বার্ন ইউনিটে দর্শনার্থীদের ভিড় কমানোর পরামর্শ
বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাঁদের সঙ্গে
আসা লোকজন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবাদকর্মীদের ভিড়ে আগুনে পোড়া
মানুষের সেবা ব্যাহত হচ্ছে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংক্রমণসহ
মৃত্যুঝুঁকির আশঙ্কা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে ভিড় এড়িয়ে প্রয়োজনীয়
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে দর্শনার্থীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন ঢাকা
মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসকেরা।
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সূত্র বলছে, গতকাল বৃহস্পতিবারও ১০০ শয্যার বার্ন ইউনিটে পাঁচ শতাধিক রোগী ভর্তি ছিলেন। ওয়ার্ড, হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (তুলনামূলক গুরুতর অবস্থা এমন রোগীদের এখানে রাখা হয়), নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র—সব জায়গাতেই গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে রোগীদের। সঙ্গে আছে দর্শনার্থীদের ভিড়। এরই মধ্যে চলমান হরতাল-অবরোধের সহিংসতায় দগ্ধদের জন্য আলাদা একটি ওয়ার্ড করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ভর্তি ছিলেন ২৩ জন। তাঁদের মধ্যে চারজন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আছেন। গত পরশু রাতে ভর্তি ৩৫ বছর বয়সী অটোরিকশাচালক আবদুর রশীদের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। শ্বাসনালিসহ তাঁর ৩৯ শতাংশ পুড়ে গেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে মনে করেন, পরিষ্কার জামাকাপড় বা চকচকে জুতা পরে ঢুকলে সংক্রমণ ঘটবে না। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। চামড়া মানুষকে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে। চামড়া পুড়ে যাওয়ায় দগ্ধ রোগীরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে ভোগেন বেশি। চিকিৎসকেরাও অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষ সতর্কতা অনুসরণ করে থাকেন।
ভিড় এড়িয়ে দগ্ধ রোগীদের পুনর্বাসনের বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক উপদেষ্টা সামন্ত লাল সেন।
চিকিৎসকেরা জানান, সম্প্রতি সংক্রমণের কারণে ১৭ বছরের এক তরুণ মারা গেছে। ৫৭ শতাংশ পোড়া নিয়ে ভর্তি হওয়া ওই রোগীটি ৮০ ভাগ সুস্থ হয়ে উঠেছিল। ১৮ দিন পর সে মারা যায়। এ ছাড়া হরতাল-অবরোধের সহিংসতায় দগ্ধ একজন যুবকের দুই হাতেও সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। সংক্রমণের কারণে তার সেরে উঠতে অনেকটা সময় লাগতে পারে। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিদগ্ধদের দেখতে যাওয়া একটি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তবে এখন থেকে যেন ভিড় না হয়, সে বিষয়ে বার্ন ইউনিটের সঙ্গে আলোচনা করে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, হরতাল-অবরোধের পেট্রলবোমায় দগ্ধদের দেখতে এ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে গেছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সমাজকল্যাণমন্ত্রী মহসিন আলী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ, প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা। একমাত্র কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যেকেই দলবল নিয়ে আসেন। এমনকি ১০০ জন পর্যন্ত সঙ্গী নিয়েও ইউনিটে ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। অনেকে বার্ন ইউনিটে যাওয়ার আগে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবর দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরাও প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ইউনিটে হাজির হচ্ছেন।
ইউনিটের একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে একত্রে অসংখ্য মানুষ কোনো রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নিয়েই হুড়মুড় করে রোগীদের কাছে চলে যাচ্ছেন। এমনকি তাঁরা নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র ও হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটেও ঢুকে পড়ছেন। সাধারণত বিভাগীয় প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অভ্যর্থনা জানান। এমন ঘটনাও ঘটছে, দর্শনার্থীদের চাপে তিনিই এই ব্যক্তিদের রোগীদের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানাতে পারছেন না। সংবাদকর্মীরাও মাঝে মাঝে যথেষ্ট বিবেচনাবোধের পরিচয় দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন কমপক্ষে ছয়জন চিকিৎসক। তাঁরা বলছেন, রোগী আসার পরপরই চিকিৎসার প্রয়োজন, কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তিরা হাসপাতালে ঢোকার পরপরই সংবাদকর্মীদের মধ্যে ছবি নেওয়া এবং কথা বলার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। চিকিৎসকেরা বলেছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিক যতজনকে অনুমতি দেবেন, শুধু ততজনই যথাযথ ব্যবস্থা অনুসরণ করে ঢুকলে রোগীরা সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে পারেন। বার্ন ইউনিটে ঢোকার আগে দর্শনার্থীদের একবারই ব্যবহার করা যায় এমন গাউন, শু-কভার ও মাস্ক ব্যবহারের অনুরোধ করেছেন তাঁরা। এ ছাড়া সংগৃহীত খবর ও ছবি সংবাদকর্মীরা নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করলে কিছুটা ভিড় কমবে।
জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাইখ সিরাজ বলেন, ‘চিকিৎসকদের উদ্বেগ যুক্তিসংগত। কিন্তু আমাদের মধ্যে ধৈর্য একেবারেই নেই। এ নিয়ে আমরা আলোচনা করব। সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।’
গতকাল হরতাল-অবরোধে দগ্ধদের দেখতে বার্ন ইউনিটে যান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন সংসদের হুইপ আ স ম ফিরোজসহ সাংসদ, কর্মকর্তারা।
রাজনৈতিক সহিংসতার মূল কারণ অবৈধ সরকার ও সংসদ বলে বিএনপি যে দাবি করছে, সে বিষয়ে স্পিকারের মন্তব্য জানতে চাইলে স্পিকার সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিরীহ ব্যক্তিদের দগ্ধ করা ছাড়া কি এর সমাধানে আর কোনো পথ নেই’? সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে জাতীয় সংসদের ভূমিকা কী—এমন প্রশ্নের জবাবে স্পিকার বলেন, ‘এ মুহূর্তে যে ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছে, তা বন্ধে আমরা সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে ধরনের দৃশ্য ভেতরে দেখতে হলো, তা কলঙ্কজনক। খুবই নৃশংস ও নারকীয়। এ ধরনের সন্ত্রাস, সহিংসতা রাজনীতি হতে পারে না। এ ধরনের সন্ত্রাস বন্ধে প্রত্যেক সচেতন বিবেকবান মানুষকে উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদেরও একই দাবি, এ ধরনের আক্রমণ বন্ধ করেন।’ স্পিকার জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে অগ্নিদগ্ধ প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা দেন।
No comments