সাদৃশ্যের সন্ধানে by শাহনেওয়াজ বিপ্লব
ভি
এস নাইপল, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। ‘টাইম’ ও ‘দ্য নিউইয়র্ক বুক
রিভিউ’ ম্যাগাজিন তাকে অভিহিত করেছেন ইংরেজি গদ্য সাহিত্যের ‘নতুন দ্রষ্টা’
ও ‘কিংবদন্তি’ হিসেবে। পৃথিবীতে এযাবৎকালে লেখা সব উপন্যাসকে বিবেচনায়
এনে, টাইম ম্যাগাজিন তার ‘এ হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’কে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ৭২তম
উপন্যাস হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছেন। ত্রিনিদাদে জন্ম নেয়া ভি এস নাইপলের
তুলনায় বাংলাদেশে জন্ম নেয়া শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বিশ্বসাহিত্যে একেবারেই
নগণ্য। বড় পুরস্কার বলতে আকাদেমি পুরস্কার (১৯৯৩) পেয়েছিলেন। অপরদিকে নাইপল
পেয়েছেন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার (২০০১), বুকার পুরস্কার (১৯৭১), ব্রিটিশ
লিটারেচার পুরস্কার (১৯৯৩), এ ছাড়া আরও এক ডজনের বেশি পুরস্কার। সেই
বিবেচনায় নাইপলের সাহিত্যসম্মান ও সাহিত্য প্রভাবের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেন
না শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, গপৎৎড়ি ঐরষষ
প্রকাশনী থেকে (১৯৬১)তে প্রকাশিত ভি এস নাইপলের ‘এ. হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’
উপন্যাসটি, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাসটির সঙ্গে
মিলিয়ে পড়লে, যে কোনো পাঠকই এ দুটো উপন্যাসের সাদৃশ্য বিবেচনা করে কেবলই
অবাক হবেন।
‘এ হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’ এর নায়ক মোহন বিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল হাতে ছয়টি আঙুল নিয়ে, হিন্দু সংস্কার মতে অমঙ্গলের প্রতীক হয়ে। ঠিক একইরকম ঘটনা ঘটেছে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাসের নায়কের বেলায়ও। এ উপন্যাসেও নায়ক কুবেরের জন্ম এক ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের রাতে, সেটিও অলক্ষুণে হিসেবে বিবেচিত হয়েছে উপন্যাসে।
মি. মোহন বিশ্বাস বহু প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত নিজের একটি পরিচয় চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন নিজের একটি ঘর; যে ঘরে তিনি তার স্বাধীনতা নিয়েই থাকবেন, যে ঘরটি মি. বিশ্বাসের ঘর বলেই চিহ্নিত হবে; সংঘবদ্ধ গণ্ডির ভেতর থেকে বেরিয়ে নিজের সতন্ত্র অবস্থান নির্মাণের চেষ্টা ‘এ. হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’ উপন্যাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। অন্যদিকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের দরিদ্র কুবেরও অজস্র প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে তার সব বিষয় আশয়ের ভেতর তার নিজের এবং পরিবারের জন্য বড় একটি ঘর তৈরির স্বপ্নকে টেনে নিয়ে গেছে। সে স্বপ্নের ভেতর ছিল ঘরের সামনে থাকবে আঙ্গিনা, বাড়ির সামনের পুকুরে থাকবে টলমল জল আর মাছ।
কুবের এবং মোহন বিশ্বাস দুজনই তাদের নিজেদের সাতন্ত্র্য খুঁজেছেন নিজেদের ঘর নির্মাণের স্বপ্নের মধ্য দিয়ে কিন্তু দুটি উপন্যাসেই নাইপল এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় একই পরিণতি টেনেছেন। ‘এ হাউজ ফর মি বিশ্বাস’ এ নায়ক মোহন বিশ্বাস উপন্যাসের শেষে এসে মৃত্যুবরণ করেছেন। কুবেরেরও হয়েছে একই পরিণতি। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কুবেরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উপন্যাস শেষ করেছেন।
নাইপল তুলসী পরিবারের প্রেক্ষাপটে একটি বড় পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে মি. বিশ্বাসকে বের করে নিয়ে এসেছেন। যেমনটি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ও করেছেন তার ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাসের। কুবেরকে তিনি দেবেন্দ্র লাল সাধু খাঁর পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে ধীরে ধীরে স্বতন্ত্র ‘কুবের’ করে তুলেছেন।
হিন্দু ধর্মীয় সংস্কারের প্রতি বিশ্বাস এর বেলায়ও উপন্যাস দুটোতে সাদৃশ্য দেখা যায়। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এবং ভি. এস নাইপল দুজনের উপন্যাসেই চরিত্রগুলো হিন্দু ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নিয়েছে।
‘এ. হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’ এবং ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাস দুটোর কাঠামোও প্রায় একইরকম। উপন্যাস দুটোর ঘটনা একটানা বর্ণিত হয়নি। বরং দুটি উপন্যাসেই চরিত্রগুলো, নায়ককে সামনে রেখে নানা পর্ববিভক্ত হয়ে মূল কাহিনীকে টেনে নিয়ে গেছে।
এমনকি ভাষাশৈলীতেও একইরকম সাদৃশ্যের দেখা মেলে নাইপল এর ‘এ হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’ এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’-এ। ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ গদ্য সৌকর্য বিন্যস্ত হয়েছে ‘এ হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’ এ-ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের অভিমত। একটি উদাহরণ ‘গ্রীণ ভ্যাল’ থেকে : ‘সে খাচ্ছিল তার কক্ষের সবুজ টেবিলে বসে। বড় দরজার আড়ালে জানালাকে পেছন দিয়ে বসেছিল সে এবং প্রতিজ্ঞ ছিল সে, ঘরের ভেতরে ছাদ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া স্যাঁতসেঁতে ঝুলকালি মাখানো পুরনো কালো লোহার রডের দিকে তাকাবে না। ঘরের ভেতরে পুরনো পত্রিকা, তামাকে গন্ধ মনে করিয়ে দিচ্ছিল তাকে বিছানার নিচে রাখা বাবার বাক্সটির কথা, যে বাক্সে বাবা শায়িত আছেন মাটির নিচে কবরে।’
‘কুবেরের বিষয় আশয়’ থেকে দ্বিতীয় উদাহরণ : ‘জলের দর কথাটা শুনলে কুবেরের বড় দুঃখ হয়। ইস তখন যদি বয়স্ক থাকতাম- হাতে টাকা থাকত! এক এক দিন ট্রেনে বসে দু’পাশের মাঠ দেখে মনে হয় সাইজ মতো বিরাট একলপ্তে অনেকটা জমি গালগল্পের জলের দরে পাওয়া যেত যদি, এদানি ব্রহ্মোত্তর দেয় না কেউ। তাহলে একেবারে কলবাড়ি করে তুলত। ভদ্রআসন, পুকুর, ফলের বাসা, সম্বচ্চরের ধান মলানোর মাঠ সব-সব এক সঙ্গে হয়ে যেতে।’
নাইপলের উপন্যাসে মি. বিশ্বাসের জন্য একটি ঘরের স্বপ্নের আকাক্সক্ষায় ব্যক্ত হয়েছে মোহন বিশ্বাসের হতাশা, বিচ্ছিন্নতা আর কলোনিয়াল সমাজব্যবস্থার অসারতার মধ্যে ব্যক্তি পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য বড়ো হয়ে ওঠা। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’এর কুবেরও মোহন বিশ্বাসের মতই হতাশ হয়েছে, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের স্বপ্ন তার ভেতরও তীব্রভাবে ছিল।
‘এ হাউজ ফর মি বিশ্বাস’ উপন্যাসটির প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬১-তে। ভি এস নাইপল জন্ম নিয়েছিলেন ত্রিনিদাদ এর চাগুয়ানাস-এ। তার জন্ম ১৯৩২ এর ১৭ আগস্ট। অপরদিকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় জন্মেছেন বাংলাদেশে ১৯৩৩-এ, বড় হয়েছেন এবং বাকি জীবন কাটিয়েছেন পশ্চিম বঙ্গে। বয়সের হিসাবে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নাইপলের চেয়ে এক বছরের ছোট। অপরদিকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬৩-তে। প্রকাশকাল হিসাবে এ দুটো গ্রন্থের মধ্যে ব্যবধান মাত্র দেড় বছরের মতো। যদিও ভি. এস নাইপলের গ্রন্থ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আগে প্রকাশিত হয়েছে। সে বিচারে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নাইপল দ্বারা কতটুকু প্রভাবিত হয়েছিলেন তার কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। দুটি উপন্যাসই পাশাপাশি রেখে পড়লে মনে হবে, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এর উপন্যাসের কুবের আর ভি. এস নাইপলের উপন্যাসের মোহন বিশ্বাস যেন একে অপরের যমজ ভাই, উপন্যাস দুটোও যেন একে অপরের যমজ। নাইপল এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যেন একইসঙ্গে বসে লিখেছেন উপন্যাস দুটো: একইরকম চরিত্র, একইরকম ঘটনা প্রবাহ, ভাষাভঙ্গি এবং একইরকমের ঘটনার সাদৃশ্যে। উপন্যাস দুটোর ঘটনার পরম্পরার এ আশ্চর্য মিল, বয়সের বিবেচনা, একইরকম উপন্যাস পরিণতি, একইরকমের উপসংহার; সাধারণ পাঠককে তো বটেই, সাহিত্য গবেষকদেরও অবাক করে।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এর জন্ম এশিয়ায়। পশ্চিমবঙ্গেই তিনি বড় হয়েছেন এবং জীবন কাটিয়েছেন। তাই তিনি উপন্যাসে পটভূমি করেছেন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাকে অপরদিকে ভি. এস নাইপল জন্মেছেন আমেরিকা মহাদেশের ক্যারিবিয়ান দ্বীপ ত্রিনিদাদে। ফলে তিনি উপন্যাসের পটভূমি করেছেন ত্রিনিদাদকে। দুজন দু’মহাদেশে জন্মগ্রহন করলেও তাদের উপন্যাসে আশ্চর্য সাদৃশ্য রয়েছে। আসলে মানবিক ঘটনার বর্ণনায় বিশ্বের সব লেখকই শেষ পর্যন্ত একইরকম ভাবনা বাঁধনে বাঁধা।
‘এ হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’ এর নায়ক মোহন বিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল হাতে ছয়টি আঙুল নিয়ে, হিন্দু সংস্কার মতে অমঙ্গলের প্রতীক হয়ে। ঠিক একইরকম ঘটনা ঘটেছে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাসের নায়কের বেলায়ও। এ উপন্যাসেও নায়ক কুবেরের জন্ম এক ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের রাতে, সেটিও অলক্ষুণে হিসেবে বিবেচিত হয়েছে উপন্যাসে।
মি. মোহন বিশ্বাস বহু প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত নিজের একটি পরিচয় চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন নিজের একটি ঘর; যে ঘরে তিনি তার স্বাধীনতা নিয়েই থাকবেন, যে ঘরটি মি. বিশ্বাসের ঘর বলেই চিহ্নিত হবে; সংঘবদ্ধ গণ্ডির ভেতর থেকে বেরিয়ে নিজের সতন্ত্র অবস্থান নির্মাণের চেষ্টা ‘এ. হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’ উপন্যাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। অন্যদিকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের দরিদ্র কুবেরও অজস্র প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে তার সব বিষয় আশয়ের ভেতর তার নিজের এবং পরিবারের জন্য বড় একটি ঘর তৈরির স্বপ্নকে টেনে নিয়ে গেছে। সে স্বপ্নের ভেতর ছিল ঘরের সামনে থাকবে আঙ্গিনা, বাড়ির সামনের পুকুরে থাকবে টলমল জল আর মাছ।
কুবের এবং মোহন বিশ্বাস দুজনই তাদের নিজেদের সাতন্ত্র্য খুঁজেছেন নিজেদের ঘর নির্মাণের স্বপ্নের মধ্য দিয়ে কিন্তু দুটি উপন্যাসেই নাইপল এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় একই পরিণতি টেনেছেন। ‘এ হাউজ ফর মি বিশ্বাস’ এ নায়ক মোহন বিশ্বাস উপন্যাসের শেষে এসে মৃত্যুবরণ করেছেন। কুবেরেরও হয়েছে একই পরিণতি। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কুবেরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উপন্যাস শেষ করেছেন।
নাইপল তুলসী পরিবারের প্রেক্ষাপটে একটি বড় পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে মি. বিশ্বাসকে বের করে নিয়ে এসেছেন। যেমনটি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ও করেছেন তার ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাসের। কুবেরকে তিনি দেবেন্দ্র লাল সাধু খাঁর পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে ধীরে ধীরে স্বতন্ত্র ‘কুবের’ করে তুলেছেন।
হিন্দু ধর্মীয় সংস্কারের প্রতি বিশ্বাস এর বেলায়ও উপন্যাস দুটোতে সাদৃশ্য দেখা যায়। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এবং ভি. এস নাইপল দুজনের উপন্যাসেই চরিত্রগুলো হিন্দু ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নিয়েছে।
‘এ. হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’ এবং ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাস দুটোর কাঠামোও প্রায় একইরকম। উপন্যাস দুটোর ঘটনা একটানা বর্ণিত হয়নি। বরং দুটি উপন্যাসেই চরিত্রগুলো, নায়ককে সামনে রেখে নানা পর্ববিভক্ত হয়ে মূল কাহিনীকে টেনে নিয়ে গেছে।
এমনকি ভাষাশৈলীতেও একইরকম সাদৃশ্যের দেখা মেলে নাইপল এর ‘এ হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’ এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’-এ। ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ গদ্য সৌকর্য বিন্যস্ত হয়েছে ‘এ হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’ এ-ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের অভিমত। একটি উদাহরণ ‘গ্রীণ ভ্যাল’ থেকে : ‘সে খাচ্ছিল তার কক্ষের সবুজ টেবিলে বসে। বড় দরজার আড়ালে জানালাকে পেছন দিয়ে বসেছিল সে এবং প্রতিজ্ঞ ছিল সে, ঘরের ভেতরে ছাদ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া স্যাঁতসেঁতে ঝুলকালি মাখানো পুরনো কালো লোহার রডের দিকে তাকাবে না। ঘরের ভেতরে পুরনো পত্রিকা, তামাকে গন্ধ মনে করিয়ে দিচ্ছিল তাকে বিছানার নিচে রাখা বাবার বাক্সটির কথা, যে বাক্সে বাবা শায়িত আছেন মাটির নিচে কবরে।’
‘কুবেরের বিষয় আশয়’ থেকে দ্বিতীয় উদাহরণ : ‘জলের দর কথাটা শুনলে কুবেরের বড় দুঃখ হয়। ইস তখন যদি বয়স্ক থাকতাম- হাতে টাকা থাকত! এক এক দিন ট্রেনে বসে দু’পাশের মাঠ দেখে মনে হয় সাইজ মতো বিরাট একলপ্তে অনেকটা জমি গালগল্পের জলের দরে পাওয়া যেত যদি, এদানি ব্রহ্মোত্তর দেয় না কেউ। তাহলে একেবারে কলবাড়ি করে তুলত। ভদ্রআসন, পুকুর, ফলের বাসা, সম্বচ্চরের ধান মলানোর মাঠ সব-সব এক সঙ্গে হয়ে যেতে।’
নাইপলের উপন্যাসে মি. বিশ্বাসের জন্য একটি ঘরের স্বপ্নের আকাক্সক্ষায় ব্যক্ত হয়েছে মোহন বিশ্বাসের হতাশা, বিচ্ছিন্নতা আর কলোনিয়াল সমাজব্যবস্থার অসারতার মধ্যে ব্যক্তি পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য বড়ো হয়ে ওঠা। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’এর কুবেরও মোহন বিশ্বাসের মতই হতাশ হয়েছে, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের স্বপ্ন তার ভেতরও তীব্রভাবে ছিল।
‘এ হাউজ ফর মি বিশ্বাস’ উপন্যাসটির প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬১-তে। ভি এস নাইপল জন্ম নিয়েছিলেন ত্রিনিদাদ এর চাগুয়ানাস-এ। তার জন্ম ১৯৩২ এর ১৭ আগস্ট। অপরদিকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় জন্মেছেন বাংলাদেশে ১৯৩৩-এ, বড় হয়েছেন এবং বাকি জীবন কাটিয়েছেন পশ্চিম বঙ্গে। বয়সের হিসাবে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নাইপলের চেয়ে এক বছরের ছোট। অপরদিকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬৩-তে। প্রকাশকাল হিসাবে এ দুটো গ্রন্থের মধ্যে ব্যবধান মাত্র দেড় বছরের মতো। যদিও ভি. এস নাইপলের গ্রন্থ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আগে প্রকাশিত হয়েছে। সে বিচারে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নাইপল দ্বারা কতটুকু প্রভাবিত হয়েছিলেন তার কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। দুটি উপন্যাসই পাশাপাশি রেখে পড়লে মনে হবে, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এর উপন্যাসের কুবের আর ভি. এস নাইপলের উপন্যাসের মোহন বিশ্বাস যেন একে অপরের যমজ ভাই, উপন্যাস দুটোও যেন একে অপরের যমজ। নাইপল এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যেন একইসঙ্গে বসে লিখেছেন উপন্যাস দুটো: একইরকম চরিত্র, একইরকম ঘটনা প্রবাহ, ভাষাভঙ্গি এবং একইরকমের ঘটনার সাদৃশ্যে। উপন্যাস দুটোর ঘটনার পরম্পরার এ আশ্চর্য মিল, বয়সের বিবেচনা, একইরকম উপন্যাস পরিণতি, একইরকমের উপসংহার; সাধারণ পাঠককে তো বটেই, সাহিত্য গবেষকদেরও অবাক করে।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এর জন্ম এশিয়ায়। পশ্চিমবঙ্গেই তিনি বড় হয়েছেন এবং জীবন কাটিয়েছেন। তাই তিনি উপন্যাসে পটভূমি করেছেন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাকে অপরদিকে ভি. এস নাইপল জন্মেছেন আমেরিকা মহাদেশের ক্যারিবিয়ান দ্বীপ ত্রিনিদাদে। ফলে তিনি উপন্যাসের পটভূমি করেছেন ত্রিনিদাদকে। দুজন দু’মহাদেশে জন্মগ্রহন করলেও তাদের উপন্যাসে আশ্চর্য সাদৃশ্য রয়েছে। আসলে মানবিক ঘটনার বর্ণনায় বিশ্বের সব লেখকই শেষ পর্যন্ত একইরকম ভাবনা বাঁধনে বাঁধা।
No comments