একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু কবি গোবিন্দ হালদার by কামাল লোহানী
‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি,
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’
পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রবল প্রাণের উচ্ছ্বাসে গর্জে ওঠা প্রতিরোধ সংগ্রমের চূড়ান্ত পর্যায়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় রচনার একটি অমোঘ অস্ত্র- এ গানটির রচয়িতা গোবিন্দ হালদার। জন্মেছিলেন পশ্চিম পরগনার বনগাঁর পূর্বপাড়ায়। চাকরি করতেন ভারত সরকারের জীবনবীমা দফতরে, ছোট্ট একটি পদে। অথচ ছোটখাটো সরলপ্রাণ মানুষটির জীবনে কী অসাধারণ দোলা লাগল পূর্ববাংলার অকুতোভয় জনগণের বিপুল বিপ্লবে। একটি মানুষ আরেকটি মানুষের বিপন্নতা আর নৃশংসতায় কী অসাধারণ মানবিক প্রেমে নিজের প্রতিবাদের ভাষাকে কলমে কালিতে সৃষ্টি করেছেন। কোমল প্রাণ মানুষ ফুলকে সে ভালোবাসেন প্রাণের বৈভবে তাই বুঝি কবি আবেগের অসীম সাহসকিতায় জনগোষ্ঠীর প্রতীক এ ফুলকে বাঁচানোর যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। গণমানুষের মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধারণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।... এই যোদ্ধা কবির সাহসী কলমে তাই কালি হয়ে রক্ত ঝরলেও বিজয়ের পূর্বগগনে রক্তলাল সূর্যের উদয়কে ইঙ্গি করেছেন।
এমনি এক সহযোদ্ধা কবি-গীতিকার গোবিন্দ হালদারকে আমরা হারিয়েছি দীর্ঘ অসুস্থতা আর বার্ধক্যের কারণে। গোবিন্দ ভুগছিলেন কয়েক বছর ধরে। নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। প্রয়োজন ছিল নিবীড় পরিচর্যা আর চিকিৎসার। সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ তিনি সামান্য বেতন পেতেন। অবসরে যে অর্থ জোগান হয় তাতে দিনগুজরান ছিল অসম্ভব। কিন্তু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান সত্ত্বেও আমরা, সরকার, রাষ্ট্র- কেউই তার প্রতি কোনো নজর দেইনি। তিনি আমাদের কাছে যতটা পরিচিত ছিলেন তেমনি কলকাতা কিংবা পশ্চিবঙ্গে ছিল না। সে কারণে আমাদের দায়িত্বটা অনেক বেশি ছিল। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলায় গোবিন্দ হালদার বিস্মরণেই চলে গিয়েছিলেন। বোধহয়, নব্বই দশকেও যদি তাকে দেখতে গিয়ে তার হতদরিদ্র অবস্থা না দেখতাম, তাহলে আমাদেরও চৈতন্যেদয় ঘটত কিনা সন্দেহ আছে।
সেবার গোবিন্দদাকে দেখতে গিয়েছিলাম বন্ধু কবি-সাংবাদিক জিয়াদ আলীকে নিয়ে। ওঁর স্বামী বিবেকানন্দ সরণির সরকারি ঘরখানা থেকে বেরিয়ে স্থানীয় সিপিএম বন্ধুদেরও বলেছিলাম খোঁজখবর রাখার জন্য। কিন্তু তা হয়নি। যা হোক ওর একমাত্র সন্তান গোপাকে খুঁজেছিলাম দেখভাল কীভাবে হচ্ছে জানার জন্য। বাসায় পাইনি, কারণ ও অন্যত্র থাকে। পরে জানতে পেরে আমায় টেলিফোন করল এবং কথা বলতে বলতে জানাতে চাইল বাবার যদি মন্দ কোনো একটা ঘটনা ঘটে যায় তাহলে কি করবো, কাকু?’ কথাটা শুনে আমি একটু চিন্তিত হলাম। কি হবে আবার? বুঝলাম কথায়, যদি মৃত্যু হয় তাহলে কি করে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে? ওকে বললাম, যা হবে তার জন্যে কোনো চিন্তা করো না, আমরা এখন থেকে চিকিৎসার সব ব্যয়ভার গ্রহণ করলাম। মাসে যে খরচ হয় আমরাই পাঠিয়ে দেব। ঠিকমতো চিকিৎসা করো। আমি ফিরে এসে গোবিন্দকে নিয়ে একটা লেখা লিখলাম খবরের কাগজে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়ে টাকা সংগ্রহ করল। ওদিকে নিউইয়র্কে বাঙালিরা একত্রিত হয়ে গোবিন্দ হালদারকে অবহেলার জন্য ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। তারা আমার লেখাটি পড়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যতটা সম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করার। অর্থ সংগ্রহ করলেন আমার কাছ থেকে গোবিন্দ হালদারের ভারতীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বরটা নিলেন। সেখানেই ওরা চার হাজার ডলার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মীদের মধ্য থেকেও কিছু টাকা পাঠান হল বটে কিন্তু তার চিকিৎসাসেবা দেখাশোনার জন্য কাউকে দায়িত্ব নেয়া উচিত ছিল। সেটা কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন নিতে পারত। কিন্তু তারা ধারে কাছেও ছিল না।
এর মধ্যে মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোবিন্দ হালদারের বিপন্নতার কথা জানতে পেরে ১৫ লাখ টাকা অনুদান হিসেবে দেন। এতে গোবিন্দ হালদার ওই ছোট কুঠুরি থেকে মুক্তি পান এবং কাকুরগাছি এলাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনে সেখানে ওঠেন। এরপর তার অসুস্থতার কারণে বারবার হাসপাতাল আর বাসা করতে থাকেন। সবশেষে ১৩ ডিসেম্বর তাকে মানিকতলায় জিতেন্দ্রনাথ রায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কিডনির জটিলতায়। অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। খবর পান হাসিনা এবং তিনি নিজে তার সঙ্গে কলকাতায় কথা বলেন। আশ্বাস দেন তার চিকিৎসার দায়িত্ব তিনি বহন করছেন। সেদিন ছিল ২০ ডিসেম্বর। আর ২২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা পৌঁছেই হাসপাতালে গোবিন্দদাকে দেখতে যান। তিনিও আশ্বস্ত করেন।
শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সহায়তা প্রদান ও সহযোগিতা দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। এ পর্যায়ে গোবিন্দ হালদারকেও তার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান করা হয় এবং তার কন্যা গোপা ও জামাই চিন্ময় এ সম্মাননা গ্রহণের জন্য ঢাকা আসে। ওরা আমার বাসায়ও এসেছিল দেখা করতে। সঙ্গে ছিলেন ওদের পরিবারের সুহৃদ নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাবেদ আলী। তখন গোবিন্দ আসতে পারেননি, তার অসুস্থতার কারণে।
আমাদের এ অকৃত্রিম বন্ধু গোবিন্দ হালদার ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ জিএন রায় হাসপাতালে পরলোকগমন করেছেন। এর পরপরই মেয়ে গোপার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বেলা ১১টায় মারা গেছেন এবং হাসপাতাল থেকে বেরুতে প্রায় ৩টা বেজে যাবে। বৌদি পারুল হালদার সেখানে ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাসায়। গোপা বলল, মাকে আনিনি। বাবাকে তো হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যাব। নিমতলা শ্মশানঘাটে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। এতদিনেও বৌদির ফোন নম্বরটা পাইনি। তাই রাত সাড়ে ১১টায় ফোন করে কথা বললাম। তিনি কাঁদছিলেন অঝোরে। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘সবশেষ হয়ে গেল। দাদা আমারতো কিছু রইল না।’
এরই মধ্যে পারুল বৌদি বললেন, বাংলাদেশ দূতবাসের উপপ্রধান এবং প্রথম সেক্রেটারি (প্রেস) খবর পেয়েই হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তখন থেকে শ্মশানঘাটে শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। ওরা কী ভালো মানুষ। ওরা আমাকে মা বলে ডেকেছেন, সম্বোধন করেছেন। কথাগুলোর মধ্যে দারুণ আবেগ ছিল। দুঃখ একটাই রয়ে গেল আমাদের জন্য গোবিন্দ হালদারের সচেতন ভালোবাসা, মুক্তি সংগ্রামের প্রতি তার যে শ্রদ্ধাবোধ, যা থেকে তিনি এদেশের মানুষ না হয়েও মুক্তিযুদ্ধের ওপর এতগুলো গান লিখে দিয়েছিলেন, তাকে যথার্থ সম্মান দেখানো অথবা তার উপযুক্ত মূল্যায়ন বহুদিন পর্যন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকার তো করবে না জানি, তো আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত ছিলাম তারা কেন করতে পারলাম না। বেতার-টিভির রয়ালটি কেন পাননি এত বছরেও? তবুও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বর্তমান সরকার তার জীবনাবসানের আরও কয়েকটা বছর যা করেছেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মীরাও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
গোবিন্দ হালদারের কালজয়ী গানগুলো মানুষের হৃদয় পটে যেমন সাহস সঞ্চার করেছিল তেমনি রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা প্রেরণা পেয়েছিলেন পাকিস্তানি হায়েনা শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।
কবি লিখছেন, পদ্মা মেঘনা যমুনা
তোমার আমার ঠিকানা।
এক বাংলার কোটি প্রাণ আজ
একই পথের নিশানা।
যুদ্ধ চলছে হায়েনাদের বিরুদ্ধে। কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবক-সাধারণ মানুষ পর্যন্ত একজোট হয়ে ছুটেছিল মুক্তিযুদ্ধে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে। বন্ধু তুমি কমরেড, অনুপ্রেরণার সঙ্গে নির্দেশ দিয়ে লিখেছিলে?
লেফট রাইট লেফট রাইট লেফট
নওজোয়ান সব এগিয়ে চলো
এগিয়ে চলো।
পথে পথে বাধার পাহাড়
বিদ্যুৎগতিতে পায়ে দলো।
গোবিন্দ হালদার লিখেছিলেন যেসব গান তার মধ্য থেকে প্রথম সেটির সুরারোপিত হয়েছিল, সেটি হলো;
‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’
জীবনসংগ্রামে শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আবেগে উল্লিখিত এই গানটি যেদিন প্রথম সন্ধ্যা অধিবেশনে স্বাধীন বাংলা বেতারে বেজে উঠল, মানুষের প্রাণে প্রাণে সে কী শক্তির প্রাবল্য লক্ষ্য করেছিলাম, আজ তা বোঝাতে পারব না! কবি বন্ধু তোমার কলম থেকে ঝরেছে কী মর্মস্পর্শী অন্তরঙ্গবাণী :
যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা
যার নদীজল ফুলে ফলে মোর স্বপ্ন আঁকা।
সে নদীর নীল অম্বর মোর মেলছে পাখা
সারাটা জীবন সে মাটির গানে অস্ত্র ধরি।
সীমাহীন মাতৃপ্রেম তোমার লেখায় উচ্ছল ছন্দে প্রকাশিত হয়েছে।
নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পিশাচদের ছেড়ে দেয়ার পরও মনকে কঠিন করে তুমি বন্ধু গোবিন্দ হালদার লিখেছিলে:
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলব না।
দুঃসহ এ বেদনার কণ্টক পথ বেয়ে
শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা
আমরা তোমাদের ভুলব না।
কবি-সহযোদ্ধা বন্ধু, তোমার পথনির্দেশ, আমরা বোধহয় মানতে পারিনি বলে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি আন্দোলন-সন্ত্রাস-জনহিংসতা, নৃশংস নরহত্যা আবার গণহত্যায় রুপ নিয়েছে। একে রুখতে আবার একাট্টা হতে হবে জনতার আকাক্সিক্ষত রাজনৈতিক অঙ্গীকারে। বন্ধু গোবিন্দ, তুমি অমর- চিরভাস্মর বাঙালির মনে প্রাণে।
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’
পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রবল প্রাণের উচ্ছ্বাসে গর্জে ওঠা প্রতিরোধ সংগ্রমের চূড়ান্ত পর্যায়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় রচনার একটি অমোঘ অস্ত্র- এ গানটির রচয়িতা গোবিন্দ হালদার। জন্মেছিলেন পশ্চিম পরগনার বনগাঁর পূর্বপাড়ায়। চাকরি করতেন ভারত সরকারের জীবনবীমা দফতরে, ছোট্ট একটি পদে। অথচ ছোটখাটো সরলপ্রাণ মানুষটির জীবনে কী অসাধারণ দোলা লাগল পূর্ববাংলার অকুতোভয় জনগণের বিপুল বিপ্লবে। একটি মানুষ আরেকটি মানুষের বিপন্নতা আর নৃশংসতায় কী অসাধারণ মানবিক প্রেমে নিজের প্রতিবাদের ভাষাকে কলমে কালিতে সৃষ্টি করেছেন। কোমল প্রাণ মানুষ ফুলকে সে ভালোবাসেন প্রাণের বৈভবে তাই বুঝি কবি আবেগের অসীম সাহসকিতায় জনগোষ্ঠীর প্রতীক এ ফুলকে বাঁচানোর যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। গণমানুষের মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধারণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।... এই যোদ্ধা কবির সাহসী কলমে তাই কালি হয়ে রক্ত ঝরলেও বিজয়ের পূর্বগগনে রক্তলাল সূর্যের উদয়কে ইঙ্গি করেছেন।
এমনি এক সহযোদ্ধা কবি-গীতিকার গোবিন্দ হালদারকে আমরা হারিয়েছি দীর্ঘ অসুস্থতা আর বার্ধক্যের কারণে। গোবিন্দ ভুগছিলেন কয়েক বছর ধরে। নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। প্রয়োজন ছিল নিবীড় পরিচর্যা আর চিকিৎসার। সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ তিনি সামান্য বেতন পেতেন। অবসরে যে অর্থ জোগান হয় তাতে দিনগুজরান ছিল অসম্ভব। কিন্তু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান সত্ত্বেও আমরা, সরকার, রাষ্ট্র- কেউই তার প্রতি কোনো নজর দেইনি। তিনি আমাদের কাছে যতটা পরিচিত ছিলেন তেমনি কলকাতা কিংবা পশ্চিবঙ্গে ছিল না। সে কারণে আমাদের দায়িত্বটা অনেক বেশি ছিল। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলায় গোবিন্দ হালদার বিস্মরণেই চলে গিয়েছিলেন। বোধহয়, নব্বই দশকেও যদি তাকে দেখতে গিয়ে তার হতদরিদ্র অবস্থা না দেখতাম, তাহলে আমাদেরও চৈতন্যেদয় ঘটত কিনা সন্দেহ আছে।
সেবার গোবিন্দদাকে দেখতে গিয়েছিলাম বন্ধু কবি-সাংবাদিক জিয়াদ আলীকে নিয়ে। ওঁর স্বামী বিবেকানন্দ সরণির সরকারি ঘরখানা থেকে বেরিয়ে স্থানীয় সিপিএম বন্ধুদেরও বলেছিলাম খোঁজখবর রাখার জন্য। কিন্তু তা হয়নি। যা হোক ওর একমাত্র সন্তান গোপাকে খুঁজেছিলাম দেখভাল কীভাবে হচ্ছে জানার জন্য। বাসায় পাইনি, কারণ ও অন্যত্র থাকে। পরে জানতে পেরে আমায় টেলিফোন করল এবং কথা বলতে বলতে জানাতে চাইল বাবার যদি মন্দ কোনো একটা ঘটনা ঘটে যায় তাহলে কি করবো, কাকু?’ কথাটা শুনে আমি একটু চিন্তিত হলাম। কি হবে আবার? বুঝলাম কথায়, যদি মৃত্যু হয় তাহলে কি করে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে? ওকে বললাম, যা হবে তার জন্যে কোনো চিন্তা করো না, আমরা এখন থেকে চিকিৎসার সব ব্যয়ভার গ্রহণ করলাম। মাসে যে খরচ হয় আমরাই পাঠিয়ে দেব। ঠিকমতো চিকিৎসা করো। আমি ফিরে এসে গোবিন্দকে নিয়ে একটা লেখা লিখলাম খবরের কাগজে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়ে টাকা সংগ্রহ করল। ওদিকে নিউইয়র্কে বাঙালিরা একত্রিত হয়ে গোবিন্দ হালদারকে অবহেলার জন্য ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। তারা আমার লেখাটি পড়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যতটা সম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করার। অর্থ সংগ্রহ করলেন আমার কাছ থেকে গোবিন্দ হালদারের ভারতীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বরটা নিলেন। সেখানেই ওরা চার হাজার ডলার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মীদের মধ্য থেকেও কিছু টাকা পাঠান হল বটে কিন্তু তার চিকিৎসাসেবা দেখাশোনার জন্য কাউকে দায়িত্ব নেয়া উচিত ছিল। সেটা কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন নিতে পারত। কিন্তু তারা ধারে কাছেও ছিল না।
এর মধ্যে মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোবিন্দ হালদারের বিপন্নতার কথা জানতে পেরে ১৫ লাখ টাকা অনুদান হিসেবে দেন। এতে গোবিন্দ হালদার ওই ছোট কুঠুরি থেকে মুক্তি পান এবং কাকুরগাছি এলাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনে সেখানে ওঠেন। এরপর তার অসুস্থতার কারণে বারবার হাসপাতাল আর বাসা করতে থাকেন। সবশেষে ১৩ ডিসেম্বর তাকে মানিকতলায় জিতেন্দ্রনাথ রায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কিডনির জটিলতায়। অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। খবর পান হাসিনা এবং তিনি নিজে তার সঙ্গে কলকাতায় কথা বলেন। আশ্বাস দেন তার চিকিৎসার দায়িত্ব তিনি বহন করছেন। সেদিন ছিল ২০ ডিসেম্বর। আর ২২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা পৌঁছেই হাসপাতালে গোবিন্দদাকে দেখতে যান। তিনিও আশ্বস্ত করেন।
শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সহায়তা প্রদান ও সহযোগিতা দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। এ পর্যায়ে গোবিন্দ হালদারকেও তার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান করা হয় এবং তার কন্যা গোপা ও জামাই চিন্ময় এ সম্মাননা গ্রহণের জন্য ঢাকা আসে। ওরা আমার বাসায়ও এসেছিল দেখা করতে। সঙ্গে ছিলেন ওদের পরিবারের সুহৃদ নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাবেদ আলী। তখন গোবিন্দ আসতে পারেননি, তার অসুস্থতার কারণে।
আমাদের এ অকৃত্রিম বন্ধু গোবিন্দ হালদার ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ জিএন রায় হাসপাতালে পরলোকগমন করেছেন। এর পরপরই মেয়ে গোপার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বেলা ১১টায় মারা গেছেন এবং হাসপাতাল থেকে বেরুতে প্রায় ৩টা বেজে যাবে। বৌদি পারুল হালদার সেখানে ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাসায়। গোপা বলল, মাকে আনিনি। বাবাকে তো হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যাব। নিমতলা শ্মশানঘাটে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। এতদিনেও বৌদির ফোন নম্বরটা পাইনি। তাই রাত সাড়ে ১১টায় ফোন করে কথা বললাম। তিনি কাঁদছিলেন অঝোরে। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘সবশেষ হয়ে গেল। দাদা আমারতো কিছু রইল না।’
এরই মধ্যে পারুল বৌদি বললেন, বাংলাদেশ দূতবাসের উপপ্রধান এবং প্রথম সেক্রেটারি (প্রেস) খবর পেয়েই হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তখন থেকে শ্মশানঘাটে শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। ওরা কী ভালো মানুষ। ওরা আমাকে মা বলে ডেকেছেন, সম্বোধন করেছেন। কথাগুলোর মধ্যে দারুণ আবেগ ছিল। দুঃখ একটাই রয়ে গেল আমাদের জন্য গোবিন্দ হালদারের সচেতন ভালোবাসা, মুক্তি সংগ্রামের প্রতি তার যে শ্রদ্ধাবোধ, যা থেকে তিনি এদেশের মানুষ না হয়েও মুক্তিযুদ্ধের ওপর এতগুলো গান লিখে দিয়েছিলেন, তাকে যথার্থ সম্মান দেখানো অথবা তার উপযুক্ত মূল্যায়ন বহুদিন পর্যন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকার তো করবে না জানি, তো আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত ছিলাম তারা কেন করতে পারলাম না। বেতার-টিভির রয়ালটি কেন পাননি এত বছরেও? তবুও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বর্তমান সরকার তার জীবনাবসানের আরও কয়েকটা বছর যা করেছেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মীরাও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
গোবিন্দ হালদারের কালজয়ী গানগুলো মানুষের হৃদয় পটে যেমন সাহস সঞ্চার করেছিল তেমনি রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা প্রেরণা পেয়েছিলেন পাকিস্তানি হায়েনা শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।
কবি লিখছেন, পদ্মা মেঘনা যমুনা
তোমার আমার ঠিকানা।
এক বাংলার কোটি প্রাণ আজ
একই পথের নিশানা।
যুদ্ধ চলছে হায়েনাদের বিরুদ্ধে। কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবক-সাধারণ মানুষ পর্যন্ত একজোট হয়ে ছুটেছিল মুক্তিযুদ্ধে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে। বন্ধু তুমি কমরেড, অনুপ্রেরণার সঙ্গে নির্দেশ দিয়ে লিখেছিলে?
লেফট রাইট লেফট রাইট লেফট
নওজোয়ান সব এগিয়ে চলো
এগিয়ে চলো।
পথে পথে বাধার পাহাড়
বিদ্যুৎগতিতে পায়ে দলো।
গোবিন্দ হালদার লিখেছিলেন যেসব গান তার মধ্য থেকে প্রথম সেটির সুরারোপিত হয়েছিল, সেটি হলো;
‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’
জীবনসংগ্রামে শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আবেগে উল্লিখিত এই গানটি যেদিন প্রথম সন্ধ্যা অধিবেশনে স্বাধীন বাংলা বেতারে বেজে উঠল, মানুষের প্রাণে প্রাণে সে কী শক্তির প্রাবল্য লক্ষ্য করেছিলাম, আজ তা বোঝাতে পারব না! কবি বন্ধু তোমার কলম থেকে ঝরেছে কী মর্মস্পর্শী অন্তরঙ্গবাণী :
যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা
যার নদীজল ফুলে ফলে মোর স্বপ্ন আঁকা।
সে নদীর নীল অম্বর মোর মেলছে পাখা
সারাটা জীবন সে মাটির গানে অস্ত্র ধরি।
সীমাহীন মাতৃপ্রেম তোমার লেখায় উচ্ছল ছন্দে প্রকাশিত হয়েছে।
নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পিশাচদের ছেড়ে দেয়ার পরও মনকে কঠিন করে তুমি বন্ধু গোবিন্দ হালদার লিখেছিলে:
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলব না।
দুঃসহ এ বেদনার কণ্টক পথ বেয়ে
শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা
আমরা তোমাদের ভুলব না।
কবি-সহযোদ্ধা বন্ধু, তোমার পথনির্দেশ, আমরা বোধহয় মানতে পারিনি বলে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি আন্দোলন-সন্ত্রাস-জনহিংসতা, নৃশংস নরহত্যা আবার গণহত্যায় রুপ নিয়েছে। একে রুখতে আবার একাট্টা হতে হবে জনতার আকাক্সিক্ষত রাজনৈতিক অঙ্গীকারে। বন্ধু গোবিন্দ, তুমি অমর- চিরভাস্মর বাঙালির মনে প্রাণে।
No comments