কোথায় র‌্যাব, কোথায় পুলিশ, কোথায় সরকার?

১৯৭১ সালে যে স্বপ্ন ও অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তার অন্যতম ছিল গণতন্ত্র ও সুশাসন। কিন্তু স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও আমরা সেই গণতন্ত্র ও সুশাসনের দেখা পাইনি। গণতন্ত্র মানে আইনের শাসন, জনগণের শাসন। গণতন্ত্র মানে পাঁচ বছর পর পর এক দিনের ভোট নয়। গণতন্ত্র মানে স্বৈরাচারের বা রাজাকারের সঙ্গে হাত মেলানো নয়। গণতন্ত্র মানে জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য জনগণের শাসন। কিন্তু বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীরা মনে করেন, গণতন্ত্র হলো তাঁদের দ্বারা, তাঁদের জন্য জনগণের নামে শাসন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রে জনগণ বরাবরই অনুপস্থিত। ৩০০ সংসদীয় আসনের বেশির ভাগের জনপ্রতিনিধিই ‘বহিরাগত’। তাঁরা এলাকায় থাকেন না। শীতের পাখির মতো নির্বাচনের সময়, ঈদে অথবা অন্য কোনো পর্বে এলাকায় যান। আমরা প্রতিবার ৩০০ নতুন জমিদার তৈরি করি। ভারতে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা আছেন, যাঁদের দিল্লিতে নিজস্ব বাড়ি নেই। মন্ত্রিত্ব চলে গেলে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। আর আমাদের মন্ত্রী-সাংসদ তো বটেই, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানেরও ঢাকায় বাড়ি না থাকলে ইজ্জত থাকে না। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। কিন্তু নেতা একা দেশ স্বাধীন করেননি।
জনগণ তাঁর সঙ্গে ছিল, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিল বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। কতিপয় রাজাকার আলবদর ছাড়া সর্বস্তরের মানুষই সেই যুদ্ধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এখনকার নেতা-নেত্রীরা দেশ শাসনে জনগণের ভূমিকা চান না। একজন জামায়াত-শিবির নামের দানবের কাঁধে সওয়ার হয়েছেন, আরেকজন স্বৈরাচারের হাত ধরে গণতন্ত্র রক্ষা করতে চাইছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা অসম্ভব হতো, এ কথা যেমন ঠিক, তেমনি বেঠিক নয় যে আওয়ামী লীগই যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি বর্তমান ভোটের রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। শাহবাগে এবং সারা দেশের গণজাগরণ মঞ্চে হাজার হাজার তরুণ জমায়েত হয়েছে, যাদের অনেকে আওয়ামী লীগকে সমর্থন না করেও যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। নির্বাচনী রাজনীতি বড় জটিল ও কুটিল। প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে কেউ শয়তানের সঙ্গেও হাত মেলায়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার হলো সমগ্র জাতির দাবি। ৪২ বছরের দায়মোচন। সেই দায়মোচনে আওয়ামী লীগের সমর্থক মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে আওয়ামী লীগের বাইরের মানুষও। কিন্তু আওয়ামী লীগ বরাবরই ‘যারা আমার সঙ্গে নেই তারা জামায়াত-শিবির’—এই নীতিতে বিশ্বাস করে। ফলে ২০০৮ সালে বিপুল ভোটে বিজয়ী দলটি এখন পরাজয়ের শঙ্কায় ভীতসন্ত্রস্ত।
গণতন্ত্রে জনগণেরই নিয়ামক শক্তি হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দল ও নেতারা বরাবর তাদের দূরে রেখেছে। কাছে টেনেছে দলীয় মাস্তান, লাঠিয়াল, চাঁদাবাজ ও গডফাদারকে। পাঁচ বছর পর পর মানুষ যে ভোট দেওয়ার অধিকারটি আদায় করেছিল নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে, তা-ও আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এ জন্য কেবল সরকার নয়, বিরোধী দলও দায়ী। তারা মুখে যতই বলুক না কেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়—মনে মনে পোষণ করে, দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়। ১৯৭১ সালের এই ডিসেম্বর মাসেই আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম প্রবল পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের পরাজিত করে। সেই পরাজয় ছিল সত্যের কাছে মিথ্যার, ন্যায়ের কাছে অন্যায়ের। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রাজাকার আলবদরদের পরাজয়। কিন্তু আজ কি আমরা সমাজের সেই দানবীয় অপশক্তিকে পরাস্ত করতে প্রস্তুত আছি? যুদ্ধাপরাধীর বিচারের মাধ্যমে অতীতের অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়া গেলেও বর্তমানে যে অন্যায় চলছে, তার প্রতিকারের জন্য আরও কঠিন সত্য সাধনায় আমাদের নিয়োজিত হতে হবে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর যেখানে সারা দেশের মানুষ স্বস্তিবোধ করার কথা, যেখানে বিজয় মিছিল বের করার কথা, সেখানে তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
আর জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা দেশজুড়ে নাশকতা চালাচ্ছে। আগুন দিয়ে মানুষ পোড়াচ্ছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর তাদের নৈতিকভাবে পরাস্ত, অবনত ও অনুতপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু ভোটের রাজনীতি তাদের আরও উৎসাহিত করেছে।এই বিজয়ের মাসে সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কখন পেট্রলবোমা ছুড়ে হত্যা করা হয়, কখন আগুনে ঝলসে যায় পুরো দেহ। কখন গীতা সেনের মতো উচ্চারণ করতে হয় ‘আমরা অসুস্থ সরকার চাই না। সুস্থ সরকার চাই।’ এই বিজয়ের মাসে কী করে মৌলবাদের দলটি সারা দেশের মানুষকে জিম্মি করে ফেলল? কী করে জনজীবনের স্বস্তি কেড়ে নিল? কী করে তারা বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে? কী করে বিচারপতি ও মন্ত্রীদের বাড়িতে হামলা চালায়? তাহলে সরকার কী করছে? জামায়াতের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করার পরও এই শক্তি তারা কোথায় পায়? এই বিজয়ের মাসে আমরা কোনো অপশক্তির অট্টহাসি দেখতে চাই না, সেই অট্টহাসির সুযোগ যাঁরা করে দিয়েছেন, আমরা তাঁদের রাজনীতির চিরদিন বিরোধিতা করব। কিন্তু এর বিপরীতে সরকারকেও জনগণের নিরাপত্তায় এগিয়ে আসতে হবে। কেবল পুলিশ দিয়ে, র‌্যাব দিয়ে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা যায় না। এ জন্য চাই নৈতিক শক্তি। চাই সত্যের শক্তি। সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারে যে নৈতিক শক্তি অর্জন করেছিল, একতরফা নির্বাচনে তার অবসান হয়েছে।
সর্বদলীয় সরকার সর্বদলীয় হারিকিরিতে পরিণত হয়েছে। যে কারণে সাবেক স্বৈরাচার গণতন্ত্রের এবং সাবেক রাজাকার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের আওয়াজ তোলার সাহস পাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার যে বিশাল একটি আয়োজন, বিরাট কর্মযজ্ঞ, সেটি সরকার কখনোই মানতে চায়নি। তারা চেয়েছে, যেনতেন প্রকারে একটি বিচার শুরু করতে। তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ কিংবা কৌঁসুলি নিয়োগে তারা যথেষ্ট গাফিলতি করেছে, সে কথা উঠে এসেছে আদালতের রায়েই। এ ধরনের একটি বিচারে সব শ্রেণী-পেশার মুক্তবুদ্ধির মানুষকে একত্র করতে পারলে বিচারের রায় ঘোষণার পর জামায়াত-শিবির চক্র সারা দেশে যে প্রচণ্ড সহিংসতার প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তা পারত না। বিরোধী দল আন্দোলনের নামে যেসব নাশকতার ঘটনা ঘটাচ্ছে, তার নিন্দা করি, বিচার দাবি করছি। একই সঙ্গে সরকার প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে যে আচরণ করছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা সংবিধান রক্ষার নির্বাচন চাই না, কার্যকর নির্বাচন চাই। আমরা আন্দোলনের নামে নাশকতা চাই না, নাশকতা রোধের আন্দোলন চাই। মৌলবাদী শক্তির ওপর ভর করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া যায় না। কেননা মৌলবাদীশক্তি কখনোই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। একাত্তরে করেনি, ২০১৩ সালেও করবে না। এই ডিসেম্বর মাসেই নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষ মুখোমুখি নয়, মারমুখী। একে অন্যকে পারলে নিঃশেষ করে দেয়। এই নিঃশেষকরণ প্রক্রিয়ার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। আর গণতন্ত্র মানলে, ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান ও আদর্শের কথা ম্বর। আমাদের গর্বের ও আনন্দের মাস। একাত্তরে এই মাসে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম। এই মাসে সেই অপশক্তি বিজয়ের অট্টহাসি হাসছে।
এই মাসে সারা দেশে তারা ভয়াবহ তাণ্ডব চালাচ্ছে। এশুনতে হবে। গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না। বিজয়ের মাসে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকর হয়েছে। এটি যেমন ন্যায়ের বিজয়, তেমনি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার সূচনাও। বিজয়ের মাস ডিসেত দিন ঢাকার বাইরে তাদের নৃশংসতা দেখেছি। গতকাল ঢাকা শহরকেও তছনছ করে দিয়েছে। এটা কী করে সম্ভব হলো? কোথায় পুলিশ? কোথায় র‌্যাব? কোথায় সরকার? সরকারের দাবি, বিরোধী দলের আন্দোলনের সঙ্গে জনগণ নেই। তাহলে সরকারের সঙ্গে কি জনগণ আছে? থাকলে এভাবে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা সারা দেশে ও রাজধানীতে নাশকতা চালাতে পারত না। এই বিচারের প্রতি জনগণের সমর্থন আছে। সমর্থন আছে ফাঁসির রায়ের প্রতিও। তার পরও এ রকম নাশকতা ঘটানোর সুযোগ কীভাবে পেল দুর্বৃত্তরা? রাষ্ট্রের সরকারের, সমাজের কি কিছুই করার নেই? প্রতিবারই ঘটনার অনেক পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে আসে। তাদের দায়িত্ব নিশ্চয়ই পোড়া গাড়ির গন্ধ শোঁকা নয়। গাড়ি যাতে না পোড়ে, মানুষ যাতে না পোড়ে, সেই ব্যবস্থা নেওয়া। মানুষ তখনই বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, যখন দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের পাশে নেই। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা কি সরকারের নীতিনির্ধারক কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আঁচ করতে পারেনি? পারলে কেন তারা ব্যবস্থা নেয়নি? এ ব্যর্থতার দায় কে নেবে? এর আগে অতি-উৎসাহী দুই প্রতিমন্ত্রী ঘটা করে ফাঁসির দিনক্ষণ দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন। এখন তাঁদের তৎপরতা নেই কেন? কেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ঢাকা শহরে লাখো মানুষকে নিয়ে এই জামায়াত-শিবিরের সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি শান্তিমিছিলবের করতে পারল না?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.