বন্ধু ফজলে বারী, স্মৃতি অক্ষয় হোক by আবুল মাল আবদুল মুহিত
আমার বন্ধু অধ্যাপক ফজলে বারী মালিক গত মাসের ৫ তারিখে ঢাকা থেকে আমেরিকায় যাওয়ার পথে ইস্তাম্বুলে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বন্ধু ও পারিবারিক মহলে তাতা বলে পরিচিত আমার এই বন্ধুটি এ দেশে তেমন পরিচিত নন। কিন্তু অর্থ ও পদার্থবিদ্যায় তিনি সারা বিশ্বে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি স্নাতক পর্যন্ত কলকাতায় পড়াশোনা করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৩ সালে গণিতে স্নাতকোত্তর পর্বের ছাত্র ছিলেন। তাঁরা ভাইবোন দুজনে একই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর বড় বোন ছিলেন একসময়কার নামকরা গায়িকা ফরিদা বারী মালিক ওরফে বিথী। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল মাত্র তিন বছরের। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়েই আমরা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। তিনি ক্যাম্পাসে নবাগত হলেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নেন এবং ১৯৫৫ সালে আমি গ্রেপ্তার হলে আমার মুক্তির জন্য বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালের প্রলয়ংকরী বন্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঢাকায় ও তার নিকটস্থ গ্রামে (আগলা, পারিল নওয়াধা) ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসনকাজ পরিচালনা করেন। সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফজলে বারী মালিক বেশ সাদাসিধে ও সরল মানুষ ছিলেন এবং সে জন্য তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন বলে মনে হয় না। তবে ছোটবেলায় তিনি সমবয়সীদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অথবা অনুজদের কাছে বড় ভাই হিসেবে খুবই সম্মান পেতেন।
তাঁর বাবা ছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিখ্যাত প্রকৌশলী মালিক আবদুল বারী। তিনি বিগত শতাব্দীর ২০-এর দশকে ভারতীয় কেন্দ্রীয় প্রকৌশলী সার্ভিসের সদস্য ছিলেন; যিনি পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সম্ভবত প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান হিসেবে অবসর নেন। অতঃপর তিনি ইস্ট পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও কাজ করেন। তাঁর মা ফিরোজা বারী মালিক সামরিক সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন; তবে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচিতি ছিল সামাজিক অঙ্গনে নেত্রী হিসেবে। একটি মজার ব্যাপার হলো, তাঁর বিয়ে হয় ১৩ বছর বয়সে এবং সে সময় তাঁকে লেখাপড়ায় ব্যস্ত রাখেন এবং সর্বশেষে শান্তনিকেতনে পাঠিয়ে দেন তাঁর স্বামী। মালিক আবদুল বারীর তিন মেয়ে ও এক ছেলে। তাঁদের কেউই এখন জীবিত নেই। তবে তাঁর দুই জামাই আমাদের ঢাকার স্নায়ু সার্জন অধ্যাপক আবদুল মান্নান এবং লন্ডনে বাস্তুকলাবিদ হাসিনুর রেজা চৌধুরী এখনো জীবিত আছেন। আবদুল মান্নান কিছুদিন আগেই আওয়ামী লীগ থেকে সাংসদ ছিলেন। আমি বিস্তৃতই লিখছি, তার কারণ হলো ফজলে বারী মালিক এ দেশে অপরিচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ফজলে বারী জার্মানি গোটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে চলে যান এবং ১৯৫৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর তিনি পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে বিজ্ঞান কর্মকর্তা হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। প্রিন্সট্রন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট গবেষণা করতে কিছুদিনের মধ্যে চলে যান এবং তার পরেই আমেরিকায় অবস্থান নেন। সম্ভবত আমেরিকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির ব্লুমিংটন ক্যাম্পাস ও সাদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির কার্বন ডেল ক্যাম্পাসে তিনি চাকরি করেন। তবে প্রায়ই ইউরোপ ও আমেরিকায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়া এবং পড়াশোনায় সময় কাটিয়েছেন। বাংলাদেশেও তিনি প্রায় প্রতিবছর আসতেন। এবার একটু দেরি করে এসেছিলেন। ইতালির ত্রিয়েস্ট শহরে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিউরিটিক্যাল ফিজিক্স নামে একটি উন্নতমানের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে অধ্যাপক ফজলে বারী মালিক একজন পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর অন্যতম বন্ধু ও গবেষণায় সহযোগী ছিলেন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত আবদুস সালাম। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি কার্বন ডেলে অধ্যাপক ও ফিজিক্সের চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন। অধুনা প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে জীবন যাপন করছিলেন।
আমি ১৯৬৯ সালে আমেরিকায় পাকিস্তান দূতাবাসে চাকরি নিয়ে যাই। তখন আসলে ১৯৭০ সালে আমার এই বন্ধুটির সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের পক্ষেÿ প্রচার-প্রচারণায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে প্রথম শুনানি হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে; আমার বন্ধুটি এর আগে থেকেই ব্লুমিংটনে বাঙালিদের সংগঠন করতে থাকেন এবং নানাভাবে বাঙালিদের খবর সংগ্রহ করতে শুরু করেন।
কংগ্রেসম্যান গালাগার হাউস ফরেন রিলেশনস কমিটির এশিয়া প্যাসিফিক সাব-কমিটির সভাপতি হিসেবে ১১ মে তিনি একটি শুনানির ব্যবস্থা করেন। এ জন্য আমার বন্ধুটি তাঁর ব্যবহারের জন্য একটি নিবন্ধ পাঠান। নিবন্ধটির নাম হলো ‘রিসেন্ট কনফ্লিক্ট বিটুইন ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট পাকিস্তান’। ছাপার হরফে প্রায় ১০ পৃষ্ঠার ব্রিফটি আমার সম্পাদিত ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) প্রকাশিত আমেরিকান রেসপন্স টু বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়্যার বইয়ের ৪৩৭ থেকে ৪৪৬ পৃষ্ঠায় দেখা যেতে পারে। এই বইয়ে আমার বন্ধুটি একটি প্রবন্ধ লেখেন এবং সেই প্রবন্ধের একটি সংলাপ হিসেবে ওই ব্রিফটি সেখানে উদ্ধৃত করেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ওয়াশিংটনে, সংবাদমাধ্যম, মার্কিন কংগ্রেস এবং শিক্ষা বলয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপক সমর্থন পায়। যদিও নিক্সন–কিসিঞ্জারের সরকারটি সব সময়ই বাংলাদেশের বিরোধিতা করে। ফজলে বারী মালিক ইন্ডিয়ানায় বাংলাদেশের প্রচারণা ছাড়াও আমেরিকার শিক্ষক ও সুধী সমাজের বিভিন্ন আসরে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন এবং লবি করেন।
ফজলে বারী সারা জীবনই একা বসবাস করেন। কিন্তু তাঁর বাড়িটি বেশ, সব সময়ই সাজানো থাকত এবং সে ব্যাপারে আমি নিজেই সাক্ষী। মাত্র কয়েক বছর আগে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন যে একজন জাপানি নারীকে বিয়ে করবেন এবং করেও বসলেন। তিনি যখন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় এলেন, তখন আমরা বিয়ের উৎসব পালন করি। তাঁদের মাত্র একটি মেয়ে। এবার তিনি যখন বেড়াতে এলেন, তখন বেশ ঘুরে বেড়ালেন এবং পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর দেখাশোনাও অনেক হলো।
কী কারণে যে তাঁর পূর্বনির্ধারিত অবস্থান দীর্ঘায়িত করেন, আমি তা জিজ্ঞেস করিনি। ৮০ বছর বয়সেও সুস্বাস্থ্যের নিদর্শন তাঁর মধ্যে দেখা যেত। আমার স্ত্রী এবার মশকরা করে বললেন যে তাতা ভাই, আপনি তো যেমন, তেমন যুবকই থেকে গেলেন। আসলে তাঁর অনেক শারীরিক অসুবিধা ছিল, কিন্তু সেটা নিয়ে খুব কথা বলতেন না এবং খুব সাবধানে থাকতেন। তিনি ভালো খাবারে আনন্দ পেতেন, কিন্তু সব সময়ই পরিমিতি সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। এবার তাঁর বাংলাদেশ সফর নিতান্তই ছিল বিদায়ের জন্য প্রস্তুতি। প্রায় সব বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন। ঢাকায় অনেক ঘোরাফেরা করেছেন। বউ-বাচ্চা নিয়ে সর্বত্র বেড়িয়েছেন।
গত ৫ জুলাই আমি রাতে একটি টেলিফোন পেলাম, তাঁর ভাগনে মজহার বলল যে মামা ইস্তাম্বুলে মারা গেছেন এবং সেখানে বাচ্চা নিয়ে মামির খুব অসুবিধা হচ্ছে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে টেলিফোন করি এবং তিনি তাঁর মৃতদেহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নেন। তাঁর কাছে আমি ও আমার বন্ধু পরিবার খুবই কৃতজ্ঞ। এতে তুর্কির বিমান সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য না বললে চলে না। তাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ঢাকায় ভ্রমণে এসে দুই দেশের মধ্যে বিমান চলাচলের প্রতিশ্রুতি দেন এবং সেটা খুবই তড়িঘড়ি করে পালন করেন। তাদের ঢাকা থেকে প্রতিদিন ফ্লাইট রয়েছে। কিন্তু তারা এখানকার সফরকারীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। বিমানে তাদের সেবা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং ইস্তাম্বুলে তারা যাত্রীদের হেস্তনেস্ত করে।
এই যেমন আমার বন্ধুটি মারা গেছেন, কিন্তু সে জন্য তারা কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি তার পরিবারকে ফোন করতেও কোনো সাহায্য তারা করেনি। আমি শুনেছি, তারা সব সময়ই যাত্রীদের সঙ্গে এ রকম দুর্ব্যবহার করে। তুর্কি এয়ারলাইনসের সেবা সম্বন্ধে আমার মনে হয় যথাযথ অভিযোগ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। যা-ই হোক, এটি ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেল।
আমি আমার একটি অত্যন্ত জ্ঞানী ও সংবেদনশীল এবং সামাজিকভাবে সচেতন বন্ধু হিসেবে ফজলে বারী মালিককে আমার দেশে পরিচিত করার জন্য এই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি। সারা জীবন তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে কাটিয়েছেন। তাঁর বন্ধু ও শিক্ষক অধ্যাপক ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ এবং আবদুস সালাম দুজনই নোবেল লরিয়েট। তিনিও নোবেল পুরস্কারের জন্য আলোচনায় আসেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক আসরে ও গবেষণাক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সুপরিচিত। বাংলাদেশে অনেক ছাত্রছাত্রী তাঁর সহায়তায় উচ্চশিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর অসংখ্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ তালিকা সম্বন্ধে কিছুদিন আগে আর একজন বিজ্ঞান বিষয়ে পারদর্শী লেখক অনেক কথা বলেছেন।
জয়তু ফজলে বারী মালিক। তোমার স্মৃতি অক্ষয় হোক, বন্ধুবর তাতা।
আবুল মাল আবদুল মুহিত: অর্থমন্ত্রী, সাংসদ।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি স্নাতক পর্যন্ত কলকাতায় পড়াশোনা করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৩ সালে গণিতে স্নাতকোত্তর পর্বের ছাত্র ছিলেন। তাঁরা ভাইবোন দুজনে একই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর বড় বোন ছিলেন একসময়কার নামকরা গায়িকা ফরিদা বারী মালিক ওরফে বিথী। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল মাত্র তিন বছরের। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়েই আমরা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। তিনি ক্যাম্পাসে নবাগত হলেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নেন এবং ১৯৫৫ সালে আমি গ্রেপ্তার হলে আমার মুক্তির জন্য বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালের প্রলয়ংকরী বন্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঢাকায় ও তার নিকটস্থ গ্রামে (আগলা, পারিল নওয়াধা) ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসনকাজ পরিচালনা করেন। সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফজলে বারী মালিক বেশ সাদাসিধে ও সরল মানুষ ছিলেন এবং সে জন্য তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন বলে মনে হয় না। তবে ছোটবেলায় তিনি সমবয়সীদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অথবা অনুজদের কাছে বড় ভাই হিসেবে খুবই সম্মান পেতেন।
তাঁর বাবা ছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিখ্যাত প্রকৌশলী মালিক আবদুল বারী। তিনি বিগত শতাব্দীর ২০-এর দশকে ভারতীয় কেন্দ্রীয় প্রকৌশলী সার্ভিসের সদস্য ছিলেন; যিনি পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সম্ভবত প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান হিসেবে অবসর নেন। অতঃপর তিনি ইস্ট পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও কাজ করেন। তাঁর মা ফিরোজা বারী মালিক সামরিক সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন; তবে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচিতি ছিল সামাজিক অঙ্গনে নেত্রী হিসেবে। একটি মজার ব্যাপার হলো, তাঁর বিয়ে হয় ১৩ বছর বয়সে এবং সে সময় তাঁকে লেখাপড়ায় ব্যস্ত রাখেন এবং সর্বশেষে শান্তনিকেতনে পাঠিয়ে দেন তাঁর স্বামী। মালিক আবদুল বারীর তিন মেয়ে ও এক ছেলে। তাঁদের কেউই এখন জীবিত নেই। তবে তাঁর দুই জামাই আমাদের ঢাকার স্নায়ু সার্জন অধ্যাপক আবদুল মান্নান এবং লন্ডনে বাস্তুকলাবিদ হাসিনুর রেজা চৌধুরী এখনো জীবিত আছেন। আবদুল মান্নান কিছুদিন আগেই আওয়ামী লীগ থেকে সাংসদ ছিলেন। আমি বিস্তৃতই লিখছি, তার কারণ হলো ফজলে বারী মালিক এ দেশে অপরিচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ফজলে বারী জার্মানি গোটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে চলে যান এবং ১৯৫৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর তিনি পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে বিজ্ঞান কর্মকর্তা হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। প্রিন্সট্রন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট গবেষণা করতে কিছুদিনের মধ্যে চলে যান এবং তার পরেই আমেরিকায় অবস্থান নেন। সম্ভবত আমেরিকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির ব্লুমিংটন ক্যাম্পাস ও সাদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির কার্বন ডেল ক্যাম্পাসে তিনি চাকরি করেন। তবে প্রায়ই ইউরোপ ও আমেরিকায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়া এবং পড়াশোনায় সময় কাটিয়েছেন। বাংলাদেশেও তিনি প্রায় প্রতিবছর আসতেন। এবার একটু দেরি করে এসেছিলেন। ইতালির ত্রিয়েস্ট শহরে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিউরিটিক্যাল ফিজিক্স নামে একটি উন্নতমানের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে অধ্যাপক ফজলে বারী মালিক একজন পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর অন্যতম বন্ধু ও গবেষণায় সহযোগী ছিলেন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত আবদুস সালাম। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি কার্বন ডেলে অধ্যাপক ও ফিজিক্সের চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন। অধুনা প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে জীবন যাপন করছিলেন।
আমি ১৯৬৯ সালে আমেরিকায় পাকিস্তান দূতাবাসে চাকরি নিয়ে যাই। তখন আসলে ১৯৭০ সালে আমার এই বন্ধুটির সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের পক্ষেÿ প্রচার-প্রচারণায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে প্রথম শুনানি হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে; আমার বন্ধুটি এর আগে থেকেই ব্লুমিংটনে বাঙালিদের সংগঠন করতে থাকেন এবং নানাভাবে বাঙালিদের খবর সংগ্রহ করতে শুরু করেন।
কংগ্রেসম্যান গালাগার হাউস ফরেন রিলেশনস কমিটির এশিয়া প্যাসিফিক সাব-কমিটির সভাপতি হিসেবে ১১ মে তিনি একটি শুনানির ব্যবস্থা করেন। এ জন্য আমার বন্ধুটি তাঁর ব্যবহারের জন্য একটি নিবন্ধ পাঠান। নিবন্ধটির নাম হলো ‘রিসেন্ট কনফ্লিক্ট বিটুইন ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট পাকিস্তান’। ছাপার হরফে প্রায় ১০ পৃষ্ঠার ব্রিফটি আমার সম্পাদিত ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) প্রকাশিত আমেরিকান রেসপন্স টু বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়্যার বইয়ের ৪৩৭ থেকে ৪৪৬ পৃষ্ঠায় দেখা যেতে পারে। এই বইয়ে আমার বন্ধুটি একটি প্রবন্ধ লেখেন এবং সেই প্রবন্ধের একটি সংলাপ হিসেবে ওই ব্রিফটি সেখানে উদ্ধৃত করেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ওয়াশিংটনে, সংবাদমাধ্যম, মার্কিন কংগ্রেস এবং শিক্ষা বলয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপক সমর্থন পায়। যদিও নিক্সন–কিসিঞ্জারের সরকারটি সব সময়ই বাংলাদেশের বিরোধিতা করে। ফজলে বারী মালিক ইন্ডিয়ানায় বাংলাদেশের প্রচারণা ছাড়াও আমেরিকার শিক্ষক ও সুধী সমাজের বিভিন্ন আসরে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন এবং লবি করেন।
ফজলে বারী সারা জীবনই একা বসবাস করেন। কিন্তু তাঁর বাড়িটি বেশ, সব সময়ই সাজানো থাকত এবং সে ব্যাপারে আমি নিজেই সাক্ষী। মাত্র কয়েক বছর আগে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন যে একজন জাপানি নারীকে বিয়ে করবেন এবং করেও বসলেন। তিনি যখন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় এলেন, তখন আমরা বিয়ের উৎসব পালন করি। তাঁদের মাত্র একটি মেয়ে। এবার তিনি যখন বেড়াতে এলেন, তখন বেশ ঘুরে বেড়ালেন এবং পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর দেখাশোনাও অনেক হলো।
কী কারণে যে তাঁর পূর্বনির্ধারিত অবস্থান দীর্ঘায়িত করেন, আমি তা জিজ্ঞেস করিনি। ৮০ বছর বয়সেও সুস্বাস্থ্যের নিদর্শন তাঁর মধ্যে দেখা যেত। আমার স্ত্রী এবার মশকরা করে বললেন যে তাতা ভাই, আপনি তো যেমন, তেমন যুবকই থেকে গেলেন। আসলে তাঁর অনেক শারীরিক অসুবিধা ছিল, কিন্তু সেটা নিয়ে খুব কথা বলতেন না এবং খুব সাবধানে থাকতেন। তিনি ভালো খাবারে আনন্দ পেতেন, কিন্তু সব সময়ই পরিমিতি সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। এবার তাঁর বাংলাদেশ সফর নিতান্তই ছিল বিদায়ের জন্য প্রস্তুতি। প্রায় সব বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন। ঢাকায় অনেক ঘোরাফেরা করেছেন। বউ-বাচ্চা নিয়ে সর্বত্র বেড়িয়েছেন।
গত ৫ জুলাই আমি রাতে একটি টেলিফোন পেলাম, তাঁর ভাগনে মজহার বলল যে মামা ইস্তাম্বুলে মারা গেছেন এবং সেখানে বাচ্চা নিয়ে মামির খুব অসুবিধা হচ্ছে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে টেলিফোন করি এবং তিনি তাঁর মৃতদেহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নেন। তাঁর কাছে আমি ও আমার বন্ধু পরিবার খুবই কৃতজ্ঞ। এতে তুর্কির বিমান সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য না বললে চলে না। তাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ঢাকায় ভ্রমণে এসে দুই দেশের মধ্যে বিমান চলাচলের প্রতিশ্রুতি দেন এবং সেটা খুবই তড়িঘড়ি করে পালন করেন। তাদের ঢাকা থেকে প্রতিদিন ফ্লাইট রয়েছে। কিন্তু তারা এখানকার সফরকারীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। বিমানে তাদের সেবা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং ইস্তাম্বুলে তারা যাত্রীদের হেস্তনেস্ত করে।
এই যেমন আমার বন্ধুটি মারা গেছেন, কিন্তু সে জন্য তারা কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি তার পরিবারকে ফোন করতেও কোনো সাহায্য তারা করেনি। আমি শুনেছি, তারা সব সময়ই যাত্রীদের সঙ্গে এ রকম দুর্ব্যবহার করে। তুর্কি এয়ারলাইনসের সেবা সম্বন্ধে আমার মনে হয় যথাযথ অভিযোগ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। যা-ই হোক, এটি ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেল।
আমি আমার একটি অত্যন্ত জ্ঞানী ও সংবেদনশীল এবং সামাজিকভাবে সচেতন বন্ধু হিসেবে ফজলে বারী মালিককে আমার দেশে পরিচিত করার জন্য এই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি। সারা জীবন তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে কাটিয়েছেন। তাঁর বন্ধু ও শিক্ষক অধ্যাপক ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ এবং আবদুস সালাম দুজনই নোবেল লরিয়েট। তিনিও নোবেল পুরস্কারের জন্য আলোচনায় আসেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক আসরে ও গবেষণাক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সুপরিচিত। বাংলাদেশে অনেক ছাত্রছাত্রী তাঁর সহায়তায় উচ্চশিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর অসংখ্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ তালিকা সম্বন্ধে কিছুদিন আগে আর একজন বিজ্ঞান বিষয়ে পারদর্শী লেখক অনেক কথা বলেছেন।
জয়তু ফজলে বারী মালিক। তোমার স্মৃতি অক্ষয় হোক, বন্ধুবর তাতা।
আবুল মাল আবদুল মুহিত: অর্থমন্ত্রী, সাংসদ।
No comments