জাতীয় সংসদ- অনুগত বিরোধী দলের অবিচল আস্থা by আলী ইমাম মজুমদার
দশম সংসদের উদ্বোধনী দিনে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ সরকারের প্রতি অবিচল আস্থার কথা বলেছেন তাঁর সূচনা বক্তব্যে।
তাঁর নেতৃত্বে বিরোধী দল স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচনে কোনো প্রার্থী দেয়নি। ‘হ্যাঁ’ ধ্বনি তুলে সমর্থন জানায় সরকারি দল-প্রস্তাবিত প্রার্থীদের। তাঁরা নির্বাচিত হলে টেবিল চাপড়ে উল্লাসও করেন সরকারি দলের সঙ্গে। বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, কোনো দল না এলে তাদের জন্য নির্বাচন থেমে থাকতে পারে না। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার জন্য নির্বাচন প্রয়োজন ছিল। এটা সম্পন্ন করতে পারার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদও জানান। সরকারে তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আছেন তাঁর দল থেকে। আছেন মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। তাঁরা আসন নিয়েছেন ট্রেজারি বেঞ্চে নয়, বিরোধী দলের সারিতে। বিরোধী দলের নেতা এটাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মতোই ‘নিউ কনসেপ্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন। আরও বলেছেন, এভাবেই তিনি সরকারকে সহযোগিতা আর আবশ্যক হলে সমালোচনা— উভয়টাই করতে সক্ষম হবেন। সেটা কীভাবে কতটা পারেন, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে দেশবাসী। কৌতূহলী অনেকেই।
এটা অনেকটাই অচেনা আর ব্যতিক্রমী এক সংসদ। প্রথমত বলতে হয়, এ সংসদের অধিকাংশ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এটা অভূতপূর্ব। বাকি আসনগুলোয় খুব কম ক্ষেত্রেই কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। মনে হয়েছে যেন ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’ চলছে ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াকওভার। দেশের বৃহত্তর দুটো দলের একটির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সুতরাং, ভোট দেওয়ার উৎসাহ ছিল খুব কমসংখ্যক লোকেরই। তদুপরি, ব্যাপক সন্ত্রাস হয়েছে, বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে। হতাহত অনেক। ভোট গ্রহণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চার শতাধিক কেন্দ্রে। ভোটকেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত পাঁচ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয় আগের রাতে। ভোটকর্মী নিহত হয়েছেন একাধিক। সুতরাং, একে ব্যতিক্রমী একটি সংসদ বলা যেতেই পারে।
তারপর আসছে বিরোধী দলের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সরকারি দায়িত্ব গ্রহণ প্রসঙ্গে। রওশন এরশাদ সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিমালা অনুসারে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আবার আসন বিন্যাসে তাঁর পাশাপাশি বসছেন সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত এ দলের সদস্যরাও। কিন্তু তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতাও বটে। বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য অনুসারেই এটা ‘নিউ কনসেপ্ট’। তাই আমাদের অনেকের কাছেই অচেনা ঠেকছে। এমনকি সরকারি দলের কারও কারও কাছেও। সে দলের একজন প্রবীণ সাংসদের (যিনি গেল মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন) মতে, জাতীয় পার্টির এ আচরণ গাছেরটি খাওয়া আর তলারটি কুড়ানোর মতো। কাঁঠালের আমসত্ত্ব হয় না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। এ নিউ কনসেপ্টের ভবিষ্যৎ আমাদের অজানা। তবে আপাতত আমরা সংসদে সক্রিয় বিরোধী দলের অবস্থান থেকে বঞ্চিত হলাম।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৯১ সালের পর পালাক্রমে সরকার ও বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তাদের যখন যারা বিরোধী দলে ছিল, তারা সংসদীয় দায়িত্ব পালন করেনি বললেই চলে। অথচ বেতন-ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। উপভোগ করেছে মর্যাদা। সংসদ বর্জন একটি স্বাভাবিক সংস্কৃতি হয়ে পড়েছিল। বর্তমান বিরোধী দল হয়তো তা করবে না। কিন্তু তারা প্রকৃত বিরোধী দল কি না, সেটা নিয়েই সংশয় রয়েছে। তদুপরি যারা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সংসদের বাইরে রইল, তারা কিন্তু এ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশীদার নয়। অংশীদার নয় তাদের সমর্থক জনগোষ্ঠী। এ অবস্থায় একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আপাতত পরিস্থিতি শান্ত। একে স্থিতিশীল রাখতে হলে সংলাপের মাধ্যমে প্রধান দলগুলোকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশীদার হতে হবে। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর ‘ক্রসফায়ার’ সাময়িক সমাধান দিলেও স্থায়ী স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে না। তবে দলমত-নির্বিশেষে সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারি পদক্ষেপের আবশ্যকতা অস্বীকার করা যায় না। স্বার্থান্ধ ব্যক্তি ব্যতীত কেউ নৈরাজ্য সমর্থন করে না। তবে এর নামে বিরোধী দল দমনও সমর্থনযোগ্য নয়। এ কার্যক্রম পক্ষপাতহীন হলে ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়া যাবে।
সংসদের বর্তমান বিরোধী দল সব জাতীয় সমস্যাতেই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে বলে জানিয়েছে। এটাই হওয়ার কথা এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও তাই হয়। মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যোগাযোগ হয়। হয় না শুধু আমাদের এ দুর্ভাগা দেশে। বর্তমান বিরোধী দলের নেতার এ মনোভাব গুরুত্বের সঙ্গে গৃহীত হতো, যদি তিনি প্রকৃতই বিরোধী দলে অবস্থান নিতেন। এ ছাড়া তাঁর দলটি ব্যাপক জনসমর্থিতও নয়। ভাগাভাগির নির্বাচন না হয়ে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে এ দলের আসন সংখ্যা বর্তমানের ধারে-কাছেও আসবে না বলে অনেকে মনে করেন। তাই তাদের সহযোগিতার প্রস্তাবটি শিষ্টাচারের বিবেচনায় প্রশংসনীয় হলেও রাজনৈতিকভাবে তেমন মূল্য বহন করে না। এতে উৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণও লক্ষণীয় হয় না।
দলটি ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দ্বৈত নীতি নিয়ে চলছে। এমনকি ক্ষমতায় থাকাকালেও প্রধান দুটো দলকে বিপরীতমুখী রাখতে সদা সচেষ্ট ছিল। সেটা যখন সম্ভব হয়নি, তখনই ক্ষমতা হারায়। শুরুতে তাদের পতিত স্বৈরাচার বলত উভয় প্রধান দল। সে পতনের দিনটিও উদ্যাপন করত। দুমুখো নীতির জন্য দলটির এখন কিন্তু বেশ কদর। বড় শরিকেরা এখন ‘পতিত’ আর ‘স্বৈরাচার’ শব্দগুলো মুখেও তোলে না। অবশ্য গেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটি আরেক দফা ভেঙেছে। যেটুকু আছে, সেখানেও নেতৃত্বের মেরুকরণ লক্ষণীয়। শেষতক কোথায় দাঁড়ায়, এটাও দেখার বিষয়।
এ দেশ ১৯৮৮ আর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দেখেছে। দেখেছে এ বছরের জানুয়ারির নির্বাচন। প্রতিটি নির্বাচনের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত রয়েছে। তবে মাত্রার হেরফের হলেও কোনোটিই জনসমর্থিত এমন দাবি করা যাবে না। এখানে ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’-এর জন্য জাতীয় পার্টিকে নেওয়া হয়েছে। আর তারা যখন গেছেই, শুধু বিরোধী দলের নেতার পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার কথা নয়। মন্ত্রিত্ব আর বিশেষ দূতের পদও চেয়েছে। পেয়েছেও। তাই তাদের কোনো নেতা সরকারের সমালোচনা করলেও তা ‘ফ্রেন্ডলি’ হবে। তির্যক হবে না—এটা অন্তত বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে জোর দিয়ে বলা যায়।
সরকারের কাছে এ বিরোধী দলের নেতার কদর কিন্তু অনেক। নির্বাচন নিয়ে এরশাদ যখন একপর্যায়ে বিগড়ে যান বা তা করার ভান করেন, তখন হাল ধরেন এ নেতাই। এরশাদ ‘র্যাবের সহায়তায়’ সিএমএইচে ভর্তি হন। মাস খানেক তথায় থাকেন। মাঝেমধ্যে খেলেন গলফ। জনৈক মুখপাত্রের মাধ্যমে নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানাতে থাকেন। তখন রওশন এরশাদ নির্বাচনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, এরশাদের নির্দেশেই তা করা হচ্ছে। তাই সরকারি দল তাদের একজন প্রবীণ নেতার আসন ছেড়ে দেয় তাঁকে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসেন তিনি।
ওই প্রবীণ নেতাকেও টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী করে সব দিক সামাল দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলের নেতার পদ ছাড়াও মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তি আর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদে নিয়োগ দলটিকে ক্ষমতার অংশীদার করেছে। সুতরাং, সরকারের প্রতি তাঁর আস্থা অবিচল থাকারই কথা।
এরশাদ বর্তমান প্রধান দুটো দলের সঙ্গেই সময়ে সময়ে জোট করেছেন। কখনো তারা তাঁকে ঠকিয়েছে। কিংবা তিনি তাদের। কারাবাস করেছেন দুটো দলের সরকারের সময়েই। তাঁর দলের মধ্যেও এ দুই দলের প্রতি চিহ্নিত অনুরাগী কয়েকজন নেতা আছেন। হুমকি-ধমকি যা-ই দিক, একা তাঁরা এগোতে পারবেন না। এটা এরশাদ ও রওশন এরশাদ উভয়ই ভালোভাবে বোঝেন। বোঝেন দলের অন্যরাও। তাই যখন যেদিকে সুবিধা, সেদিকেই ঝুঁকে পড়েন। অতীতের অবজ্ঞা, অবহেলা আর কথা না রাখার বিষয়গুলোও উপেক্ষা করেন নিজেদের গরজেই। আর তা করতে গিয়ে চৈতন্য মহাপ্রভুর শিষ্য ও বন্ধু নিত্যানন্দ রচিত একটি গানের কলি হয়তো বা স্মরণে আনেন। সে গানের কলিটি হচ্ছে:
মেরেছিস কলসির কানা,
তাই বলে কি প্রেম দেব না?
চৈতন্য মহাপ্রভু আর তাঁর শিষ্য সেই প্রেম বিলিয়েছিলেন নিছক সদিচ্ছায়। আর আমাদের বর্তমান সংসদের বিরোধী দলের প্রেম কিন্তু অনেক চড়া মূল্যে কেনা।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
এটা অনেকটাই অচেনা আর ব্যতিক্রমী এক সংসদ। প্রথমত বলতে হয়, এ সংসদের অধিকাংশ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এটা অভূতপূর্ব। বাকি আসনগুলোয় খুব কম ক্ষেত্রেই কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। মনে হয়েছে যেন ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’ চলছে ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াকওভার। দেশের বৃহত্তর দুটো দলের একটির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সুতরাং, ভোট দেওয়ার উৎসাহ ছিল খুব কমসংখ্যক লোকেরই। তদুপরি, ব্যাপক সন্ত্রাস হয়েছে, বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে। হতাহত অনেক। ভোট গ্রহণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চার শতাধিক কেন্দ্রে। ভোটকেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত পাঁচ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয় আগের রাতে। ভোটকর্মী নিহত হয়েছেন একাধিক। সুতরাং, একে ব্যতিক্রমী একটি সংসদ বলা যেতেই পারে।
তারপর আসছে বিরোধী দলের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সরকারি দায়িত্ব গ্রহণ প্রসঙ্গে। রওশন এরশাদ সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিমালা অনুসারে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আবার আসন বিন্যাসে তাঁর পাশাপাশি বসছেন সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত এ দলের সদস্যরাও। কিন্তু তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতাও বটে। বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য অনুসারেই এটা ‘নিউ কনসেপ্ট’। তাই আমাদের অনেকের কাছেই অচেনা ঠেকছে। এমনকি সরকারি দলের কারও কারও কাছেও। সে দলের একজন প্রবীণ সাংসদের (যিনি গেল মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন) মতে, জাতীয় পার্টির এ আচরণ গাছেরটি খাওয়া আর তলারটি কুড়ানোর মতো। কাঁঠালের আমসত্ত্ব হয় না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। এ নিউ কনসেপ্টের ভবিষ্যৎ আমাদের অজানা। তবে আপাতত আমরা সংসদে সক্রিয় বিরোধী দলের অবস্থান থেকে বঞ্চিত হলাম।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৯১ সালের পর পালাক্রমে সরকার ও বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তাদের যখন যারা বিরোধী দলে ছিল, তারা সংসদীয় দায়িত্ব পালন করেনি বললেই চলে। অথচ বেতন-ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। উপভোগ করেছে মর্যাদা। সংসদ বর্জন একটি স্বাভাবিক সংস্কৃতি হয়ে পড়েছিল। বর্তমান বিরোধী দল হয়তো তা করবে না। কিন্তু তারা প্রকৃত বিরোধী দল কি না, সেটা নিয়েই সংশয় রয়েছে। তদুপরি যারা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সংসদের বাইরে রইল, তারা কিন্তু এ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশীদার নয়। অংশীদার নয় তাদের সমর্থক জনগোষ্ঠী। এ অবস্থায় একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আপাতত পরিস্থিতি শান্ত। একে স্থিতিশীল রাখতে হলে সংলাপের মাধ্যমে প্রধান দলগুলোকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশীদার হতে হবে। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর ‘ক্রসফায়ার’ সাময়িক সমাধান দিলেও স্থায়ী স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে না। তবে দলমত-নির্বিশেষে সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারি পদক্ষেপের আবশ্যকতা অস্বীকার করা যায় না। স্বার্থান্ধ ব্যক্তি ব্যতীত কেউ নৈরাজ্য সমর্থন করে না। তবে এর নামে বিরোধী দল দমনও সমর্থনযোগ্য নয়। এ কার্যক্রম পক্ষপাতহীন হলে ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়া যাবে।
সংসদের বর্তমান বিরোধী দল সব জাতীয় সমস্যাতেই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে বলে জানিয়েছে। এটাই হওয়ার কথা এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও তাই হয়। মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যোগাযোগ হয়। হয় না শুধু আমাদের এ দুর্ভাগা দেশে। বর্তমান বিরোধী দলের নেতার এ মনোভাব গুরুত্বের সঙ্গে গৃহীত হতো, যদি তিনি প্রকৃতই বিরোধী দলে অবস্থান নিতেন। এ ছাড়া তাঁর দলটি ব্যাপক জনসমর্থিতও নয়। ভাগাভাগির নির্বাচন না হয়ে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে এ দলের আসন সংখ্যা বর্তমানের ধারে-কাছেও আসবে না বলে অনেকে মনে করেন। তাই তাদের সহযোগিতার প্রস্তাবটি শিষ্টাচারের বিবেচনায় প্রশংসনীয় হলেও রাজনৈতিকভাবে তেমন মূল্য বহন করে না। এতে উৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণও লক্ষণীয় হয় না।
দলটি ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দ্বৈত নীতি নিয়ে চলছে। এমনকি ক্ষমতায় থাকাকালেও প্রধান দুটো দলকে বিপরীতমুখী রাখতে সদা সচেষ্ট ছিল। সেটা যখন সম্ভব হয়নি, তখনই ক্ষমতা হারায়। শুরুতে তাদের পতিত স্বৈরাচার বলত উভয় প্রধান দল। সে পতনের দিনটিও উদ্যাপন করত। দুমুখো নীতির জন্য দলটির এখন কিন্তু বেশ কদর। বড় শরিকেরা এখন ‘পতিত’ আর ‘স্বৈরাচার’ শব্দগুলো মুখেও তোলে না। অবশ্য গেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটি আরেক দফা ভেঙেছে। যেটুকু আছে, সেখানেও নেতৃত্বের মেরুকরণ লক্ষণীয়। শেষতক কোথায় দাঁড়ায়, এটাও দেখার বিষয়।
এ দেশ ১৯৮৮ আর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দেখেছে। দেখেছে এ বছরের জানুয়ারির নির্বাচন। প্রতিটি নির্বাচনের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত রয়েছে। তবে মাত্রার হেরফের হলেও কোনোটিই জনসমর্থিত এমন দাবি করা যাবে না। এখানে ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’-এর জন্য জাতীয় পার্টিকে নেওয়া হয়েছে। আর তারা যখন গেছেই, শুধু বিরোধী দলের নেতার পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার কথা নয়। মন্ত্রিত্ব আর বিশেষ দূতের পদও চেয়েছে। পেয়েছেও। তাই তাদের কোনো নেতা সরকারের সমালোচনা করলেও তা ‘ফ্রেন্ডলি’ হবে। তির্যক হবে না—এটা অন্তত বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে জোর দিয়ে বলা যায়।
সরকারের কাছে এ বিরোধী দলের নেতার কদর কিন্তু অনেক। নির্বাচন নিয়ে এরশাদ যখন একপর্যায়ে বিগড়ে যান বা তা করার ভান করেন, তখন হাল ধরেন এ নেতাই। এরশাদ ‘র্যাবের সহায়তায়’ সিএমএইচে ভর্তি হন। মাস খানেক তথায় থাকেন। মাঝেমধ্যে খেলেন গলফ। জনৈক মুখপাত্রের মাধ্যমে নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানাতে থাকেন। তখন রওশন এরশাদ নির্বাচনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, এরশাদের নির্দেশেই তা করা হচ্ছে। তাই সরকারি দল তাদের একজন প্রবীণ নেতার আসন ছেড়ে দেয় তাঁকে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসেন তিনি।
ওই প্রবীণ নেতাকেও টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী করে সব দিক সামাল দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলের নেতার পদ ছাড়াও মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তি আর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদে নিয়োগ দলটিকে ক্ষমতার অংশীদার করেছে। সুতরাং, সরকারের প্রতি তাঁর আস্থা অবিচল থাকারই কথা।
এরশাদ বর্তমান প্রধান দুটো দলের সঙ্গেই সময়ে সময়ে জোট করেছেন। কখনো তারা তাঁকে ঠকিয়েছে। কিংবা তিনি তাদের। কারাবাস করেছেন দুটো দলের সরকারের সময়েই। তাঁর দলের মধ্যেও এ দুই দলের প্রতি চিহ্নিত অনুরাগী কয়েকজন নেতা আছেন। হুমকি-ধমকি যা-ই দিক, একা তাঁরা এগোতে পারবেন না। এটা এরশাদ ও রওশন এরশাদ উভয়ই ভালোভাবে বোঝেন। বোঝেন দলের অন্যরাও। তাই যখন যেদিকে সুবিধা, সেদিকেই ঝুঁকে পড়েন। অতীতের অবজ্ঞা, অবহেলা আর কথা না রাখার বিষয়গুলোও উপেক্ষা করেন নিজেদের গরজেই। আর তা করতে গিয়ে চৈতন্য মহাপ্রভুর শিষ্য ও বন্ধু নিত্যানন্দ রচিত একটি গানের কলি হয়তো বা স্মরণে আনেন। সে গানের কলিটি হচ্ছে:
মেরেছিস কলসির কানা,
তাই বলে কি প্রেম দেব না?
চৈতন্য মহাপ্রভু আর তাঁর শিষ্য সেই প্রেম বিলিয়েছিলেন নিছক সদিচ্ছায়। আর আমাদের বর্তমান সংসদের বিরোধী দলের প্রেম কিন্তু অনেক চড়া মূল্যে কেনা।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments