রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে একদিন by খান মাহবুব
রবীন্দ্রনাথের
বাড়িতে যাব এ উত্তেজনায় কলকাতার পার্কস্ট্রিটের হোটেলে রাতে ঘুম হচ্ছিল
না। কৈশোরে পড়া রবীন্দ্র স্মৃতিকথা ‘আমার ছেলেবেলার’ নানা লাইন, নানা উপমা
বারবার মনের কুঠিরে উঁকি দিচ্ছিল। কলকাতার কাকডাকা ভোরে ট্যাক্সিচালকের
সঙ্গে দরদাম মিটিয়ে রওনা। আমি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরীর
সহযাত্রী হয়েছি। ট্যাক্সি সরু রাস্তা, বড় রাস্তা, অলিগলি পেরিয়ে একসময়
হাজির হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রবেশ তোরণে। মদন চ্যাটার্জি লেনের শুরুতে
বাড়ির প্রধান তোরণ পেরুনোর পর আমাদের দু’জনের অপলক দৃষ্টি। রাস্তার পাশের
বাড়িগুলো গভীর দৃষ্টিতে কবি আসাদ ভাই দেখছেন, আর অনুমান করার চেষ্টা করছেন
কোন বাড়িটা রবীন্দ্রনাথের আমলের। আমরা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায় পা
দিতেই জড়সড় এক বৃদ্ধ জানালেন রবীন্দ্রনাথের গাড়ি বাঁ দিকে। গাড়িটা যত্নের
সঙ্গে সংরক্ষণ করা আছে। কালো রঙের বড় জিপ। সাবেকি, তবে বনেদী।
বাড়ির আঙ্গিনাজুড়ে এক ধরনের ছায়াস্নিগ্ধ পরিবেশ। শান্ত ও মগ্নতার ঘোর বাড়ির সর্বত্র। নাগরিক সভ্যতার ব্যস্ততার ছাপ একটুও নেই। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথা ‘আমার ছেলেবেলায়’ লেখা- তখন কাজের এত বেশি হাঁস-ফাঁসানি ছিল না, বসে বসে দিন চলত, রবীন্দ্র আবাসে এখনও বোধকরি দিন বসে বসে, আস্তে আস্তে চলে। রবীন্দ্রনাথের বাড়িকে প্রাসাদ বললে ভুল হবে, অনেকগুলো প্রাসাদ। যাকে বলা যায় প্রাসাদমালা। বাড়ির প্রবেশপথে রবীন্দ্রনাথ ও বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি। এই বাড়ির বড় একটা অংশে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চললেও বাড়ির আঙ্গিক, বিন্যাস ও মৌলিকত্বে সাবেকি রূপ লালন করা আছে যত্নের সঙ্গে আজও।
বাড়ির বহিঃরাঙ্গন দেখার সময় মনটা উসখুস করছিল ভেতরে ঢুকে রবীন্দ্রস্মৃতির ‘ছেলেবেলার’ গল্পের সঙ্গে নানা অনুষঙ্গের মিল-অমিল মিলিয়ে দেখতে। পনের রুপির টিকিট কেটে মোবাইল, ক্যামেরা, ব্যাগ নিরাপত্তাকর্মীদের জিম্মায় রেখে ত্রিতল রবীন্দ্রস্মৃতি জাদুঘরে প্রবেশ করলাম।
বিশাল বিশাল বড় ও উঁচু কক্ষ। বিভিন্ন স্মৃতির স্মারক থরে থরে সাজানো। নানা স্মৃতি স্মারকের অনুষঙ্গের উপস্থিতি যেন আজও শত বছরের পুরনো রবীন্দ্রনাথকে হাজির করে। মনে হয় এখনও এ বাড়িতে উঠানে হাঁটছে রবীন্দ্র আমলের চাকর ব্রজেশ্বর কিংবা প্যারীদাসী।
রবীন্দ্রনাথের যাপিত জীবনের প্রায় সব স্মারক এখানে রক্ষিত। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর রান্নাঘর, মাটির উনান থেকে শুরু করে পদ্মা বোটের ডেমো। সালওয়ারী রবীন্দ্রনাথকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৯১৬-এ বার্মায় রবীন্দ্রনাথ, ১৯১৬ সালে জাপানে, ১৯২১-এ বার্লিনে, ১৯৩০-এ প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৩২-এ ইরানে, ১৯৩২-এ আরবের বেদুইনের সঙ্গে- এ রকম নানা শিরোনামে। বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এ পরিবারে অনেক বিখ্যাত কবি, চিত্রকর জন্ম নিয়েছিল। তাদের কর্মের স্মারক বিশেষত রবীন্দ্রনাথের ভাতিজা অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম, চিত্রকর্মের ব্যবহৃত সাজ-সরঞ্জাম এখনও দর্শনার্থীরা কৌতূহলভরা দৃষ্টিতে দেখে।
রবীন্দ্র পরিবারের সদস্য গোলাপলাল ঠাকুর, সতীন্দ্র ঠাকুর, রাজা রামনাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকের তৈলচিত্র সংগৃহীত আছে।
রবীন্দ্রনাথের চার বছরের ছবি থেকে শুরু করে, খাবার ঘর, বসার ঘর, সঙ্গীত কক্ষ, লেখার ঘর- এমনকি যে ঘরে ১৩৪৮ বাং ২২ শ্রাবণ দ্বি-প্রহরে কবিগুরু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন এখনও সেখানে শঙ্খ দিয়ে পিদিমের আলোকে ঘিরে এক আবহ তৈরি করা আছে। রবীন্দ্রনাথের বসার ঘর, পড়ার ঘর ইত্যাদির আসবাবপত্র শুধু রবীন্দ্র আমলের নয়, এর সাজানোর ঢংও ওই আমলেরই রাখা হয়েছে। দেখলে মনে হয় এই পড়ার ঘরেই বুঝি এই চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে পড়ছিলেন একটু আগে রবীন্দ্রনাথ।
বাড়িতে দর্শনার্থীদের জন্য সব সময় চলতে থাকে মৃদুলয়ে আদিসূরে রবীন্দ্র সঙ্গীত। দর্শনার্থীরা এই সঙ্গীতের মোহনীতে দুলতে থাকে, আর ঘুরতে থাকে নানা কক্ষে।
রবীন্দ্রনাথের প্রচুর পোশাক এখনও রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘরে আছে। ফাল্গুনী নাট্যাভিনয়ে বাউলের ভূমিকায় পরার জন্য প্রতিমা দেবী যে-আলখাল্লা রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন আজও তা পলিথিন দিয়ে মুড়ে সংরক্ষণ করা আছে।
বাড়ির কয়েকটা কক্ষজুড়ে সংরক্ষণ করা আছে ঊনবিংশ শতাব্দীর স্মারক জিনিসপত্র। এখানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। বিদ্যাসাগরের বই-পুস্তক, কাগজপত্র, চাদর, ধুতি, কৃত্রিম দাঁত, শকুন্তলার প্রথম সংস্করণের কপি ইত্যাদি।
রবীন্দ্র আঙ্গিনায় ঘুরতে ঘুরতে আসাদ ভাই বললেন, বুঝলে মাহবুব কেন রবীন্দ্রনাথের ডায়াবেটিস ছিল না!
এখন বুঝলাম। এত বড় বাড়ি প্রতিদিন এক চক্কর দিলেই ডায়াবেটিস বাপ বাপ করে পালাবে। পুরো বাড়ি ঘুরে এবার বাড়ির ছাদে গেলাম, ছাদে খানিকটা কাঠের শেড দেয়া আছে। অযতেœ ভেঙেচুরে গেছে। এখন আর আশপাশের উঁচু ভবনের কারণে দূরে দেখা যায় না। তবে ছাদের প্রশস্ত লনের নান্দনিক সৌন্দর্য এখনও মিয়ম্রাণ হয়নি।
বাড়িটা দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে দুপুর। রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘বেলা বেড়ে যায়, রোদ্দুর ওঠে কড়া হয়ে, দেউরিতে ঘণ্টা বেজে ওঠে।’ ঘণ্টা না বাজলেও পেট কিন্তু ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে দুপুরের খাবারের জন্য। আমরা ধীর পায়ে রবীন্দ্র আঙ্গিনার এক স্বপ্নিল ঘোর থেকে বেরিয়ে এলাম। আস্তে আস্তে নগরের প্রশস্ত রাস্তা, গাড়ির আওয়াজ, কোলাহল আমাদের আলিঙ্গন করল যান্ত্রিক সভ্যতার ব্যস্ততার গহিনে। কিন্তু মনটা এখনও বারবার ফিরে যেতে চায় রবীন্দ্রস্মৃতির বৈভবে ভরা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির স্বর্গ-আঙ্গিনায়।
বাড়ির আঙ্গিনাজুড়ে এক ধরনের ছায়াস্নিগ্ধ পরিবেশ। শান্ত ও মগ্নতার ঘোর বাড়ির সর্বত্র। নাগরিক সভ্যতার ব্যস্ততার ছাপ একটুও নেই। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথা ‘আমার ছেলেবেলায়’ লেখা- তখন কাজের এত বেশি হাঁস-ফাঁসানি ছিল না, বসে বসে দিন চলত, রবীন্দ্র আবাসে এখনও বোধকরি দিন বসে বসে, আস্তে আস্তে চলে। রবীন্দ্রনাথের বাড়িকে প্রাসাদ বললে ভুল হবে, অনেকগুলো প্রাসাদ। যাকে বলা যায় প্রাসাদমালা। বাড়ির প্রবেশপথে রবীন্দ্রনাথ ও বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি। এই বাড়ির বড় একটা অংশে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চললেও বাড়ির আঙ্গিক, বিন্যাস ও মৌলিকত্বে সাবেকি রূপ লালন করা আছে যত্নের সঙ্গে আজও।
বাড়ির বহিঃরাঙ্গন দেখার সময় মনটা উসখুস করছিল ভেতরে ঢুকে রবীন্দ্রস্মৃতির ‘ছেলেবেলার’ গল্পের সঙ্গে নানা অনুষঙ্গের মিল-অমিল মিলিয়ে দেখতে। পনের রুপির টিকিট কেটে মোবাইল, ক্যামেরা, ব্যাগ নিরাপত্তাকর্মীদের জিম্মায় রেখে ত্রিতল রবীন্দ্রস্মৃতি জাদুঘরে প্রবেশ করলাম।
বিশাল বিশাল বড় ও উঁচু কক্ষ। বিভিন্ন স্মৃতির স্মারক থরে থরে সাজানো। নানা স্মৃতি স্মারকের অনুষঙ্গের উপস্থিতি যেন আজও শত বছরের পুরনো রবীন্দ্রনাথকে হাজির করে। মনে হয় এখনও এ বাড়িতে উঠানে হাঁটছে রবীন্দ্র আমলের চাকর ব্রজেশ্বর কিংবা প্যারীদাসী।
রবীন্দ্রনাথের যাপিত জীবনের প্রায় সব স্মারক এখানে রক্ষিত। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর রান্নাঘর, মাটির উনান থেকে শুরু করে পদ্মা বোটের ডেমো। সালওয়ারী রবীন্দ্রনাথকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৯১৬-এ বার্মায় রবীন্দ্রনাথ, ১৯১৬ সালে জাপানে, ১৯২১-এ বার্লিনে, ১৯৩০-এ প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৩২-এ ইরানে, ১৯৩২-এ আরবের বেদুইনের সঙ্গে- এ রকম নানা শিরোনামে। বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এ পরিবারে অনেক বিখ্যাত কবি, চিত্রকর জন্ম নিয়েছিল। তাদের কর্মের স্মারক বিশেষত রবীন্দ্রনাথের ভাতিজা অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম, চিত্রকর্মের ব্যবহৃত সাজ-সরঞ্জাম এখনও দর্শনার্থীরা কৌতূহলভরা দৃষ্টিতে দেখে।
রবীন্দ্র পরিবারের সদস্য গোলাপলাল ঠাকুর, সতীন্দ্র ঠাকুর, রাজা রামনাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকের তৈলচিত্র সংগৃহীত আছে।
রবীন্দ্রনাথের চার বছরের ছবি থেকে শুরু করে, খাবার ঘর, বসার ঘর, সঙ্গীত কক্ষ, লেখার ঘর- এমনকি যে ঘরে ১৩৪৮ বাং ২২ শ্রাবণ দ্বি-প্রহরে কবিগুরু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন এখনও সেখানে শঙ্খ দিয়ে পিদিমের আলোকে ঘিরে এক আবহ তৈরি করা আছে। রবীন্দ্রনাথের বসার ঘর, পড়ার ঘর ইত্যাদির আসবাবপত্র শুধু রবীন্দ্র আমলের নয়, এর সাজানোর ঢংও ওই আমলেরই রাখা হয়েছে। দেখলে মনে হয় এই পড়ার ঘরেই বুঝি এই চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে পড়ছিলেন একটু আগে রবীন্দ্রনাথ।
বাড়িতে দর্শনার্থীদের জন্য সব সময় চলতে থাকে মৃদুলয়ে আদিসূরে রবীন্দ্র সঙ্গীত। দর্শনার্থীরা এই সঙ্গীতের মোহনীতে দুলতে থাকে, আর ঘুরতে থাকে নানা কক্ষে।
রবীন্দ্রনাথের প্রচুর পোশাক এখনও রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘরে আছে। ফাল্গুনী নাট্যাভিনয়ে বাউলের ভূমিকায় পরার জন্য প্রতিমা দেবী যে-আলখাল্লা রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন আজও তা পলিথিন দিয়ে মুড়ে সংরক্ষণ করা আছে।
বাড়ির কয়েকটা কক্ষজুড়ে সংরক্ষণ করা আছে ঊনবিংশ শতাব্দীর স্মারক জিনিসপত্র। এখানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। বিদ্যাসাগরের বই-পুস্তক, কাগজপত্র, চাদর, ধুতি, কৃত্রিম দাঁত, শকুন্তলার প্রথম সংস্করণের কপি ইত্যাদি।
রবীন্দ্র আঙ্গিনায় ঘুরতে ঘুরতে আসাদ ভাই বললেন, বুঝলে মাহবুব কেন রবীন্দ্রনাথের ডায়াবেটিস ছিল না!
এখন বুঝলাম। এত বড় বাড়ি প্রতিদিন এক চক্কর দিলেই ডায়াবেটিস বাপ বাপ করে পালাবে। পুরো বাড়ি ঘুরে এবার বাড়ির ছাদে গেলাম, ছাদে খানিকটা কাঠের শেড দেয়া আছে। অযতেœ ভেঙেচুরে গেছে। এখন আর আশপাশের উঁচু ভবনের কারণে দূরে দেখা যায় না। তবে ছাদের প্রশস্ত লনের নান্দনিক সৌন্দর্য এখনও মিয়ম্রাণ হয়নি।
বাড়িটা দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে দুপুর। রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘বেলা বেড়ে যায়, রোদ্দুর ওঠে কড়া হয়ে, দেউরিতে ঘণ্টা বেজে ওঠে।’ ঘণ্টা না বাজলেও পেট কিন্তু ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে দুপুরের খাবারের জন্য। আমরা ধীর পায়ে রবীন্দ্র আঙ্গিনার এক স্বপ্নিল ঘোর থেকে বেরিয়ে এলাম। আস্তে আস্তে নগরের প্রশস্ত রাস্তা, গাড়ির আওয়াজ, কোলাহল আমাদের আলিঙ্গন করল যান্ত্রিক সভ্যতার ব্যস্ততার গহিনে। কিন্তু মনটা এখনও বারবার ফিরে যেতে চায় রবীন্দ্রস্মৃতির বৈভবে ভরা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির স্বর্গ-আঙ্গিনায়।
No comments