দুই পরিবারের টানাটানি লাশ পড়ে আছে হিমঘরে by রুদ্র মিজান ও আল আমিন
একুশ দিন ধরে লাশ পড়ে আছে হিমঘরে। লাশের
দাবিদার দুই স্ত্রী। একজন মুসলিম। অন্যজন হিন্দু। দুই জনেরই দাবি খোকন
নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরীর স্ত্রী তারা। মুসলিম স্ত্রীর দাবি ইসলাম ধর্ম
গ্রহণ করে খোকন তাকে বিয়ে করেছিলেন। হিন্দু স্ত্রীর দাবি সনাতন ধর্ম
বিশ্বাসে থেকেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। দুই এমন দাবির বিষয়টি আদালতেও
গড়িয়েছে। তবে প্রথম দফায় আদালতও কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। এমন অবস্থায়
লাশের ঠিকানা এখন হিমঘরে। লাশ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে এমন টানাটানি নিয়ে
মানবজমিনের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে চমকপ্রদ তথ্য। দুই পরিবারের দাবি ও লাশ
নিয়ে টানাহেঁচড়ার পেছনে রয়েছে খোকনের অর্থ ও সম্পত্তি দখলের লড়াই। এমন
অবস্থায় দুই পরিবারের বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায় দুই পরিবারেই থাকতেন খোকন
নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরী। রাজধানীর উত্তর শাহজাহান পুরের বাসায় খোকন দ্বিতীয়
স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। মাঝে মধ্যে মসজিদে নামাজেও যেতেন। কোরবানি দিয়ে
মাংসও বিতরণ করতেন। অন্যদিকে প্রথম স্ত্রী ও খোকনের এক ভাইয়ের দাবি রায়ের
বাগের বাসায় প্রথম স্ত্রীর সঙ্গেও থাকতেন খোকন। তিনি সনাতন ধর্মের সব আচার
অনুষ্ঠান পালন করতেন। নিয়মিত মন্দিরে যেতেন।
গত ১৫ই জুন খোকন অসুস্থ হয়ে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৬শে জুন সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে তিনি মারা যান। হাসপাতালে তার সঙ্গে থাকা স্ত্রী হাবিবা আক্তার খানম বাবলি স্বামীর লাশ নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। এসময় বাদ সাধেন আগের স্ত্রী মিরা নন্দী এবং তার দু’সন্তান বাবলু ও চন্দনা। তারা দাবি করেন লাশ তারা নিয়ে হিন্দুধর্ম মতে সৎকার করবেন। বিষয়টি থানা পুলিশ থেকে আদালত পর্যন্ত গড়ায়। গত ১০ই জুলাই এ বিষয়ে আদালতের শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু এ দিন বিচারক এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না বলে অন্য আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
খোকন নন্দী মুসলমান হয়েই দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন বলে দাবি তার দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা খানম বাবলির। এর পক্ষে তার কাছে প্রমাণও রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ২রা জুলাই খোকনের সঙ্গে বিয়ে হয় বাবলির। এর আগে হাবিবুর রহমান নামে প্রথম শ্রেণীর একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এফিডেভিট করে খোকন ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বাবলি বলেন, বিয়ের কাবিননামা, এফিডেভিট আছে। তিনি আমার স্বামী এবং মুসলমান এটা প্রমাণের জন্য আর কি প্রয়োজন। খোকনের জীবিত থাকা চার ভাইয়ের মধ্যে দু’ভাই জহরলাল নন্দী ও সাগর নন্দী থাকেন ঢাকায়। এর মধ্যে খোকন ও বাবলির উত্তর শাহজাহানপুরের ৩৩১ নম্বর বাসায় প্রায়ই আসা-যাওয়া করতেন সাগর নন্দী। সাগর দীর্ঘদিন তেজতুরি বাজারে ছিলেন। বর্তমানে ১৮৬/১৩ তেজকুনিপাড়ায় থাকেন। সাগর ওই বাসায় গেলেও ঢাকায় থাকা অপর ভাই জহরলাল নন্দী ওই বাসায় কখনও যাননি। বাসার তত্ত্বাবধায়ক আবদুস সালাম ও খোকার বাসার গৃহপরিচারিকা তাসলিমা জানান, সাগর প্রায়ই বাসায় আসতেন। বাসার পাশের লন্ড্রী ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন নুরু জানান, বাসায় মাঝে মাঝে খোকার ভাই সাগর যেতেন। সকালে তার লন্ড্রী দোকানে কাপড় নিয়ে যেতেন তিনি। কিন্তু খোকনের মৃত্যুর পর স্ত্রী হাবিবা খানম বাবলিকে চিনেন না বলে অস্বীকার করেন এই সাগর। মানবজমিন থেকে ফোনে এই প্রতিবেদক কথা বলেন সাগর নন্দীর সঙ্গে। তিনি ওই বাসায় যেতেন উল্লেখ করে তার কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ওই বাসায় যাতায়াত ছিল সত্য। কিন্তু সমাধান আমার পক্ষে সম্ভব না। কারণ হচ্ছে ভাইয়ের সম্পদ। তার ছেলেমেয়েরা এটা মানবে না।
উত্তর শাহজাহানপুরের বাসার আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে খোকনকে তারা মুসলমান হিসেবেই জানতেন। তারা তাকে খোকা ভাই ডাকতেন। তবে তিনি সকালে বাসা থেকে বের হতেন, ফিরতেন রাতে। এজন্য আশপাশের লোকজনের সঙ্গে তার তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। পাড়ার দোকানদার নজরুল ও বাসার গৃহপরিচারিকা তাসলিমা জানান, মাঝে মাঝে শুক্রবারে নামাজ পড়তে পাশের মসজিদে যেতেন খোকন। এছাড়া প্রতি ঈদ-উল আজহায় কোরবানি দিতেন এই দম্পতি। গরুর মাংস বিতরণ করতেন খোকন নিজেই। পাড়ার দোকানদার নজরুল, দেলোয়ার, বাসার তত্ত্বাবধায়ক আবদুস সালাম, গৃহপরিচারিকা তাসলিমাকে গরুর মাংস দিতেন প্রতি ঈদেই। কুরবানি দিতেন খোকার শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ বাবলির পিতার বাড়ি সিদ্ধেশ্বরীতে। উত্তর শাহজাহানপুরে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে আছেন এই দম্পতি। বাসার মালিক আতাউর রহমানের ভাইপো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ-র ছাত্র এ টি এম তারেক জানান, খোকনকে একজন মুসলমান হিসেবেই জানেন তারা। খোকা একজন ব্যবসায়ী। সকালে বের হয়ে রাতে ফিরতেন। তাই তার সম্পর্কে খুব বেশি জানা নেই তাদের। হাবিবা আক্তার খানম বাবলির জাতীয় পরিচয়পত্রে তার পিতার নাম মৃত হাবিবুর রহমান, মায়ের মঞ্জুরা বেগম, জন্ম তারিখ ২রা ডিসেম্বর ১৯৫৬ সাল ও বাসার ঠিকানা ১১/১ সিদ্ধেশ্বরী উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু স্বামী হিসেবে কারও নাম উল্লেখ নেই। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোকার প্রথম স্ত্রী ও সন্তানরা। এ বিষয়ে বাবলি বলেন, তখন এত কিছু চিন্তা করিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হাবিবা আক্তার খানম ওরফে বাবলির সঙ্গে খোকন নন্দীর পরিচয় হয় পুরানা পল্টনে একটি চটপটির দোকানে। পরিচয়ের সূত্র ধরে ১৯৮৪ সালের ২রা জুলাই তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮৬ সালে প্রথম স্ত্রী মীরাকে ডিভোর্স দেন খোকা। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র আদালতে দিয়েছেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা খানম বাবলি। মীরার সঙ্গে খোকনের ভাই বাবুলের অনৈতিক সম্পর্কের বিষয় জানার পরই খোকন দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। বাবুল বর্তমানে মীরার সঙ্গেই রাজধানীর ১৫ রায়ের বাজারে থাকেন। এ বিষয়ে খোকনের গ্রামের বাড়ি মহেশখালীর জামালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বাবুল মিয়া বলেন, জহরলাল নন্দীর সঙ্গে তার বৌদি মীরার অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি গোপন কিছু না। এটা আমরা সবাই জানি। এ কারণেই খোকা ধর্মান্তরিত হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন হাবিবা খানম বাবলিকে। বাবলিকে নিয়ে অনেকবার খোকা কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলেন বলেও জানান তিনি।
সূত্র জানায়, খোকন ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে অসুস্থ হলেও ছোট ভাই সাগর ছাড়া অন্যরা তাকে দেখতে যেতেন না। গত এপ্রিল মাসে অসুস্থ হলে তাকে কলাবাগানের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন ক্ষুব্ধ হয়ে মহেসখালীতে থাকা তার ছোটভাই শান্তি নন্দীকে ফোনে খোকা বলেছিলেন, তোরা কি আমাকে দেখতে আসবি না? এসময় শান্তি বলেছিলেন, আপনি মুসলমান। এসে কি করবো? আমরা তো আপনার লাশও পাবো না। তবে বারডেমে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে দেখতে এসেছিলেন খোকার ভাইয়েরা। বারডেমে ভর্তির সময় বাবলি ফোনে ডেকে এনেছিলেন খোকনের ম্যানেজার দুলাল চন্দ্রকে। হাসপাতালের যাবতীয় কাগজে খোকনের নাম খোকন নন্দী লেখান দুলাল। তবে সূত্রে জানা গেছে, ধর্মন্তরিত হলেও ব্যবসার প্রয়োজনে খোকা তার আগের নামই ব্যবহার করতেন।
এদিকে মীরা নন্দীর রায়ের বাগের ভাড়া বাসা ও ওই এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খোকন ওই বাসায়ও মাঝে মধ্যে যেতেন। ওই ভাড়া বাসার পাশের মুদি দোকানদার আবদুর রহমান খোকন প্রসঙ্গে বলেন, খোকন হিন্দু ধর্মের আচার অনুষ্ঠান পালন করতেন। মোহাম্মদপুর থানাধীন রায়েরবাজারের সুলতানগঞ্জের কাপড় পট্টির ১৫ নম্বর হাজি ভবনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ওই বাসার এক তলায় ১/সি নম্বর ফ্ল্যাটে খোকন চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী মীরা নন্দী তার ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকেন। তবে বাসায় কাউকে পাওয়া যায়নি। কাজের মেয়ে গৃহকর্মী দয়াকে সাংবাদিক পরিচয় দিলে কোন কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, সবাই গ্রামের বাড়িতে গেছেন। আমাকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করে গেছেন। ওই বাড়ির মালিক আলহাজ নূরুল ইসলাম বলেন, প্রায় ৫ মাস আগে মীরা নন্দী আমার কাছে একতলার একটি ফ্লাট ভাড়া নিয়েছেন। তার স্বামী এ বাসায় সপ্তাহে দু’দিন থাকতেন। তিনি হিন্দুধর্ম পালন করতেন। সব সময় ধুতি পরে থাকতেন। দেখা হলেই আগেই নমস্কার বলে সম্মান জানাতেন। মানুষ হিসেবে মন্দ ছিলেন না। এ বিষয়ে ওই বাসার নিরাপত্তারক্ষী মো. রফিকুল ইসলাম জানান, খোকন নন্দী একজন হিন্দু ছিলেন। ছোট ও বড় পূজায় তিনি আমাকে টাকা-পয়সা দিতেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে একটি পাঞ্জাবিও কিনে দিয়েছিলেন। প্রায় ১ মাস আগে শুনতে পাই, তার আরেকটি স্ত্রী আছে। ওই স্ত্রীর বাসা রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায়। দ্বিতীয় স্ত্রীকে কেন্দ্র করে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তার ঝগড়া লেগে থাকতো। দ্বিতীয় স্ত্রী মুসলিম। আর প্রথম স্ত্রী হিন্দু। তাই কেউ কাউকে দেখতে পারতেন না। প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী পক্ষ থেকে খোকনকে চাপ দেয়া হতো উভয়কে তালাক দেয়ার জন্য। তিনি বলেন, মৃত্যুর প্রায় এক সপ্তাহ আগে তিনি আমাকে বাসার পাশের মুরগি পট্টিতে মাংস আনতে দিয়েছিলেন। তখন তাকে আমি এক কেজি গরুর মাংস এনে দিলে তিনি আমাকে বলেন, গরুর মাংস আনলেন কেন। আমি তো হিন্দু। খোকনের বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হয় ওই বাসার পাশের মুদি দোকানদার আবদুর রহমানের সঙ্গে। বলেন, খোকন নন্দী প্রায় আমার দোকানে আড্ডা দিতেন। সন্ধ্যার পরই বেশি আসতেন। ছেলে বাবলু নন্দী জানান, তার পিতার লাশের শেষকৃত্য না হওয়ায় তাদের পরিবারের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। তিনি যেন স্বর্গ লাভ করেন এজন্য গ্রামের বাড়িতে শ্রদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আদালতে যে মামলা করা হয়েছে ওই মামলার রায় যদি তাদের বিপক্ষে যায় তাহলে তারা ওই রায় মানবেন কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আশা করি বিজ্ঞ আদালত ন্যায়বিচার করবেন। এরপর থেকেই তার একটি ওয়ারিদ নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। রিং হলে রিসিভ করেন না। মৃতের ফার্মগেটের ক্যাপিটাল মার্কেটের ম্যানেজার দুলাল চন্দ্র রায় বলেন, গত রোজায় তিনি ক্যাপিটাল মার্কেটে সবাইকে ইফতারি খাইয়েছেন। তবে তার ম্যার্কেট, ব্যাংক একাউন্ট, ইনক্যাম টাক্স, মামলায় খোকন নন্দী উল্লেখ করা আছে।
No comments