পুলিশকে জনগণের আস্থা অর্জনের পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর
সন্ত্রাস,
নাশকতামূলক কর্মকা-, হত্যা, গাড়িতে আগুনসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে পুলিশ
দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা। তিনি বলেছেন, শত বাধার মধ্যে দিন-রাত পরিশ্রম করে পুলিশ সদস্যরা
অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী
বলেন, আপনারা আপনাদের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে যাবেন এবং জনগণের
আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করবেন- সেটাই আমরা চাই। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর
রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স মাঠে পুলিশ সপ্তাহ-২০১৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত এক বছরে
দেশ যখন শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে চলছিলো, বিশ্বের মাঝে মাথ উঁচু করে
দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো। এসময়ে কোন কারণ ছাড়াই বিএনপি-জামায়াত
সন্ত্রাসী কর্মকা- শুরু করেছে। মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো জঘন্য কাজ করে
যাচ্ছে। এদের হাত থেকে দুই বছরের শিশুটি পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। স্বজন
হারানোর আহাজারি আজ দেশের আকাশে বাতাসে। এদের সন্ত্রাসী তৎপরতা রুখে দিতেই
হবে। তিনি বলেন, যে পুলিশ বিএনপির নেত্রীকে নিরাপত্তা দিচ্ছে, সেই পুলিশের
ওপরই বিএনপি এবং তার দোসর জামায়াত-শিবির হামলা চালাচ্ছে। ২০১৩ সালে তারা ১৭
জন পুলিশকে হত্যা করেছিল ও কয়েক শ’ জনকে আহত করেছিল। তিনি আরো বলেন, সব
স্তরের পুলিশ সদস্যদের পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। শেখ
হাসিনা বলেন, অবরোধের নামে বোমাবাজির কারণে মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম
জমায়েত বিশ্ব ইজতেমায় লাখো লাখো মুসলিমকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। মার্কিন
সিনেটরের সই জাল করে ও ভারতের ক্ষমতাসীন পার্টি বিজিবি সভাপতির টেলিফোন
আলাপ নিয়ে মিথ্যাচার করে বিএনপি দেশের ভাবমূর্তিকে পদদলিত করেছে। তিনি
বলেন, দেশকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি
শান্তিপূর্ণ দেশ হবে। ?এখানে সহিংসতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের কোন স্থান নেই।
তাই আমি দেশের সকল জনগণের কাছে আহ্বান জানাবো সন্ত্রাসী কর্মকা-ের
বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হবে এবং এই সন্ত্রাস
প্রতিরোধ করতে হবে। পুলিশ বাহিনীকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করার জন্য আমি
দেশবাসীকে আহ্বান জানান তিনি। পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী
বলেন, আপনারা আপনাদের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে যাবেন এবং জনগণের
আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করবেন- সেটাই আমরা চাই। এ সময় দেশে নাশকতা ও সন্ত্রাসী
কর্মকা-ের চিত্রও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুলিশের আধুনিকায়নে আমরা যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তার অধিকাংশই ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করেছি। গত ছয় বছরে পুলিশে ৩১ হাজার ৭৪৪টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আরো ৫০ হাজার পদ সৃষ্টির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পুলিশে বর্তমানে গ্রেড-১ পদ রয়েছে দুটি। প্রয়োজনে আরো একটি গ্রেড-১ পদ বাড়ানোর আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় বর্তমানে কনস্টেবল হতে এসআই পর্যন্ত ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা পর্যায়ক্রমে ‘সকল স্তরের পুলিশ সদস্যদের জন্য বাস্তবায়নের’ও আশ্বাস দেন তিনি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সকল উন্নয়নের পূর্বশর্ত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আইনশৃঙ্খলা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থকে আমরা ব্যয় নয়, বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করি। একটি নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ দেশ গড়ার লক্ষ্যে পুলিশের কৌশলগত পরিকল্পনা, অবকাঠামো ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা এবং পুলিশের সামর্থ্য বৃদ্ধি করার কাজ অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশের বার্ষিক কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি পেশায় কৃতিত্বের জন্য ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক’ ও ‘রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক’ পাওয়া ৮৬ সদস্যকে পদক তুলে দেন। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হকসহ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশের দাবি-দাওয়া নিয়ে বৈঠক: এদিকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে গতকাল সাড়ে ১১টায় রাজারবাগের টেলিকম অডিটরিয়ামে পুলিশ সুপার থেকে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান খান কামাল উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের বিভিন্ন দাবি- দাওয়ার বিষয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। সবশেষে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবির বিষয়গুলো বিবেচনা ও পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশে জনবল বৃদ্ধির প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার ৬৬ জন নাগরিকের বিপরীতে ১ জন পুলিশ রয়েছে। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি ৭২৮ জন নাগরিকের বিপরীতে ১ জন ও পাকিস্তানে প্রতি ৬২৫ জন পুলিশ সদস্যের বিপরীতে ১ জন পুলিশ সদস্য কাজ করেন। আইজিপি বলেন, বর্তমান সরকার এরই মধ্যে ৩২ হাজার জনবল বৃদ্ধি করেছেন। এরপরেও পুলিশে জনবল সঙ্কট রয়েছে। নতুন করে ৫০ হাজার জনবল নিয়োগের প্রধানমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। বিশেষায়িত ইউনিটের মাধ্যমে নতুন জনবল সংযুক্ত করা হবে। আইজিপি বলেন, পুলিশের যানবাহনের ব্যাপক স্বল্পতা রয়েছে। পর্যাপ্ত যানবাহন ব্যতীত পুরোপুরি সফল হওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া, জনবল ও যানবাহনের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অন্যান্য সরঞ্জাম প্রয়োজন। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব বিবেচনা করবে বলে তিনি বলেন। আইজিপি বলেন, বর্তমানে পুলিশের চাহিদার মাত্র দুই ভাগ আবাসন সুবিধা রয়েছে। পুলিশের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া, রাজধানী ঢাকায় মাত্র দুটি রাজারবাগ ও মিরপুর পুলিশ লাইন্স রয়েছে। এতে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনায় তাৎক্ষণিক পুলিশ মোতায়েনে সময় লাগে। এ জন্য ঢাকার উত্তরা ও ডেমরাসহ চারটি পুলিশ লাইন্স করার প্রক্রিয়া চলছে। এখন ‘ফ্রেশ মানি’ শুধু র্যাব, আর্মড পুলিশসহ বিশেষায়িত ইউনিটগুলো পায়। এটি পুরো বাহিনীর জন্য করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আইজিপি’র বক্তব্য শেষে ডিএমপি’র তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা আহত হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কিংবা স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। অথচ পুলিশ হাসপাতালকে আরো উন্নত ও আধুনিক করে এখানেই চিকিৎসা প্রদান সম্ভব। তিনি পুলিশ হাসপাতাল উন্নত ও আধুনিক করার দাবি জানান। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার হাফিজ আক্তার হাইওয়েতে পেট্রোল গাড়ির অপর্যাপ্ততার কথা তুলে ধরে বৃদ্ধির সুপারিশ করেন। গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন- অর-রশিদ বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিভিন্ন চিঠিতে পুলিশ অধিদপ্তর উল্লেখ করা হয়। অথচ ১৯৯৪ সালে পুলিশ অধিদপ্তর বাদ দিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার করা হয়েছে। এটি যথাযথভাবে অনুসরণ করার দাবি জানান তিনি। ঢাকার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, বর্তমানে কনস্টেবল থেকে উপ-পরিদর্শকরা (এসআই) ঝুঁকিভাতা পায়। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করেন। তিনি সকল পুলিশ সদস্যের জন্য ঝুঁকিভাতা প্রবর্তনের দাবি করেন। সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীর মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অপরাধীদের সাজার আওতা বাড়ানোর দাবি করেন। ডিএমপি’র ওয়ারী বিভাগের ডিসি মোস্তাক আহমেদ দ্রুত কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিট চালুর দাবি জানিয়ে বলেন, থানায় দায়িত্ব পালনরত এসআইদের দ্রুত ঘটনাস্থলে যাওয়া বা মুভমেন্টের জন্য ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে মোটরসাইকেল কিনে দেয়া যেতে পারে। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এসএসপি এজাজ আহমেদ সারা দেশে মোবাইল কোর্টে সাজা প্রদানকারীদের তালিকা এসবিতে পাঠানোর কথা বলেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনের জন্য এটা জরুরি। ভোলার পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট না দেয়ার সুপারিশ করেন। এতে সন্ত্রাসী বা বিদেশী নাগরিকরা পাসপোর্ট পেয়ে যেতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। নরসিংদীর এসপি আমেনা খাতুন নারী সহায়তা কেন্দ্র বাড়ানোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অতিরিক্ত ডিআইজি জহিরুল ইসলাম সারা দেশে পুলিশের ইন্টারনেট সেবা দেয়ার আহ্বান জানান। ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার মিলি বিশ্বাস বলেন, নারী পুলিশ সদস্যদের আবাসন প্রয়োজন। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়া বলেন, র্যাবে বেশির ভাগ সময় নবীন পুলিশ কর্মকর্তাদের পোস্টিং করা হয়। নবীনরা দক্ষ না হওয়ায় কাজ করতে বেগ পেতে হয়। একই সঙ্গে তিনি র্যাবের জনবল সঙ্কটের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, র্যাবে ১১ হাজার জনবল থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে ৮ হাজার জনবল রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এপিসিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম বৃদ্ধিরও দাবি জানান। এছাড়া, তিনি র্যাবের ডিজি পদের মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়টিও উল্লেখ করেন। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, পুলিশে জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। যানবাহন সঙ্কট দূর করতে হবে এবং পুলিশ সদস্যদের আবাসন সমস্যা নিরসন করতে হবে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত বক্তব্য শেষে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী আপনাদের ওপর অনেক নির্ভরশীল। পুলিশ বাহিনী শুধু দেশেই নয় বিদেশেও সমান্তরালভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বাস্তবায়নযোগ্য প্রতিটি দাবি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, পুলিশ হাসপাতাল উন্নত ও আধুনিক করা হবে। এ জন্য তিনি একটি প্রস্তাবনা আহ্বান করেছেন। লোকবলও বাড়ানোর জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান। এছাড়া, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা বলেন। তিনি বলেন, এবারও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ১৩ জন সদস্য জীবন দিয়েছেন। পুলিশ সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নির্ভীকভাবে কাজ করছে। সাইবার ক্রাইম ও কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিট দ্রুত চালুর আশ্বাস দেন। যানবাহন বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পর আমরা যদি দেরি করে ঘটনাস্থলে পৌঁছি, তাহলে তো আমাদের বিপদ। প্রধানমন্ত্রীকে একসঙ্গে কিছু গাড়ি কিনে দিতে বলেছি। তিনি বিষয়টি বিবেচনা করবেন। পুলিশের যানবাহন সমস্যা দ্রুত লাঘব করা হবে। র্যাবের দাবি-দাওয়া প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, র্যাবের নাম শুনলে সন্ত্রাসীরা ভয়ে কম্পমান হয়। র্যাবকে আরো বেশি শক্তিশালী এবং আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুলিশের আধুনিকায়নে আমরা যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তার অধিকাংশই ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করেছি। গত ছয় বছরে পুলিশে ৩১ হাজার ৭৪৪টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আরো ৫০ হাজার পদ সৃষ্টির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পুলিশে বর্তমানে গ্রেড-১ পদ রয়েছে দুটি। প্রয়োজনে আরো একটি গ্রেড-১ পদ বাড়ানোর আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় বর্তমানে কনস্টেবল হতে এসআই পর্যন্ত ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা পর্যায়ক্রমে ‘সকল স্তরের পুলিশ সদস্যদের জন্য বাস্তবায়নের’ও আশ্বাস দেন তিনি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সকল উন্নয়নের পূর্বশর্ত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আইনশৃঙ্খলা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থকে আমরা ব্যয় নয়, বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করি। একটি নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ দেশ গড়ার লক্ষ্যে পুলিশের কৌশলগত পরিকল্পনা, অবকাঠামো ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা এবং পুলিশের সামর্থ্য বৃদ্ধি করার কাজ অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশের বার্ষিক কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি পেশায় কৃতিত্বের জন্য ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক’ ও ‘রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক’ পাওয়া ৮৬ সদস্যকে পদক তুলে দেন। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হকসহ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশের দাবি-দাওয়া নিয়ে বৈঠক: এদিকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে গতকাল সাড়ে ১১টায় রাজারবাগের টেলিকম অডিটরিয়ামে পুলিশ সুপার থেকে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান খান কামাল উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের বিভিন্ন দাবি- দাওয়ার বিষয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। সবশেষে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবির বিষয়গুলো বিবেচনা ও পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশে জনবল বৃদ্ধির প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার ৬৬ জন নাগরিকের বিপরীতে ১ জন পুলিশ রয়েছে। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি ৭২৮ জন নাগরিকের বিপরীতে ১ জন ও পাকিস্তানে প্রতি ৬২৫ জন পুলিশ সদস্যের বিপরীতে ১ জন পুলিশ সদস্য কাজ করেন। আইজিপি বলেন, বর্তমান সরকার এরই মধ্যে ৩২ হাজার জনবল বৃদ্ধি করেছেন। এরপরেও পুলিশে জনবল সঙ্কট রয়েছে। নতুন করে ৫০ হাজার জনবল নিয়োগের প্রধানমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। বিশেষায়িত ইউনিটের মাধ্যমে নতুন জনবল সংযুক্ত করা হবে। আইজিপি বলেন, পুলিশের যানবাহনের ব্যাপক স্বল্পতা রয়েছে। পর্যাপ্ত যানবাহন ব্যতীত পুরোপুরি সফল হওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া, জনবল ও যানবাহনের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অন্যান্য সরঞ্জাম প্রয়োজন। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব বিবেচনা করবে বলে তিনি বলেন। আইজিপি বলেন, বর্তমানে পুলিশের চাহিদার মাত্র দুই ভাগ আবাসন সুবিধা রয়েছে। পুলিশের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া, রাজধানী ঢাকায় মাত্র দুটি রাজারবাগ ও মিরপুর পুলিশ লাইন্স রয়েছে। এতে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনায় তাৎক্ষণিক পুলিশ মোতায়েনে সময় লাগে। এ জন্য ঢাকার উত্তরা ও ডেমরাসহ চারটি পুলিশ লাইন্স করার প্রক্রিয়া চলছে। এখন ‘ফ্রেশ মানি’ শুধু র্যাব, আর্মড পুলিশসহ বিশেষায়িত ইউনিটগুলো পায়। এটি পুরো বাহিনীর জন্য করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আইজিপি’র বক্তব্য শেষে ডিএমপি’র তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা আহত হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কিংবা স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। অথচ পুলিশ হাসপাতালকে আরো উন্নত ও আধুনিক করে এখানেই চিকিৎসা প্রদান সম্ভব। তিনি পুলিশ হাসপাতাল উন্নত ও আধুনিক করার দাবি জানান। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার হাফিজ আক্তার হাইওয়েতে পেট্রোল গাড়ির অপর্যাপ্ততার কথা তুলে ধরে বৃদ্ধির সুপারিশ করেন। গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন- অর-রশিদ বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিভিন্ন চিঠিতে পুলিশ অধিদপ্তর উল্লেখ করা হয়। অথচ ১৯৯৪ সালে পুলিশ অধিদপ্তর বাদ দিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার করা হয়েছে। এটি যথাযথভাবে অনুসরণ করার দাবি জানান তিনি। ঢাকার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, বর্তমানে কনস্টেবল থেকে উপ-পরিদর্শকরা (এসআই) ঝুঁকিভাতা পায়। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করেন। তিনি সকল পুলিশ সদস্যের জন্য ঝুঁকিভাতা প্রবর্তনের দাবি করেন। সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীর মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অপরাধীদের সাজার আওতা বাড়ানোর দাবি করেন। ডিএমপি’র ওয়ারী বিভাগের ডিসি মোস্তাক আহমেদ দ্রুত কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিট চালুর দাবি জানিয়ে বলেন, থানায় দায়িত্ব পালনরত এসআইদের দ্রুত ঘটনাস্থলে যাওয়া বা মুভমেন্টের জন্য ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে মোটরসাইকেল কিনে দেয়া যেতে পারে। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এসএসপি এজাজ আহমেদ সারা দেশে মোবাইল কোর্টে সাজা প্রদানকারীদের তালিকা এসবিতে পাঠানোর কথা বলেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনের জন্য এটা জরুরি। ভোলার পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট না দেয়ার সুপারিশ করেন। এতে সন্ত্রাসী বা বিদেশী নাগরিকরা পাসপোর্ট পেয়ে যেতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। নরসিংদীর এসপি আমেনা খাতুন নারী সহায়তা কেন্দ্র বাড়ানোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অতিরিক্ত ডিআইজি জহিরুল ইসলাম সারা দেশে পুলিশের ইন্টারনেট সেবা দেয়ার আহ্বান জানান। ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার মিলি বিশ্বাস বলেন, নারী পুলিশ সদস্যদের আবাসন প্রয়োজন। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়া বলেন, র্যাবে বেশির ভাগ সময় নবীন পুলিশ কর্মকর্তাদের পোস্টিং করা হয়। নবীনরা দক্ষ না হওয়ায় কাজ করতে বেগ পেতে হয়। একই সঙ্গে তিনি র্যাবের জনবল সঙ্কটের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, র্যাবে ১১ হাজার জনবল থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে ৮ হাজার জনবল রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এপিসিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম বৃদ্ধিরও দাবি জানান। এছাড়া, তিনি র্যাবের ডিজি পদের মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়টিও উল্লেখ করেন। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, পুলিশে জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। যানবাহন সঙ্কট দূর করতে হবে এবং পুলিশ সদস্যদের আবাসন সমস্যা নিরসন করতে হবে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত বক্তব্য শেষে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী আপনাদের ওপর অনেক নির্ভরশীল। পুলিশ বাহিনী শুধু দেশেই নয় বিদেশেও সমান্তরালভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বাস্তবায়নযোগ্য প্রতিটি দাবি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, পুলিশ হাসপাতাল উন্নত ও আধুনিক করা হবে। এ জন্য তিনি একটি প্রস্তাবনা আহ্বান করেছেন। লোকবলও বাড়ানোর জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান। এছাড়া, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা বলেন। তিনি বলেন, এবারও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ১৩ জন সদস্য জীবন দিয়েছেন। পুলিশ সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নির্ভীকভাবে কাজ করছে। সাইবার ক্রাইম ও কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিট দ্রুত চালুর আশ্বাস দেন। যানবাহন বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পর আমরা যদি দেরি করে ঘটনাস্থলে পৌঁছি, তাহলে তো আমাদের বিপদ। প্রধানমন্ত্রীকে একসঙ্গে কিছু গাড়ি কিনে দিতে বলেছি। তিনি বিষয়টি বিবেচনা করবেন। পুলিশের যানবাহন সমস্যা দ্রুত লাঘব করা হবে। র্যাবের দাবি-দাওয়া প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, র্যাবের নাম শুনলে সন্ত্রাসীরা ভয়ে কম্পমান হয়। র্যাবকে আরো বেশি শক্তিশালী এবং আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করা হবে।
No comments