পূর্ণ গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা: কিছু প্রস্তাবনা
দেশের
দুই প্রধান রাজনৈতিক দল কর্তৃক নির্বাচনের ওপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপের ফলে
অর্থবহ ও পূর্ণ গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশের অভিযাত্রা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত
হয়ে পড়েছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন
অবশ্যই একমাত্র সাংবিধানিক, আইনসিদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি। নির্বাচনের
মাধ্যমে বৈধতা ও ম্যান্ডেট প্রাপ্ত হয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ গণতান্ত্রিক
শাসনব্যবস্থার শুভ সূচনা করে থাকেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তাই অবাধ, সুষ্ঠু
ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য। তবে কার্যকর ও অর্থবহ গণতান্ত্রিক
ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুধু নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। আর একথা বলার
অপেক্ষা রাখে না যে, নির্বাচনের ওপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপের কারণে আমাদের
সংবিধানের ১১ ধারায় অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশকে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জনআকাক্সক্ষা অনেকটাই অপূর্ণ রয়ে গেছে।
বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, সিভিল সার্ভিস ও গণমাধ্যমের মতো বেশ কয়েকটি পরীক্ষিত ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রেই পেয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের নেতৃবৃন্দ, স্বজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে, এটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, নির্বাচনের পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক হিসেবে গড়ে তোলা, দায়িত্বশীল বিরোধী দলের উপস্থিতি এবং বৃহত্তর স্বার্থে অতীত ও বর্তমানের কিছু কিছু বিষয়ে আপস-মীমাংসার মানসিকতা থাকা গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য অপরিহার্য। বরং তারা তাদের ক্ষমতাবৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে গণতন্ত্রকে সেøাগান হিসেবে ব্যবহার করছেন এবং শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানসমূহকে এই অভিলাষ বাস্তবায়নের পথে বাধা হিসেবেই দেখছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাদেরকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করে, যার অনিবার্য পরিণতি এসব প্রতিষ্ঠানের নগ্ন দলীয়করণ। এই প্রক্রিয়ার অশুভ ফলাফল সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও সঞ্চালিত হয় এবং যে কোন উপায়ে নির্বাচনে জয়লাভ রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য জীবন-মরণ সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
১৯৯১ সালে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের পর থেকে আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া যেন অবিশ্বাস, কূটকৌশল, সন্ত্রাস, টাকার খেলা, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রাণঘাতী দ্বন্দ্ব এবং শেষমেশ যে কোনভাবে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান- এই অশুভ চক্রের মধ্যে আটকে পড়েছে। পাঁচ বছর পর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ১৯৯১ সালের পর থেকে এ যাবত অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনের মধ্যে দুটিতেই নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নটির মীমাংসা অনেক নিরপরাধ জীবন ও সরকারি সম্পত্তি বিনষ্টের বিনিময়ে সম্ভব হয়েছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে আবার নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই একেবারে বিলুপ্ত করে দেয়, যার বিরোধিতা বিরোধী দল অব্যাহতভাবেই করে আসছিল। এই বিলুপ্তি বিরোধী দলকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য আন্দোলনে নামতে বাধ্য করে। শুরুতে এ আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও সরকারের অনমনীয় অবস্থানের কারণে তা ক্রমান্বয়ে সহিংস রূপ নেয়। তবে বিরোধীদলের এই আন্দোলন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা বিরোধী জোটকে চলতি বছরের ৫ই জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী নির্বিচার সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিরীহ জনগণের জীবননাশের দিকে ধাবিত করে। তবে এ আন্দোলন যেমন সরকারকে সন্ত্রস্ত করতে পারেনি, তেমনি বিরোধী জোটও তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হয়নি।
সন্ত্রাসের ফলে সংঘটিত হতাহতের ঘটনা ছিল অভূতপূর্ব। এই বর্বরোচিত কর্মকা- দরিদ্র জনগণকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কৃষক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীগণ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় চরম সংকটের সম্মুখীন হন। দেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, কারণ তারা তাদের নির্ধারিত প্রাত্যহিক শিক্ষাক্রম কিংবা সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছিল না। দেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদে এই ক্ষতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। আরও আশঙ্কার বিষয় এই যে, দেশের নাগরিকদের নির্দ্বিধায় ও নির্ভয়ে তাদের উদ্বেগ ও মতামত প্রকাশের সুযোগ আজ অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। বস্তুত, নাগরিকদের কণ্ঠস্বর এখন অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনই আজ গুরুতর হুমকির মুখে পড়েছে, যা আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয়।
আমরা একদল নিরপেক্ষ উদ্বিগ্ন নাগরিক নিজেদের বিবেক ও সম্মিলিত দায়িত্ববোধের তাগিদে দেশের এই দুঃসহ রাজনৈতিক সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতির সামনে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা প্রকাশে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। ১৯৯১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা জানি যে, প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে একটি অস্থায়ী নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা আমাদের এই জটিল রাজনৈতিক সংকটের একটি সাময়িক ও অতি সরলীকৃত সমাধান মাত্র। কিন্তু এই সমস্যার শেকড় আমাদের জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক গতিধারার আরও গভীরে প্রোথিত। বাংলাদেশের জনগণ দেশের নেতিবাচক রাজনীতিতে আজ অতিষ্ঠ এবং তারা এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চায়। তাই আমাদের প্রস্তাবনার মূল লক্ষ্য হলো, দেশের বিদ্যমান সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসনকল্পে একটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা। আমরা এই পৌনঃপুনিক সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সমস্যা থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে চাই, এবং তা করা দরকার সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের মাধ্যমে। নয়তো আমাদের আশঙ্কা যে, এই নির্বাচনী গণতন্ত্রের উৎপীড়ন (ঃুৎধহহু ড়ভ বষবপঃড়ৎধষ ফবসড়পৎধপু) আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার এক স্থায়ী দুষ্টক্ষততে পরিণত হবে।
আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলসমূহকেই পরিবর্তনের মূল রূপকার হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সে জন্য রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলসমূহকে সংবেদনশীল ও দায়িত্ববান হতে হবে এবং সংকট উত্তরণে এসব প্রস্তাবনা অথবা সকলকে সম্পৃক্ত করে সৃষ্ট অনুরূপ একটি ‘পথ নির্দেশিকা’ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা নিশ্চিত যে, একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজল্পের বাংলাদেশী নাগরিক। রাজনৈতিক কর্মকা-ে সাধারণ নাগরিকদের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হলে রাজনৈতিক দলসমূহও জনগণের শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে।
আমাদের প্রস্তাবনা :
উপরোক্ত সূচনা বক্তব্যের আলোকে এবং বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের জটিলতা ও স্পর্শকাতরতা অনুধাবন করে আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ একটি সীমিত কর্মসূচির প্রস্তাবনা প্রকাশ করতে চাই। বর্তমান সংকটের দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানকল্পে সংবিধানের কিছু সংশোধনী ও বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে আমরা নিম্নের প্রস্তাবনা পেশ করছি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, প্রস্তাবিত সংস্কারসমূহ বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধন করবে। আমাদের প্রস্তাবনা দুটি বড় ভাগে বিভাজন করা যেতে পারে: (১) সংবিধানের সংশোধনী ও (২) প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্বিন্যাস।
আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ বিশ্বাস করি যে, সকলের অংশগ্রহণ ও আলোচনার স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংবিধানের সংশোধন ও প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্বিন্যাসের বিষয়ে আরও বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এই অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি বেরিয়ে আসবে। আমরা আশা করি যে, প্রধান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণে সম্মত হবেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রধান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে, যদিও বিষয়ের প্রকৃতি ও জটিলতা বিবেচনা করে অন্যান্য স্বার্থ-সংশ্লিষ্টদেরও এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ প্রয়োজনে এক্ষেত্রে একটি গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।
আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, শাসন ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা ও ন্যায়পরায়নতা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের আস্থা মূলত নির্ভর করে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকার ও একই পর্যায়ের বিভিন্ন নির্বাহীর মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের যথোপযুক্ত বণ্টনের ওপর। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে আরও অধিকতর কার্যকর ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য (পযবপশং ধহফ নধষধহপবং) নির্দিষ্ট করা জরুরি। একইসঙ্গে জরুরি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভূমিকা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে সেগুলো পরিচালনার জন্য উপযুক্ত আইনি বিধানের প্রবর্তন। প্রাথমিক পর্যায়ে আইনজ্ঞ ও প্রথিতযশা পার্লামেন্টেরিয়ান, শিক্ষাবিদ, সংসদ ও সংসদের বাইরের বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতা এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে একটি ‘বিশেষজ্ঞ কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে। কমিশন প্রণীত সুপারিশমালা পার্লামেন্টে বিবেচিত ও আলোচিত হতে পারে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে পারেন।
বাংলাদেশের সামনে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নিম্নেবর্ণিত বিষয়াদির ওপর অধিক মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয় (পূর্ণাঙ্গ তালিকা নহে)
১. রাষ্ট্রপতি পদের পূর্ণ স্বাধীনতা; রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের পদ্ধতি; প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ
২. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য (পযবপশং ধহফ নধষধহপবং):
ক) যে সমস্ত বিষয়ে রাষ্ট্রপতির নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকবে।
খ) রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ক্ষমতা, ঐচ্ছিক ক্ষমতা ও ভিন্নমত প্রদানের ক্ষমতা।
গ) প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য ও দায়িত্ব পুনঃনির্ধারণ।
ঘ) দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের উপযোগিতা।
৩. নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে নতুন ভাবনা: বিদ্যমান ফার্স্ট পাস্ট দি পোস্ট পদ্ধতি, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কিংবা মিশ্র পদ্ধতি।
৪. সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভূমিকা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে সেগুলো পরিচালনের জন্য উপযুক্ত আইনি বিধান।
৫. সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা রেখে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক সংসদীয় আসন সংরক্ষণ।
৬. নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, ক্ষমতা ও সম্পদ হস্তান্তর এবং সেই লক্ষ্যে কার্যকর আইনি বিধান।
৭. সংসদীয় আসনের ভোটারগণ কর্তৃক তাদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে প্রত্যাহারের বিধান।
৮. সংবিধানের ৭০ ধারায় দলীয় সংসদ সদস্যদের সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট প্রদানে যে বাধা আরোপিত আছে তা রহিতকরণ।
৯. জাতীয় ও স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির ওপর গণভোট গ্রহণের আবশ্যিক বিধান।
প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়াদি
আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ মনে করি, রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুনরুজ্জীবিত ও শক্তিশালী করা এবং এগুলোকে সকল ধরনের দলীয় ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা প্রয়োজন। এসব প্রতিষ্ঠান যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো বিনির্মাণের অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ। এগুলো হলো গণতান্ত্রিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সোপান এবং এগুলোর স্বাধীন ও দায়বদ্ধভাবে কাজ করার জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক। নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান, তাদের নাগরিক অধিকারসমূহ সমুন্নত রাখা, সরকারকে জবাবদিহি করা তথা সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার ভিত্তিতে উপযুক্ত লোক নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়নসহ গণশুনানির ব্যবস্থা করা দরকার। প্রশাসনিক, সংসদীয় ও নাগরিক সমাজ কর্তৃক যথাযথ নিরীক্ষা এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য এগুলোর শীর্ষ পদে পেশাদার ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সুনামসম্পন্ন ও জনবান্ধব ব্যক্তিদেরকে নিয়োগ দেয়া আবশ্যক। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এসব কর্মকর্তাগণ একটি গ্রহণযোগ্য প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবেন এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্রাঞ্চের নিম্নোক্ত সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ সংস্থাসমূহ সংস্কারের জন্য নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। (এটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়)
১. জাতীয় সংসদ
২. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
৩. বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন
৪. সরকারি কর্ম কমিশন
৫. দুর্নীতি দমন কমিশন
৬. তথ্য কমিশন
৭. মানবাধিকার কমিশন
গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশও অতীব জরুরি। রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সংস্কার প্রচেষ্টা নিম্নলিখিত বিষয়াদির মধ্যে নিবিষ্ট করা যেতে পারে:
৮. রাষ্ট্র-বহির্ভূত (হড়হ-ংঃধঃব) প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনৈতিক দল:
ক. রাজনৈতিক দলসমূহের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা
খ. দলসমূহের আর্থিক স্বচ্ছতা
গ. শিক্ষক, ছাত্র, পেশাজীবী সংগঠন এবং সরকারি স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত ও বিধিবদ্ধ সংস্থাসমূহের অথবা বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসমূহকে দলের কাঠামো থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্তকরণ
ঘ. রাজনৈতিক দলসমূহের বিদেশী শাখা বিলুপ্তকরণ
ঙ. দলের নেতৃবৃন্দের সাধারণ সদস্যদের নিকট জবাবদিহিতা
চ. দলের নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন এবং দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সাধারণ সদস্যদের ভূমিকা
ছ. দলীয় কমিটিসমূহে নারীদের যৌক্তিক প্রতিনিধিত্ব
স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহেরও জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। এসব প্রতিষ্ঠানের নিম্নোক্ত সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে:
৯. স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ:
ক. একটি বিকেন্দ্রীকরণ নীতি প্রণয়ন এবং ওই নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে আইনের পুনর্বিন্যাস
খ. স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের কাঠামো ও নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার
গ. স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণ
ঘ. দায়িত্ব ও কর্তব্য হস্তান্তর
ঙ. কর্মকর্তা ও কর্মচারী হস্তান্তর
চ. স্থানীয় সরকার কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক জাতীয় বাজেটের একটি অংশ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর
ছ. সুনির্দিষ্ট ম্যান্ডেটসহ স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন
জ. সংরক্ষিত আসন পদ্ধতির সংস্কার
ঞ. স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের অধিক্ষেত্র অন্য কর্তৃপক্ষের আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখা
১০. নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম:
শাসন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি বলিষ্ঠ ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ এবং স্বাধীন গণমাধ্যম বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টির গুরুত্বও অপরিসীম। সেই লক্ষ্যে একটি যথোপযুক্ত আইনি কাঠামো প্রয়োজন, যাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নিম্নোক্ত বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত থাকবে:
ক. কর্তৃপক্ষীয় ভয়-ভীতি মুক্ত একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতকরণ
খ. নাগরিক সমাজ যাতে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে তাদের কার্যপরিধি সঙ্কুচিত করার প্রচেষ্টাকে নিবৃতকরণ
গ. নাগরিক সমাজের বিভক্তিকরণে ‘ক্রনিজম’ বা কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের বিলোপ সাধন
ঘ. নাগরিক সমাজের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন
ঙ. গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অর্থবহ বিকাশের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
চ. প্রেস ইন্সটিটিউট-এর প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন
উপসংহার
অনেক প্রতিকূলতার মুখে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ অতীতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এবং অনেক বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক দলসমূহ গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে একটি ‘যৌথ ঘোষণা’ প্রণয়ন করেছিল। আমরা আশা করি যে, আমাদের রাজনীতিবিদগণ আবারও সাহসিকতা ও প্রজ্ঞা প্রদর্শন করে দেশে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ সমাধানে ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবেন এবং বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য একটি কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবেন। এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি জাতীয় সনদ প্রস্তুত হতে পারে, যেটি সংশ্লিষ্ট সকলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে একটি নতুন সামাজিক চুক্তিতে পরিণত হবে।
আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ বিশ্বাস করি যে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস ও সহনশীলতা সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। আমরা আরও বিশ্বাস করি যে, আমাদের অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদগণ এ ধরনের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম- কারণ অতীতে এ ধরনের সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের বহু নিদর্শন তারা দেখেছেন। আজ সময় এসেছে বিভাজনের রাজনীতিকে পেছনে ফেলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অন্তর্ভুক্তিকরণ ও সমঝোতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। অতীতের বিভেদ ও প্রতিবন্ধকতাসমূহের ঊর্ধ্বে উঠে সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য বর্তমান সময়ের চাইতে ভাল সময় আর হতে পারে না। কতগুলো সুস্পষ্ট মূল্যবোধে বিশ্বাস ১৬ কোটি বাংলাদেশীর এই দেশটিকে বিশ্বসভায় তার যথোপযুক্ত স্থানে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এখন ভবিষ্যতের দিকে আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করতেই হবে।
উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের পক্ষে ১০ মে ২০১৫ তারিখে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত।
বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, সিভিল সার্ভিস ও গণমাধ্যমের মতো বেশ কয়েকটি পরীক্ষিত ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রেই পেয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের নেতৃবৃন্দ, স্বজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে, এটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, নির্বাচনের পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক হিসেবে গড়ে তোলা, দায়িত্বশীল বিরোধী দলের উপস্থিতি এবং বৃহত্তর স্বার্থে অতীত ও বর্তমানের কিছু কিছু বিষয়ে আপস-মীমাংসার মানসিকতা থাকা গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য অপরিহার্য। বরং তারা তাদের ক্ষমতাবৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে গণতন্ত্রকে সেøাগান হিসেবে ব্যবহার করছেন এবং শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানসমূহকে এই অভিলাষ বাস্তবায়নের পথে বাধা হিসেবেই দেখছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাদেরকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করে, যার অনিবার্য পরিণতি এসব প্রতিষ্ঠানের নগ্ন দলীয়করণ। এই প্রক্রিয়ার অশুভ ফলাফল সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও সঞ্চালিত হয় এবং যে কোন উপায়ে নির্বাচনে জয়লাভ রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য জীবন-মরণ সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
১৯৯১ সালে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের পর থেকে আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া যেন অবিশ্বাস, কূটকৌশল, সন্ত্রাস, টাকার খেলা, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রাণঘাতী দ্বন্দ্ব এবং শেষমেশ যে কোনভাবে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান- এই অশুভ চক্রের মধ্যে আটকে পড়েছে। পাঁচ বছর পর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ১৯৯১ সালের পর থেকে এ যাবত অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনের মধ্যে দুটিতেই নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নটির মীমাংসা অনেক নিরপরাধ জীবন ও সরকারি সম্পত্তি বিনষ্টের বিনিময়ে সম্ভব হয়েছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে আবার নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই একেবারে বিলুপ্ত করে দেয়, যার বিরোধিতা বিরোধী দল অব্যাহতভাবেই করে আসছিল। এই বিলুপ্তি বিরোধী দলকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য আন্দোলনে নামতে বাধ্য করে। শুরুতে এ আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও সরকারের অনমনীয় অবস্থানের কারণে তা ক্রমান্বয়ে সহিংস রূপ নেয়। তবে বিরোধীদলের এই আন্দোলন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা বিরোধী জোটকে চলতি বছরের ৫ই জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী নির্বিচার সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিরীহ জনগণের জীবননাশের দিকে ধাবিত করে। তবে এ আন্দোলন যেমন সরকারকে সন্ত্রস্ত করতে পারেনি, তেমনি বিরোধী জোটও তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হয়নি।
সন্ত্রাসের ফলে সংঘটিত হতাহতের ঘটনা ছিল অভূতপূর্ব। এই বর্বরোচিত কর্মকা- দরিদ্র জনগণকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কৃষক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীগণ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় চরম সংকটের সম্মুখীন হন। দেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, কারণ তারা তাদের নির্ধারিত প্রাত্যহিক শিক্ষাক্রম কিংবা সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছিল না। দেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদে এই ক্ষতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। আরও আশঙ্কার বিষয় এই যে, দেশের নাগরিকদের নির্দ্বিধায় ও নির্ভয়ে তাদের উদ্বেগ ও মতামত প্রকাশের সুযোগ আজ অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। বস্তুত, নাগরিকদের কণ্ঠস্বর এখন অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনই আজ গুরুতর হুমকির মুখে পড়েছে, যা আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয়।
আমরা একদল নিরপেক্ষ উদ্বিগ্ন নাগরিক নিজেদের বিবেক ও সম্মিলিত দায়িত্ববোধের তাগিদে দেশের এই দুঃসহ রাজনৈতিক সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতির সামনে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা প্রকাশে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। ১৯৯১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা জানি যে, প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে একটি অস্থায়ী নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা আমাদের এই জটিল রাজনৈতিক সংকটের একটি সাময়িক ও অতি সরলীকৃত সমাধান মাত্র। কিন্তু এই সমস্যার শেকড় আমাদের জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক গতিধারার আরও গভীরে প্রোথিত। বাংলাদেশের জনগণ দেশের নেতিবাচক রাজনীতিতে আজ অতিষ্ঠ এবং তারা এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চায়। তাই আমাদের প্রস্তাবনার মূল লক্ষ্য হলো, দেশের বিদ্যমান সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসনকল্পে একটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা। আমরা এই পৌনঃপুনিক সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সমস্যা থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে চাই, এবং তা করা দরকার সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের মাধ্যমে। নয়তো আমাদের আশঙ্কা যে, এই নির্বাচনী গণতন্ত্রের উৎপীড়ন (ঃুৎধহহু ড়ভ বষবপঃড়ৎধষ ফবসড়পৎধপু) আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার এক স্থায়ী দুষ্টক্ষততে পরিণত হবে।
আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলসমূহকেই পরিবর্তনের মূল রূপকার হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সে জন্য রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলসমূহকে সংবেদনশীল ও দায়িত্ববান হতে হবে এবং সংকট উত্তরণে এসব প্রস্তাবনা অথবা সকলকে সম্পৃক্ত করে সৃষ্ট অনুরূপ একটি ‘পথ নির্দেশিকা’ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা নিশ্চিত যে, একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজল্পের বাংলাদেশী নাগরিক। রাজনৈতিক কর্মকা-ে সাধারণ নাগরিকদের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হলে রাজনৈতিক দলসমূহও জনগণের শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে।
আমাদের প্রস্তাবনা :
উপরোক্ত সূচনা বক্তব্যের আলোকে এবং বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের জটিলতা ও স্পর্শকাতরতা অনুধাবন করে আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ একটি সীমিত কর্মসূচির প্রস্তাবনা প্রকাশ করতে চাই। বর্তমান সংকটের দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানকল্পে সংবিধানের কিছু সংশোধনী ও বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে আমরা নিম্নের প্রস্তাবনা পেশ করছি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, প্রস্তাবিত সংস্কারসমূহ বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধন করবে। আমাদের প্রস্তাবনা দুটি বড় ভাগে বিভাজন করা যেতে পারে: (১) সংবিধানের সংশোধনী ও (২) প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্বিন্যাস।
আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ বিশ্বাস করি যে, সকলের অংশগ্রহণ ও আলোচনার স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংবিধানের সংশোধন ও প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্বিন্যাসের বিষয়ে আরও বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এই অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি বেরিয়ে আসবে। আমরা আশা করি যে, প্রধান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণে সম্মত হবেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রধান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে, যদিও বিষয়ের প্রকৃতি ও জটিলতা বিবেচনা করে অন্যান্য স্বার্থ-সংশ্লিষ্টদেরও এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ প্রয়োজনে এক্ষেত্রে একটি গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।
আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, শাসন ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা ও ন্যায়পরায়নতা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের আস্থা মূলত নির্ভর করে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকার ও একই পর্যায়ের বিভিন্ন নির্বাহীর মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের যথোপযুক্ত বণ্টনের ওপর। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে আরও অধিকতর কার্যকর ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য (পযবপশং ধহফ নধষধহপবং) নির্দিষ্ট করা জরুরি। একইসঙ্গে জরুরি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভূমিকা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে সেগুলো পরিচালনার জন্য উপযুক্ত আইনি বিধানের প্রবর্তন। প্রাথমিক পর্যায়ে আইনজ্ঞ ও প্রথিতযশা পার্লামেন্টেরিয়ান, শিক্ষাবিদ, সংসদ ও সংসদের বাইরের বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতা এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে একটি ‘বিশেষজ্ঞ কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে। কমিশন প্রণীত সুপারিশমালা পার্লামেন্টে বিবেচিত ও আলোচিত হতে পারে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে পারেন।
বাংলাদেশের সামনে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নিম্নেবর্ণিত বিষয়াদির ওপর অধিক মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয় (পূর্ণাঙ্গ তালিকা নহে)
১. রাষ্ট্রপতি পদের পূর্ণ স্বাধীনতা; রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের পদ্ধতি; প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ
২. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য (পযবপশং ধহফ নধষধহপবং):
ক) যে সমস্ত বিষয়ে রাষ্ট্রপতির নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকবে।
খ) রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ক্ষমতা, ঐচ্ছিক ক্ষমতা ও ভিন্নমত প্রদানের ক্ষমতা।
গ) প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য ও দায়িত্ব পুনঃনির্ধারণ।
ঘ) দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের উপযোগিতা।
৩. নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে নতুন ভাবনা: বিদ্যমান ফার্স্ট পাস্ট দি পোস্ট পদ্ধতি, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কিংবা মিশ্র পদ্ধতি।
৪. সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভূমিকা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে সেগুলো পরিচালনের জন্য উপযুক্ত আইনি বিধান।
৫. সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা রেখে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক সংসদীয় আসন সংরক্ষণ।
৬. নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, ক্ষমতা ও সম্পদ হস্তান্তর এবং সেই লক্ষ্যে কার্যকর আইনি বিধান।
৭. সংসদীয় আসনের ভোটারগণ কর্তৃক তাদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে প্রত্যাহারের বিধান।
৮. সংবিধানের ৭০ ধারায় দলীয় সংসদ সদস্যদের সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট প্রদানে যে বাধা আরোপিত আছে তা রহিতকরণ।
৯. জাতীয় ও স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির ওপর গণভোট গ্রহণের আবশ্যিক বিধান।
প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়াদি
আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ মনে করি, রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুনরুজ্জীবিত ও শক্তিশালী করা এবং এগুলোকে সকল ধরনের দলীয় ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা প্রয়োজন। এসব প্রতিষ্ঠান যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো বিনির্মাণের অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ। এগুলো হলো গণতান্ত্রিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সোপান এবং এগুলোর স্বাধীন ও দায়বদ্ধভাবে কাজ করার জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক। নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান, তাদের নাগরিক অধিকারসমূহ সমুন্নত রাখা, সরকারকে জবাবদিহি করা তথা সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার ভিত্তিতে উপযুক্ত লোক নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়নসহ গণশুনানির ব্যবস্থা করা দরকার। প্রশাসনিক, সংসদীয় ও নাগরিক সমাজ কর্তৃক যথাযথ নিরীক্ষা এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য এগুলোর শীর্ষ পদে পেশাদার ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সুনামসম্পন্ন ও জনবান্ধব ব্যক্তিদেরকে নিয়োগ দেয়া আবশ্যক। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এসব কর্মকর্তাগণ একটি গ্রহণযোগ্য প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবেন এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্রাঞ্চের নিম্নোক্ত সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ সংস্থাসমূহ সংস্কারের জন্য নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। (এটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়)
১. জাতীয় সংসদ
২. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
৩. বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন
৪. সরকারি কর্ম কমিশন
৫. দুর্নীতি দমন কমিশন
৬. তথ্য কমিশন
৭. মানবাধিকার কমিশন
গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশও অতীব জরুরি। রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সংস্কার প্রচেষ্টা নিম্নলিখিত বিষয়াদির মধ্যে নিবিষ্ট করা যেতে পারে:
৮. রাষ্ট্র-বহির্ভূত (হড়হ-ংঃধঃব) প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনৈতিক দল:
ক. রাজনৈতিক দলসমূহের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা
খ. দলসমূহের আর্থিক স্বচ্ছতা
গ. শিক্ষক, ছাত্র, পেশাজীবী সংগঠন এবং সরকারি স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত ও বিধিবদ্ধ সংস্থাসমূহের অথবা বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসমূহকে দলের কাঠামো থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্তকরণ
ঘ. রাজনৈতিক দলসমূহের বিদেশী শাখা বিলুপ্তকরণ
ঙ. দলের নেতৃবৃন্দের সাধারণ সদস্যদের নিকট জবাবদিহিতা
চ. দলের নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন এবং দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সাধারণ সদস্যদের ভূমিকা
ছ. দলীয় কমিটিসমূহে নারীদের যৌক্তিক প্রতিনিধিত্ব
স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহেরও জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। এসব প্রতিষ্ঠানের নিম্নোক্ত সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে:
৯. স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ:
ক. একটি বিকেন্দ্রীকরণ নীতি প্রণয়ন এবং ওই নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে আইনের পুনর্বিন্যাস
খ. স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের কাঠামো ও নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার
গ. স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণ
ঘ. দায়িত্ব ও কর্তব্য হস্তান্তর
ঙ. কর্মকর্তা ও কর্মচারী হস্তান্তর
চ. স্থানীয় সরকার কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক জাতীয় বাজেটের একটি অংশ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর
ছ. সুনির্দিষ্ট ম্যান্ডেটসহ স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন
জ. সংরক্ষিত আসন পদ্ধতির সংস্কার
ঞ. স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের অধিক্ষেত্র অন্য কর্তৃপক্ষের আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখা
১০. নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম:
শাসন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি বলিষ্ঠ ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ এবং স্বাধীন গণমাধ্যম বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টির গুরুত্বও অপরিসীম। সেই লক্ষ্যে একটি যথোপযুক্ত আইনি কাঠামো প্রয়োজন, যাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নিম্নোক্ত বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত থাকবে:
ক. কর্তৃপক্ষীয় ভয়-ভীতি মুক্ত একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতকরণ
খ. নাগরিক সমাজ যাতে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে তাদের কার্যপরিধি সঙ্কুচিত করার প্রচেষ্টাকে নিবৃতকরণ
গ. নাগরিক সমাজের বিভক্তিকরণে ‘ক্রনিজম’ বা কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের বিলোপ সাধন
ঘ. নাগরিক সমাজের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন
ঙ. গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অর্থবহ বিকাশের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
চ. প্রেস ইন্সটিটিউট-এর প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন
উপসংহার
অনেক প্রতিকূলতার মুখে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ অতীতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এবং অনেক বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক দলসমূহ গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে একটি ‘যৌথ ঘোষণা’ প্রণয়ন করেছিল। আমরা আশা করি যে, আমাদের রাজনীতিবিদগণ আবারও সাহসিকতা ও প্রজ্ঞা প্রদর্শন করে দেশে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ সমাধানে ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবেন এবং বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য একটি কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবেন। এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি জাতীয় সনদ প্রস্তুত হতে পারে, যেটি সংশ্লিষ্ট সকলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে একটি নতুন সামাজিক চুক্তিতে পরিণত হবে।
আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ বিশ্বাস করি যে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস ও সহনশীলতা সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। আমরা আরও বিশ্বাস করি যে, আমাদের অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদগণ এ ধরনের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম- কারণ অতীতে এ ধরনের সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের বহু নিদর্শন তারা দেখেছেন। আজ সময় এসেছে বিভাজনের রাজনীতিকে পেছনে ফেলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অন্তর্ভুক্তিকরণ ও সমঝোতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। অতীতের বিভেদ ও প্রতিবন্ধকতাসমূহের ঊর্ধ্বে উঠে সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য বর্তমান সময়ের চাইতে ভাল সময় আর হতে পারে না। কতগুলো সুস্পষ্ট মূল্যবোধে বিশ্বাস ১৬ কোটি বাংলাদেশীর এই দেশটিকে বিশ্বসভায় তার যথোপযুক্ত স্থানে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এখন ভবিষ্যতের দিকে আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করতেই হবে।
উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের পক্ষে ১০ মে ২০১৫ তারিখে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত।
No comments