রাষ্ট্র ও রাজনীতি- সংকট উত্তরণে একটি গুচ্ছ প্রস্তাব by নূহ-উল-আলম লেনিন
গত ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ১২ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক জনপ্রিয় দল (৪২ শতাংশ সমর্থক) হিসেবে স্বীকৃত হলেও
প্রধান বিরোধী দলসহ সব দল অংশগ্রহণ না করায় নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ বলে অনেকে মনে করেন। তা সত্ত্বেও এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রথমত সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন বানচালের অসাধু প্রচেষ্টা এবং তৃতীয় পক্ষকে ডেকে এনে অসাংবিধানিক ধারা প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে।
আপাতত দেশবাসী হানাহানি, সন্ত্রাস, রক্তপাত ও সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার হাত থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পেয়েছে। অর্থনীতি ও জনজীবনেও কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। আন্দোলনের নামে গত কয়েক মাস যে নারকীয় তাণ্ডব, নাশকতা ও গণহত্যা হয়েছে, দেশবাসী তার পুনরাবৃত্তি রোধে বদ্ধপরিকর। বিরোধী জোট যদি এর থেকে কিছু শিক্ষা নিয়ে থাকে, তাহলে তা তাদের জন্য যেমন, তেমনি দেশের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনবে।
দশম জাতীয় সংসদ একটা বাস্তবতা। আইন ও সংবিধানের দৃষ্টিতে এই সংসদ যেমন বৈধ, তেমনি এই সরকারও বৈধ। অতএব, এই সংসদকে এবং সরকারকে কাজ করতে দিতে হবে। তবে আইনগত ও সাংবিধানিকভাবে বৈধ হলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধান হয়ে গেছে, এমনটি বলা যায় না। এ জন্য সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা স্থায়ী সমাধানসূত্র উদ্ভাবিত ও বাস্তবায়িত না হলে দেশে স্থায়ী শান্তি, স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব হবে না।
বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেন বলেই একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন। ৫ জানুয়ারির আগেই তিনি প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন—ক. সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিবাদী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়তে হবে বিএনপিকে; খ. হত্যা, সন্ত্রাস, অবরোধ, হরতাল, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও হানাহানি বন্ধ করতে হবে। আর এ দুটি শর্ত পূরণ হলে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। অর্থবহ সংলাপের মধ্য দিয়ে যদি মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য হয়, তাহলে একাদশ জাতীয় সংসদ এগিয়ে আনা বা গ্রহণযোগ্য কোনো ফর্মুলার ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী দরজা খোলা রেখেছেন। এই দরজা দিয়ে সংকট উত্তরণের দায়িত্ব বিরোধী দলসহ সব পক্ষ গ্রহণ করবে কি না, সেটি দেখার বিষয়।
গত ২৯ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে মহামান্য রাষ্ট্রপতিও তাঁর ভাষণে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে অন্তত এটুকু স্পষ্ট হয়েছে, দেশে একটা রাজনৈতিক সংকট আছে, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে যার আশু সমাধান হওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতি নিজে সংলাপের তাগিদ দেওয়া ছাড়া সমাধানসূত্র চাপিয়ে দেননি। প্রধানমন্ত্রীও তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেননি। দেশের গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটি, ব্যবসায়ী মহল ও কল্যাণকামী রাজনৈতিক মহল বর্তমান সংকট উত্তরণের বিষয়ে তাদের আকাঙ্ক্ষা, তাগিদ ও নানামুখী চিন্তা-ভাবনাও প্রকাশ করছে। দুই দিন আগেও যাঁরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত রাখার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন, তাঁরাও অর্থবহ সংলাপের মাধ্যমে সংকট উত্তরণের কথা বলছেন।
দেশের একটি প্রধান দৈনিকসহ একাধিক সংবাদপত্র তাদের সম্পাদকীয়তে এবং ‘সুশীল সমাজের’ কোনো কোনো সংগঠন সংলাপের সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা ঠিক করার কথা বলেছেন। আমার দল আওয়ামী লীগের অবস্থানের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। আমি একজন নাগরিক হিসেবে মনে করি, ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ প্রশ্নে মতৈক্য হলেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের সংকটের সমাধান হবে না। নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, এর অনুষঙ্গ মাত্র। প্রতিটি নির্বাচিত সরকারের আমলে আমরা লক্ষ করেছি, বিরোধী দল দিনের পর দিন সংসদ বর্জন করে চলেছে। ১৯৯১ সালের পর অদ্যাবধি কোনো সংসদই কার্যকর হয়নি। সংসদ অকার্যকর রেখে গণতন্ত্র সম্পূর্ণ হতে পারে না।
১৯৯১ সাল থেকে অদ্যাবধি জাতীয় উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো রকম মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভাবাদর্শগত প্রশ্নের অনিবার্য বিভক্তি সত্ত্বেও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে দল ও জোটগুলোর মধ্যে যে মতৈক্যের প্রয়োজন ছিল, তা-ও হয়নি। অথচ সংসদে বেতন-ভাতা, বিনা শুল্কে দামি গাড়ি ক্রয় ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রশ্নে সব সাংসদ অনন্য জাতীয় মতৈক্য প্রদর্শন করেছেন। জাতীয় স্বার্থে বৈদেশিক নীতির প্রশ্নেও সরকার ও বিরোধী দলের মতৈক্য থাকার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও ভারতবিরোধিতা বিএনপি-জামায়াতের কাছে একটা মোক্ষম অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা পাকিস্তানি ধারা।
একজন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও এর অনুষঙ্গ আর্থসামাজিক সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য আমি নিম্নলিখিত প্যাকেজ প্রস্তাব সরকার, বিএনপি ও দেশের কল্যাণকামী সব মানুষের কাছে উত্থাপন করছি—
১. বর্তমান সংবিধানের আওতার মধ্যেই নির্বাচনকালীন সরকার এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। অনির্বাচিত সরকার অথবা তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রহণযোগ্য হবে না।
একটি যথার্থ শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা, ক্ষমতা ও এখতিয়ারের বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছার ঐকান্তিক চেষ্টা চালাতে হবে। মোদ্দা কথা, এমন একটা অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে জনগণ নির্ভয়ে তার পছন্দসই প্রার্থী বা দলকে ভোট দিতে পারবে। কোনো অপশক্তি ভোটের ফলাফল উল্টে দিতে পারবে না।
২. জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের মতো সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
৩. ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রতিটি দলকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।
৪. কোনো রাজনৈতিক দল সংসদ বর্জন করতে পারবে না। সংসদীয় রীতি অনুযায়ী ওয়াকআউট বা কোনো একটি ইস্যুতে সংসদ বয়কট চললেও একটানা সংসদ বর্জন নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের (সাত দিন বা ১০ দিন হতে পারে) অতিরিক্ত সংসদ বর্জন করলে সংশ্লিষ্ট দল, জোট বা সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। যেমন—সংসদ বর্জনকারী কোনো দল বা জোট বা ব্যক্তি সব ধরনের সংসদীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
৫. সুনির্দিষ্ট গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ, দুর্নীতি তথা সংবিধানবহির্ভূত কর্মকাণ্ড ছাড়া রাজনৈতিক নির্যাতন/ হয়রানি/ মত প্রকাশের স্বাধীনতা/ গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে।
৬. হরতাল ও অবরোধ নিষিদ্ধ থাকবে। অন্তত ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে হরতাল-অবরোধ নিষিদ্ধ থাকবে। তবে সংবিধান ও আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী শ্রমিক শ্রেণীর বৈধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার বা ধর্মঘটের অধিকার বহাল থাকবে।
রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ ও আইনসংগত সভা, সমাবেশ, মিছিল, পদযাত্রা, অনশন ইত্যাদির ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা চলবে না।
এর পরও যদি কোনো দল বা জোট হরতাল বা অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি নেয়, তাহলে এতে দেশের যে সম্পদ ধ্বংস হবে, জনগণের জানমালের যে ক্ষতি হবে, হরতাল ও অবরোধ আহ্বানকারী দল সেই ক্ষতি পূরণে আইনত বাধ্য থাকবে—এই মর্মে জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে সংসদে আইন পাস করতে হবে।
৭. যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ যেকোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাস, দুর্নীতির বিচার করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলবে না। বিচার বিভাগের কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া অথবা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা চলবে না।
দেশে সুশাসন ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
আমি মনে করি, উল্লিখিত বিষয়গুলোতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপের মধ্য দিয়ে মতৈক্য সৃষ্টি হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্থায়ী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমার প্রস্তাব হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এখনই উল্লিখিত বিষয়গুলোতে সংলাপে উৎসাহিত না হয় অথবা উদ্যোগ গ্রহণ না করে, তাহলে জনমত সৃষ্টি এবং জাতীয় মতৈক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দেশের নাগরিক সমাজের একটি ফোরাম গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে এ বিষয়গুলো আলোচনা করে একটা মতৈক্যের জায়গায় পৌঁছানো যায়।
রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষারোপ না করে দল-মতনির্বিশেষে আমাদের দেশের মূলধারার সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, সংবিধিবদ্ধ এনজিও (যারা বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত) ছাড়া অন্য সব সুশীল সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন ও শ্রমজীবী মানুষের সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সর্বদলীয় নাগরিক ফোরাম উল্লিখিত বিষয়গুলোতে প্রথমে নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করতে পারে। কিছুটা সময়সাপেক্ষ ও দুরূহ হলেও এই সর্বদলীয় নাগরিক ফোরাম যদি উল্লিখিত বিষয়ে মতৈক্যের ভিত্তিতে একটি ‘জাতীয় সনদ’ বা প্রস্তাব প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়, তখন তা দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পেশ করা যেতে পারে।
আমরা আশা করতে পারি, এ-জাতীয় মতৈক্যের প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলো সানন্দে গ্রহণ করবে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে সংকট উত্তরণে উল্লিখিত প্রস্তাব বাস্তবায়ন এবং সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কত দ্রুত এই নির্বাচন হবে, তা নির্ভর করবে উল্লিখিত প্যাকেজ প্রস্তাব গ্রহণ ও মতৈক্য প্রতিষ্ঠার ওপর।
সর্বোপরি একটি আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন স্বাধীন, সার্বভৌম সভ্য জাতি হিসেবে বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যেমন অন্য কোনো দেশের কাছে ধরনা দিতে পারে না, তেমনি যত শক্তিধরই হোক, আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপও আমরা বরদাশত করতে পারি না। আমাদের সব দলের সম্মিলিত কর্তব্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ এবং দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচিয়ে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন রূপায়ণ করা।
নূহ-উল-আলম লেনিন: সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
আপাতত দেশবাসী হানাহানি, সন্ত্রাস, রক্তপাত ও সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার হাত থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পেয়েছে। অর্থনীতি ও জনজীবনেও কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। আন্দোলনের নামে গত কয়েক মাস যে নারকীয় তাণ্ডব, নাশকতা ও গণহত্যা হয়েছে, দেশবাসী তার পুনরাবৃত্তি রোধে বদ্ধপরিকর। বিরোধী জোট যদি এর থেকে কিছু শিক্ষা নিয়ে থাকে, তাহলে তা তাদের জন্য যেমন, তেমনি দেশের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনবে।
দশম জাতীয় সংসদ একটা বাস্তবতা। আইন ও সংবিধানের দৃষ্টিতে এই সংসদ যেমন বৈধ, তেমনি এই সরকারও বৈধ। অতএব, এই সংসদকে এবং সরকারকে কাজ করতে দিতে হবে। তবে আইনগত ও সাংবিধানিকভাবে বৈধ হলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধান হয়ে গেছে, এমনটি বলা যায় না। এ জন্য সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা স্থায়ী সমাধানসূত্র উদ্ভাবিত ও বাস্তবায়িত না হলে দেশে স্থায়ী শান্তি, স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব হবে না।
বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেন বলেই একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন। ৫ জানুয়ারির আগেই তিনি প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন—ক. সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিবাদী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়তে হবে বিএনপিকে; খ. হত্যা, সন্ত্রাস, অবরোধ, হরতাল, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও হানাহানি বন্ধ করতে হবে। আর এ দুটি শর্ত পূরণ হলে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। অর্থবহ সংলাপের মধ্য দিয়ে যদি মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য হয়, তাহলে একাদশ জাতীয় সংসদ এগিয়ে আনা বা গ্রহণযোগ্য কোনো ফর্মুলার ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী দরজা খোলা রেখেছেন। এই দরজা দিয়ে সংকট উত্তরণের দায়িত্ব বিরোধী দলসহ সব পক্ষ গ্রহণ করবে কি না, সেটি দেখার বিষয়।
গত ২৯ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে মহামান্য রাষ্ট্রপতিও তাঁর ভাষণে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে অন্তত এটুকু স্পষ্ট হয়েছে, দেশে একটা রাজনৈতিক সংকট আছে, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে যার আশু সমাধান হওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতি নিজে সংলাপের তাগিদ দেওয়া ছাড়া সমাধানসূত্র চাপিয়ে দেননি। প্রধানমন্ত্রীও তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেননি। দেশের গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটি, ব্যবসায়ী মহল ও কল্যাণকামী রাজনৈতিক মহল বর্তমান সংকট উত্তরণের বিষয়ে তাদের আকাঙ্ক্ষা, তাগিদ ও নানামুখী চিন্তা-ভাবনাও প্রকাশ করছে। দুই দিন আগেও যাঁরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত রাখার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন, তাঁরাও অর্থবহ সংলাপের মাধ্যমে সংকট উত্তরণের কথা বলছেন।
দেশের একটি প্রধান দৈনিকসহ একাধিক সংবাদপত্র তাদের সম্পাদকীয়তে এবং ‘সুশীল সমাজের’ কোনো কোনো সংগঠন সংলাপের সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা ঠিক করার কথা বলেছেন। আমার দল আওয়ামী লীগের অবস্থানের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। আমি একজন নাগরিক হিসেবে মনে করি, ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ প্রশ্নে মতৈক্য হলেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের সংকটের সমাধান হবে না। নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, এর অনুষঙ্গ মাত্র। প্রতিটি নির্বাচিত সরকারের আমলে আমরা লক্ষ করেছি, বিরোধী দল দিনের পর দিন সংসদ বর্জন করে চলেছে। ১৯৯১ সালের পর অদ্যাবধি কোনো সংসদই কার্যকর হয়নি। সংসদ অকার্যকর রেখে গণতন্ত্র সম্পূর্ণ হতে পারে না।
১৯৯১ সাল থেকে অদ্যাবধি জাতীয় উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো রকম মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভাবাদর্শগত প্রশ্নের অনিবার্য বিভক্তি সত্ত্বেও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে দল ও জোটগুলোর মধ্যে যে মতৈক্যের প্রয়োজন ছিল, তা-ও হয়নি। অথচ সংসদে বেতন-ভাতা, বিনা শুল্কে দামি গাড়ি ক্রয় ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রশ্নে সব সাংসদ অনন্য জাতীয় মতৈক্য প্রদর্শন করেছেন। জাতীয় স্বার্থে বৈদেশিক নীতির প্রশ্নেও সরকার ও বিরোধী দলের মতৈক্য থাকার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও ভারতবিরোধিতা বিএনপি-জামায়াতের কাছে একটা মোক্ষম অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা পাকিস্তানি ধারা।
একজন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও এর অনুষঙ্গ আর্থসামাজিক সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য আমি নিম্নলিখিত প্যাকেজ প্রস্তাব সরকার, বিএনপি ও দেশের কল্যাণকামী সব মানুষের কাছে উত্থাপন করছি—
১. বর্তমান সংবিধানের আওতার মধ্যেই নির্বাচনকালীন সরকার এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। অনির্বাচিত সরকার অথবা তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রহণযোগ্য হবে না।
একটি যথার্থ শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা, ক্ষমতা ও এখতিয়ারের বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছার ঐকান্তিক চেষ্টা চালাতে হবে। মোদ্দা কথা, এমন একটা অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে জনগণ নির্ভয়ে তার পছন্দসই প্রার্থী বা দলকে ভোট দিতে পারবে। কোনো অপশক্তি ভোটের ফলাফল উল্টে দিতে পারবে না।
২. জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের মতো সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
৩. ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রতিটি দলকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।
৪. কোনো রাজনৈতিক দল সংসদ বর্জন করতে পারবে না। সংসদীয় রীতি অনুযায়ী ওয়াকআউট বা কোনো একটি ইস্যুতে সংসদ বয়কট চললেও একটানা সংসদ বর্জন নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের (সাত দিন বা ১০ দিন হতে পারে) অতিরিক্ত সংসদ বর্জন করলে সংশ্লিষ্ট দল, জোট বা সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। যেমন—সংসদ বর্জনকারী কোনো দল বা জোট বা ব্যক্তি সব ধরনের সংসদীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
৫. সুনির্দিষ্ট গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ, দুর্নীতি তথা সংবিধানবহির্ভূত কর্মকাণ্ড ছাড়া রাজনৈতিক নির্যাতন/ হয়রানি/ মত প্রকাশের স্বাধীনতা/ গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে।
৬. হরতাল ও অবরোধ নিষিদ্ধ থাকবে। অন্তত ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে হরতাল-অবরোধ নিষিদ্ধ থাকবে। তবে সংবিধান ও আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী শ্রমিক শ্রেণীর বৈধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার বা ধর্মঘটের অধিকার বহাল থাকবে।
রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ ও আইনসংগত সভা, সমাবেশ, মিছিল, পদযাত্রা, অনশন ইত্যাদির ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা চলবে না।
এর পরও যদি কোনো দল বা জোট হরতাল বা অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি নেয়, তাহলে এতে দেশের যে সম্পদ ধ্বংস হবে, জনগণের জানমালের যে ক্ষতি হবে, হরতাল ও অবরোধ আহ্বানকারী দল সেই ক্ষতি পূরণে আইনত বাধ্য থাকবে—এই মর্মে জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে সংসদে আইন পাস করতে হবে।
৭. যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ যেকোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাস, দুর্নীতির বিচার করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলবে না। বিচার বিভাগের কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া অথবা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা চলবে না।
দেশে সুশাসন ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
আমি মনে করি, উল্লিখিত বিষয়গুলোতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপের মধ্য দিয়ে মতৈক্য সৃষ্টি হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্থায়ী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমার প্রস্তাব হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এখনই উল্লিখিত বিষয়গুলোতে সংলাপে উৎসাহিত না হয় অথবা উদ্যোগ গ্রহণ না করে, তাহলে জনমত সৃষ্টি এবং জাতীয় মতৈক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দেশের নাগরিক সমাজের একটি ফোরাম গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে এ বিষয়গুলো আলোচনা করে একটা মতৈক্যের জায়গায় পৌঁছানো যায়।
রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষারোপ না করে দল-মতনির্বিশেষে আমাদের দেশের মূলধারার সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, সংবিধিবদ্ধ এনজিও (যারা বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত) ছাড়া অন্য সব সুশীল সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন ও শ্রমজীবী মানুষের সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সর্বদলীয় নাগরিক ফোরাম উল্লিখিত বিষয়গুলোতে প্রথমে নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করতে পারে। কিছুটা সময়সাপেক্ষ ও দুরূহ হলেও এই সর্বদলীয় নাগরিক ফোরাম যদি উল্লিখিত বিষয়ে মতৈক্যের ভিত্তিতে একটি ‘জাতীয় সনদ’ বা প্রস্তাব প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়, তখন তা দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পেশ করা যেতে পারে।
আমরা আশা করতে পারি, এ-জাতীয় মতৈক্যের প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলো সানন্দে গ্রহণ করবে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে সংকট উত্তরণে উল্লিখিত প্রস্তাব বাস্তবায়ন এবং সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কত দ্রুত এই নির্বাচন হবে, তা নির্ভর করবে উল্লিখিত প্যাকেজ প্রস্তাব গ্রহণ ও মতৈক্য প্রতিষ্ঠার ওপর।
সর্বোপরি একটি আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন স্বাধীন, সার্বভৌম সভ্য জাতি হিসেবে বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যেমন অন্য কোনো দেশের কাছে ধরনা দিতে পারে না, তেমনি যত শক্তিধরই হোক, আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপও আমরা বরদাশত করতে পারি না। আমাদের সব দলের সম্মিলিত কর্তব্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ এবং দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচিয়ে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন রূপায়ণ করা।
নূহ-উল-আলম লেনিন: সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
No comments