পাকিস্তান: ফের ভুল পথে by হাসান ফেরদৌস
কাল ভোরেই নতুন পাকিস্তান—এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইমরান খান কয়েক হাজার লোক নিয়ে ইসলামাবাদে ধরনা শুরু করেছিলেন। লক্ষ্য, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন দখল। কাল সকালেই বিপ্লব—সে কথা শুনে এক পাকিস্তানি যুবক তাঁর বন্ধুকে ডেকে বললেন, ‘ভাই, আজ রাতেই যদি “ইনকিলাব” ঘটে যায়, তাহলে প্লিজ তুই আমাকে সকাল সকাল ডেকে দিস। তা না হলে আমি হয়তো পুরোনো পাকিস্তানেই রয়ে যাব।’
না, ইমরান খান ও তাঁর জিহাদি পার্টনার তাহির-উল-কাদরি সরকার উচ্ছেদের দাবি নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করেছেন, তার ফলে কোনো বিপ্লব ঘটেনি। দু-চারটি গাড়ি ভেঙেছে, সরকারি টেলিভিশন কেন্দ্রের কিছু সাজসরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও ইসলামাবাদের কনস্টিটিউশনাল অ্যাভিনিউ, যেখানে এই দুই নেতার অনুসারীরা ডেরা বেঁধেছেন, তার আশপাশে প্রস্রাবের নহর বয়ে গেছে। ব্যস, এই পর্যন্তই। নওয়াজ শরিফ যেখানে ছিলেন, সেখানেই আছেন। মাঝখান থেকে ইমরানের নিজের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেছে।
১৫ মাস আগে পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বিপুল ভোটাধিক্যে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ বিজয়ী হয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতা গ্রহণ করে। অনেক পেছনে থেকে তৃতীয় স্থান দখল করে ইমরান খানের দল পিটিআই। ইমরান, যিনি আশা করেছিলেন এবার তিনিই দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন, নির্বাচনের ফলাফলে বড় রকমের ঘা খেয়েছিলেন। অবশ্য সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে তাঁর দল খাইবারপাখতুনখাওয়ার প্রাদেশিক সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। নির্বাচনের পরপর ইমরান ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেছিলেন বটে, কিন্তু তেমন শোরগোল তোলেননি। নবনির্বাচিত সাংসদদের নিয়ে আইন পরিষদে যোগও দিয়েছিলেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতে কী হলো কে জানে, তিনি ঠিক করলেন, ‘দুর্নীতিবাজ’ নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতা থেকে হটাতে হবে, সে জন্য যদি ফের সেনাবাহিনী তলব করতে হয়, তাতেও পরোয়া নেই। (শুধু নওয়াজ শরিফকে হটালে পাকিস্তান রাতারাতি কীভাবে পরিস্থানে পরিণত হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য মিলল না)। এ কাজে তাঁর দোসর হিসেবে জুটল কানাডাপ্রবাসী এক জিহাদি নেতা। তাহির-উল কাদরি নামের সেই মোল্লা গত সপ্তাহে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নওয়াজকে পদত্যাগ করতে হবে। এই নয়া জিহাদ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি নিজে ঘরে ফিরছেন না, শেষ গোসল তিনি নিয়ে ফেলেছেন, এখন দরকার হলে শহীদ হবেন। সে লক্ষ্যে লাঠি-সড়কি নিয়ে তাঁরা রওনা হলেন নওয়াজ শরিফের সরকারি বাসভবনের দিকে।
ইমরানের দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন, দলের নির্বাচিত সভাপতি জাভেদ হাশমি সাংবাদিক ডেকে সে কথা ঘোষণাও করেছিলেন। কিন্তু সে মতামত উপেক্ষা করে ইমরান একাই ঠিক করলেন, প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওেয় তিনি নিজেই নেতৃত্ব দেবেন। (‘আমি দলের নেতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আমার ওপর ন্যস্ত,’ হাশমির প্রতিবাদের জবাবে ইমরান তাঁকে এ কথা বলেছিলেন।) অবশ্য রাত যেতে না যেতেই শোনা গেল, সেনাকর্তাদের সঙ্গে জিহাদি নেতার সলা–পরামর্শ হয়েছে, কাদরি সাহেব আপাতত আন্দোলন মুলতবি রাখছেন। ইমরান খানের সঙ্গেও সেনাকর্তাদের বাৎচিতের পর তাঁকে হাসিমুখে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল। তাঁর দলের এক মুখপাত্র এমন কথাও মুখ ফসকে বলে ফেললেন, সেনাবাহিনীর তরফ থেকে তাঁরা ‘সিগন্যাল’ পেয়েছেন।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে তার মেয়াদ পূরণ করার আগেই ক্ষমতা থেকে হটানোর পরিচিত ও নিয়মসিদ্ধ পথ পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোট উত্থাপন। ইমরান-কাদরি সে পথে না গিয়ে রাস্তা দখলের পথ বেছে নিলেন কেন, তা বোঝা কঠিন নয়। পার্লামেন্টে নওয়াজ শরিফের পক্ষে বিপুল সমর্থন রয়েছে। এই মুহূর্তে সরকার পতন হোক, সুস্থ মস্তিষ্কের কেউই সে দাবি সমর্থন করবেন না। ইমরানের নিজের দলের সদস্যরাই এ ব্যাপারে গররাজি। ইমরান তাঁদের নির্দেশ দিয়েছিলেন অবিলম্বে পদত্যাগ করতে। তাঁর দলের নয় সদস্য সরাসরি ‘না’ করে বসেন, বাকি ২৫ জন স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র না পাঠিয়ে পাঠালেন খোদ খানবাবার কাছে। অর্থাৎ, কাগজে-কলমে তাঁরা এখনো পুরোদস্তুর সাংসদ।
অনুমান করি ইমরান অপেক্ষায় ছিলেন, গণ-আন্দোলন তেতে উঠলেই সেনাবাহিনী নাক গলাবে, দেশরক্ষার তারাই তো শেষ ভরসা। সে কথার ইঙ্গিত দিয়ে ইমরান বারবার বলেছেন, ‘আম্পায়ার’ শিগগিরই হাত তুলবেন। কে এই আম্পায়ার তা তিনি খোলাসা করে বলেননি, তবে আকেলমন্দদের ধারণা, তিনি সেনাপ্রধান রাহিল শরিফের কথাই বলে থাকবেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সম্পর্ক ভালো নয়। ১৫ বছর আগে আরেক সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফ তাঁকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছিলেন। বর্তমান সেনাপ্রধান সেই একই পথ নিতে পারেন, এমন একটা অঙ্ক ইমরানের হয়তো থেকে থাকবে। গত এপ্রিলে বেসরকারি টিভি চ্যানেল জিও টিভির প্রধান হামিদ মির অজ্ঞাতনামা আততায়ীর হাতে আক্রান্ত হলে অভিযোগ উঠেছিল এর পেছনে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআইয়ের হাত ছিল। সে কথায় আইএসআই-প্রধান ইসলাম নাখোশ হয়েছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও নওয়াজ জিওর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তাঁর আমন্ত্রণে নওয়াজ ভারতে গিয়েছিলেন ও মোদির সঙ্গে উপহার চালাচালি করেছিলেন। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় নেতার সঙ্গে তাঁর এই মাখামাখি পাকিস্তান সেনাবাহিনী খুব সুনজরে দেখছে না, সে কথা অনেকেই বলেছেন। ফলে, ‘আ যা’ বললেই পাকিস্তানের মহা দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দেশোদ্ধারের লক্ষ্যে মসনদে বসে পড়বে, ইমরানের এই বিশ্বাসের পেছনে যুক্তি থাকতেই পারে।
বোঝাই যাচ্ছে, ইমরান তাঁর নিজের জোরে ইসলামাবাদের রাস্তাঘাট বন্ধ করতে পারেন ও কনস্টিটিউশনাল অ্যাভিনিউর আশপাশে প্রস্রাবের নহরত বইয়ে দিতে পারেন, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। তিনি শহুরে মানুষ, তাঁর ডাকে শহরের ছেলেছোকরা বিস্তর জুটেছে, সঙ্গে কয়েক ডজন অভিজাত তারকা। ফলে মাগনা ফুর্তির জন্য লোক জমায়েতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু সরকার পতনের জন্য যে ‘মাসল’ দরকার, ইমরানের দলের তা নেই। সে জন্য তাঁকে নির্ভর করতে হচ্ছে কাদরি ও তাঁর আনসার বাহিনীর ওপর। এই দুই দলের লোকজনের মনজিলে মকসুদ অভিন্ন হলেও তরিকা এক নয়। ইমরানের সমর্থকেরা যে রক কনসার্টে বোরকাবিহীন মেয়েদের সঙ্গে বল্গাহীন নৃত্যে লিপ্ত, তা দেখে কাদরির সমর্থকদের সঙ্গে তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে।
ইমরান ও কাদরি পাকিস্তানের আগাপাছতলা বদলে ফেলার যে দাবি তুলেছেন, তার যে কোনো গুণগত মূল্য নেই, সে কথা কেউ বলে না। দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও সামরিক দুঃশাসনে দেশটির গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। নওয়াজ বা তাঁর জায়গায় অন্য যে কেউ আসুন, রাতারাতি এই অবস্থার বদল হবে না। শহুরে মানুষকে এক ছাতার নিচে আনার মাধ্যমে ইমরান একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরেছেন। তাঁর দাবির কারণেই পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ভোট কারচুপির দাবি মেনে নিয়ে নওয়াজ বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করেছেন। আরও দ্রুত ও ব্যাপক পরিবর্তন চাই, এমন দাবি উত্থাপন করে ইমরান যদি দেশের মানুষকে এক করতে পারেন, তাহলে সেটাই হবে গণতন্ত্রের পক্ষে সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু এ সবই করা দরকার গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর ভেতর থেকে। রাজনৈতিক আন্দোলন অবশ্যই সেই পরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু আন্দোলনকে ব্যবহার করে সেনাবাহিনীর কাঁধে বন্দুক রেখে ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা মোটেই গণতান্ত্রিক পথ নয়।
এ কথার আরও প্রমাণ মেলে ইমরানের দোসর জিহাদি নেতা কাদরিকে দেখে, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর সমর্থন বড়জোর ঈষদুষ্ণ। কেউ কেউ তাহির-উল-কাদরিকে ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনির সঙ্গে তুলনা করেছেন, তবে খোমেনি যে গণতন্ত্রের মানসপুত্র ছিলেন না, সে কথা বুঝিয়ে বলার নেই। শুধু কাদরি নন, ইমরান আম্পায়ার হিসেবে এমন এক চক্রকে বেছে নিয়েছেন, যারা আজীবন গণতন্ত্রের বিপক্ষে কাজ করেছে। ফলে তাঁর উদ্দেশ্যের সাধুতা মেনে নিলেও যে পথ তিনি বেছে নিয়েছেন, তাকে কোনোভাবেই হালাল বলা চলে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাই যদি চলতি আন্দোলনের লক্ষ্য হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর ভেতর দিয়েই সে পরিবর্তন আনা সম্ভব, এই কথাটা ইমরান যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, তাঁর ও পাকিস্তানের জন্য ততই মঙ্গল।
মেয়াদ পূরণের আগেই ক্ষমতা ত্যাগের দাবি নিয়ে আন্দোলনের ইতিহাস একদম নতুন নয়। কিন্তু প্রায় কখনোই সে আন্দোলন সুফল বয়ে আনে না। থাইল্যান্ডে বিভক্ত নাগরিক আন্দোলনের ফলে সেখানে এখন সামরিক বাহিনী ক্ষমতায়। ইউক্রেনেও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বহিষ্কার করার পর দেশটি এখন পুরোদস্তুর গৃহযুদ্ধের কবলে।
বাংলাদেশেও কেউ কেউ নির্বাচনের বদলে রাস্তা দখল করে ক্ষমতা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে। ইতিহাসের শিক্ষা তারা যদি মাথায় রাখে, আখেরে ভালো ফল মিলবে।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
না, ইমরান খান ও তাঁর জিহাদি পার্টনার তাহির-উল-কাদরি সরকার উচ্ছেদের দাবি নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করেছেন, তার ফলে কোনো বিপ্লব ঘটেনি। দু-চারটি গাড়ি ভেঙেছে, সরকারি টেলিভিশন কেন্দ্রের কিছু সাজসরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও ইসলামাবাদের কনস্টিটিউশনাল অ্যাভিনিউ, যেখানে এই দুই নেতার অনুসারীরা ডেরা বেঁধেছেন, তার আশপাশে প্রস্রাবের নহর বয়ে গেছে। ব্যস, এই পর্যন্তই। নওয়াজ শরিফ যেখানে ছিলেন, সেখানেই আছেন। মাঝখান থেকে ইমরানের নিজের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেছে।
১৫ মাস আগে পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বিপুল ভোটাধিক্যে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ বিজয়ী হয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতা গ্রহণ করে। অনেক পেছনে থেকে তৃতীয় স্থান দখল করে ইমরান খানের দল পিটিআই। ইমরান, যিনি আশা করেছিলেন এবার তিনিই দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন, নির্বাচনের ফলাফলে বড় রকমের ঘা খেয়েছিলেন। অবশ্য সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে তাঁর দল খাইবারপাখতুনখাওয়ার প্রাদেশিক সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। নির্বাচনের পরপর ইমরান ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেছিলেন বটে, কিন্তু তেমন শোরগোল তোলেননি। নবনির্বাচিত সাংসদদের নিয়ে আইন পরিষদে যোগও দিয়েছিলেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতে কী হলো কে জানে, তিনি ঠিক করলেন, ‘দুর্নীতিবাজ’ নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতা থেকে হটাতে হবে, সে জন্য যদি ফের সেনাবাহিনী তলব করতে হয়, তাতেও পরোয়া নেই। (শুধু নওয়াজ শরিফকে হটালে পাকিস্তান রাতারাতি কীভাবে পরিস্থানে পরিণত হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য মিলল না)। এ কাজে তাঁর দোসর হিসেবে জুটল কানাডাপ্রবাসী এক জিহাদি নেতা। তাহির-উল কাদরি নামের সেই মোল্লা গত সপ্তাহে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নওয়াজকে পদত্যাগ করতে হবে। এই নয়া জিহাদ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি নিজে ঘরে ফিরছেন না, শেষ গোসল তিনি নিয়ে ফেলেছেন, এখন দরকার হলে শহীদ হবেন। সে লক্ষ্যে লাঠি-সড়কি নিয়ে তাঁরা রওনা হলেন নওয়াজ শরিফের সরকারি বাসভবনের দিকে।
ইমরানের দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন, দলের নির্বাচিত সভাপতি জাভেদ হাশমি সাংবাদিক ডেকে সে কথা ঘোষণাও করেছিলেন। কিন্তু সে মতামত উপেক্ষা করে ইমরান একাই ঠিক করলেন, প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওেয় তিনি নিজেই নেতৃত্ব দেবেন। (‘আমি দলের নেতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আমার ওপর ন্যস্ত,’ হাশমির প্রতিবাদের জবাবে ইমরান তাঁকে এ কথা বলেছিলেন।) অবশ্য রাত যেতে না যেতেই শোনা গেল, সেনাকর্তাদের সঙ্গে জিহাদি নেতার সলা–পরামর্শ হয়েছে, কাদরি সাহেব আপাতত আন্দোলন মুলতবি রাখছেন। ইমরান খানের সঙ্গেও সেনাকর্তাদের বাৎচিতের পর তাঁকে হাসিমুখে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল। তাঁর দলের এক মুখপাত্র এমন কথাও মুখ ফসকে বলে ফেললেন, সেনাবাহিনীর তরফ থেকে তাঁরা ‘সিগন্যাল’ পেয়েছেন।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে তার মেয়াদ পূরণ করার আগেই ক্ষমতা থেকে হটানোর পরিচিত ও নিয়মসিদ্ধ পথ পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোট উত্থাপন। ইমরান-কাদরি সে পথে না গিয়ে রাস্তা দখলের পথ বেছে নিলেন কেন, তা বোঝা কঠিন নয়। পার্লামেন্টে নওয়াজ শরিফের পক্ষে বিপুল সমর্থন রয়েছে। এই মুহূর্তে সরকার পতন হোক, সুস্থ মস্তিষ্কের কেউই সে দাবি সমর্থন করবেন না। ইমরানের নিজের দলের সদস্যরাই এ ব্যাপারে গররাজি। ইমরান তাঁদের নির্দেশ দিয়েছিলেন অবিলম্বে পদত্যাগ করতে। তাঁর দলের নয় সদস্য সরাসরি ‘না’ করে বসেন, বাকি ২৫ জন স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র না পাঠিয়ে পাঠালেন খোদ খানবাবার কাছে। অর্থাৎ, কাগজে-কলমে তাঁরা এখনো পুরোদস্তুর সাংসদ।
অনুমান করি ইমরান অপেক্ষায় ছিলেন, গণ-আন্দোলন তেতে উঠলেই সেনাবাহিনী নাক গলাবে, দেশরক্ষার তারাই তো শেষ ভরসা। সে কথার ইঙ্গিত দিয়ে ইমরান বারবার বলেছেন, ‘আম্পায়ার’ শিগগিরই হাত তুলবেন। কে এই আম্পায়ার তা তিনি খোলাসা করে বলেননি, তবে আকেলমন্দদের ধারণা, তিনি সেনাপ্রধান রাহিল শরিফের কথাই বলে থাকবেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সম্পর্ক ভালো নয়। ১৫ বছর আগে আরেক সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফ তাঁকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছিলেন। বর্তমান সেনাপ্রধান সেই একই পথ নিতে পারেন, এমন একটা অঙ্ক ইমরানের হয়তো থেকে থাকবে। গত এপ্রিলে বেসরকারি টিভি চ্যানেল জিও টিভির প্রধান হামিদ মির অজ্ঞাতনামা আততায়ীর হাতে আক্রান্ত হলে অভিযোগ উঠেছিল এর পেছনে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআইয়ের হাত ছিল। সে কথায় আইএসআই-প্রধান ইসলাম নাখোশ হয়েছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও নওয়াজ জিওর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তাঁর আমন্ত্রণে নওয়াজ ভারতে গিয়েছিলেন ও মোদির সঙ্গে উপহার চালাচালি করেছিলেন। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় নেতার সঙ্গে তাঁর এই মাখামাখি পাকিস্তান সেনাবাহিনী খুব সুনজরে দেখছে না, সে কথা অনেকেই বলেছেন। ফলে, ‘আ যা’ বললেই পাকিস্তানের মহা দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দেশোদ্ধারের লক্ষ্যে মসনদে বসে পড়বে, ইমরানের এই বিশ্বাসের পেছনে যুক্তি থাকতেই পারে।
বোঝাই যাচ্ছে, ইমরান তাঁর নিজের জোরে ইসলামাবাদের রাস্তাঘাট বন্ধ করতে পারেন ও কনস্টিটিউশনাল অ্যাভিনিউর আশপাশে প্রস্রাবের নহরত বইয়ে দিতে পারেন, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। তিনি শহুরে মানুষ, তাঁর ডাকে শহরের ছেলেছোকরা বিস্তর জুটেছে, সঙ্গে কয়েক ডজন অভিজাত তারকা। ফলে মাগনা ফুর্তির জন্য লোক জমায়েতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু সরকার পতনের জন্য যে ‘মাসল’ দরকার, ইমরানের দলের তা নেই। সে জন্য তাঁকে নির্ভর করতে হচ্ছে কাদরি ও তাঁর আনসার বাহিনীর ওপর। এই দুই দলের লোকজনের মনজিলে মকসুদ অভিন্ন হলেও তরিকা এক নয়। ইমরানের সমর্থকেরা যে রক কনসার্টে বোরকাবিহীন মেয়েদের সঙ্গে বল্গাহীন নৃত্যে লিপ্ত, তা দেখে কাদরির সমর্থকদের সঙ্গে তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে।
ইমরান ও কাদরি পাকিস্তানের আগাপাছতলা বদলে ফেলার যে দাবি তুলেছেন, তার যে কোনো গুণগত মূল্য নেই, সে কথা কেউ বলে না। দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও সামরিক দুঃশাসনে দেশটির গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। নওয়াজ বা তাঁর জায়গায় অন্য যে কেউ আসুন, রাতারাতি এই অবস্থার বদল হবে না। শহুরে মানুষকে এক ছাতার নিচে আনার মাধ্যমে ইমরান একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরেছেন। তাঁর দাবির কারণেই পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ভোট কারচুপির দাবি মেনে নিয়ে নওয়াজ বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করেছেন। আরও দ্রুত ও ব্যাপক পরিবর্তন চাই, এমন দাবি উত্থাপন করে ইমরান যদি দেশের মানুষকে এক করতে পারেন, তাহলে সেটাই হবে গণতন্ত্রের পক্ষে সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু এ সবই করা দরকার গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর ভেতর থেকে। রাজনৈতিক আন্দোলন অবশ্যই সেই পরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু আন্দোলনকে ব্যবহার করে সেনাবাহিনীর কাঁধে বন্দুক রেখে ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা মোটেই গণতান্ত্রিক পথ নয়।
এ কথার আরও প্রমাণ মেলে ইমরানের দোসর জিহাদি নেতা কাদরিকে দেখে, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর সমর্থন বড়জোর ঈষদুষ্ণ। কেউ কেউ তাহির-উল-কাদরিকে ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনির সঙ্গে তুলনা করেছেন, তবে খোমেনি যে গণতন্ত্রের মানসপুত্র ছিলেন না, সে কথা বুঝিয়ে বলার নেই। শুধু কাদরি নন, ইমরান আম্পায়ার হিসেবে এমন এক চক্রকে বেছে নিয়েছেন, যারা আজীবন গণতন্ত্রের বিপক্ষে কাজ করেছে। ফলে তাঁর উদ্দেশ্যের সাধুতা মেনে নিলেও যে পথ তিনি বেছে নিয়েছেন, তাকে কোনোভাবেই হালাল বলা চলে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাই যদি চলতি আন্দোলনের লক্ষ্য হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর ভেতর দিয়েই সে পরিবর্তন আনা সম্ভব, এই কথাটা ইমরান যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, তাঁর ও পাকিস্তানের জন্য ততই মঙ্গল।
মেয়াদ পূরণের আগেই ক্ষমতা ত্যাগের দাবি নিয়ে আন্দোলনের ইতিহাস একদম নতুন নয়। কিন্তু প্রায় কখনোই সে আন্দোলন সুফল বয়ে আনে না। থাইল্যান্ডে বিভক্ত নাগরিক আন্দোলনের ফলে সেখানে এখন সামরিক বাহিনী ক্ষমতায়। ইউক্রেনেও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বহিষ্কার করার পর দেশটি এখন পুরোদস্তুর গৃহযুদ্ধের কবলে।
বাংলাদেশেও কেউ কেউ নির্বাচনের বদলে রাস্তা দখল করে ক্ষমতা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে। ইতিহাসের শিক্ষা তারা যদি মাথায় রাখে, আখেরে ভালো ফল মিলবে।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments