ঘাতক কাঁটায় বিদ্ধ গণমাধ্যম by সোহরাব হাসান
ত্রিপুরার টিভি চ্যানেল ভ্যানগার্ড ২৪-এর বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত সপ্তাহে আগরতলা গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের পাশেই আরশীনগর নয়, ত্রিপুরা। সেখানে যেসব পড়শি বসত করে, তারাও বাঙালি, আমাদের অত্যন্ত আপনজন। ভ্যানগার্ড ২৪-এর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে চিরকুট ব্যান্ডদলের শিল্পীরা দর্শক-শ্রোতাদের দারুণ মুগ্ধ করেছেন। এ রকম গানের ও প্রাণের সম্মিলনই পারে দু্ই দেশের সম্পর্ককে আরও নিবিড় ও সংহত করতে।
টিভি চ্যানেলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেবক ভট্টাচার্য যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন, তার মোদ্দা কথাটি হলো পৃথিবীর সব দেশেই সাহসী গণমাধ্যমকে ঘাতক কাঁটার ওপর দিয়ে চলতে হয়। শাসকগোষ্ঠী থেকে শুরু করে মাফিয়া চক্র—সবাই চায় গণমাধ্যমকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এই কাঁটা কখনো আসে সরকারের কালো আইনরূপে, কখনো আসে রাজনৈতিক মস্তানদের পেশিশক্তি বলে।
অনুষ্ঠানে টিভি চ্যানেলটির দুটো আলোচিত নিউজ ভিডিও দেখানো হলো। গত লোকসভা নির্বাচনে ভ্যানগার্ড ২৪-এর একজন আলোকচিত্রী ত্রিপুরার একটি ভোটকেন্দ্রের ভেতরে পোলিং অফিসারের সামনে ব্যালট পেপারে দলীয় কর্মীদের সিল মারার ছবি তুলে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। আঞ্চলিক টিভি চ্যানেলটির এই সচিত্র খবর মুহূর্তে ভারতের প্রধান গণমাধ্যমগুলো লুফে নেয়। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, যে আলোকচিত্রী এই ছবি তুলেছেন, পুলিশ তাঁর নামে মামলা দিলেও ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। ওই আলোকচিত্রী এখন উচ্চ আদালতের কাছ থেকে আগাম জামিন নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন।
দ্বিতীয়টি হলো মাফিয়া চক্রের অপকর্মের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে তাদের হাতে টিভি চ্যানেলটির দুজন সাংবাদিকের অপহরণের ঘটনা। পরে টিভি চ্যানেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় ওই দুই সাংবাদিককে উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। ওখানে তবু রাষ্ট্রযন্ত্র ভোটকেন্দ্রের তোলা ছবিকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করেনি। এখানে সেটিও হয়।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী আয়োজনটি ছিল অভিনব, ব্যতিক্রমী। কোনো মন্ত্রী, নেতা বা বিশিষ্ট ব্যক্তি নন, ‘সান্ধ্যনীড়’ নামে একটি বৃদ্ধাশ্রমের চারজন সদস্যকে দিয়ে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বেলে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করানোর পাশাপাশি দেশ ও সমাজের জন্য তাঁদের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। এভাবেই চার প্রবীণ নারী-পুরুষকে সম্মানিত করল ভ্যানগার্ড ২৪। টিভি চ্যানেলটি বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে উল্লিখিত তিন সাহসী সাংবাদিককে পুরস্কৃত করে।
একজন সাংবাদিকের বড় শক্তি সত্য। সেই সত্য যদি তিনি না বলতে পারেন, না লিখতে পারেন, তাহলে সাংবাদিকতা হিজ মাস্টার্স ভয়েসে পরিণত হয়। প্রায় সব দেশে শাসক ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী সত্যকে কমবেশি ভয় পায়। একটি সরকার কতটা গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু—তা পরিমাপ করার সহজ উপায় হলো গণমাধ্যমের প্রতি তারা কী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
২.
শেখ হাসিনার তৃতীয় সরকার সম্ভবত নিজের প্রতি অনাস্থার কারণেই মেয়াদের আট মাসের মাথায় একসঙ্গে অনেকগুলো ফ্রন্ট খুলে বসেছে। একদিকে তারা বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের বিচার করছে কথিত গাড়ি ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের মামলায়, অন্যদিকে গণমাধ্যমকে শায়েস্তা করতে একটার পর একটা আইন জারির পাঁয়তারা করছে। একটি সরকারের নিত্যনতুন আইন করার প্রয়োজন তখনই হয়, যখন তার পায়ের তলায় মাটি থাকে না। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশটি চালিয়েছিলেন কোনো আইন ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার ছাড়াই। আর গত শতকের নব্বইয়ে সব কালাকানুন পায়ে মাড়িয়েই এ দেশের মানুষ স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিল। কোনো কালো আইনই কোনো সরকারকে রক্ষা করতে পারে না। বরং সেই সরকারের কালো আইনগুলো পরবর্তী সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে। বিশেষ ক্ষমতা আইন, সন্ত্রাস দমন আইন ও দ্রুত বিচার আইন—এ ধরনের অসংখ্য আইনের কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।
সম্প্রতি জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে সব মহলে বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় বইছে। সংগত কারণেই গণমাধ্যমের অংশীজনেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এর আগে জেলা প্রশাসক সম্মেলন সামনে রেখে তথ্য মন্ত্রণালয় একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছিল, যার মূল কথা ছিল, জেলা প্রশাসকদের হাতে পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করার ক্ষমতা অর্পণ। কী ভয়ংকর কথা! একজন জেলা প্রশাসক চাইলেই যেকোনো পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করে দিতে পারবেন।
কোনো আদালত নয়, প্রেস কাউন্সিল নয়—একজন আমলা মনে করবেন, এই পত্রিকাটি বের হওয়া উচিত কিংবা উচিত নয়। পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো খবর বা ছবি নিয়ে সরকার আপত্তি করতে পারে, আদালতে প্রতিকারও চাইতে পারে। কিন্তু পত্রিকার যে সংখ্যাটি প্রকাশিতই হয়নি, সেটি আগাম বন্ধ করার মতো কালো আইন আবারও দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে!
এই আইনের খসড়া নিয়ে সাংবাদিকেরা প্রতিবাদ করলে সরকার কিছুটা পিছু হটে। কিন্তু এর কিছুদিন পরই আসে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার ঘোষণা। দ্রুত বিকাশমান বেসরকারি টেলিভিশন-বেতারকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্যই নাকি এই নীতিমালা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘গণমাধ্যম যাতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, সে জন্য জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা করা হয়েছে।’ দায়িত্বশীল গণমাধ্যম আমরাও চাই। প্রশ্ন হলো, এই দায়িত্বের বিষয়টি কে ঠিক করবেন? করবেন গণমাধ্যমের অংশীজনেরা, অ্যাকেডেমিশিয়ানরা, আইন বিশেষজ্ঞরা। সরকার এখানে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল করার আগে তাঁর মন্ত্রীদের দায়িত্বশীল করেল দেশ অনেক বেশি উপকৃত হবে।
উদ্বেগের বিষয়, সরকার এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। অনলাইন সংবাদপত্রের জন্যও একই ধরনের নীতিমালা করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রধান তথ্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত সাব-কমিটি অনলাইন মাস মিডিয়া নীতিমালার খসড়াও প্রণয়ন করেছে। প্রস্তাবিত এই খসড়া পাস হলে অনলাইন সংবাদপত্রের ওপরও সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। সমালোচনার মুখে এখন মন্ত্রীরা বলছেন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা বাধ্যতামূলক নয়, নির্দেশনামূলক। এই নীতিমালার ভিত্তিতে আইন হবে, কমিশন হবে এবং কমিশনই ঠিক করবে কীভাবে বেসরকারি বেতার-টেলিভিশন চলবে।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক কমিশনগুলোর হাল দেখে মনে শঙ্কা জাগে, জাতীয় সম্প্রচার কমিশনও আরেকটি হুকুমবরদার প্রতিষ্ঠান হবে কি না। শেখ হাসিনার প্রথম সরকার বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে বেতার-টিভির স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার জন্য কমিটি করেছিল। কমিটির লোকেরা হিল্লি–দিল্লি ঘুরে আসার পর একটি রিপোর্টও জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা সরকারের পছন্দ হয়নি। কেননা, এ রিপোর্ট বাস্তবায়িত হলে টিভি-বেতারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তাহলে কি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যই এত আয়োজন, এত কমিশন, এত আইন?
সরকার বেসরকারি খাতে বেতার-টেলিভিশন করার অনুমতি দিয়েছে বলেই কি সরকারি বেতার-টিভি জবাবদিহির বাইরে থাকবে? রাষ্ট্রীয় বেতার-টিভি কি শুধু সরকারি দলের নেতা-নেত্রীদের ছবিই দেখাবে, বক্তৃতা শোনাবে? ভারতে আকাশবাণী বা দূরদর্শন পুরো সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারা তো সারাক্ষণ ক্ষমতাসীনদের বন্দনা ও বিরোধীদের নিন্দামন্দ করে না।
সরকার নীতিমালা করে বলতে পারে না, কোন পত্রিকা কী লিখবে, কোন টেলিভিশন কী দেখাবে, কোন অনুষ্ঠান বা টক শোতে কাকে আনা হবে, কাকে আনা হবে না। বাক বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমা আমাদের সংবিধানেই নির্দিষ্ট করা আছে। সেই সীমা সরকার, গণমাধ্যম কেউই লঙ্ঘন করতে পারে না।
৩.
সরকারের নীতিনির্ধারকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে তাঁরা এখন যে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে এত তোলপাড় করছেন, তার প্রয়োজন ছিল না। গণমাধ্যম পরিচালনার জন্য আইন ও নীতিমালা তো আছেই। ১৯৭৪ সালে প্রণীত বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইনটি তঁারা একবার দেখে নিতে পারেন। প্রেস কাউন্সিল আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সংবাদপত্র এবং সংবাদ পরিবেশকদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে সহায়তা করা।
প্রেস কাউন্সিলের নীতিমালায় বলা আছে, ১. জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় জনগণকে জানানোর দায়িত্ব সংবাদিকদের। ২. সাংবাদিককে তাঁর পেশাগত দায়িত্বের প্রয়োজনে ব্যক্তি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহের কার্যকলাপ এবং দোষত্রুটি সম্বন্ধে সংবাদ ও মন্তব্য প্রকাশ করতে হয়। এ দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্যভিত্তিক সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিককে দুর্ভোগমুক্ত রাখা উচিত। ৩. অসংশয় সত্য সংবাদের নির্ভুলতা সঠিকভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব না হলেও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত সংবাদ জনস্বার্থের প্রয়োজনে শাস্তির ঝুঁকি ব্যতিরেকেই পরিবেশন করা যেতে পারে। ৪. অপরাধ ও দুর্নীতি প্রতিরোধের সামাজিক দায়িত্ব পালনে সংবাদপত্র সংবাদ সংগ্রহের জন্য এমন সব আইনত ও যুক্তিসংগত পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে, যেগুলো অন্যত্র গ্রহণযোগ্য নয়। গণব্যাধি (খবর) প্রকাশ করে, এ রকম সংবাদের ওপর সেন্সরের প্রবণতা বিপজ্জনক হতে পারে। (সূত্র: সংবাদবিষয়ক আইন, গাজী শামছুর রহমান, বাংলা একাডেমী ১৯৮৪)
অন্যদিকে সরকার জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নামে যে নির্দেশনা জারি করেছে তার লক্ষ্যই হলো গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ। প্রথমটি সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের কাজের সুযোগ দেওয়ার ওপর জোর দিলেও দ্বিতীয়টিতে পদে পদে নিষেধাজ্ঞার কথা রয়েছে। মুদ্রিত ও বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের প্রকাশ ভিন্ন হলেও বিষয়বস্তু অভিন্ন। অতএব, এক নীতিতেই চলতে বাধা কোথায়?
সবশেষে প্রেস কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান গাজী শামছুর রহমানের একটি কথা দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। তিনি লিখেছেন, ‘দায়িত্ব যেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং যেখানে স্বাধীনতার ওপর আঘাত আসতে পারে সরকারের তরফ থেকে, সেখানে সরকারের পক্ষে ওই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেওয়া সমীচীন নয়।’ (সূত্র: ওই)
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net
টিভি চ্যানেলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেবক ভট্টাচার্য যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন, তার মোদ্দা কথাটি হলো পৃথিবীর সব দেশেই সাহসী গণমাধ্যমকে ঘাতক কাঁটার ওপর দিয়ে চলতে হয়। শাসকগোষ্ঠী থেকে শুরু করে মাফিয়া চক্র—সবাই চায় গণমাধ্যমকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এই কাঁটা কখনো আসে সরকারের কালো আইনরূপে, কখনো আসে রাজনৈতিক মস্তানদের পেশিশক্তি বলে।
অনুষ্ঠানে টিভি চ্যানেলটির দুটো আলোচিত নিউজ ভিডিও দেখানো হলো। গত লোকসভা নির্বাচনে ভ্যানগার্ড ২৪-এর একজন আলোকচিত্রী ত্রিপুরার একটি ভোটকেন্দ্রের ভেতরে পোলিং অফিসারের সামনে ব্যালট পেপারে দলীয় কর্মীদের সিল মারার ছবি তুলে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। আঞ্চলিক টিভি চ্যানেলটির এই সচিত্র খবর মুহূর্তে ভারতের প্রধান গণমাধ্যমগুলো লুফে নেয়। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, যে আলোকচিত্রী এই ছবি তুলেছেন, পুলিশ তাঁর নামে মামলা দিলেও ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। ওই আলোকচিত্রী এখন উচ্চ আদালতের কাছ থেকে আগাম জামিন নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন।
দ্বিতীয়টি হলো মাফিয়া চক্রের অপকর্মের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে তাদের হাতে টিভি চ্যানেলটির দুজন সাংবাদিকের অপহরণের ঘটনা। পরে টিভি চ্যানেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় ওই দুই সাংবাদিককে উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। ওখানে তবু রাষ্ট্রযন্ত্র ভোটকেন্দ্রের তোলা ছবিকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করেনি। এখানে সেটিও হয়।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী আয়োজনটি ছিল অভিনব, ব্যতিক্রমী। কোনো মন্ত্রী, নেতা বা বিশিষ্ট ব্যক্তি নন, ‘সান্ধ্যনীড়’ নামে একটি বৃদ্ধাশ্রমের চারজন সদস্যকে দিয়ে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বেলে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করানোর পাশাপাশি দেশ ও সমাজের জন্য তাঁদের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। এভাবেই চার প্রবীণ নারী-পুরুষকে সম্মানিত করল ভ্যানগার্ড ২৪। টিভি চ্যানেলটি বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে উল্লিখিত তিন সাহসী সাংবাদিককে পুরস্কৃত করে।
একজন সাংবাদিকের বড় শক্তি সত্য। সেই সত্য যদি তিনি না বলতে পারেন, না লিখতে পারেন, তাহলে সাংবাদিকতা হিজ মাস্টার্স ভয়েসে পরিণত হয়। প্রায় সব দেশে শাসক ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী সত্যকে কমবেশি ভয় পায়। একটি সরকার কতটা গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু—তা পরিমাপ করার সহজ উপায় হলো গণমাধ্যমের প্রতি তারা কী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
২.
শেখ হাসিনার তৃতীয় সরকার সম্ভবত নিজের প্রতি অনাস্থার কারণেই মেয়াদের আট মাসের মাথায় একসঙ্গে অনেকগুলো ফ্রন্ট খুলে বসেছে। একদিকে তারা বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের বিচার করছে কথিত গাড়ি ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের মামলায়, অন্যদিকে গণমাধ্যমকে শায়েস্তা করতে একটার পর একটা আইন জারির পাঁয়তারা করছে। একটি সরকারের নিত্যনতুন আইন করার প্রয়োজন তখনই হয়, যখন তার পায়ের তলায় মাটি থাকে না। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশটি চালিয়েছিলেন কোনো আইন ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার ছাড়াই। আর গত শতকের নব্বইয়ে সব কালাকানুন পায়ে মাড়িয়েই এ দেশের মানুষ স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিল। কোনো কালো আইনই কোনো সরকারকে রক্ষা করতে পারে না। বরং সেই সরকারের কালো আইনগুলো পরবর্তী সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে। বিশেষ ক্ষমতা আইন, সন্ত্রাস দমন আইন ও দ্রুত বিচার আইন—এ ধরনের অসংখ্য আইনের কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।
সম্প্রতি জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে সব মহলে বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় বইছে। সংগত কারণেই গণমাধ্যমের অংশীজনেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এর আগে জেলা প্রশাসক সম্মেলন সামনে রেখে তথ্য মন্ত্রণালয় একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছিল, যার মূল কথা ছিল, জেলা প্রশাসকদের হাতে পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করার ক্ষমতা অর্পণ। কী ভয়ংকর কথা! একজন জেলা প্রশাসক চাইলেই যেকোনো পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করে দিতে পারবেন।
কোনো আদালত নয়, প্রেস কাউন্সিল নয়—একজন আমলা মনে করবেন, এই পত্রিকাটি বের হওয়া উচিত কিংবা উচিত নয়। পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো খবর বা ছবি নিয়ে সরকার আপত্তি করতে পারে, আদালতে প্রতিকারও চাইতে পারে। কিন্তু পত্রিকার যে সংখ্যাটি প্রকাশিতই হয়নি, সেটি আগাম বন্ধ করার মতো কালো আইন আবারও দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে!
এই আইনের খসড়া নিয়ে সাংবাদিকেরা প্রতিবাদ করলে সরকার কিছুটা পিছু হটে। কিন্তু এর কিছুদিন পরই আসে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার ঘোষণা। দ্রুত বিকাশমান বেসরকারি টেলিভিশন-বেতারকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্যই নাকি এই নীতিমালা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘গণমাধ্যম যাতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, সে জন্য জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা করা হয়েছে।’ দায়িত্বশীল গণমাধ্যম আমরাও চাই। প্রশ্ন হলো, এই দায়িত্বের বিষয়টি কে ঠিক করবেন? করবেন গণমাধ্যমের অংশীজনেরা, অ্যাকেডেমিশিয়ানরা, আইন বিশেষজ্ঞরা। সরকার এখানে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল করার আগে তাঁর মন্ত্রীদের দায়িত্বশীল করেল দেশ অনেক বেশি উপকৃত হবে।
উদ্বেগের বিষয়, সরকার এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। অনলাইন সংবাদপত্রের জন্যও একই ধরনের নীতিমালা করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রধান তথ্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত সাব-কমিটি অনলাইন মাস মিডিয়া নীতিমালার খসড়াও প্রণয়ন করেছে। প্রস্তাবিত এই খসড়া পাস হলে অনলাইন সংবাদপত্রের ওপরও সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। সমালোচনার মুখে এখন মন্ত্রীরা বলছেন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা বাধ্যতামূলক নয়, নির্দেশনামূলক। এই নীতিমালার ভিত্তিতে আইন হবে, কমিশন হবে এবং কমিশনই ঠিক করবে কীভাবে বেসরকারি বেতার-টেলিভিশন চলবে।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক কমিশনগুলোর হাল দেখে মনে শঙ্কা জাগে, জাতীয় সম্প্রচার কমিশনও আরেকটি হুকুমবরদার প্রতিষ্ঠান হবে কি না। শেখ হাসিনার প্রথম সরকার বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে বেতার-টিভির স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার জন্য কমিটি করেছিল। কমিটির লোকেরা হিল্লি–দিল্লি ঘুরে আসার পর একটি রিপোর্টও জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা সরকারের পছন্দ হয়নি। কেননা, এ রিপোর্ট বাস্তবায়িত হলে টিভি-বেতারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তাহলে কি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যই এত আয়োজন, এত কমিশন, এত আইন?
সরকার বেসরকারি খাতে বেতার-টেলিভিশন করার অনুমতি দিয়েছে বলেই কি সরকারি বেতার-টিভি জবাবদিহির বাইরে থাকবে? রাষ্ট্রীয় বেতার-টিভি কি শুধু সরকারি দলের নেতা-নেত্রীদের ছবিই দেখাবে, বক্তৃতা শোনাবে? ভারতে আকাশবাণী বা দূরদর্শন পুরো সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারা তো সারাক্ষণ ক্ষমতাসীনদের বন্দনা ও বিরোধীদের নিন্দামন্দ করে না।
সরকার নীতিমালা করে বলতে পারে না, কোন পত্রিকা কী লিখবে, কোন টেলিভিশন কী দেখাবে, কোন অনুষ্ঠান বা টক শোতে কাকে আনা হবে, কাকে আনা হবে না। বাক বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমা আমাদের সংবিধানেই নির্দিষ্ট করা আছে। সেই সীমা সরকার, গণমাধ্যম কেউই লঙ্ঘন করতে পারে না।
৩.
সরকারের নীতিনির্ধারকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে তাঁরা এখন যে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে এত তোলপাড় করছেন, তার প্রয়োজন ছিল না। গণমাধ্যম পরিচালনার জন্য আইন ও নীতিমালা তো আছেই। ১৯৭৪ সালে প্রণীত বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইনটি তঁারা একবার দেখে নিতে পারেন। প্রেস কাউন্সিল আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সংবাদপত্র এবং সংবাদ পরিবেশকদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে সহায়তা করা।
প্রেস কাউন্সিলের নীতিমালায় বলা আছে, ১. জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় জনগণকে জানানোর দায়িত্ব সংবাদিকদের। ২. সাংবাদিককে তাঁর পেশাগত দায়িত্বের প্রয়োজনে ব্যক্তি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহের কার্যকলাপ এবং দোষত্রুটি সম্বন্ধে সংবাদ ও মন্তব্য প্রকাশ করতে হয়। এ দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্যভিত্তিক সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিককে দুর্ভোগমুক্ত রাখা উচিত। ৩. অসংশয় সত্য সংবাদের নির্ভুলতা সঠিকভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব না হলেও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত সংবাদ জনস্বার্থের প্রয়োজনে শাস্তির ঝুঁকি ব্যতিরেকেই পরিবেশন করা যেতে পারে। ৪. অপরাধ ও দুর্নীতি প্রতিরোধের সামাজিক দায়িত্ব পালনে সংবাদপত্র সংবাদ সংগ্রহের জন্য এমন সব আইনত ও যুক্তিসংগত পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে, যেগুলো অন্যত্র গ্রহণযোগ্য নয়। গণব্যাধি (খবর) প্রকাশ করে, এ রকম সংবাদের ওপর সেন্সরের প্রবণতা বিপজ্জনক হতে পারে। (সূত্র: সংবাদবিষয়ক আইন, গাজী শামছুর রহমান, বাংলা একাডেমী ১৯৮৪)
অন্যদিকে সরকার জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নামে যে নির্দেশনা জারি করেছে তার লক্ষ্যই হলো গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ। প্রথমটি সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের কাজের সুযোগ দেওয়ার ওপর জোর দিলেও দ্বিতীয়টিতে পদে পদে নিষেধাজ্ঞার কথা রয়েছে। মুদ্রিত ও বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের প্রকাশ ভিন্ন হলেও বিষয়বস্তু অভিন্ন। অতএব, এক নীতিতেই চলতে বাধা কোথায়?
সবশেষে প্রেস কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান গাজী শামছুর রহমানের একটি কথা দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। তিনি লিখেছেন, ‘দায়িত্ব যেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং যেখানে স্বাধীনতার ওপর আঘাত আসতে পারে সরকারের তরফ থেকে, সেখানে সরকারের পক্ষে ওই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেওয়া সমীচীন নয়।’ (সূত্র: ওই)
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net
No comments