মায়ের ভাষার স্টাইলটা আনতে চেয়েছি by কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক
হাসান
আজিজুল হক এই জীবনে সাক্ষাৎকার একেবারে কম দেননি, অনেক কথাও বলেছেন। তার
কথার আলাদা গতি আছে, প্রেম-বাসনা আছে। তিনি যেন এক কথামুখর মানুষ। তার
সঙ্গে কথা বলে কখনও ক্লান্তি আসে না। তিনি যেন আমাদের জন্য বয়ে বেড়াচ্ছেন
সংস্কৃতির এক জার্নি। ২ ফেব্র“য়ারি ছিল তার ৭৫তম জন্মদিন। এই দিন তার
সাহিত্য নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন এই সময়ের আরেক কথাসাহিত্যিক কামরুজ্জামান
জাহাঙ্গীর। সেই সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ ছাপা হলো যুগান্তরের পাঠকেন জন্য।
বি.স. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর: আপনার ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে আপনাকে স্বাগত,
আপনি আছেন কেমন?
হাসান আজিজুল হক : এই তো আছি ভালোই। তোমরা ভালোই তো আছো?
হ্যাঁ, তা আছি। ৭৫তম জন্মদিন তো একজন লেখকের একটা ল্যান্ডমার্কও। এ নিয়ে কিছু বলবেন?
:কোনো কোনো কাগজে কি কি সব এসেছে শুনলাম। স্থানীয় কাগজেও নিউজ ছিল আর-কি।
আমরা আপনার ‘আগুনপাখি’ নিয়ে কিছু কথা বলি। এ উপন্যাসের মূল প্রণোদনাটা আপনি পেলেন কী করে?
:সাজ্জাদ শরিফ আমায় দেশ ভাগ নিয়ে কোনো গল্প লেখার বিষয়ে আগ্রহী কি-না জানতে চায়। আমি বললাম, তা তো আছেই। আমি একটা লিখে দেব। তা গল্প হয় কি-না বলতে পারব না। লিখলাম ‘একটি নির্জলা কথা’।
এটা তো গল্পই ছিল? তারপরের কথাও বলুন।
:হ্যাঁ,- তো, সনৎকুমার সাহা এটি পড়ে বেশ উদ্দীপ্ত হলেন এবং তিনি বললেন, এটার ভেতর কিন্তু দারুণ একটা ফোর্স আছে। আপনি এ নিয়ে কাজ করতে পারেন! আমি তখন বললাম, তাহলে দেব নাকি ডিনামাইট ফাটিয়ে হা হা হা? তখনই এটিকে একটা উপন্যাসে রূপান্তর করার কথা ভাবলাম। এর ভাষা নিয়েও অনেক ভাবনা শুরু হল আমার।
আমারও যদ্দূর মনে পড়ছে, ২০০৪ এর দিকে আপনি চট্টগ্রামে এ ধরনের উপন্যাসে বর্ধমানের একটা ভাষা ব্যবহারের কথা বলেছিলেন। এ নিয়ে আমরা মতবিনিময় করছিলাম। আমার কাছেও মনে হল, এই উপন্যাসের জন্য বর্ধমান এলাকার ভাষাটা ব্যবহার করলে তো ভালোই হবে। তবে কথা হচ্ছে হাসান ভাই, আপনি কেবল ক্রিয়াপদ আর কিছু বিশেষ্য, বিশেষণ আর অন্বয়বাদী শব্দেই স্থানীয় শব্দ আনলেন। এতে কি ভাষার আলাদা শক্তিটা আনা গেল?
:আমি কিন্তু একপর্যায়ে চিন্তা করলাম পুরোটায় যবগ্রামের ভাষা দিই। তবে এখানে পাঠস্বাদুতার বিষয়টাও ভাবতে হল। তুমি দেখবে, এই ভাষাতে পুরুষ/মহিলা, মহিলা/মহিলা, এমনকি হিন্দু মহিলা আর মুসলিম মহিলার ভেতর পার্থক্য আছে। আমি আমার মায়ের ভাষার স্টাইলটা আনতে চেয়েছি।
তবু ভাষা তো দেখি অনেকটা প্রমিত আচরণেই ছিল।
:আমি ভাষাকে উন্মুক্ত আকাশের মতোই একটা বিষয় মনে করি। মানুষ তার স্বাধীন মতে তা ব্যবহার করবে। লেখার সঙ্গে এর একটা সংযোগ তো থাকা দরকার!
উপন্যাসে কি আপনি যুক্ত বাংলার বা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক আকাক্সক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন? শরৎ বসু বা সুবাস বসু কিংবা আবুল হাশিমদের মিলিত বাংলার কথা বলতে চেয়েছেন?
: যুক্ত বাংলার একটা বিষয় শরৎ বসু-আবুল হাশিমদের রাজনৈতিক ইচ্ছায় ছিল। কিন্তু জিন্নাহ, বলবভাই প্যাটেল বা নেহেরুকে সামাল দেবে কে? গান্ধী অবশ্য দেশ ভাগ নিয়ে তখন বলেছিলেন, আমার বুকের ভেতর শেল মারা হল! তবে এই উপন্যাসে আমি আমার মায়ের সাফারিংসটাই আনতে চেয়েছি,- হিন্দু, মুসলিম, যুক্ত বাংলা, সর্বভারতীয় কোনো বিষয় নয়। যতভাবেই বলো জাহাঙ্গীর, পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের যন্ত্রণা তো ছিল আলাদা।
আপনি কি এ উপন্যাস লিখে তৃপ্ত, উপন্যাসের একটা আদল মনমতো আনতে পেরেছেন?
:আমি তো বলেছি। আমার যা বলার ছিল তা বলেছি তো।
তবু ‘তিস্তাপুরাণ’, ‘খোয়াবনামা’র ভেতর যে আলাদা একটা অদ্ভুত শক্তি বা বিষয় আছে, তা তো এখানে আছে বলে মনে হয় না! তা কি এখানে অনেকটা পারিবারিক ডায়েরির আকারে আসেনি?
:আমি তো পারিবারিক একটা বিষয়ই সব কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে ভিন্ন আদলে আনতে চেয়েছি।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা উপন্যাস লেখার কাজ অনেকটাই গুছিয়ে এনেছিলেন, কিন্তু তার অকাল মৃত্যুতে তা আর হল না। এতে বাংলাসাহিত্যের বড় ক্ষতি হল বলতে হয়। আপনার কি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ ধরনের কাজ করার কোনো পরিকল্পনা আছে?
:তুমি যা বললে তা অত্যন্ত সত্যি কথা, ইলিয়াস যে মাঝে মাঝে বলতেন না যে একশ/দেড়শ বছর বাঁচা দরকার, আমিও নিজে সেটা অনুভব করি। হ্যাঁ, তিনি মুক্তিযুদ্ধের ওপর উপন্যাস লেখার ব্যাপারে কাজ শুরু করেছিলেন। নোট তৈরি করছিলেন, তার পরিকল্পনার কথা তো জানতামই। কিন্তু তিনি তা শেষ করতে পারলেন না। আমাদের কপাল ভালো যে দুটো উপন্যাস তিনি লিখে যেতে পেরেছিলেন। তার মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধের মহৎ একটা লেখা থেকে নিশ্চয়ই আমরা বঞ্চিত হয়েছি। তার কাজটা তো আর আমার নেয়ার বিষয় নয়। কেউ কারও কাজ হাতেও নিতে পারে না। মানুষের আয়ু যদি নিরবধি হতো তাহলে অনেক আশার বাণীই শোনাতে পারতাম তোমাদের- কিন্তু তা তো নয়। কতকিছুই তো করতে চাই- তরলাবালা : বঙ্গরমণী গাথা উপন্যাসটি শেষ করতে চাই। মাস ছয়েক পর আবার তা শুরু করব ভাবছি। তবে হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধকে বিশাল ক্যানভাস করে কিছু করতে গেলে ইলিয়াসের চাওয়ার মতোই দুশ বছরের আয়ু দরকার।
কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কথা আপনি বিশেষ মর্যাদা দিয়েই স্মরণ করেন এবং তা যর্থার্থই। তবে আমরা আপনার লেখা থেকে এও জানি যে, আপনি বলে থাকেন কথাসাহিত্যের ইতিহাস ফর্মের ইতিহাস নয়। আমরা যদি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র শিল্পসম্মত উপন্যাসের কথা বলি, যেমন ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ বা ‘চাঁদের অমাবস্যা’র কথা যদি বলি, তাহলে এগুলোর ফর্মের বিশেষত্বও কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ফর্মের এই বিশেষত্বটা কি অস্বীকার করবেন?
: না না, ফর্মের বিষয়টা তো আমি অস্বীকার করবই না। কিন্তু এ জায়গায় আমি বার বার বলছি, ওয়ালীউল্লাহ্ আগে ফর্ম ঠিক করে লিখেছিলেন? নাকি লেখার ব্যাপারটাকে খুব এফেকটিভলি কী করে প্রকাশ করা যায়, সেইটা ভেবে ফর্ম তৈরি করেছিলেন? কোন্টা আগে?! ওই যুগে যে কথা তাকে বলতে হবে, তা সব-চাইতে তীব্রভাবে, সব-চাইতে গভীর ভাবে, সব-চাইতে একেবারে তল পর্যন্ত বিবেচনা করে, তা যদি বলতে হয় তাহলে লালসালুর নিজস্ব ফর্ম দরকার। যে-কথাগুলো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে চেয়েছিলেন, সেই কথাগুলোকে তত জোর দিয়ে প্রকাশ করার জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাদা ফর্মের প্রয়োজন ছিল। একেবারেই ফর্মলেস লেখা, প্রায় কোনোরকমের কারিগরি নেই, কৌশল নেই, খুবই সাধারণভাবে তৈরি করা এলোমেলো লেখা কার? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পথের পাঁচালিতে তিনি কোনো ফর্মেরই তোয়াক্কা করেননি। কাজেই কোনো লেখাকে শুধু ফর্মের দিক চিন্তা করে নিন্দা-মন্দ করতে হয় না। কারণ তখন মনে হয়, ঠিক যে কয়টা প্যাঁচ থাকলে কৌটোর মুখটা ঠিকমতো লাগবে, সেই কয়টা প্যাঁচই বিভূতিভূষণের ঢাকনাতে আছে, বুঝতে পেরেছ? সেই কয়টা দরকারি প্যাঁচই আবার মানিকের ঢাকনাতে আছে। একেই বলে ফর্ম আর বক্তব্য বিষয়ের এক অদ্ভুত বিবাহ। এই বিবাহটা ঘটাতে হয়। একজন লেখককে এভাবে কাজ করতে হয়। নাটক তো অনেককাল আগে থেকেই লেখা হচ্ছে, সফোক্লিসও
নাটক লিখেছেন, আবার শেকসপিয়রও নাটক লিখেছেন; শেকসপিয়র আজ থাকলে তোমাদের জিজ্ঞেস করতেন, তোমরা ফর্ম ভাঙার জন্য নাটক লিখছ, নাকি অন্যকিছু? কথা হচ্ছে, এই যে মাতামাতিটা করা হয়, তাতে আঁধার এবং আধেয়’র মধ্যে একাত্ম সম্পর্ক, তা আমরা মিস্ করি। এ জন্যই এ দুটোকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা করতে চাওয়ার, করার কোনো দরকার নেই। সফোক্লিসের ফর্মটা আমাদের কাছে ত্র“টিপূর্ণ মনে হয় না, পুরনোও মনে হয় না। মনে হয় যে, হ্যাঁ, কীভাবে সফোক্লিস, ইউরিপিডাস বা ঈসকাইলাসরা অদ্ভুতভাবে গল্পটা বললেন তাই কিন্তু বড়। তুমি ওইভাবে গল্পটা বলতেও পারবে না। তারা তাদের কথাগুলো সবচেয়ে ভালোভাবে বলার জন্যই ওই ফর্মটা বেছে নিয়েছেন। ওর চাইতে সংক্ষেপে, ওই কয়টি পাতার মধ্যে এই মহাট্র্যাজেডি নাটকে আনা যেত না। সেই জন্যই আমার মনে হয় যে, যে যত বড় লেখক তার তত ভালো ফর্ম। ফর্মের নিজস্ব ইতিহাস যদি ধরি তাহলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কারণ সমাজের বিবর্তনের, সমাজের ক্রম-অগ্রসরমানতার পারস্পরিক নিজস্ব ধাপ অনুপাতে একটা চেহারা আছে। সেই জন্য ফর্মের ইতিহাস দেয়া যায়। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবে, পৃথিবীর সব লেখকই নিজের কাছে অনন্য এবং নিজের ফর্ম হন্যে হয়ে খুঁজতে যাওয়া ভুল। এমনকি ম্যাজিক রিয়েলিস্টদের ভেতর তুমি যতগুলো লেখককে অন্তর্ভুক্ত করতে চাও, সেই লেখকদের একজনের ফর্মের সঙ্গে অন্যজনের ফর্মের কোনো মিল নেই। ইউসার লেখার সঙ্গে মার্কেজের লেখা, ফুয়েন্তেজ, কার্পেন্তিয়র বা হুয়ান রুলফোর লেখা- কারও সঙ্গে কারও লেখা মিলবে? হুয়ান রুলফোর মাত্র পাদ্রে পেরোমার নামের চমৎকার একটা উপন্যাস আর কয়েকটা মাত্র ছোটগল্প। কী অপূর্ব শিল্প। কিন্তু তার সঙ্গে কারও মিল পাবে? শুধু ফর্ম নিয়ে এসব তোমরা বলো কেন? লেখকরা এভাবে বলার জন্য বলেছে তোমাদের? আমরা আগে ফর্ম নিয়ে কাজ করছি, তারপরে উপন্যাস বা গল্প লিখেছি- এ-রকম বলেছে কোনো লেখক? তোমরা সমালোচকরা এসব কেন বলো? হ্যাঁ, বুঝবার জন্য ইচ্ছা হলে বলতে পার? সেই জন্য আমি ফর্মের ব্যাপারটা এভাবেই দেখি।
হাসান আজিজুল হক : এই তো আছি ভালোই। তোমরা ভালোই তো আছো?
হ্যাঁ, তা আছি। ৭৫তম জন্মদিন তো একজন লেখকের একটা ল্যান্ডমার্কও। এ নিয়ে কিছু বলবেন?
:কোনো কোনো কাগজে কি কি সব এসেছে শুনলাম। স্থানীয় কাগজেও নিউজ ছিল আর-কি।
আমরা আপনার ‘আগুনপাখি’ নিয়ে কিছু কথা বলি। এ উপন্যাসের মূল প্রণোদনাটা আপনি পেলেন কী করে?
:সাজ্জাদ শরিফ আমায় দেশ ভাগ নিয়ে কোনো গল্প লেখার বিষয়ে আগ্রহী কি-না জানতে চায়। আমি বললাম, তা তো আছেই। আমি একটা লিখে দেব। তা গল্প হয় কি-না বলতে পারব না। লিখলাম ‘একটি নির্জলা কথা’।
এটা তো গল্পই ছিল? তারপরের কথাও বলুন।
:হ্যাঁ,- তো, সনৎকুমার সাহা এটি পড়ে বেশ উদ্দীপ্ত হলেন এবং তিনি বললেন, এটার ভেতর কিন্তু দারুণ একটা ফোর্স আছে। আপনি এ নিয়ে কাজ করতে পারেন! আমি তখন বললাম, তাহলে দেব নাকি ডিনামাইট ফাটিয়ে হা হা হা? তখনই এটিকে একটা উপন্যাসে রূপান্তর করার কথা ভাবলাম। এর ভাষা নিয়েও অনেক ভাবনা শুরু হল আমার।
আমারও যদ্দূর মনে পড়ছে, ২০০৪ এর দিকে আপনি চট্টগ্রামে এ ধরনের উপন্যাসে বর্ধমানের একটা ভাষা ব্যবহারের কথা বলেছিলেন। এ নিয়ে আমরা মতবিনিময় করছিলাম। আমার কাছেও মনে হল, এই উপন্যাসের জন্য বর্ধমান এলাকার ভাষাটা ব্যবহার করলে তো ভালোই হবে। তবে কথা হচ্ছে হাসান ভাই, আপনি কেবল ক্রিয়াপদ আর কিছু বিশেষ্য, বিশেষণ আর অন্বয়বাদী শব্দেই স্থানীয় শব্দ আনলেন। এতে কি ভাষার আলাদা শক্তিটা আনা গেল?
:আমি কিন্তু একপর্যায়ে চিন্তা করলাম পুরোটায় যবগ্রামের ভাষা দিই। তবে এখানে পাঠস্বাদুতার বিষয়টাও ভাবতে হল। তুমি দেখবে, এই ভাষাতে পুরুষ/মহিলা, মহিলা/মহিলা, এমনকি হিন্দু মহিলা আর মুসলিম মহিলার ভেতর পার্থক্য আছে। আমি আমার মায়ের ভাষার স্টাইলটা আনতে চেয়েছি।
তবু ভাষা তো দেখি অনেকটা প্রমিত আচরণেই ছিল।
:আমি ভাষাকে উন্মুক্ত আকাশের মতোই একটা বিষয় মনে করি। মানুষ তার স্বাধীন মতে তা ব্যবহার করবে। লেখার সঙ্গে এর একটা সংযোগ তো থাকা দরকার!
উপন্যাসে কি আপনি যুক্ত বাংলার বা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক আকাক্সক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন? শরৎ বসু বা সুবাস বসু কিংবা আবুল হাশিমদের মিলিত বাংলার কথা বলতে চেয়েছেন?
: যুক্ত বাংলার একটা বিষয় শরৎ বসু-আবুল হাশিমদের রাজনৈতিক ইচ্ছায় ছিল। কিন্তু জিন্নাহ, বলবভাই প্যাটেল বা নেহেরুকে সামাল দেবে কে? গান্ধী অবশ্য দেশ ভাগ নিয়ে তখন বলেছিলেন, আমার বুকের ভেতর শেল মারা হল! তবে এই উপন্যাসে আমি আমার মায়ের সাফারিংসটাই আনতে চেয়েছি,- হিন্দু, মুসলিম, যুক্ত বাংলা, সর্বভারতীয় কোনো বিষয় নয়। যতভাবেই বলো জাহাঙ্গীর, পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের যন্ত্রণা তো ছিল আলাদা।
আপনি কি এ উপন্যাস লিখে তৃপ্ত, উপন্যাসের একটা আদল মনমতো আনতে পেরেছেন?
:আমি তো বলেছি। আমার যা বলার ছিল তা বলেছি তো।
তবু ‘তিস্তাপুরাণ’, ‘খোয়াবনামা’র ভেতর যে আলাদা একটা অদ্ভুত শক্তি বা বিষয় আছে, তা তো এখানে আছে বলে মনে হয় না! তা কি এখানে অনেকটা পারিবারিক ডায়েরির আকারে আসেনি?
:আমি তো পারিবারিক একটা বিষয়ই সব কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে ভিন্ন আদলে আনতে চেয়েছি।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা উপন্যাস লেখার কাজ অনেকটাই গুছিয়ে এনেছিলেন, কিন্তু তার অকাল মৃত্যুতে তা আর হল না। এতে বাংলাসাহিত্যের বড় ক্ষতি হল বলতে হয়। আপনার কি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ ধরনের কাজ করার কোনো পরিকল্পনা আছে?
:তুমি যা বললে তা অত্যন্ত সত্যি কথা, ইলিয়াস যে মাঝে মাঝে বলতেন না যে একশ/দেড়শ বছর বাঁচা দরকার, আমিও নিজে সেটা অনুভব করি। হ্যাঁ, তিনি মুক্তিযুদ্ধের ওপর উপন্যাস লেখার ব্যাপারে কাজ শুরু করেছিলেন। নোট তৈরি করছিলেন, তার পরিকল্পনার কথা তো জানতামই। কিন্তু তিনি তা শেষ করতে পারলেন না। আমাদের কপাল ভালো যে দুটো উপন্যাস তিনি লিখে যেতে পেরেছিলেন। তার মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধের মহৎ একটা লেখা থেকে নিশ্চয়ই আমরা বঞ্চিত হয়েছি। তার কাজটা তো আর আমার নেয়ার বিষয় নয়। কেউ কারও কাজ হাতেও নিতে পারে না। মানুষের আয়ু যদি নিরবধি হতো তাহলে অনেক আশার বাণীই শোনাতে পারতাম তোমাদের- কিন্তু তা তো নয়। কতকিছুই তো করতে চাই- তরলাবালা : বঙ্গরমণী গাথা উপন্যাসটি শেষ করতে চাই। মাস ছয়েক পর আবার তা শুরু করব ভাবছি। তবে হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধকে বিশাল ক্যানভাস করে কিছু করতে গেলে ইলিয়াসের চাওয়ার মতোই দুশ বছরের আয়ু দরকার।
কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কথা আপনি বিশেষ মর্যাদা দিয়েই স্মরণ করেন এবং তা যর্থার্থই। তবে আমরা আপনার লেখা থেকে এও জানি যে, আপনি বলে থাকেন কথাসাহিত্যের ইতিহাস ফর্মের ইতিহাস নয়। আমরা যদি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র শিল্পসম্মত উপন্যাসের কথা বলি, যেমন ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ বা ‘চাঁদের অমাবস্যা’র কথা যদি বলি, তাহলে এগুলোর ফর্মের বিশেষত্বও কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ফর্মের এই বিশেষত্বটা কি অস্বীকার করবেন?
: না না, ফর্মের বিষয়টা তো আমি অস্বীকার করবই না। কিন্তু এ জায়গায় আমি বার বার বলছি, ওয়ালীউল্লাহ্ আগে ফর্ম ঠিক করে লিখেছিলেন? নাকি লেখার ব্যাপারটাকে খুব এফেকটিভলি কী করে প্রকাশ করা যায়, সেইটা ভেবে ফর্ম তৈরি করেছিলেন? কোন্টা আগে?! ওই যুগে যে কথা তাকে বলতে হবে, তা সব-চাইতে তীব্রভাবে, সব-চাইতে গভীর ভাবে, সব-চাইতে একেবারে তল পর্যন্ত বিবেচনা করে, তা যদি বলতে হয় তাহলে লালসালুর নিজস্ব ফর্ম দরকার। যে-কথাগুলো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে চেয়েছিলেন, সেই কথাগুলোকে তত জোর দিয়ে প্রকাশ করার জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাদা ফর্মের প্রয়োজন ছিল। একেবারেই ফর্মলেস লেখা, প্রায় কোনোরকমের কারিগরি নেই, কৌশল নেই, খুবই সাধারণভাবে তৈরি করা এলোমেলো লেখা কার? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পথের পাঁচালিতে তিনি কোনো ফর্মেরই তোয়াক্কা করেননি। কাজেই কোনো লেখাকে শুধু ফর্মের দিক চিন্তা করে নিন্দা-মন্দ করতে হয় না। কারণ তখন মনে হয়, ঠিক যে কয়টা প্যাঁচ থাকলে কৌটোর মুখটা ঠিকমতো লাগবে, সেই কয়টা প্যাঁচই বিভূতিভূষণের ঢাকনাতে আছে, বুঝতে পেরেছ? সেই কয়টা দরকারি প্যাঁচই আবার মানিকের ঢাকনাতে আছে। একেই বলে ফর্ম আর বক্তব্য বিষয়ের এক অদ্ভুত বিবাহ। এই বিবাহটা ঘটাতে হয়। একজন লেখককে এভাবে কাজ করতে হয়। নাটক তো অনেককাল আগে থেকেই লেখা হচ্ছে, সফোক্লিসও
নাটক লিখেছেন, আবার শেকসপিয়রও নাটক লিখেছেন; শেকসপিয়র আজ থাকলে তোমাদের জিজ্ঞেস করতেন, তোমরা ফর্ম ভাঙার জন্য নাটক লিখছ, নাকি অন্যকিছু? কথা হচ্ছে, এই যে মাতামাতিটা করা হয়, তাতে আঁধার এবং আধেয়’র মধ্যে একাত্ম সম্পর্ক, তা আমরা মিস্ করি। এ জন্যই এ দুটোকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা করতে চাওয়ার, করার কোনো দরকার নেই। সফোক্লিসের ফর্মটা আমাদের কাছে ত্র“টিপূর্ণ মনে হয় না, পুরনোও মনে হয় না। মনে হয় যে, হ্যাঁ, কীভাবে সফোক্লিস, ইউরিপিডাস বা ঈসকাইলাসরা অদ্ভুতভাবে গল্পটা বললেন তাই কিন্তু বড়। তুমি ওইভাবে গল্পটা বলতেও পারবে না। তারা তাদের কথাগুলো সবচেয়ে ভালোভাবে বলার জন্যই ওই ফর্মটা বেছে নিয়েছেন। ওর চাইতে সংক্ষেপে, ওই কয়টি পাতার মধ্যে এই মহাট্র্যাজেডি নাটকে আনা যেত না। সেই জন্যই আমার মনে হয় যে, যে যত বড় লেখক তার তত ভালো ফর্ম। ফর্মের নিজস্ব ইতিহাস যদি ধরি তাহলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কারণ সমাজের বিবর্তনের, সমাজের ক্রম-অগ্রসরমানতার পারস্পরিক নিজস্ব ধাপ অনুপাতে একটা চেহারা আছে। সেই জন্য ফর্মের ইতিহাস দেয়া যায়। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবে, পৃথিবীর সব লেখকই নিজের কাছে অনন্য এবং নিজের ফর্ম হন্যে হয়ে খুঁজতে যাওয়া ভুল। এমনকি ম্যাজিক রিয়েলিস্টদের ভেতর তুমি যতগুলো লেখককে অন্তর্ভুক্ত করতে চাও, সেই লেখকদের একজনের ফর্মের সঙ্গে অন্যজনের ফর্মের কোনো মিল নেই। ইউসার লেখার সঙ্গে মার্কেজের লেখা, ফুয়েন্তেজ, কার্পেন্তিয়র বা হুয়ান রুলফোর লেখা- কারও সঙ্গে কারও লেখা মিলবে? হুয়ান রুলফোর মাত্র পাদ্রে পেরোমার নামের চমৎকার একটা উপন্যাস আর কয়েকটা মাত্র ছোটগল্প। কী অপূর্ব শিল্প। কিন্তু তার সঙ্গে কারও মিল পাবে? শুধু ফর্ম নিয়ে এসব তোমরা বলো কেন? লেখকরা এভাবে বলার জন্য বলেছে তোমাদের? আমরা আগে ফর্ম নিয়ে কাজ করছি, তারপরে উপন্যাস বা গল্প লিখেছি- এ-রকম বলেছে কোনো লেখক? তোমরা সমালোচকরা এসব কেন বলো? হ্যাঁ, বুঝবার জন্য ইচ্ছা হলে বলতে পার? সেই জন্য আমি ফর্মের ব্যাপারটা এভাবেই দেখি।
‘সাবিত্রি
উপাখ্যান’-এ নারীর একটা জীবন, একটা হাহাকারময় জার্নি আছে। কিন্তু
ধর্ষণাক্রান্ত নারীর মামলার কী হল, তারা শেষ পর্যন্ত কি করতে পারল,
সংখ্যালঘুর থরোথরোও অবজার্ভেশন কি আমরা আশা করতে পারি।
: আমার তো ইচ্ছা আছে সেই বয়োবৃদ্ধ নারী, নানা পীড়নে আক্রান্ত সেই নারীর বিষয়ে ধারাবাহিকতা রেখে আরও কিছু কাজ করা যায় কি-না- দেখা যাক।
আপনার সঙ্গে কথা বলা মানেই একটা সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে স্পর্শ করা,- আপনি দীর্ঘজীবী হোন হাসান ভাই।
: তোমার সঙ্গে কথা বলতেও ভালো লাগছে- ভালো থেকো।
: আমার তো ইচ্ছা আছে সেই বয়োবৃদ্ধ নারী, নানা পীড়নে আক্রান্ত সেই নারীর বিষয়ে ধারাবাহিকতা রেখে আরও কিছু কাজ করা যায় কি-না- দেখা যাক।
আপনার সঙ্গে কথা বলা মানেই একটা সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে স্পর্শ করা,- আপনি দীর্ঘজীবী হোন হাসান ভাই।
: তোমার সঙ্গে কথা বলতেও ভালো লাগছে- ভালো থেকো।
No comments