অদৃশ্য জলের দাগ by মোসাদ্দেক আহমেদ
চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে গর্ভধারণের বাসনা
ঝুঁকিপূর্ণ ফলে চামেলির কথা শুনে দম ধরে থাকলেও অবাক হয়নি রিয়াজ, বরং
সম্মতিসূচক সমবেদনাই জানিয়েছিল; সেই সঙ্গে স্বস্তিবোধও কম হয়নি। প্রকাণ্ড
শোকের কবল থেকে বেরিয়ে আসার হয়তো এটাই হতে পারে শেষ রাস্তা; চামেলির
চিন্তার সক্ষমতা দেখে মনে মনে কৃতজ্ঞবোধও করেছে রিয়াজ। কিন্তু কথাটা অধিক
বয়সে সন্তানধারণ, স্বাস্থ্যঝুঁকির পরিণতিও ভাবাচ্ছে তলে তলে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে চামেলির মাতৃত্বই জয়ী হতে চলেছে, ভালোয় ভালোয় ছয় মাস অতিক্রান্ত হতে চামেলি ভাবে, এবার তবে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে দেখা যাক। যাকে হারিয়েছে চিরতরে, তাকে যদি ফিরে পাওয়া যায় আরেক রূপে, এই তার আশা। কল্পনাতেও কি কখনো ভেবেছিল এমন বাজি ধরতে হবে এই আইবুড়ি বয়সে। একমাত্র কন্যা লাবণ্যার হত্যাকাণ্ড যখন তাকে আত্মহননের পথে ঠেলে দিচ্ছিল, সমস্ত কিছু অর্থহীন হয়ে পড়েছিল, এমনকি স্বামীর সান্নিধ্যও, তখন গর্ভাধারণের স্বপ্নই নবতর অবলম্বন হয়ে আসে।
কাজেই গর্ভলক্ষণ ফুটে ওঠামাত্র অন্যরা এবার ছেলে হবে বলে রব তুললেও চামেলি কামনা করেছে লাবণ্যাকেই, লাবণ্যার প্রতিরূপ আরেক কন্যাকেই। অন্যদের দলে খোদ শাশুড়ির ভোট পড়ায় বেশ বিপাকেই সে; যদিও রিয়াজের সমর্থন তার দিকে আর সেটাই বল-ভরসা জোগাতে যথেষ্ট। এই দ্বৈরথে মহিলামহলের ভূমিকায় সে বিস্মিত; অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলামহল থাকে ছেলেসন্তানের পক্ষে; এটা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের ফল কি না তা ভেবে দেখার বিষয়; তবে এখানে অর্থনৈতিক বিষয়ও যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, তাও সমান সত্য।
আলগোছে উঠে এসে চামেলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই দেখে। লাবণ্যা তো খুন হলো এই যৌবনের তাপে পুড়েই! বিয়ের পরও একটা কী দুটো ছেলে লাবণ্যার পিছু ছাড়ল না; নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে গেলে তার মেয়েটারও দোষ ছিল; একটু পুরুষঘেঁষাই ছিল মেয়েটা। এসব তার স্বামীকে গোপনে গোপনে ঈর্ষান্বিত করেছিল; পরিণাম ভালো হয়নি। বিয়ের বছর গড়ানোর আগেই স্বামীর হাতে খুন হয় তার অপরূপা মেয়েটি। ফলে লাবণ্যার মতোই আরেকটি ফুটফুটে কন্যাসন্তান যদি সত্য সত্যই এবার তার পেটে এসে থাকে, তখন? বিশেষত প্রশ্নটা যেখানে লালনপালনের এবং বিয়ের পর মেয়ের নির্বিঘ্নতার! মাথা ঝিমঝিম করে উঠতে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিয়ে হাঁপাতে থাকে; চোখের কোনা ভারী হয়ে জ্বালাতে থাকলে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে কিছু সময়।
শুয়ে আছ যে, রেডি হয়ে নাও, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তো। বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে রিয়াজ তাগাদা দেয়।
জানো, আমার না কেমন ভয় ভয় করছে। অদ্ভুত দোটানায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি। ভাবছি যে আসবে, সে যদি মেয়ে হয়, তখন নতুন কোনো দুর্যোগ ঘনিয়ে আসবে না তো?
রিয়াজ বাকরুদ্ধ হয়ে উদাস হয়ে পড়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে বউয়ের নিকট এগিয়ে আসে, এ সময় নির্ভার থাকতে হয়। ডাক্তার তো তেমনই বলেছেন। সামান্য অপেক্ষা করে যোগ করে, তবে কি মনোভাব বদলে ফেলতে বলছ?
কক্ষনো না, আমার লাবণ্যাকেই চাই, নইলে কিছুই চাই না; নতুন লাবণ্যাকে আমি আগলে রাখব চোখে চোখে, আমার রক্তদামে তাকে বাঁচিয়ে রাখব।
স্ত্রীকে কাছে টেনে শাবাশ জানায় রিয়াজ, ভেরি গুড। কে বলে তোমার গার্ডস নেই, প্রতিকূল পরিস্থিতি তোমাকে বদলে দিয়েছে। তুমি শুধু নবজন্ম দিচ্ছো না, তোমার নিজেরও নবজন্ম হয়েছে।
স্বামীর প্রশংসাসূচক জবাবের বিপরীতে চট করে রা করতে পারল না চামেলি, কেননা এতে যে কেবল স্তুতির ছোঁয়া রয়েছে, তা নয়, সারবত্তাও কম নেই। শক্ত জাতের মহিলা সে কোনোকালেও ছিল না, বরং রিয়াজের প্রখর ব্যক্তিত্বের নিচে ইট-চাপা ঘাসের ন্যায় বিবর্ণই ছিল; শক্ত হাতে মেয়েকে প্রতিপালন করতে পারলে হয়তো সর্বনাশ এড়ানো যেত; পুরুষমানুষের ঈর্ষাবোধের পরিণাম এইভাবে চূড়ান্ততায় গড়াবে তা ছিল ভাবনার অতীত। না, কথাটা একতরফা হচ্ছে বোধহয়; এটা কেবল ঈর্ষাবোধের ব্যাপার নয়, এই ভয়ংকর জিঘাংসার পেছনে ঘাতক জামাইটার খুনি-সত্তাই নিরঙ্কুশ দায়ী। প্ল্যানমাফিক মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে মেয়েটাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল ফুপুর বাড়িতে, যাওয়ার আগে লাল জামদানিও কিনে দিয়েছিল ঘাতকটা; ফলে স্বামীর দুরভিসন্ধির বিন্দুবিসর্গ টের পায়নি হতভাগী, উপরন্তু প্রসাধনীর নিপুণ টানে নিজেকে সেজেছিল মহারানি; নিঃসঙ্গ বোকাসোকা বৃদ্ধা ফুপুশাশুড়িও খুশিমনেই আপ্যায়িত করে নববধূকে, কিন্তু হায়, সবই বৃথা, নববধূর ডগডগে লাল জামদানি রক্তলাল হয়ে উঠলে রুপালি চাঁদটাও পাল্লা দিয়ে রক্তিম হয়ে ওঠে; লাবণ্যার রক্তাক্ত মুখখানি তাকে দেখতে দেওয়া হয়নি, তবে চামেলির কল্পনা করে নিতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না কী অমানুষিক কষ্ট পেয়েই না তার বুকের মানিক কতল হয়েছিল! না, এবার যেন একই ভুলের পুনরুক্তি না হয়; এর জন্য সম্ভাব্য যা যা করার দরকার তা করতে সে পিছপা হবে না; সন্তান মানুষ করতে হলে মাত্রাতিরিক্ত বাৎসল্য ক্ষতির হেতু হতে পারে, কোমলতার পাশাপাশি কঠোরতাও লাগে বই কি। কিন্তু সেটাই কি সব? একটা পর্যায়ে গিয়ে জীবনেচ্ছার কতটুকুই-বা তার নিয়ন্ত্রণাধীন, বিষাদে মুখ ঢেকে যায় আবার।
দেরি করো না লক্ষ্মীটি, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল হয়ে যাবে।
না, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল তো হয়ইনি, উলটো আরাধ্য সুসংবাদ জানতে পেরে সনোগ্রাফির টেবিলেই খুশিতে কেঁদে ফেলল চামেলি, খুশিতে রিয়াজের চোখ দুটোও চিকচিক করছে। মেয়েসন্তানই আসছে রক্তরঞ্জিত শূন্যতাকে কিছুটা হলেও ঢেকে দিতে। মায়েরা সুন্দর হয়ে উঠলে নাকি মেয়েসন্তান পেটে আসে, এবারকার গর্ভকালীন পেলবমসৃণ মনোহারিতা তো তেমন আভাসই দিচ্ছিল; কিন্তু তার পরেও অনিশ্চয়তা থেকে যায়; লোকবিশ্বাস গণ্ডায় গণ্ডায় ভেস্তে যাওয়ার নজিরই বেশি, তদুপরি গোটা ঘটনার পশ্চাতে রয়ে গেছে চরম বিভীষিকাময় ক্ষতচিহ্ন।
রোগিণীর আনন্দোচ্ছ্বাস ছুঁয়ে গেলে মহিলা ডাক্তারের কণ্ঠস্বর সচল হয়, এত খুশি হচ্ছেন, আগে ছেলে বুঝি।
না, আগেও মেয়ে ছিল, আমাদের বংশে ছেলের সংখ্যা বরাবর কম।
তা হলে আপনারা অন্যরকম; সাধারণত যা দেখি, মেয়ের কথা শুনতে মায়েদের মুখ পাংশু, বলতে কি, অনেক মায়ের সংসারই ভেঙে যায় ছেলে না হওয়ায়; যেন ছেলে না হওয়ার সমস্ত দায় মায়েদের, চাই কি তালাকনামাও নেমে আসতে দেরি হয় না। মহিলা ডাক্তার এভাবে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
আপনি দোয়া করবেন, আমাদের মেয়েটি যেন দীর্ঘজীবী হয়, বেঁচে থাকে পূর্ণ পরমায়ু পর্যন্ত।
বাড়ি ফিরে আসার পর সেই খুশির আবহ আরেকধাপ বিস্তৃত হয়। প্রথমদিকে ছেলের দিকে পক্ষপাত থাকলেও চামেলির শাশুড়ির মতামত দ্রুত পালটে যায়, বল কি বউমা, এমন মেয়ে তো ছেলের অধিক, তোমার খালি কোল এবার উপচে পড়–ক।
ননদরাও কম যায় না, তোমাকে আর পায় কে ভাবি, যাকে চেয়েছ সে-ই আসছে। চাওয়ার মতো চাইতে জানলে এমনই হয়।
দেখতে দেখতে কটা দিন বাড়ির নিরুত্তাপ পরিবেশে রং লাগে। লাবণ্যা পেটে থাকার সময় যতটা যত্নবতী ছিল, তার চেয়ে বেশি ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে লাগল চামেলি; ওষুধ খাওয়ার কথা আগেরবার তেমন মনে না থাকলেও এক্ষণে তা হচ্ছে না; শাকসবজিও খাচ্ছে তিনবেলা। স্ত্রীর এই ইতিবাচক পরিবর্তন রিয়াজকেও সুখী করে, তুমি দেখছি গুড গার্ল হয়ে গেছ। অক্ষরে অক্ষরে সব মেনে চলছ, কোথাও অনিয়ম হচ্ছে না।
স্বামীর উৎসাহব্যঞ্জক বাক্যে চামেলি উৎফুল্ল হলেও সবটা প্রকাশ করে না, আহা, আগেই এত সব বলো না। বুড়ি বয়সে পেটে ধরা, কখন কী হয় বলা যায়। জানো, কিছুতে স্বস্তি পাচ্ছি না, তার ওপর ঈশান কোণের সেই কালো মেঘটার ভয়।
স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে রিয়াজ স্তব্ধ হয়ে যায়। চামেলির জীবনে ঝড়-তুফান তো কম গেল না। লাবণ্যা পেটে আসার আগেও একটি সন্তান ধরেছিল সে। কিন্তু তা ছিল জরায়ুর বাইরে, টিউবে; ডাক্তারি পরিভাষায় একটোপিক প্রেগন্যান্সি। ৯ সপ্তাহের মাথায় টিউব ফেটে বউ তার মরণাপন্ন হওয়ার জোগাড়, জরুরি অপারেশন আর ৪ ব্যাগ রক্ত সে যাত্রায় প্রাণ বাঁচিয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে অনেক মায়ের সন্তানধারণ ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যায়। ভাগ্য সহায়, তাদের বেলায় তেমন হয়নি।
দশ দিন পর ডাক্তার দেখানোর কথা, চামেলি একাকী গিয়েছিল। একবেলা অপেক্ষা করলে রিয়াজও সঙ্গী হতে পারত, কিন্তু তার তর সয়নি। কারণ পেটের কন্যাসন্তানই; মনোভার ভেঙে বেরিয়ে আসার যে সুবর্ণ মওকা উপস্থিত, সেখানে অত অপেক্ষার ধার ধারলে চলে? বাচ্চার প্রতিটি কোমল নড়াচড়াই উপভোগ্য, বলতে কি তা ব্রহ্মস্বাদের তুল্য, তা হলে বিলম্ব সইবে কেন! দেখেশুনে রোগিণীর পরিস্থিতি অনুকূল পেয়ে মহিলা ডাক্তারের মুখে প্রশান্তির চিহ্ন, বেবি ইজ ফাইন। গ্রোথ স্যাটিসফ্যাক্টরি। পানিও ভালো। মনে হচ্ছে পরামর্শ সুন্দর মেনে চলছেন। সবসময় হাশিখুশি থাকবেন, এটাও বাচ্চাকে ভালো রাখে। হ্যাঁ, বিজ্ঞান তেমনি বলে, আপনার আনন্দ বাচ্চাকেও আনন্দিত করে।
তাই, জানেন, আমি না মিউজিক শুনি, আমি বুঝতে পারি বাচ্চাটি তখন রিল্যাক্স করে। ফিস মিটিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে চামেলি যখন বেরিয়ে এলো, তখনো হাতে অনেকটা সময়; ভাবল ফিরতিপথে একবার কুমুর ওখানে নামলে মন্দ হয় না। কুমু তার স্কুলজীবনের বন্ধু, বাল্যের বন্ধুবান্ধবরা মধুর হয় সবসময়। পরবর্তী জীবনে অনেকে বন্ধু হয় বটে, কিন্তু বাল্যের মতো তা মধুরতর হয় কী! বাল্যবান্ধবীর সঙ্গে প্রফুল্লতা ভাগ করে নিতে পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে তা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যে উৎফুল্লতা নিয়ে প্রাণের সখার কাছে গেল, কুমুকে দেখার পর, তার কথা শোনার পর, একফুৎকারে মিইয়ে গেল। সমস্যা হয়েছে কুমুর মেয়ে কলেজ-পড়ুয়া তনিমাকে নিয়ে; কুমুর মেয়েটিই বড় আর ছেলে ছোট, স্কুলে পড়ে। কলেজের একটা ছেলের সঙ্গে তনিমার যে প্রেম এবং মাত্র কদিন আগে বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ঘুণাক্ষরেও তা জানতে পারেনি কুমু। জানলো কবে? ঠিক দুদিন আগে আর তা এমনভাবে যে, তাতে কেলেঙ্কারির একশেষ। এসব বিয়েতে যেভাবে ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, কটা দিন খোঁজখবর পাওয়া যায় না, এখানে তেমন ঘটেনি; বরং সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরে এসে তনিমা বলেছিল, সারাদিন বান্ধবীর বাসায় ছিলাম, মেলা নোটস, কী করব মা, নোটসগুলো বুঝে নিতেই দিন কাবার। এই বিয়ের আরেক ব্যতিক্রম এই, বিয়ের অব্যবহিত পরেই ওদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়; মনোমালিন্যের জের ধরে হোক কী ছেলেটার মনের বদমায়েশি হোক, ছেলেটি তাদের ঘনিষ্ঠ ভিডিওদৃশ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে; ব্যস, আর কী, ডাউনলোডের যুগে তা বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, এমনকি তা পাড়ার কিশোরদের মোবাইল ফোনে- ফোনেও। ভগ্নহৃদয় তনিমা তার পড়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে নিশ্চুপ বসে আছে আর কুমুর মুখমণ্ডলে রাজ্যের দুঃখ, হতাশা এবং ক্ষোভ, বল চামেলি এখন আমি কী করি? তোর মেয়ে তো তবু একঅর্থে মরে বেঁচেছে, কিন্তু তনিমা? পোড়ামুখী তো বেঁচে থেকেও মরা, সাথে আমরাও।
দুটো আলাদা ঘটনাবলির মধ্যে একটা মূল ঐক্য দেখতে পেয়ে চামেলি স্তম্ভিত যেন; কুমুকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাটুকুও হারিয়ে ফেলে। যখন সে বাড়ির পথ ধরে, তখনো বুকের অস্থিরতা চরমে; দুটো ঘটনার সঙ্গে আরও দুর্ঘটনা যে ভবিষ্যতে যুক্ত হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়। গর্ভস্থিত মেয়েটিও তো বড় হয়ে হাঁটতে পারে একই পথে আর সেই আশঙ্কাই প্রবল; সত্যের খাতিরে এটা তো সত্য, রিয়াজের সঙ্গে বিয়ের আগে সে নিজেও কি মেয়েলি ছলাকলায় কম পারদর্শী ছিল; অন্য স্তাবক ছেলে বন্ধুদের কথা বাদই যাক, তার কলেজের সবচেয়ে মেধাবী যুবকটি কেন সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মঘাতী হয়েছিল, সেটার কারণ দর্শাতে বললে তা কি সে সত্যিই দিতে পারবে এই মধ্যবয়সে? জিনবাহিত এসব কার্যকারণ সূত্র যদি রক্তে থাকে, তবে এর দুরন্ত গতি রুখবে কে? তা ছাড়া পুরুষবান্ধব সমাজব্যবস্থার উসকানিও এখানে বিবেচ্য। কথাটা ঘূর্ণাবর্তই, তা হলে এই কি ভালো নয়, পেটের সন্তানকে চিরকাল পেটেই রেখে দেওয়া, মাতৃজঠরের মতোন নিরাপত্তার আশ্বাস জগৎজুড়ে আর কোথাও আছে কী! কোথায় যেন পড়েছিল, অমিয়ভূষণেই, আমরা কেউ জন্মাতে চাই না, জন্মের সময় নবজাতকের তীব্র চিৎকারই তেমন প্রমাণ।
দুপুরের তপ্ত রোদ মাথায় করে যখন বাসায় ফিরে এলো, চামেলির কাহিল অবস্থা। আগের বার ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর তার মধ্যে যে ইতিকর্তব্যতা দেখা গিয়েছিল, ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠার দুরন্ত সাহস দেখা গিয়েছিল, তাতে সূক্ষ্ম ধস নামে যেন-বা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, সবকিছুই চলছে যথাবিহিত, ওষুধ খাওয়া থেকে ডাক্তার দেখানো, এমনকি মিউজিক শোনাটাও, কিন্তু কোথায় যেন সেই স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব, ভাঙাহাটের আর্তনাদ; বিনিদ্র বউকে পরপর কদিন পূর্বেকার ন্যায় জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতবিহ্বল রিয়াজ সহসা বুঝতে পারে- সেই অভেদ্য পূর্ববৎ খোলসই তবে, যা প্রথম ফুটে উঠেছিল লাবণ্যাকে হারানোর পর; মাঝের কিছুদিন ব্যতিক্রম, সকলের অগোচরে ফের সেই ব্যাপার, পুনরপি লুকিয়ে স্ত্রীর বিনিদ্র রাত্রিযাপন আর খোলা জানালার গ্রিলে নিজেকে সঁপে দেওয়া; বোঝাই যাচ্ছে এমন সঁপে দেওয়ায় কোনো বৃদ্ধি নেই। নাছোড় বিপন্নতা তবে পিছু হটেনি; চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার মতোই চোরাটানে তলিয়ে যাচ্ছে চামেলি!
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে চামেলির মাতৃত্বই জয়ী হতে চলেছে, ভালোয় ভালোয় ছয় মাস অতিক্রান্ত হতে চামেলি ভাবে, এবার তবে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে দেখা যাক। যাকে হারিয়েছে চিরতরে, তাকে যদি ফিরে পাওয়া যায় আরেক রূপে, এই তার আশা। কল্পনাতেও কি কখনো ভেবেছিল এমন বাজি ধরতে হবে এই আইবুড়ি বয়সে। একমাত্র কন্যা লাবণ্যার হত্যাকাণ্ড যখন তাকে আত্মহননের পথে ঠেলে দিচ্ছিল, সমস্ত কিছু অর্থহীন হয়ে পড়েছিল, এমনকি স্বামীর সান্নিধ্যও, তখন গর্ভাধারণের স্বপ্নই নবতর অবলম্বন হয়ে আসে।
কাজেই গর্ভলক্ষণ ফুটে ওঠামাত্র অন্যরা এবার ছেলে হবে বলে রব তুললেও চামেলি কামনা করেছে লাবণ্যাকেই, লাবণ্যার প্রতিরূপ আরেক কন্যাকেই। অন্যদের দলে খোদ শাশুড়ির ভোট পড়ায় বেশ বিপাকেই সে; যদিও রিয়াজের সমর্থন তার দিকে আর সেটাই বল-ভরসা জোগাতে যথেষ্ট। এই দ্বৈরথে মহিলামহলের ভূমিকায় সে বিস্মিত; অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলামহল থাকে ছেলেসন্তানের পক্ষে; এটা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের ফল কি না তা ভেবে দেখার বিষয়; তবে এখানে অর্থনৈতিক বিষয়ও যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, তাও সমান সত্য।
আলগোছে উঠে এসে চামেলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই দেখে। লাবণ্যা তো খুন হলো এই যৌবনের তাপে পুড়েই! বিয়ের পরও একটা কী দুটো ছেলে লাবণ্যার পিছু ছাড়ল না; নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে গেলে তার মেয়েটারও দোষ ছিল; একটু পুরুষঘেঁষাই ছিল মেয়েটা। এসব তার স্বামীকে গোপনে গোপনে ঈর্ষান্বিত করেছিল; পরিণাম ভালো হয়নি। বিয়ের বছর গড়ানোর আগেই স্বামীর হাতে খুন হয় তার অপরূপা মেয়েটি। ফলে লাবণ্যার মতোই আরেকটি ফুটফুটে কন্যাসন্তান যদি সত্য সত্যই এবার তার পেটে এসে থাকে, তখন? বিশেষত প্রশ্নটা যেখানে লালনপালনের এবং বিয়ের পর মেয়ের নির্বিঘ্নতার! মাথা ঝিমঝিম করে উঠতে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিয়ে হাঁপাতে থাকে; চোখের কোনা ভারী হয়ে জ্বালাতে থাকলে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে কিছু সময়।
শুয়ে আছ যে, রেডি হয়ে নাও, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তো। বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে রিয়াজ তাগাদা দেয়।
জানো, আমার না কেমন ভয় ভয় করছে। অদ্ভুত দোটানায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি। ভাবছি যে আসবে, সে যদি মেয়ে হয়, তখন নতুন কোনো দুর্যোগ ঘনিয়ে আসবে না তো?
রিয়াজ বাকরুদ্ধ হয়ে উদাস হয়ে পড়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে বউয়ের নিকট এগিয়ে আসে, এ সময় নির্ভার থাকতে হয়। ডাক্তার তো তেমনই বলেছেন। সামান্য অপেক্ষা করে যোগ করে, তবে কি মনোভাব বদলে ফেলতে বলছ?
কক্ষনো না, আমার লাবণ্যাকেই চাই, নইলে কিছুই চাই না; নতুন লাবণ্যাকে আমি আগলে রাখব চোখে চোখে, আমার রক্তদামে তাকে বাঁচিয়ে রাখব।
স্ত্রীকে কাছে টেনে শাবাশ জানায় রিয়াজ, ভেরি গুড। কে বলে তোমার গার্ডস নেই, প্রতিকূল পরিস্থিতি তোমাকে বদলে দিয়েছে। তুমি শুধু নবজন্ম দিচ্ছো না, তোমার নিজেরও নবজন্ম হয়েছে।
স্বামীর প্রশংসাসূচক জবাবের বিপরীতে চট করে রা করতে পারল না চামেলি, কেননা এতে যে কেবল স্তুতির ছোঁয়া রয়েছে, তা নয়, সারবত্তাও কম নেই। শক্ত জাতের মহিলা সে কোনোকালেও ছিল না, বরং রিয়াজের প্রখর ব্যক্তিত্বের নিচে ইট-চাপা ঘাসের ন্যায় বিবর্ণই ছিল; শক্ত হাতে মেয়েকে প্রতিপালন করতে পারলে হয়তো সর্বনাশ এড়ানো যেত; পুরুষমানুষের ঈর্ষাবোধের পরিণাম এইভাবে চূড়ান্ততায় গড়াবে তা ছিল ভাবনার অতীত। না, কথাটা একতরফা হচ্ছে বোধহয়; এটা কেবল ঈর্ষাবোধের ব্যাপার নয়, এই ভয়ংকর জিঘাংসার পেছনে ঘাতক জামাইটার খুনি-সত্তাই নিরঙ্কুশ দায়ী। প্ল্যানমাফিক মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে মেয়েটাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল ফুপুর বাড়িতে, যাওয়ার আগে লাল জামদানিও কিনে দিয়েছিল ঘাতকটা; ফলে স্বামীর দুরভিসন্ধির বিন্দুবিসর্গ টের পায়নি হতভাগী, উপরন্তু প্রসাধনীর নিপুণ টানে নিজেকে সেজেছিল মহারানি; নিঃসঙ্গ বোকাসোকা বৃদ্ধা ফুপুশাশুড়িও খুশিমনেই আপ্যায়িত করে নববধূকে, কিন্তু হায়, সবই বৃথা, নববধূর ডগডগে লাল জামদানি রক্তলাল হয়ে উঠলে রুপালি চাঁদটাও পাল্লা দিয়ে রক্তিম হয়ে ওঠে; লাবণ্যার রক্তাক্ত মুখখানি তাকে দেখতে দেওয়া হয়নি, তবে চামেলির কল্পনা করে নিতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না কী অমানুষিক কষ্ট পেয়েই না তার বুকের মানিক কতল হয়েছিল! না, এবার যেন একই ভুলের পুনরুক্তি না হয়; এর জন্য সম্ভাব্য যা যা করার দরকার তা করতে সে পিছপা হবে না; সন্তান মানুষ করতে হলে মাত্রাতিরিক্ত বাৎসল্য ক্ষতির হেতু হতে পারে, কোমলতার পাশাপাশি কঠোরতাও লাগে বই কি। কিন্তু সেটাই কি সব? একটা পর্যায়ে গিয়ে জীবনেচ্ছার কতটুকুই-বা তার নিয়ন্ত্রণাধীন, বিষাদে মুখ ঢেকে যায় আবার।
দেরি করো না লক্ষ্মীটি, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল হয়ে যাবে।
না, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল তো হয়ইনি, উলটো আরাধ্য সুসংবাদ জানতে পেরে সনোগ্রাফির টেবিলেই খুশিতে কেঁদে ফেলল চামেলি, খুশিতে রিয়াজের চোখ দুটোও চিকচিক করছে। মেয়েসন্তানই আসছে রক্তরঞ্জিত শূন্যতাকে কিছুটা হলেও ঢেকে দিতে। মায়েরা সুন্দর হয়ে উঠলে নাকি মেয়েসন্তান পেটে আসে, এবারকার গর্ভকালীন পেলবমসৃণ মনোহারিতা তো তেমন আভাসই দিচ্ছিল; কিন্তু তার পরেও অনিশ্চয়তা থেকে যায়; লোকবিশ্বাস গণ্ডায় গণ্ডায় ভেস্তে যাওয়ার নজিরই বেশি, তদুপরি গোটা ঘটনার পশ্চাতে রয়ে গেছে চরম বিভীষিকাময় ক্ষতচিহ্ন।
রোগিণীর আনন্দোচ্ছ্বাস ছুঁয়ে গেলে মহিলা ডাক্তারের কণ্ঠস্বর সচল হয়, এত খুশি হচ্ছেন, আগে ছেলে বুঝি।
না, আগেও মেয়ে ছিল, আমাদের বংশে ছেলের সংখ্যা বরাবর কম।
তা হলে আপনারা অন্যরকম; সাধারণত যা দেখি, মেয়ের কথা শুনতে মায়েদের মুখ পাংশু, বলতে কি, অনেক মায়ের সংসারই ভেঙে যায় ছেলে না হওয়ায়; যেন ছেলে না হওয়ার সমস্ত দায় মায়েদের, চাই কি তালাকনামাও নেমে আসতে দেরি হয় না। মহিলা ডাক্তার এভাবে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
আপনি দোয়া করবেন, আমাদের মেয়েটি যেন দীর্ঘজীবী হয়, বেঁচে থাকে পূর্ণ পরমায়ু পর্যন্ত।
বাড়ি ফিরে আসার পর সেই খুশির আবহ আরেকধাপ বিস্তৃত হয়। প্রথমদিকে ছেলের দিকে পক্ষপাত থাকলেও চামেলির শাশুড়ির মতামত দ্রুত পালটে যায়, বল কি বউমা, এমন মেয়ে তো ছেলের অধিক, তোমার খালি কোল এবার উপচে পড়–ক।
ননদরাও কম যায় না, তোমাকে আর পায় কে ভাবি, যাকে চেয়েছ সে-ই আসছে। চাওয়ার মতো চাইতে জানলে এমনই হয়।
দেখতে দেখতে কটা দিন বাড়ির নিরুত্তাপ পরিবেশে রং লাগে। লাবণ্যা পেটে থাকার সময় যতটা যত্নবতী ছিল, তার চেয়ে বেশি ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে লাগল চামেলি; ওষুধ খাওয়ার কথা আগেরবার তেমন মনে না থাকলেও এক্ষণে তা হচ্ছে না; শাকসবজিও খাচ্ছে তিনবেলা। স্ত্রীর এই ইতিবাচক পরিবর্তন রিয়াজকেও সুখী করে, তুমি দেখছি গুড গার্ল হয়ে গেছ। অক্ষরে অক্ষরে সব মেনে চলছ, কোথাও অনিয়ম হচ্ছে না।
স্বামীর উৎসাহব্যঞ্জক বাক্যে চামেলি উৎফুল্ল হলেও সবটা প্রকাশ করে না, আহা, আগেই এত সব বলো না। বুড়ি বয়সে পেটে ধরা, কখন কী হয় বলা যায়। জানো, কিছুতে স্বস্তি পাচ্ছি না, তার ওপর ঈশান কোণের সেই কালো মেঘটার ভয়।
স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে রিয়াজ স্তব্ধ হয়ে যায়। চামেলির জীবনে ঝড়-তুফান তো কম গেল না। লাবণ্যা পেটে আসার আগেও একটি সন্তান ধরেছিল সে। কিন্তু তা ছিল জরায়ুর বাইরে, টিউবে; ডাক্তারি পরিভাষায় একটোপিক প্রেগন্যান্সি। ৯ সপ্তাহের মাথায় টিউব ফেটে বউ তার মরণাপন্ন হওয়ার জোগাড়, জরুরি অপারেশন আর ৪ ব্যাগ রক্ত সে যাত্রায় প্রাণ বাঁচিয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে অনেক মায়ের সন্তানধারণ ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যায়। ভাগ্য সহায়, তাদের বেলায় তেমন হয়নি।
দশ দিন পর ডাক্তার দেখানোর কথা, চামেলি একাকী গিয়েছিল। একবেলা অপেক্ষা করলে রিয়াজও সঙ্গী হতে পারত, কিন্তু তার তর সয়নি। কারণ পেটের কন্যাসন্তানই; মনোভার ভেঙে বেরিয়ে আসার যে সুবর্ণ মওকা উপস্থিত, সেখানে অত অপেক্ষার ধার ধারলে চলে? বাচ্চার প্রতিটি কোমল নড়াচড়াই উপভোগ্য, বলতে কি তা ব্রহ্মস্বাদের তুল্য, তা হলে বিলম্ব সইবে কেন! দেখেশুনে রোগিণীর পরিস্থিতি অনুকূল পেয়ে মহিলা ডাক্তারের মুখে প্রশান্তির চিহ্ন, বেবি ইজ ফাইন। গ্রোথ স্যাটিসফ্যাক্টরি। পানিও ভালো। মনে হচ্ছে পরামর্শ সুন্দর মেনে চলছেন। সবসময় হাশিখুশি থাকবেন, এটাও বাচ্চাকে ভালো রাখে। হ্যাঁ, বিজ্ঞান তেমনি বলে, আপনার আনন্দ বাচ্চাকেও আনন্দিত করে।
তাই, জানেন, আমি না মিউজিক শুনি, আমি বুঝতে পারি বাচ্চাটি তখন রিল্যাক্স করে। ফিস মিটিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে চামেলি যখন বেরিয়ে এলো, তখনো হাতে অনেকটা সময়; ভাবল ফিরতিপথে একবার কুমুর ওখানে নামলে মন্দ হয় না। কুমু তার স্কুলজীবনের বন্ধু, বাল্যের বন্ধুবান্ধবরা মধুর হয় সবসময়। পরবর্তী জীবনে অনেকে বন্ধু হয় বটে, কিন্তু বাল্যের মতো তা মধুরতর হয় কী! বাল্যবান্ধবীর সঙ্গে প্রফুল্লতা ভাগ করে নিতে পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে তা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যে উৎফুল্লতা নিয়ে প্রাণের সখার কাছে গেল, কুমুকে দেখার পর, তার কথা শোনার পর, একফুৎকারে মিইয়ে গেল। সমস্যা হয়েছে কুমুর মেয়ে কলেজ-পড়ুয়া তনিমাকে নিয়ে; কুমুর মেয়েটিই বড় আর ছেলে ছোট, স্কুলে পড়ে। কলেজের একটা ছেলের সঙ্গে তনিমার যে প্রেম এবং মাত্র কদিন আগে বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ঘুণাক্ষরেও তা জানতে পারেনি কুমু। জানলো কবে? ঠিক দুদিন আগে আর তা এমনভাবে যে, তাতে কেলেঙ্কারির একশেষ। এসব বিয়েতে যেভাবে ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, কটা দিন খোঁজখবর পাওয়া যায় না, এখানে তেমন ঘটেনি; বরং সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরে এসে তনিমা বলেছিল, সারাদিন বান্ধবীর বাসায় ছিলাম, মেলা নোটস, কী করব মা, নোটসগুলো বুঝে নিতেই দিন কাবার। এই বিয়ের আরেক ব্যতিক্রম এই, বিয়ের অব্যবহিত পরেই ওদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়; মনোমালিন্যের জের ধরে হোক কী ছেলেটার মনের বদমায়েশি হোক, ছেলেটি তাদের ঘনিষ্ঠ ভিডিওদৃশ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে; ব্যস, আর কী, ডাউনলোডের যুগে তা বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, এমনকি তা পাড়ার কিশোরদের মোবাইল ফোনে- ফোনেও। ভগ্নহৃদয় তনিমা তার পড়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে নিশ্চুপ বসে আছে আর কুমুর মুখমণ্ডলে রাজ্যের দুঃখ, হতাশা এবং ক্ষোভ, বল চামেলি এখন আমি কী করি? তোর মেয়ে তো তবু একঅর্থে মরে বেঁচেছে, কিন্তু তনিমা? পোড়ামুখী তো বেঁচে থেকেও মরা, সাথে আমরাও।
দুটো আলাদা ঘটনাবলির মধ্যে একটা মূল ঐক্য দেখতে পেয়ে চামেলি স্তম্ভিত যেন; কুমুকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাটুকুও হারিয়ে ফেলে। যখন সে বাড়ির পথ ধরে, তখনো বুকের অস্থিরতা চরমে; দুটো ঘটনার সঙ্গে আরও দুর্ঘটনা যে ভবিষ্যতে যুক্ত হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়। গর্ভস্থিত মেয়েটিও তো বড় হয়ে হাঁটতে পারে একই পথে আর সেই আশঙ্কাই প্রবল; সত্যের খাতিরে এটা তো সত্য, রিয়াজের সঙ্গে বিয়ের আগে সে নিজেও কি মেয়েলি ছলাকলায় কম পারদর্শী ছিল; অন্য স্তাবক ছেলে বন্ধুদের কথা বাদই যাক, তার কলেজের সবচেয়ে মেধাবী যুবকটি কেন সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মঘাতী হয়েছিল, সেটার কারণ দর্শাতে বললে তা কি সে সত্যিই দিতে পারবে এই মধ্যবয়সে? জিনবাহিত এসব কার্যকারণ সূত্র যদি রক্তে থাকে, তবে এর দুরন্ত গতি রুখবে কে? তা ছাড়া পুরুষবান্ধব সমাজব্যবস্থার উসকানিও এখানে বিবেচ্য। কথাটা ঘূর্ণাবর্তই, তা হলে এই কি ভালো নয়, পেটের সন্তানকে চিরকাল পেটেই রেখে দেওয়া, মাতৃজঠরের মতোন নিরাপত্তার আশ্বাস জগৎজুড়ে আর কোথাও আছে কী! কোথায় যেন পড়েছিল, অমিয়ভূষণেই, আমরা কেউ জন্মাতে চাই না, জন্মের সময় নবজাতকের তীব্র চিৎকারই তেমন প্রমাণ।
দুপুরের তপ্ত রোদ মাথায় করে যখন বাসায় ফিরে এলো, চামেলির কাহিল অবস্থা। আগের বার ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর তার মধ্যে যে ইতিকর্তব্যতা দেখা গিয়েছিল, ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠার দুরন্ত সাহস দেখা গিয়েছিল, তাতে সূক্ষ্ম ধস নামে যেন-বা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, সবকিছুই চলছে যথাবিহিত, ওষুধ খাওয়া থেকে ডাক্তার দেখানো, এমনকি মিউজিক শোনাটাও, কিন্তু কোথায় যেন সেই স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব, ভাঙাহাটের আর্তনাদ; বিনিদ্র বউকে পরপর কদিন পূর্বেকার ন্যায় জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতবিহ্বল রিয়াজ সহসা বুঝতে পারে- সেই অভেদ্য পূর্ববৎ খোলসই তবে, যা প্রথম ফুটে উঠেছিল লাবণ্যাকে হারানোর পর; মাঝের কিছুদিন ব্যতিক্রম, সকলের অগোচরে ফের সেই ব্যাপার, পুনরপি লুকিয়ে স্ত্রীর বিনিদ্র রাত্রিযাপন আর খোলা জানালার গ্রিলে নিজেকে সঁপে দেওয়া; বোঝাই যাচ্ছে এমন সঁপে দেওয়ায় কোনো বৃদ্ধি নেই। নাছোড় বিপন্নতা তবে পিছু হটেনি; চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার মতোই চোরাটানে তলিয়ে যাচ্ছে চামেলি!
No comments