দিন আরও ১ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে মহেশখালী থানা পুলিশ। এ ঘটনায় ১১ দালালের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে মামলা করেছে পুলিশ। অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে গত বছরের ১৭ই নভেম্বর ৬২০ জনকে আটক করে নৌবাহিনী।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের ৫০ নটিক্যাল মাইল অদূরে মিয়ানমারের পতাকাবাহী একটি ট্রলার থেকে তাদের আটক করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে ৫৫৫ জন পুরুষ, ৩১ জন নারী, ২৬ শিশুসহ ৬ জন পাচারকারী ও দুজন দালাল চক্রের সদস্য। এদের মধ্যে ২১ জন মিয়ানমারের নাগরিকও ছিল। এ ঘটনায় নৌবাহিনী দুটি মামলা দায়ের করে। ২০১৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে চকরিয়া পৌরসভার পালাকাটা এলাকা থেকে ১৯ জনকে আটক করে পুলিশ। দালালরা তাদের কাছ থেকে মাথাপিছু ১০-১৫ হাজার টাকা করে নিয়ে কক্সবাজার নিয়ে আসে এ সময় আটককৃতরা জানান। পরে রাতে সাগরে নিয়ে তাদের দস্যুদের হাতে তুলে দেয়। দস্যুরা তাদের টাকা-পয়সা লুট করে ছেড়ে দেয়।
২০১৪ সালের ১১ই জুন ৩১৮ জন যাত্রী নিয়ে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সেন্টমার্টিনের অদূরে বঙ্গোপসাগরে দালালদের নিযুক্ত বিদেশী সন্ত্রাসীদের গুলিতে পাঁচজন নিহত হন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন আরও ৬৩ যাত্রী। পরে কোস্টগার্ডের সদস্যরা সাগর থেকে হতাহত যাত্রীদের উদ্ধার করে। গত বছরের ৪ঠা আগস্ট শহরের নাজিরাটেক উপকূলে শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার বিধ্বস্ত হয়। এতে এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। তার আগে গত বছরের ১১ই ফেব্রুয়ারি কোস্টগার্ড সদস্যরা সেন্টমার্টিন এলাকা থেকে ২১১ যাত্রীবোঝাই দুটি ট্রলার জব্দ করে। এসব যাত্রীর মধ্যে মিয়ানমারের ২০ জন নারী ও ১৭ জন শিশু ছিল।
২০১২ সালের ৭ই নভেম্বর টেকনাফ উপকূলে ১১০ জন যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় আরেকটি ট্রলার। পরদিন নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও বিজিবির সদস্যরা সমুদ্রে তল্লাশি চালিয়ে ২৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করলেও নিখোঁজ হন ৮২ জন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি আরও জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দালালরা লোকজন সংগ্রহ করে ট্রলারে করে মালয়েশিয়ার কথা বলে নিয়ে যায় থাইল্যান্ড উপকূলে। সেখানে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করা হয় জনপ্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। তারপর মুক্তিপণ আদায়ে চলে নির্মম ও অমানবিক নির্যাতন।
জেলা পুলিশের তথ্য মতে, শহরের নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরাটেক, সমিতিপাড়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটা, উখিয়ার সোনারপাড়া, রেজুরখাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী, টেকনাফের বাহারছড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, ঘোলারপাড়া, মাঝরপাড়া, পশ্চিমপাড়া, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া, শামলাপুর, সদরের ঈদগাঁও, খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, পিএমখালী, চকরিয়া, পেকুয়ার ৬০টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ পাচার করা হচ্ছে।
আর এসব পাচারকারী দেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকদের লোভ দেখিয়ে মালয়েশিয়ায় যেতে উদ্বুদ্ধ করে। শুরুতে তাদের কাছ থেকে কোন টাকা-পয়সা নেয়া না হলেও মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডে পৌঁছতে পারলে সেখানে থাকা পাচারকারী চক্র টাকা আদায় করে।
কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বলেন, উদ্ধার হওয়া মালয়েশিয়াগামীরা দালালদের চেনে না। আবার দালালরা একজন আরেকজনকে চেনে না। এর ফলে তথ্য পেতে সমস্যা হয়। যারা ধরা পড়ে তাদের বাইরে তথ্য পাওয়া যায় না।
কক্সবাজারস্থ বিজিবি-১৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুজ্জামান বলেন, মানব পাচার রোধে সামাজিকভাবে সচেতনতা জরুরি। এজন্য তিনি জনপ্রতিনিধি, সামাজিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও মন্দিরের পুরোহিত সর্বোপরি সমাজের সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, মানব পাচার সামাজিক ব্যাধি। এ থেকে রক্ষা পেতে সমাজের সকল স্তরের লোকজনকে এগিয়ে আসতে হবে। কক্সবাজারস্থ বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল খালেকুজ্জামান বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে পাচার রোধ সম্ভব নয়। এটি রোধ করতে হলে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মানব পাচারের ক্ষতিকর বিষয়গুলো জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে। বিজিবি প্রতি মাসেই এরকম সভা করে সচেতনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
জানা গেছে, ঝুঁকি আর অমানবিক নির্যাতন সয়ে স্বপ্নের মালয়েশিয়া যাত্রা নতুন কোন ঘটনা নয়। গত ৩ বছর ধরে চলে আসছে এসব ঘটনা। এ সময়ে সাগরে ট্রলার ডুবিতে পাচ শতাধিক মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে দুই হাজারেরও বেশি। পাচারকারীর গুলিতে নিহতও হয়েছে অনেকই। উদ্ধার হয়েছে ২৯৪৫ জন যাত্রী। আর একই সময়ে মানব পাচার আইনে মামলা হয়েছে ৩০৬টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৫৩১ জনকে। এদের মধ্যে আটক হয়েছে ৪৭৭ জন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে থাইল্যান্ডে গণকবরে বাংলাদেশী লোকজনের লাশ উদ্ধারের ঘটনা।
উপকূলের পাঁচ হাজারেরও বেশি শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধের কোন খোঁজ নেই। আবার অনেককে অপহরণ করেই নিয়ে যাওয়া হয় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। সেখানে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ই তাদের উদ্দেশ্য। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের আর মালয়েশিয়ায় পৌঁছা হয় না। হয় দালালদের নির্যাতনে মাঝ দরিয়াতেই মারা পড়ে, নয়তো ঠাঁই হয় থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে। পাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার বদলে তাদের সেখানে বন্দি করে। তাদের হত্যার হুমকি দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করে মোটা অঙ্কের টাকা। তবে টাকা দিলেও অনেক সময় মুক্তি মেলে না। তাদের হত্যা করে কবর দেয়া হয় গহিন বনেই। আর থাইল্যান্ডের গহিন বনে একের পর এক গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় কক্সবাজার উপকূলের নিখোঁজ এই পাঁচ হাজারেরও বেশি পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২০১২ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ১৩২ জন অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় আটক করে ৮৬ জন পাচারকারীর দলের সদস্যকে। এ ব্যাপারে ১৭৭ জনকে আসামি করে ২৭টি মামলা লিপিবদ্ধ করা হয়।
২০১৩ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ১০২৮ জন অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় আটক করে ১১৩ জন পাচারকারীর দলের সদস্যকে। এ ব্যাপারে ৪২৭ জনকে আসামি করে ৮১টি মামলা লিপিবদ্ধ করা হয়।
২০১৪ সালের ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ২৩৫ জন অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় আটক করে ৬৩ জন পাচারকারীর দলের সদস্যকে। এ ব্যাপারে ১৯০ জনকে আসামি করে ৫৮টি মামলা করা হয়।
পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী সূত্র জানায়, গত ২রা এপ্রিল রাতে মালয়েশিয়াগামীদের উদ্ধার করতে গিয়ে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিনড্রাইভ সড়কের রামু উপজেলার হিমছড়ি পাহাড়ে বন্যহাতির আক্রমণে ১৭ বিজিবির সদস্য ল্যান্স নায়েক হাবিবুর রহমান নিহত হয়।
এ বছরের ২৯শে জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেলের খোদাইবাড়ি পয়েন্টে দেড়শ যাত্রী নিয়ে এফভি ইদ্রিস নামে একটি ট্রলার ডুবে যায়। সন্ধ্যা নাগাদ ডুবে যাওয়া ট্রলারসহ ৪২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এক দিন পর শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টায় কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও স্থানীয়রা যৌথ অভিযান চালিয়ে ৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। একইদিন বিকালে ১ জনের মৃতদেহ ও তারপরের দিন আরও ১ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে মহেশখালী থানা পুলিশ। এ ঘটনায় ১১ দালালের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে মামলা করেছে পুলিশ। অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে গত বছরের ১৭ই নভেম্বর ৬২০ জনকে আটক করে নৌবাহিনী।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের ৫০ নটিক্যাল মাইল অদূরে মিয়ানমারের পতাকাবাহী একটি ট্রলার থেকে তাদের আটক করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে ৫৫৫ জন পুরুষ, ৩১ জন নারী, ২৬ শিশুসহ ৬ জন পাচারকারী ও দুজন দালাল চক্রের সদস্য। এদের মধ্যে ২১ জন মিয়ানমারের নাগরিকও ছিল। এ ঘটনায় নৌবাহিনী দুটি মামলা দায়ের করে। ২০১৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে চকরিয়া পৌরসভার পালাকাটা এলাকা থেকে ১৯ জনকে আটক করে পুলিশ। দালালরা তাদের কাছ থেকে মাথাপিছু ১০-১৫ হাজার টাকা করে নিয়ে কক্সবাজার নিয়ে আসে এ সময় আটককৃতরা জানান। পরে রাতে সাগরে নিয়ে তাদের দস্যুদের হাতে তুলে দেয়। দস্যুরা তাদের টাকা-পয়সা লুট করে ছেড়ে দেয়।
২০১৪ সালের ১১ই জুন ৩১৮ জন যাত্রী নিয়ে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সেন্টমার্টিনের অদূরে বঙ্গোপসাগরে দালালদের নিযুক্ত বিদেশী সন্ত্রাসীদের গুলিতে পাঁচজন নিহত হন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন আরও ৬৩ যাত্রী। পরে কোস্টগার্ডের সদস্যরা সাগর থেকে হতাহত যাত্রীদের উদ্ধার করে। গত বছরের ৪ঠা আগস্ট শহরের নাজিরাটেক উপকূলে শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার বিধ্বস্ত হয়। এতে এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। তার আগে গত বছরের ১১ই ফেব্রুয়ারি কোস্টগার্ড সদস্যরা সেন্টমার্টিন এলাকা থেকে ২১১ যাত্রীবোঝাই দুটি ট্রলার জব্দ করে। এসব যাত্রীর মধ্যে মিয়ানমারের ২০ জন নারী ও ১৭ জন শিশু ছিল।
২০১২ সালের ৭ই নভেম্বর টেকনাফ উপকূলে ১১০ জন যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় আরেকটি ট্রলার। পরদিন নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও বিজিবির সদস্যরা সমুদ্রে তল্লাশি চালিয়ে ২৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করলেও নিখোঁজ হন ৮২ জন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি আরও জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দালালরা লোকজন সংগ্রহ করে ট্রলারে করে মালয়েশিয়ার কথা বলে নিয়ে যায় থাইল্যান্ড উপকূলে। সেখানে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করা হয় জনপ্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। তারপর মুক্তিপণ আদায়ে চলে নির্মম ও অমানবিক নির্যাতন।
জেলা পুলিশের তথ্য মতে, শহরের নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরাটেক, সমিতিপাড়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটা, উখিয়ার সোনারপাড়া, রেজুরখাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী, টেকনাফের বাহারছড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, ঘোলারপাড়া, মাঝরপাড়া, পশ্চিমপাড়া, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া, শামলাপুর, সদরের ঈদগাঁও, খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, পিএমখালী, চকরিয়া, পেকুয়ার ৬০টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ পাচার করা হচ্ছে।
আর এসব পাচারকারী দেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকদের লোভ দেখিয়ে মালয়েশিয়ায় যেতে উদ্বুদ্ধ করে। শুরুতে তাদের কাছ থেকে কোন টাকা-পয়সা নেয়া না হলেও মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডে পৌঁছতে পারলে সেখানে থাকা পাচারকারী চক্র টাকা আদায় করে।
কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বলেন, উদ্ধার হওয়া মালয়েশিয়াগামীরা দালালদের চেনে না। আবার দালালরা একজন আরেকজনকে চেনে না। এর ফলে তথ্য পেতে সমস্যা হয়। যারা ধরা পড়ে তাদের বাইরে তথ্য পাওয়া যায় না।
কক্সবাজারস্থ বিজিবি-১৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুজ্জামান বলেন, মানব পাচার রোধে সামাজিকভাবে সচেতনতা জরুরি। এজন্য তিনি জনপ্রতিনিধি, সামাজিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও মন্দিরের পুরোহিত সর্বোপরি সমাজের সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, মানব পাচার সামাজিক ব্যাধি। এ থেকে রক্ষা পেতে সমাজের সকল স্তরের লোকজনকে এগিয়ে আসতে হবে। কক্সবাজারস্থ বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল খালেকুজ্জামান বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে পাচার রোধ সম্ভব নয়। এটি রোধ করতে হলে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মানব পাচারের ক্ষতিকর বিষয়গুলো জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে। বিজিবি প্রতি মাসেই এরকম সভা করে সচেতনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
No comments