অঘোষিত জরুরি অবস্থার কবলে বাংলাদেশ by সাদেক খান
কার্যত
একটি অঘোষিত জরুরি অবস্থার ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দুঃসময় যাপন করছে
বাংলাদেশ। ২০ জানুয়ারি কর্মসপ্তাহ-মধ্যবর্তী খবর, বিগত সপ্তাহান্তের
দু’দিনসহ চার দিনে ক্রসফায়ারে তিনজন বিরোধীদলীয় নেতা নিহত। তাদের মধ্যে
দু’জন ছাত্রদল আর একজন জামায়াত নেতা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি)
ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন দু’জন। আর র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন এক
ছাত্রদল নেতা। ডিবির ক্রসফায়ারের সর্বশেষ শিকার বিশ্ব ইজতেমার আখেরি
মুনাজাতের পরদিন খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনি।
খিলগাঁও জোড়াপুকুর মাঠে ডিবি পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হন তিনি। নিহত জনির
বাবা ইয়াকুব আলী জানান, ছোট ভাই মনিরুজ্জামানকে দেখতে সোমবার ঢাকা
কেন্দ্রীয় কারাগারে যায় জনি। সেখান থেকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা তাকে
ধরে নিয়ে যান। একই দিনে দিবাগত রাতে নড়াইলের পৌর কাউন্সিলর ইমরুল কায়েস
ঢাকায় ডিবির ক্রসফায়ারে নিহত হন। ১৫ জানুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। ১৯
জানুয়ারি রাত সাড়ে ৩টার দিকে মতিঝিলের এজিবি কলোনির কাঁচাবাজার এলাকায়
ক্রসফায়ারে নিহত হয়ে অজ্ঞাত হিসেবে পড়ে ছিল তার লাশ। একটি নয়, দু’টি নয়,
১০টি বুলেটবিদ্ধ ছিল তার বুক। পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে তার পরিবারের
সদস্যরা ঢাকায় আসেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তারা তার লাশ শনাক্ত
করেন। পরিবারের অভিযোগ, গ্রেফতারের পর ঠাণ্ডামাথায় তাকে গুলি করে হত্যা করা
হয়েছে।
এর আগে ১৫ জানুয়ারি রাতে যৌথবাহিনীর অভিযানের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন আরেক ছাত্রদল নেতা। নিহত মতিউর রহমান শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি ছিলেন। বিএনপির দাবি, গ্রেফতারের পর পরিকল্পিতভাবে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মতিউর রহমানকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আটক করে। তার বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা বা একটি জিডিও ছিল না। মফস্বল এলাকায় পুলিশ-র্যাবের হাতে গুম-গ্রেফতার, নির্যাতনে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা কেউ পালিয়ে কেউ নিরুদ্দেশ। প্রতিবাদে জেলাওয়ারি হরতাল চলেছে থেকে থেকে, দেশব্যাপী টানা অবরোধ কর্মসূচির ১৫ দিন ধরে। অবরোধের ষোড়শ দিবস থেকে চলছে ঢাকা ও খুলনা বিভাগে ৪৮ ঘণ্টার টানা হরতাল, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে আগে থেকে চলা হরতাল এদিন শেষ হচ্ছে। পুলিশ-বিজিবি-র্যাবের কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থায় স্বাভাবিকতার একটা চেহারা বজায় রাখতে সরকার সম বলে দাবি করছে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র। কিন্তু রাস্তাঘাটে যানবাহনের স্বল্পতা, দোকানপাটের বন্ধ দরজা আর পেট্রলবোমার আতঙ্কগ্রস্ত পথচারী অন্য চেহারা তুলে ধরছে। আর দূরযাত্রার মহাসড়ক রেলপথ নৌপথে অবরোধ সমানে চলেছে। যার ফলে সারা দেশে বাণিজ্যিক তৎপরতা স্থবির। কলকারখানা চলছে বন্ধ ফটকের আবডালে। কৃষকের ঘরে সবজি, ফলমূল পচছে, বাজারজাত হতে পারছে না। অথচ চাহিদা মোতাবেক আমদানির অভাবে দাম চড়ছে কাঁচামালের হাটবাজারে। সরবরাহ বিভ্রাটে চালের দরও ঊর্ধ্বমুখী। সরকার বাহাদুর জোরগলায় বলছে, আর ১০ দিনে সব অবরোধকারী পিটিয়ে ঠাণ্ডা করে দেয়া হবে; সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়, মতাসীন দলের কর্মীদের হাতেই নাস্তানাবুদ হবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। হুমকি-ধমকি দিতে সরব পুলিশপ্রধান, র্যাবপ্রধান, বিজিবিপ্রধান। দেখামাত্র ‘সন্ত্রাসী’কে গুলি করা হবে, বলছেন তারা। কেউ কেউ এমন কথায় ’৭৪ সালের রীবাহিনীর অভিযানকালে তৎকালীন সরকারের গুলি করার নির্দেশ সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর মন্তব্য স্মরণ করছেন। মওলানা ভাসানী বলেছিলেন : মুজিব, সন্ত্রাসী কি কারো গায়ে লেখা থাকে?
বিএনপি গোষ্ঠী এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো সমস্বরে প্রতিবাদ করেছে, সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর কর্মকর্তাদের এমন নির্দেশ সংবিধানের ও মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, বর্বরতা। অন্য দিকে, পুলিশি হামলার পাল্টা সহিংসতা, চোরাগোপ্তা বোমাবাজি, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, কোথাও কোথাও সামনা-সামনি প্রতিরোধ সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। পুলিশও মারা পড়ছে। অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছে অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে যাত্রী গাড়িচালক পথচারী অনেকে। সুশীলসমাজের নৈরাশ্য প্রকাশ পেয়েছে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকের মন্তব্যে : ‘মনে হয় এই অবস্থা চলতেই থাকবে। চলতে চলতে দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংসের পর একটা সমাধানের পথ বের হয়ে আসবে। ভালো থাকতে তো আর কেউ সমঝোতায় বসবে না!’
বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মুনাজাতের পরদিন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয়ের গেটে পুলিশের তালাবদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েই সংবাদ সম্মেলন করেন। অবরোধে দেশব্যাপী নাশকতার জন্য সরকারকেই দায়ী করে খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অতীতেও এ ধরনের কাজ করেছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সম্পর্কে দেশে-বিদেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মতাসীনেরা নাশকতা ও অন্তর্ঘাতের পথ বেছে নিয়েছে। পুলিশি পাহারার মধ্যে নারী, শিশু, ছাত্রছাত্রীদের বহনকারী যানবাহনে পেট্রলবোমা মেরে অনেক নিরপরাধ মানুষকে হতাহত ও দগ্ধ করা হয়েছে। এসব পৈশাচিক বর্বরতার আমরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দেশের চলমান সঙ্কট নিছক কোনো আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়। এটি রাজনৈতিক সঙ্কট। এর রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমরা মতাসীনদের আবারো আহ্বান জানাচ্ছি।’
সরকারের উদ্দেশে তিনি আরো বলেন, ‘অত্যাচার, দমন অভিযান, গণগ্রেফতার বন্ধ করুন। মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা বন্দীদের মুক্তি দিন। গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের ওপর থেকে সব বাধা তুলে নিন। যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, তা স্বাভাবিক করুন। মানুষকে স্বস্তি ও শান্তি দিন। উসকানি, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচারের অপরাজনীতি বন্ধ করুন। জনগণের ভোট দেয়ার যে অধিকার কেড়ে নিয়েছেন, তা ফিরিয়ে দিন এবং অবিলম্বে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদপে নিন।’
অন্য দিকে, আগের দিন ১৮ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের সাথে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কটা করে বলেন, ‘কেউ যদি ভেবে থাকে যে (ভারতের) বিজেপি ও (মার্কিন) কংগ্রেসম্যানরা সরকার উৎখাত করে বিএনপিকে মতায় বসাবে, তা হবে দুর্ভাগ্যের কথা। (সংবিধান মোতাবেক) বিএনপি-জামায়াত সরকারেও নেই, বিরোধী দলেও নেই। তাদের হাহাকারের আগুন পুড়িয়ে মারছে দেশের মানুষকে। চোখের সামনে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে তা সহ্য করা হবে না। অগ্নিসংযোগ করা ছাড়া বিএনপির আর কোনো আন্দোলন নেই। বিএনপি নেত্রীর আন্দোলনের অর্থ হচ্ছে মানুষ পুড়িয়ে মারা, বাস-ট্রাকে অগ্নিসংযোগ এবং তারা একের পর এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। এমনকি গর্ভবতী মহিলাও তাদের সহিংসতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না। এ দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিশ্বাস করে না। তারা এখনো পাকিস্তানপ্রীতিতে বিশ্বাসী, যা বাঙালি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। বিএনপি বেশ কয়েকবার মতায় এসেছিল এবং প্রতিবারই তারা দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকার দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অচিরেই বিশ্বে মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে পরিণত হবে। দেশের জনগণ বিশ্বাস করে, কেবলমাত্র আওয়ামী লীগই দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং সরকার জনগণের আকাক্সা পূরণে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু বিএনপি এ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেতে চেষ্টা চালাচ্ছে।’
তারপর ২০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বোমা হামলায় দগ্ধদের ছবির পেপার কাটিং দেখালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি দেখানোর সময় প্রধানমন্ত্রী নিজে কাঁদলেন, কাঁদালেন সংসদ সদস্য সবাইকে। তার মন্ত্রী-এমপিদের দিয়ে সংসদে বলালেন : সহিংসতা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হতে পারে না, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অপারেশন কিনহার্ট অথবা যৌথবাহিনী নামিয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পদপে দিতে হবে, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার করতে হবে; বিএনপি-জামায়াতের সাথে কোনো সংলাপ বা আলোচনা হবে না। বিএনপি-জামায়াতকে জঙ্গি সংগঠন উল্লেখ করে দল দু’টিকে নিষিদ্ধ করার দাবিও তোলা হয়। সেই দাবির প্রতিধ্বনি করে মিডিয়ায় বিবৃতি পাঠালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী : ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর কূটনীতিকেরা কেউ কেউ বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকার উদ্যোগ নিলে তার প্রতি তারা সমর্থন দেবে। সাংবাদিকেরা খবর নিয়ে জানল, কেউ কেউ নয়, শুধু ঘোর কর্তৃত্ববাদী মিলিটারি শাসক জেনারেল সিসির তথা মিসরের রাষ্ট্রদূত তার দেশে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করার নজির দিয়ে এ কথা বলেছে।
প্রসঙ্গত, ভূরাজনৈতিক পর্যবেক দু’জন প্রবীণ বৈদেশিক কূটনীতিবিদ বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ভারতের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক-রাষ্ট্রদূত কুলদীপ নায়ার শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের সাফাইও তিনি গেয়েছেন এ কথা বলে : (মূলধারার বিরোধী জোটের) ‘বর্জন সত্ত্বেও সামগ্রিক অর্থে নির্বাচন হয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক জেনারেল এইচ এম এরশাদ কিছু আসন পেতে সম হয়েছেন। এর ভিত্তিতে এটি এখন পার্লামেন্টের প্রধান বিরোধী দল।’ এখন অবস্থাদৃষ্টে এ বছর ৭ জানুয়ারি লিখিত একটি ভাষ্যে তিনি বলেছেন : ‘শেখ হাসিনার শাসন হলো এক ব্যক্তির শাসন। তিনি ুব্ধ হতে পারেন এমন রায় দেয়ার েেত্র বিচার বিভাগও দ্বিধাবোধ করেন। আমলাতন্ত্র, সেটা তো পরিণত হয়েছে তল্পিবাহকে।’
বেগম জিয়ার অভিযোগ হলো, তাকে সারা রাত অফিসে অবরুদ্ধ থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। এ অভিযোগ সত্য হতে পারে। পুলিশ নিজেরাও স্বীকার করেছে যে, তারা খালেদার নিরাপত্তা জোরদার করেছে এবং তিনি চাইলে তাকে তারা তার বাসায় পৌঁছে দিতে পারে। দৃশ্যত, তিনি চাইছিলেন বাইরে এমন কোনো স্থানে যেতে, যেখান থেকে বর্জন করা নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে সমাবেশে যোগ দিতে পারেন।
তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এত দিনে এ দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করা উচিত ছিল। অনেক স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাযোদ্ধারা একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রাধান্য বিস্তারে নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছেন। তাদের থেকে বাংলাদেশে কোনো ভিন্নতা নেই।
বাংলাদেশের জন্মের সময় স্বাধীনতাযোদ্ধা ও গণতন্ত্রের রকেরা যে সামাজিক কাঠামো অর্জন করেছিলেন, তা ছিন্নভিন্ন করে ফেলার প্রচেষ্টা সব থেকে বেদনাদায়ক। সময়ের সাথে সাথে তারা বেশি বেশি মতা দখলের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন, চেয়েছেন প্রাধান্য বিস্তার করতে। তাদের ল্য অর্জনের েেত্র তারা দৃশ্যত কোনো কিছুতে থামেন না। বাংলাদেশ এমনই একটি অবস্থার মাঝে অবস্থান করছে। সেনাবাহিনী যখন মতা দখল করেছে, তখন তারা শাসন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেনারা দেখতে পেয়েছে যে, বাংলাদেশীরা নিজেদের নিজেরাই কঠোরতা ও বিচারবুদ্ধিহীনতার সাথে শাসন করা ভালোবাসেন।
‘ইসলামের প্রতি স্পর্শকাতর অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধর্মনিরপে ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগ। পূর্ব বাংলা থেকে জন্ম হওয়া ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিল পাকিস্তান। পরে পূর্ববাংলা হয় পূর্ব পাকিস্তান। এই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার দাবিকে দমিয়ে রাখা যায়নি, স্বাধীনতার আকাক্সা এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত। এখানকার মানুষ উদার মনের। তারা আধুনিক সময়ে ক্রমাগত ধর্মীয় মানসিকতার হয়ে উঠছেন। প্রায় ১০ লাখ হিন্দু বাস করেন বাংলাদেশে। কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই তারা তাদের ধর্মীয় রীতি পালন করেন।
‘বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হয়নি, কেননা দেশটি এখনো চরমমাত্রায় বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। ঢাকাকে বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় এবং বড় অঙ্কের টাকা সরবরাহ করার জন্য সহযোগিতামূলক একটি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী রয়েছে, যেখানে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে আমেরিকা।
বাংলাদেশী নেতারা যত দিন পর্যন্ত না নিজেদের খতিয়ে দেখবেন, তত দিন অব্যাহতভাবে বিদেশী শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকবেন, যারা স্বভাবতই মূল্য আদায় করে নেবে। তারা যেভাবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে, তাতে বিদেশী প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে কোনো বলিষ্ঠ কার্যক্রম রাজনৈতিক দলগুলোর নেই। বরঞ্চ অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়। বাংলাদেশের ট্র্যাজেডি হলোÑ উভয় বেগম তাদের ব্যক্তিগত বৈরিতার কারণে বহির্বিশ্বের শক্তির সাহায্যে সমর্থন গড়ে তোলা অব্যাহত রেখেছেন। যত দিন তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রোপটে আধিপত্য করবেন, বাংলাদেশের সামান্যই ভবিষ্যৎ রয়েছে। কিন্তু এটা তা হলে পরিবর্তন হবে কিভাবে? দুর্ভাগ্যের কথা, কোনো বিকল্প আবির্ভূত হচ্ছে না।’
‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নতুন নির্বাচনের ঘোষণার প্রত্যাশা করাটা হয়তো অনেক বেশি চাওয়া হবে। এ প্রক্রিয়ায় নিয়মের মধ্যে থেকে ভাগ্য যাচাইয়ে বিএনপিকে একটা সুযোগ দেয়া উচিত। চরম বিভক্ত এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত একটি দেশে মনে হচ্ছে এটাই একমাত্র সমাধানের উপায়। ন্যায়সঙ্গত স্বাভাবিক পরিস্থিতি না আসা পর্যন্ত দেশের মানুষের দরিদ্রতা ঘুচানো সম্ভব নয়, যার যেটা করার প্রতিশ্রুতি উভয় দলই দিয়েছে। রাজনৈতিক েেত্র নতুন সূচনা ব্যতীত এটা সম্ভব নয়, ঘটবেও না।’ কুলদীপ নিজেই আভাস দিচ্ছেন যে, এমন সমাধান (সামরিক হস্তেেপর অস্ত্রোপচার ছাড়া) দুরাশা মাত্র।
অন্য দিকে, বাংলাদেশে অতীতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত (বর্তমানে গ্রন্থকার-গবেষক) উইলিয়াম বি মাইলাম ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ভোটারবঞ্চনার নির্বাচনকে প্রথম থেকেই একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করার অশুভ পাঁয়তারা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কুলদীপ নায়ারের ওই ভাষ্য রচনার প্রায় একই সময়ে রচিত ১৬ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে মাইলাম লিখেছেন :
‘সব ধরনের বিরোধিতার বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা তীব্র করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতারা (প্রকৃতপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাকে আজকের দিনে কারো কাছেই জবাব দিতে হয় না) তাদের সিদ্ধান্তের এই সঙ্কেতবার্তাই পাঠাচ্ছেন যে, আওয়ামী লীগের একদলীয় সরকারকে সংহত করে একদলীয় রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়া তারা সম্পন্ন করতে চাইছে জনগণ তাদের মোহভঙ্গের রোষানলে গণ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে সেটাই সম্ভবত নিপীড়নের চক্রকে তীব্রতা দিচ্ছে। বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে সহিংসতা এবং উসকে দিচ্ছে আরো অনেক বেশি অস্থিতিশীলতা।
এই নিবন্ধ ছাপা হওয়ার আগেই সহিংসতা শুরু হয়ে যেতে পারে। সরকারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিএনপি একটি সমাবেশ করতে চায়। সরকার সম্প্রতি রাজপথের আন্দোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞা ধরে রাখতে যদি তারা চাপ সৃষ্টি করে চলে তাহলে সেটা হবে সহিংসতা পাকানোর মালমসলা।
স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন যেকোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এজেন্ডাই থাকে নিরঙ্কুশ মতা কুগিত করা। আর সেই মতাকে ব্যবহার করে তারা যেকোনো বিরোধী দল, যারা বৈধতা দাবি করতে পারে, তাদের ধ্বংস করতে চায়। বিএনপি যদিও মতায় থাকতে খারাপ রেকর্ড করেছে, কিন্তু তারা বৈধতা দাবি করতে পারে। উভয় দলই দুঃশাসন চালিয়েছে। বেশ কয়েক মাস ধরে এই গুজব চালু রয়েছে যে, কোনো-না-কোনো অভিযোগে বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করা হবে। সেটা সম্ভবত দুর্নীতি কিংবা সম্ভবত ইকোনমিস্টের ভাষ্য মতে, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে। আদালতগুলোর ওপর সরকারের যে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং তাদের স্বৈরতান্ত্রিক মনমানসিকতার যা লণ, তাতে আওয়ামী লীগ কার্যত তাদের সরকারের বিরোধী ভূমিকায় থাকা দলনেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনতে পারে এবং আদালত সে অভিযোগ বহাল রাখবেন। আদপে দেশের অভ্যন্তরে অসন্তোষ দানা বাঁধার আশঙ্কা করে সরকার সব বিরোধী দলের ওপর আগাম আঘাত হানতেই এই আকস্মিক দমনপীড়ন শুরু করেছে।
অনেক পর্যবেকের মতে, আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত জনরোষ এড়াতে পেরেছে কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে থেকেছে। দারিদ্র্য ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে, যদিও তা ঘটেছে নিতান্ত মন্থরগতিতে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি মিডিয়ায় তাঁর পরিকল্পিত নারীর মতায়ন এবং অনগ্রসর শ্রেণীর ভাগ্য উন্নয়নের ছক তুলে ধরেছেন। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে, পরিসংখ্যান যা-ই বলুক, সরকারের অবস্থা বাস্তবে যা, তার চেয়ে অনেক বেশি ইতিবাচকভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে। যে রকম পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, জাতীয় অর্থনীতির চেহারা বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় চেহারা মোটেও সে রকম নয়। সেটা যা-ই হোক না কেন, (রাষ্ট্রনৈতিকভাবে) শেখ হাসিনার বৈধতা কখনোই ততটা শক্ত ভিত্তির ওপর ছিল না, যতটা তিনি নিজে ভাবেন। আর তাই তিনি এক দিকে বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে চেয়েছেন, অন্য দিকে জনসাধারণের চোখে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন (নতুনভাবে) তুলে ধরছেন।
‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্ভবত ধরে নিয়েছে যে, বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র এখন একটি হারানো বিষয়। যদি অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকে এবং বাংলাদেশ অকার্যকর হয়ে পড়ে তাহলে ভারতের হারাবার অনেক কিছুই রয়েছে, কিন্তু তাকে এখনো পর্যন্ত নিরুদ্বেগ মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে যারা আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের বিরোধী তাদের কাছে এ অবস্থা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। পাশ্চাত্য শক্তিগুলো আদৌ কি করতে পারে? তারা কি চেষ্টা করে দেখবে, যাতে বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতাদের জেলের বাইরে রাখা যায় এবং যাতে তাদের কোনো তি না হয় তেমন কোনো পন্থা উদ্ভাবন করা যায় কিনা?
এক রসিক ব্যক্তি সম্প্রতি লিখেছেন যে, ‘শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে প্রশিতি করেছেন, কী করে পীড়ন করা যায়, কী করে চরিত্র হনন করা যায়, কী করে মুক্তকণ্ঠকে স্তব্ধ করা যায়। আর লোক ঠগানোরও প্রশিণ দিয়েছেন, যেমন সাজানো আন্দোলন (শাহবাগ আন্দোলনের মতো) কী করে পাকিয়ে তোলা ও রদ করা যায়; সৃষ্টি করা যায় পোষ্য বিরোধী দল, যেটি হবে তার সরকারের অংশ, যে দলের নেতারা তার মন্ত্রিসভায় বসবে, শাসকদলের পে ভোট দেবে।’ এই অজ্ঞাতনামা লেখক আরো লিখেছেন, ‘তিনি বিশ্বের প্রথম স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্রের মডেল সৃষ্টি করেছেন।’
আমার অনুমান, সুশীলসমাজের গণতান্ত্রিক ব্যক্তিরা এবং বিরোধী দল লড়াই ব্যতিরেকে নতি স্বীকার করবে না। আজ হোক কাল হোক, শান্তিপূর্ণভাবে একটি সরকারের পালাবদলের অনুপস্থিতিতে সহিংসতা হবে এবং তা যথেষ্ট মারাত্মক হতে পারে। আমরা (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়) আমাদের ঔদাসিন্যের জন্য পরে পস্তাতে পারি। সহিংসতার পরিণামে যেসব অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে তার মধ্যে সাধারণত সেনাবাহিনীর মতা দখল অন্যতম।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট
এর আগে ১৫ জানুয়ারি রাতে যৌথবাহিনীর অভিযানের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন আরেক ছাত্রদল নেতা। নিহত মতিউর রহমান শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি ছিলেন। বিএনপির দাবি, গ্রেফতারের পর পরিকল্পিতভাবে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মতিউর রহমানকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আটক করে। তার বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা বা একটি জিডিও ছিল না। মফস্বল এলাকায় পুলিশ-র্যাবের হাতে গুম-গ্রেফতার, নির্যাতনে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা কেউ পালিয়ে কেউ নিরুদ্দেশ। প্রতিবাদে জেলাওয়ারি হরতাল চলেছে থেকে থেকে, দেশব্যাপী টানা অবরোধ কর্মসূচির ১৫ দিন ধরে। অবরোধের ষোড়শ দিবস থেকে চলছে ঢাকা ও খুলনা বিভাগে ৪৮ ঘণ্টার টানা হরতাল, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে আগে থেকে চলা হরতাল এদিন শেষ হচ্ছে। পুলিশ-বিজিবি-র্যাবের কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থায় স্বাভাবিকতার একটা চেহারা বজায় রাখতে সরকার সম বলে দাবি করছে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র। কিন্তু রাস্তাঘাটে যানবাহনের স্বল্পতা, দোকানপাটের বন্ধ দরজা আর পেট্রলবোমার আতঙ্কগ্রস্ত পথচারী অন্য চেহারা তুলে ধরছে। আর দূরযাত্রার মহাসড়ক রেলপথ নৌপথে অবরোধ সমানে চলেছে। যার ফলে সারা দেশে বাণিজ্যিক তৎপরতা স্থবির। কলকারখানা চলছে বন্ধ ফটকের আবডালে। কৃষকের ঘরে সবজি, ফলমূল পচছে, বাজারজাত হতে পারছে না। অথচ চাহিদা মোতাবেক আমদানির অভাবে দাম চড়ছে কাঁচামালের হাটবাজারে। সরবরাহ বিভ্রাটে চালের দরও ঊর্ধ্বমুখী। সরকার বাহাদুর জোরগলায় বলছে, আর ১০ দিনে সব অবরোধকারী পিটিয়ে ঠাণ্ডা করে দেয়া হবে; সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়, মতাসীন দলের কর্মীদের হাতেই নাস্তানাবুদ হবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। হুমকি-ধমকি দিতে সরব পুলিশপ্রধান, র্যাবপ্রধান, বিজিবিপ্রধান। দেখামাত্র ‘সন্ত্রাসী’কে গুলি করা হবে, বলছেন তারা। কেউ কেউ এমন কথায় ’৭৪ সালের রীবাহিনীর অভিযানকালে তৎকালীন সরকারের গুলি করার নির্দেশ সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর মন্তব্য স্মরণ করছেন। মওলানা ভাসানী বলেছিলেন : মুজিব, সন্ত্রাসী কি কারো গায়ে লেখা থাকে?
বিএনপি গোষ্ঠী এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো সমস্বরে প্রতিবাদ করেছে, সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর কর্মকর্তাদের এমন নির্দেশ সংবিধানের ও মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, বর্বরতা। অন্য দিকে, পুলিশি হামলার পাল্টা সহিংসতা, চোরাগোপ্তা বোমাবাজি, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, কোথাও কোথাও সামনা-সামনি প্রতিরোধ সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। পুলিশও মারা পড়ছে। অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছে অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে যাত্রী গাড়িচালক পথচারী অনেকে। সুশীলসমাজের নৈরাশ্য প্রকাশ পেয়েছে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকের মন্তব্যে : ‘মনে হয় এই অবস্থা চলতেই থাকবে। চলতে চলতে দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংসের পর একটা সমাধানের পথ বের হয়ে আসবে। ভালো থাকতে তো আর কেউ সমঝোতায় বসবে না!’
বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মুনাজাতের পরদিন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয়ের গেটে পুলিশের তালাবদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েই সংবাদ সম্মেলন করেন। অবরোধে দেশব্যাপী নাশকতার জন্য সরকারকেই দায়ী করে খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অতীতেও এ ধরনের কাজ করেছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সম্পর্কে দেশে-বিদেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মতাসীনেরা নাশকতা ও অন্তর্ঘাতের পথ বেছে নিয়েছে। পুলিশি পাহারার মধ্যে নারী, শিশু, ছাত্রছাত্রীদের বহনকারী যানবাহনে পেট্রলবোমা মেরে অনেক নিরপরাধ মানুষকে হতাহত ও দগ্ধ করা হয়েছে। এসব পৈশাচিক বর্বরতার আমরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দেশের চলমান সঙ্কট নিছক কোনো আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়। এটি রাজনৈতিক সঙ্কট। এর রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমরা মতাসীনদের আবারো আহ্বান জানাচ্ছি।’
সরকারের উদ্দেশে তিনি আরো বলেন, ‘অত্যাচার, দমন অভিযান, গণগ্রেফতার বন্ধ করুন। মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা বন্দীদের মুক্তি দিন। গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের ওপর থেকে সব বাধা তুলে নিন। যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, তা স্বাভাবিক করুন। মানুষকে স্বস্তি ও শান্তি দিন। উসকানি, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচারের অপরাজনীতি বন্ধ করুন। জনগণের ভোট দেয়ার যে অধিকার কেড়ে নিয়েছেন, তা ফিরিয়ে দিন এবং অবিলম্বে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদপে নিন।’
অন্য দিকে, আগের দিন ১৮ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের সাথে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কটা করে বলেন, ‘কেউ যদি ভেবে থাকে যে (ভারতের) বিজেপি ও (মার্কিন) কংগ্রেসম্যানরা সরকার উৎখাত করে বিএনপিকে মতায় বসাবে, তা হবে দুর্ভাগ্যের কথা। (সংবিধান মোতাবেক) বিএনপি-জামায়াত সরকারেও নেই, বিরোধী দলেও নেই। তাদের হাহাকারের আগুন পুড়িয়ে মারছে দেশের মানুষকে। চোখের সামনে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে তা সহ্য করা হবে না। অগ্নিসংযোগ করা ছাড়া বিএনপির আর কোনো আন্দোলন নেই। বিএনপি নেত্রীর আন্দোলনের অর্থ হচ্ছে মানুষ পুড়িয়ে মারা, বাস-ট্রাকে অগ্নিসংযোগ এবং তারা একের পর এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। এমনকি গর্ভবতী মহিলাও তাদের সহিংসতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না। এ দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিশ্বাস করে না। তারা এখনো পাকিস্তানপ্রীতিতে বিশ্বাসী, যা বাঙালি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। বিএনপি বেশ কয়েকবার মতায় এসেছিল এবং প্রতিবারই তারা দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকার দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অচিরেই বিশ্বে মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে পরিণত হবে। দেশের জনগণ বিশ্বাস করে, কেবলমাত্র আওয়ামী লীগই দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং সরকার জনগণের আকাক্সা পূরণে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু বিএনপি এ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেতে চেষ্টা চালাচ্ছে।’
তারপর ২০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বোমা হামলায় দগ্ধদের ছবির পেপার কাটিং দেখালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি দেখানোর সময় প্রধানমন্ত্রী নিজে কাঁদলেন, কাঁদালেন সংসদ সদস্য সবাইকে। তার মন্ত্রী-এমপিদের দিয়ে সংসদে বলালেন : সহিংসতা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হতে পারে না, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অপারেশন কিনহার্ট অথবা যৌথবাহিনী নামিয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পদপে দিতে হবে, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার করতে হবে; বিএনপি-জামায়াতের সাথে কোনো সংলাপ বা আলোচনা হবে না। বিএনপি-জামায়াতকে জঙ্গি সংগঠন উল্লেখ করে দল দু’টিকে নিষিদ্ধ করার দাবিও তোলা হয়। সেই দাবির প্রতিধ্বনি করে মিডিয়ায় বিবৃতি পাঠালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী : ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর কূটনীতিকেরা কেউ কেউ বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকার উদ্যোগ নিলে তার প্রতি তারা সমর্থন দেবে। সাংবাদিকেরা খবর নিয়ে জানল, কেউ কেউ নয়, শুধু ঘোর কর্তৃত্ববাদী মিলিটারি শাসক জেনারেল সিসির তথা মিসরের রাষ্ট্রদূত তার দেশে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করার নজির দিয়ে এ কথা বলেছে।
প্রসঙ্গত, ভূরাজনৈতিক পর্যবেক দু’জন প্রবীণ বৈদেশিক কূটনীতিবিদ বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ভারতের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক-রাষ্ট্রদূত কুলদীপ নায়ার শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের সাফাইও তিনি গেয়েছেন এ কথা বলে : (মূলধারার বিরোধী জোটের) ‘বর্জন সত্ত্বেও সামগ্রিক অর্থে নির্বাচন হয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক জেনারেল এইচ এম এরশাদ কিছু আসন পেতে সম হয়েছেন। এর ভিত্তিতে এটি এখন পার্লামেন্টের প্রধান বিরোধী দল।’ এখন অবস্থাদৃষ্টে এ বছর ৭ জানুয়ারি লিখিত একটি ভাষ্যে তিনি বলেছেন : ‘শেখ হাসিনার শাসন হলো এক ব্যক্তির শাসন। তিনি ুব্ধ হতে পারেন এমন রায় দেয়ার েেত্র বিচার বিভাগও দ্বিধাবোধ করেন। আমলাতন্ত্র, সেটা তো পরিণত হয়েছে তল্পিবাহকে।’
বেগম জিয়ার অভিযোগ হলো, তাকে সারা রাত অফিসে অবরুদ্ধ থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। এ অভিযোগ সত্য হতে পারে। পুলিশ নিজেরাও স্বীকার করেছে যে, তারা খালেদার নিরাপত্তা জোরদার করেছে এবং তিনি চাইলে তাকে তারা তার বাসায় পৌঁছে দিতে পারে। দৃশ্যত, তিনি চাইছিলেন বাইরে এমন কোনো স্থানে যেতে, যেখান থেকে বর্জন করা নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে সমাবেশে যোগ দিতে পারেন।
তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এত দিনে এ দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করা উচিত ছিল। অনেক স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাযোদ্ধারা একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রাধান্য বিস্তারে নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছেন। তাদের থেকে বাংলাদেশে কোনো ভিন্নতা নেই।
বাংলাদেশের জন্মের সময় স্বাধীনতাযোদ্ধা ও গণতন্ত্রের রকেরা যে সামাজিক কাঠামো অর্জন করেছিলেন, তা ছিন্নভিন্ন করে ফেলার প্রচেষ্টা সব থেকে বেদনাদায়ক। সময়ের সাথে সাথে তারা বেশি বেশি মতা দখলের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন, চেয়েছেন প্রাধান্য বিস্তার করতে। তাদের ল্য অর্জনের েেত্র তারা দৃশ্যত কোনো কিছুতে থামেন না। বাংলাদেশ এমনই একটি অবস্থার মাঝে অবস্থান করছে। সেনাবাহিনী যখন মতা দখল করেছে, তখন তারা শাসন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেনারা দেখতে পেয়েছে যে, বাংলাদেশীরা নিজেদের নিজেরাই কঠোরতা ও বিচারবুদ্ধিহীনতার সাথে শাসন করা ভালোবাসেন।
‘ইসলামের প্রতি স্পর্শকাতর অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধর্মনিরপে ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগ। পূর্ব বাংলা থেকে জন্ম হওয়া ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিল পাকিস্তান। পরে পূর্ববাংলা হয় পূর্ব পাকিস্তান। এই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার দাবিকে দমিয়ে রাখা যায়নি, স্বাধীনতার আকাক্সা এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত। এখানকার মানুষ উদার মনের। তারা আধুনিক সময়ে ক্রমাগত ধর্মীয় মানসিকতার হয়ে উঠছেন। প্রায় ১০ লাখ হিন্দু বাস করেন বাংলাদেশে। কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই তারা তাদের ধর্মীয় রীতি পালন করেন।
‘বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হয়নি, কেননা দেশটি এখনো চরমমাত্রায় বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। ঢাকাকে বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় এবং বড় অঙ্কের টাকা সরবরাহ করার জন্য সহযোগিতামূলক একটি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী রয়েছে, যেখানে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে আমেরিকা।
বাংলাদেশী নেতারা যত দিন পর্যন্ত না নিজেদের খতিয়ে দেখবেন, তত দিন অব্যাহতভাবে বিদেশী শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকবেন, যারা স্বভাবতই মূল্য আদায় করে নেবে। তারা যেভাবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে, তাতে বিদেশী প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে কোনো বলিষ্ঠ কার্যক্রম রাজনৈতিক দলগুলোর নেই। বরঞ্চ অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়। বাংলাদেশের ট্র্যাজেডি হলোÑ উভয় বেগম তাদের ব্যক্তিগত বৈরিতার কারণে বহির্বিশ্বের শক্তির সাহায্যে সমর্থন গড়ে তোলা অব্যাহত রেখেছেন। যত দিন তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রোপটে আধিপত্য করবেন, বাংলাদেশের সামান্যই ভবিষ্যৎ রয়েছে। কিন্তু এটা তা হলে পরিবর্তন হবে কিভাবে? দুর্ভাগ্যের কথা, কোনো বিকল্প আবির্ভূত হচ্ছে না।’
‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নতুন নির্বাচনের ঘোষণার প্রত্যাশা করাটা হয়তো অনেক বেশি চাওয়া হবে। এ প্রক্রিয়ায় নিয়মের মধ্যে থেকে ভাগ্য যাচাইয়ে বিএনপিকে একটা সুযোগ দেয়া উচিত। চরম বিভক্ত এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত একটি দেশে মনে হচ্ছে এটাই একমাত্র সমাধানের উপায়। ন্যায়সঙ্গত স্বাভাবিক পরিস্থিতি না আসা পর্যন্ত দেশের মানুষের দরিদ্রতা ঘুচানো সম্ভব নয়, যার যেটা করার প্রতিশ্রুতি উভয় দলই দিয়েছে। রাজনৈতিক েেত্র নতুন সূচনা ব্যতীত এটা সম্ভব নয়, ঘটবেও না।’ কুলদীপ নিজেই আভাস দিচ্ছেন যে, এমন সমাধান (সামরিক হস্তেেপর অস্ত্রোপচার ছাড়া) দুরাশা মাত্র।
অন্য দিকে, বাংলাদেশে অতীতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত (বর্তমানে গ্রন্থকার-গবেষক) উইলিয়াম বি মাইলাম ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ভোটারবঞ্চনার নির্বাচনকে প্রথম থেকেই একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করার অশুভ পাঁয়তারা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কুলদীপ নায়ারের ওই ভাষ্য রচনার প্রায় একই সময়ে রচিত ১৬ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে মাইলাম লিখেছেন :
‘সব ধরনের বিরোধিতার বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা তীব্র করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতারা (প্রকৃতপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাকে আজকের দিনে কারো কাছেই জবাব দিতে হয় না) তাদের সিদ্ধান্তের এই সঙ্কেতবার্তাই পাঠাচ্ছেন যে, আওয়ামী লীগের একদলীয় সরকারকে সংহত করে একদলীয় রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়া তারা সম্পন্ন করতে চাইছে জনগণ তাদের মোহভঙ্গের রোষানলে গণ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে সেটাই সম্ভবত নিপীড়নের চক্রকে তীব্রতা দিচ্ছে। বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে সহিংসতা এবং উসকে দিচ্ছে আরো অনেক বেশি অস্থিতিশীলতা।
এই নিবন্ধ ছাপা হওয়ার আগেই সহিংসতা শুরু হয়ে যেতে পারে। সরকারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিএনপি একটি সমাবেশ করতে চায়। সরকার সম্প্রতি রাজপথের আন্দোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞা ধরে রাখতে যদি তারা চাপ সৃষ্টি করে চলে তাহলে সেটা হবে সহিংসতা পাকানোর মালমসলা।
স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন যেকোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এজেন্ডাই থাকে নিরঙ্কুশ মতা কুগিত করা। আর সেই মতাকে ব্যবহার করে তারা যেকোনো বিরোধী দল, যারা বৈধতা দাবি করতে পারে, তাদের ধ্বংস করতে চায়। বিএনপি যদিও মতায় থাকতে খারাপ রেকর্ড করেছে, কিন্তু তারা বৈধতা দাবি করতে পারে। উভয় দলই দুঃশাসন চালিয়েছে। বেশ কয়েক মাস ধরে এই গুজব চালু রয়েছে যে, কোনো-না-কোনো অভিযোগে বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করা হবে। সেটা সম্ভবত দুর্নীতি কিংবা সম্ভবত ইকোনমিস্টের ভাষ্য মতে, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে। আদালতগুলোর ওপর সরকারের যে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং তাদের স্বৈরতান্ত্রিক মনমানসিকতার যা লণ, তাতে আওয়ামী লীগ কার্যত তাদের সরকারের বিরোধী ভূমিকায় থাকা দলনেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনতে পারে এবং আদালত সে অভিযোগ বহাল রাখবেন। আদপে দেশের অভ্যন্তরে অসন্তোষ দানা বাঁধার আশঙ্কা করে সরকার সব বিরোধী দলের ওপর আগাম আঘাত হানতেই এই আকস্মিক দমনপীড়ন শুরু করেছে।
অনেক পর্যবেকের মতে, আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত জনরোষ এড়াতে পেরেছে কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে থেকেছে। দারিদ্র্য ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে, যদিও তা ঘটেছে নিতান্ত মন্থরগতিতে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি মিডিয়ায় তাঁর পরিকল্পিত নারীর মতায়ন এবং অনগ্রসর শ্রেণীর ভাগ্য উন্নয়নের ছক তুলে ধরেছেন। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে, পরিসংখ্যান যা-ই বলুক, সরকারের অবস্থা বাস্তবে যা, তার চেয়ে অনেক বেশি ইতিবাচকভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে। যে রকম পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, জাতীয় অর্থনীতির চেহারা বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় চেহারা মোটেও সে রকম নয়। সেটা যা-ই হোক না কেন, (রাষ্ট্রনৈতিকভাবে) শেখ হাসিনার বৈধতা কখনোই ততটা শক্ত ভিত্তির ওপর ছিল না, যতটা তিনি নিজে ভাবেন। আর তাই তিনি এক দিকে বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে চেয়েছেন, অন্য দিকে জনসাধারণের চোখে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন (নতুনভাবে) তুলে ধরছেন।
‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্ভবত ধরে নিয়েছে যে, বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র এখন একটি হারানো বিষয়। যদি অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকে এবং বাংলাদেশ অকার্যকর হয়ে পড়ে তাহলে ভারতের হারাবার অনেক কিছুই রয়েছে, কিন্তু তাকে এখনো পর্যন্ত নিরুদ্বেগ মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে যারা আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের বিরোধী তাদের কাছে এ অবস্থা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। পাশ্চাত্য শক্তিগুলো আদৌ কি করতে পারে? তারা কি চেষ্টা করে দেখবে, যাতে বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতাদের জেলের বাইরে রাখা যায় এবং যাতে তাদের কোনো তি না হয় তেমন কোনো পন্থা উদ্ভাবন করা যায় কিনা?
এক রসিক ব্যক্তি সম্প্রতি লিখেছেন যে, ‘শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে প্রশিতি করেছেন, কী করে পীড়ন করা যায়, কী করে চরিত্র হনন করা যায়, কী করে মুক্তকণ্ঠকে স্তব্ধ করা যায়। আর লোক ঠগানোরও প্রশিণ দিয়েছেন, যেমন সাজানো আন্দোলন (শাহবাগ আন্দোলনের মতো) কী করে পাকিয়ে তোলা ও রদ করা যায়; সৃষ্টি করা যায় পোষ্য বিরোধী দল, যেটি হবে তার সরকারের অংশ, যে দলের নেতারা তার মন্ত্রিসভায় বসবে, শাসকদলের পে ভোট দেবে।’ এই অজ্ঞাতনামা লেখক আরো লিখেছেন, ‘তিনি বিশ্বের প্রথম স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্রের মডেল সৃষ্টি করেছেন।’
আমার অনুমান, সুশীলসমাজের গণতান্ত্রিক ব্যক্তিরা এবং বিরোধী দল লড়াই ব্যতিরেকে নতি স্বীকার করবে না। আজ হোক কাল হোক, শান্তিপূর্ণভাবে একটি সরকারের পালাবদলের অনুপস্থিতিতে সহিংসতা হবে এবং তা যথেষ্ট মারাত্মক হতে পারে। আমরা (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়) আমাদের ঔদাসিন্যের জন্য পরে পস্তাতে পারি। সহিংসতার পরিণামে যেসব অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে তার মধ্যে সাধারণত সেনাবাহিনীর মতা দখল অন্যতম।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট
No comments