কৃষকবন্ধু ‘হ্যাপি আপা’ ব্য by সুমন মোল্লা ও দিলীপ কুমার সাহা
ছাইদুন্নেছা হ্যাপি |
দূর
থেকে বোঝার উপায় নেই, কেউ খেতে কাজ করছেন। ছাইদুন্নেছা হ্যাপি উচ্চ স্বরে
‘মতি ভাই’ বলে ডাক দিলেন। পা কয়েক দূর থেকেই জবাব এল, ‘আফা, আমি তো আফনার
কথাই মনে করতাছি।’ কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন ছাইদুন্নেছা। কাছে গিয়ে
দেখা গেল, পঞ্চাশোর্ধ্ব এক কৃষক জমিতে কাজ করছেন। নাম মতি মিয়া।
মুলাখেতের পরিচর্যা করছেন তিনি। মতি মিয়ার মতো খিলপাড়া ব্লকের সব কৃষকের
কাছেই ছাইদুন্নেছা ‘হ্যাপি আপা’ নামে পরিচিত। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি
কার্যালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তিনি। খিলপাড়া ব্লক উপজেলার ৮ নম্বর
মারিয়া ইউনিয়নের। চার বছর ধরে তিনি ওই ব্লকের দায়িত্বে আছেন। আধুনিক ও
জুতসই প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে এই ব্লকে চাষাবাদে এসেছে ব্যাপক সাফল্য।
ব্লকের দেড় হাজার কৃষক ও তাঁদের পরিবারের কাছে ছাইদুন্নেছা কৃষকবন্ধু
হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
কৃষিকাজে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে গত বছর বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন এই কৃষি কর্মকর্তা। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, ছাইদুন্নেছা তাঁর পেশাকে শুধু চাকরির ফ্রেমে আবদ্ধ রাখেননি। একজন সুনাগরিকের দায় থেকে তাঁর কর্তব্য পালন করছেন। (কৃষকের বাড়ির আঙিনায় গোবর ও উচ্ছিষ্ট ব্যবহার করে জৈবসার তৈরির কাজ তদারক করছেন কৃষি কর্মকর্তা ছাইদুন্নেছা হ্যাপি। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো) ইউনিয়নের খিলপাড়া, ঝাটাশিরা, কাতিয়ারচর, পাঠানকান্দি ও পেড়াভাঙ্গা গ্রাম নিয়ে খিলপাড়া ব্লক। কয়েক বছর আগেও এ ব্লকের বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি থাকত। কৃষিকাজে লাভ নেই—এমনটাই বিশ্বাস ছিল স্থানীয় ব্যক্তিদের। কিন্তু ছাইদুন্নেছা দায়িত্ব নেওয়ার পর কৃষকেরা ধীরে ধীরে এই বিশ্বাস থেকে বের হয়ে আসেন। ওই ব্লকের জমির পরিমাণ ৪০০ হেক্টর। এখন খাল, বিল আর ডোবা ছাড়া এক চিলতে জমিও অনাবাদি নেই। ঝাটাশিরা গ্রামের রিংকু বেগম বলেন, ‘আপা শিখাইছে কীভাবে একসঙ্গে কয়েক জাতের সবজি চাষ করা যায়। এখন বাড়ির আঙিনায়ও সবজি চাষ করছি।’
ছাইদুন্নেছা কৃষকদের শিখিয়েছেন, কীভাবে আদর্শ বীজতলা গড়ে তুলতে হয়। ফলন বাড়াতে লঘুপদ্ধতির গুরুত্ব কী, শুরুতে কৃষকেরা এ সূত্র মানতে চাইতেন না। লঘু পদ্ধতিতে ১০ লাইন পর পর এক লাইন ফাঁকা রাখতে হয়। এতে ফলনের পরিমাণ কমে যায় বলে ধারণা ছিল কৃষকদের। কিন্তু এখন ব্লকের জমিতে শতভাগ লঘুপদ্ধতিই লক্ষ করা গেছে। এক মিটার পর পর ৫০ সেন্টিমিটার ফাঁকা রেখে আদর্শ বীজতলা গড়ে তোলার মন্ত্র এখন কৃষকদের অজানা নয়।
ব্লকের পাঁচটি গ্রামকে বাইরের মানুষের কাছে ‘কম্পোস্ট ভিলেজ’ হিসেবে পরিচিত করে তুলেছেন ছাইদুন্নেছা। কয়েক বছর আগেও ব্লকের কৃষকেরা জমিতে শতভাগ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফসল ফলাতেন। কিন্তু ছাইদুন্নেছা শিখিয়েছেন, বাড়ির আঙিনায় পড়ে থাকা উপকরণ দিয়েই কীভাবে সার তৈরি হয় এবং সেই সার ফলনের জন্য কতটা ভালো। কৃষকেরা এখন গোবর দিয়ে গর্ত পদ্ধতিতে গর্তকম্পোস্ট আর রাস্তার পাশে কচুরিপানা দিয়ে কম্পোস্ট হিপ করেছেন।
খিলপাড়া গ্রামের কৃষক জহির মিয়া বললেন, ‘পাখি ডাইক্কা আনাও যে কৃষিকাজের অংশ, আপা আওয়ার আগে আমরা কেউ জানতাম না।’ তিনি জানান, এ পদ্ধতির জন্য জমিতে ডাল পুঁতে পাখিদের বসার ব্যবস্থা করতে হয়, যাতে পাখি সেখানে বসে খেতের পোকমাকড় খেতে পারে। ফলে জমিতে আর কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় না।
ব্যাংকঋণ না মিললেও তার সমাধান বাতলেছেন ছাইদুন্নেছা। ব্লকে তিনটি কৃষক দল গঠন করেছেন। দুটি পুরুষ, একটি নারী দল। দলের প্রত্যেক সদস্যের মাসিক চাঁদা ৫০ টাকা। এ জন্য পৃথক ব্যাংক হিসাবও খোলা হয়েছে। প্রতি মাসে কৃষক দলগুলোর উঠান বৈঠক হচ্ছে। তিন হিসাবে এখন সঞ্চয়ের পরিমাণ কয়েক লাখ টাকা। সেই টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে দুটি পাওয়ার টিলারও।
পাঠানকান্দি গ্রামের কৃষক হাসিম উদ্দিন বলেন, ‘এখন আমরা নিজেদের মেশিন দিয়েই চাষ করি। এ জন্য একরপ্রতি ৮০০ টাকা জমা রাখি। তাতে কৃষক ও সমিতি দুই পক্ষেরই লাভ।’
জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার চন্ডিপাশা গ্রামের মেয়ে ছাইদুন্নেছা (৩২)। তাঁর হাত ধরে একটি ব্লকে কৃষিবিপ্লব ঘটেছে। কৃষকদের পরিবারে ফিরে এসেছে সুখ-সমৃদ্ধি।
৮ নম্বর মারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘ছাইদুন্নেছা মাঠের মানুষ। সরকারি দপ্তরের চেয়ারে বসে থেকে দিন পার করার মানুষ তিনি নন। তাঁর হাত ধরে আমার ইউনিয়নের খিলপাড়া ব্লকের কৃষকেরা এখন ভালো আছেন।’
ছাইদুন্নেছা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, কর্মসংস্থান, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য কৃষিকে ঘিরে। তাই ক্ষেত্রটিকে ভালোবেসে ফেলেছি। ব্লকের কৃষক ও কৃষক পরিবারকে নিজের ভেবেছি। আন্তরিক থেকে কাজ করে যাচ্ছি। বিনিময়ে কৃষক ও কৃষক পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পাচ্ছি আদর, স্নেহ আর সম্মান।’
কৃষিকাজে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে গত বছর বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন এই কৃষি কর্মকর্তা। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, ছাইদুন্নেছা তাঁর পেশাকে শুধু চাকরির ফ্রেমে আবদ্ধ রাখেননি। একজন সুনাগরিকের দায় থেকে তাঁর কর্তব্য পালন করছেন। (কৃষকের বাড়ির আঙিনায় গোবর ও উচ্ছিষ্ট ব্যবহার করে জৈবসার তৈরির কাজ তদারক করছেন কৃষি কর্মকর্তা ছাইদুন্নেছা হ্যাপি। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো) ইউনিয়নের খিলপাড়া, ঝাটাশিরা, কাতিয়ারচর, পাঠানকান্দি ও পেড়াভাঙ্গা গ্রাম নিয়ে খিলপাড়া ব্লক। কয়েক বছর আগেও এ ব্লকের বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি থাকত। কৃষিকাজে লাভ নেই—এমনটাই বিশ্বাস ছিল স্থানীয় ব্যক্তিদের। কিন্তু ছাইদুন্নেছা দায়িত্ব নেওয়ার পর কৃষকেরা ধীরে ধীরে এই বিশ্বাস থেকে বের হয়ে আসেন। ওই ব্লকের জমির পরিমাণ ৪০০ হেক্টর। এখন খাল, বিল আর ডোবা ছাড়া এক চিলতে জমিও অনাবাদি নেই। ঝাটাশিরা গ্রামের রিংকু বেগম বলেন, ‘আপা শিখাইছে কীভাবে একসঙ্গে কয়েক জাতের সবজি চাষ করা যায়। এখন বাড়ির আঙিনায়ও সবজি চাষ করছি।’
ছাইদুন্নেছা কৃষকদের শিখিয়েছেন, কীভাবে আদর্শ বীজতলা গড়ে তুলতে হয়। ফলন বাড়াতে লঘুপদ্ধতির গুরুত্ব কী, শুরুতে কৃষকেরা এ সূত্র মানতে চাইতেন না। লঘু পদ্ধতিতে ১০ লাইন পর পর এক লাইন ফাঁকা রাখতে হয়। এতে ফলনের পরিমাণ কমে যায় বলে ধারণা ছিল কৃষকদের। কিন্তু এখন ব্লকের জমিতে শতভাগ লঘুপদ্ধতিই লক্ষ করা গেছে। এক মিটার পর পর ৫০ সেন্টিমিটার ফাঁকা রেখে আদর্শ বীজতলা গড়ে তোলার মন্ত্র এখন কৃষকদের অজানা নয়।
ব্লকের পাঁচটি গ্রামকে বাইরের মানুষের কাছে ‘কম্পোস্ট ভিলেজ’ হিসেবে পরিচিত করে তুলেছেন ছাইদুন্নেছা। কয়েক বছর আগেও ব্লকের কৃষকেরা জমিতে শতভাগ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফসল ফলাতেন। কিন্তু ছাইদুন্নেছা শিখিয়েছেন, বাড়ির আঙিনায় পড়ে থাকা উপকরণ দিয়েই কীভাবে সার তৈরি হয় এবং সেই সার ফলনের জন্য কতটা ভালো। কৃষকেরা এখন গোবর দিয়ে গর্ত পদ্ধতিতে গর্তকম্পোস্ট আর রাস্তার পাশে কচুরিপানা দিয়ে কম্পোস্ট হিপ করেছেন।
খিলপাড়া গ্রামের কৃষক জহির মিয়া বললেন, ‘পাখি ডাইক্কা আনাও যে কৃষিকাজের অংশ, আপা আওয়ার আগে আমরা কেউ জানতাম না।’ তিনি জানান, এ পদ্ধতির জন্য জমিতে ডাল পুঁতে পাখিদের বসার ব্যবস্থা করতে হয়, যাতে পাখি সেখানে বসে খেতের পোকমাকড় খেতে পারে। ফলে জমিতে আর কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় না।
ব্যাংকঋণ না মিললেও তার সমাধান বাতলেছেন ছাইদুন্নেছা। ব্লকে তিনটি কৃষক দল গঠন করেছেন। দুটি পুরুষ, একটি নারী দল। দলের প্রত্যেক সদস্যের মাসিক চাঁদা ৫০ টাকা। এ জন্য পৃথক ব্যাংক হিসাবও খোলা হয়েছে। প্রতি মাসে কৃষক দলগুলোর উঠান বৈঠক হচ্ছে। তিন হিসাবে এখন সঞ্চয়ের পরিমাণ কয়েক লাখ টাকা। সেই টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে দুটি পাওয়ার টিলারও।
পাঠানকান্দি গ্রামের কৃষক হাসিম উদ্দিন বলেন, ‘এখন আমরা নিজেদের মেশিন দিয়েই চাষ করি। এ জন্য একরপ্রতি ৮০০ টাকা জমা রাখি। তাতে কৃষক ও সমিতি দুই পক্ষেরই লাভ।’
জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার চন্ডিপাশা গ্রামের মেয়ে ছাইদুন্নেছা (৩২)। তাঁর হাত ধরে একটি ব্লকে কৃষিবিপ্লব ঘটেছে। কৃষকদের পরিবারে ফিরে এসেছে সুখ-সমৃদ্ধি।
৮ নম্বর মারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘ছাইদুন্নেছা মাঠের মানুষ। সরকারি দপ্তরের চেয়ারে বসে থেকে দিন পার করার মানুষ তিনি নন। তাঁর হাত ধরে আমার ইউনিয়নের খিলপাড়া ব্লকের কৃষকেরা এখন ভালো আছেন।’
ছাইদুন্নেছা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, কর্মসংস্থান, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য কৃষিকে ঘিরে। তাই ক্ষেত্রটিকে ভালোবেসে ফেলেছি। ব্লকের কৃষক ও কৃষক পরিবারকে নিজের ভেবেছি। আন্তরিক থেকে কাজ করে যাচ্ছি। বিনিময়ে কৃষক ও কৃষক পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পাচ্ছি আদর, স্নেহ আর সম্মান।’
No comments