ব্যুরো থেকে কমিশন : অর্জন নাকি বিসর্জন? by ইকতেদার আহমেদ
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ১৯৫৭-এর মাধ্যমে দুর্নীতি দমন ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। একজন মহাপরিচালক এবং একাধিক পরিচালক সমন্বয়ে ব্যুরো গঠিত হয়েছিল। ব্যুরোর মহাপরিচালক ও পরিচালকরা সরকারের বিভিন্ন বিভাগ প্রধানত, প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ থেকে প্রেষণে (ডেপুটেশন) নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা নং ১৯৭-এ উল্লেখ রয়েছে, বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটসহ কোনো সরকারি কর্মচারী যারা সরকারের অনুমোদন ব্যতিরেকে অপসারণযোগ্য নন তারা সরকারি দায়িত্ব পালন সংশ্লেষে কোনো অপরাধ করে থাকলে সরকারের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে কোনো আদালত তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারবে না। ফৌজদারি কার্যবিধির এ বিধানটি ব্যুরো কর্তৃক তদন্ত কার্য সমাপনান্তে অভিযোগপত্র বিচারার্থে গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করায় কোনো আদালত ব্যুরো কর্তৃক দাখিলকৃত অভিযোগপত্র সরকারের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারত না। ব্যুরো কর্তৃক তদন্তের ক্ষেত্রে অভিযোগপত্র দায়ের পরবর্তী সরকারের পূর্বানুমোদনের বিধান ব্যুরোর স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হতো এবং এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ব্যুরোর বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত কার্যকেও প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিত।
পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ প্রণীত হয় এবং পরবর্তীকালে এ আইনসহ দণ্ডবিধির অধীনে কৃত কতিপয় অপরাধ দুর্নীতি দমন আইন ১৯৫৭-এর অধীনে শাস্তিযোগ্য করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যুরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে না পারায় এবং কার্যকর ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন বাধা হিসেবে দেখা দেয়ায় দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রমকে সার্থকভাবে প্রতিরোধের লক্ষ্যে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা অনুভূত হতে থাকে। এরই ফলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর মাধ্যমে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ কমিশন তিনজন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত এবং কমিশনারদের মধ্য থেকে যে কোনো একজনকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
কমিশনারদের নিয়োগ বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য আইনে পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটির বিধান রাখা হয়েছে। এ পাঁচ সদস্য হলেন- (ক) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক, (খ) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, (গ) বাংলাদেশের মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, (ঘ) সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং (ঙ) অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবদের মধ্যে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব। প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের বিচারককে কমিটির সভাপতির দায়িত্ব প্রদানপূর্বক বলা হয়েছে, কমিটি সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে দু’জন ব্যক্তির নামের তালিকা প্রণয়ন করে নিয়োগ প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবে।
আইনে কমিশনারদের অপসারণ বিষয়ে বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের একজন বিচারক যেরূপ কারণ ও পদ্ধতিতে অপসারিত হতে পারেন, সেরূপ কারণ ও পদ্ধতি ব্যতীত কোনো কমিশনারকে অপসারণ করা যাবে না।
কমিশনারদের যোগ্যতা বিষয়ে যদিও আইনে বলা হয়েছে- আইনে, শিক্ষায়, প্রশাসনে, বিচারে বা শৃংখলা বাহিনীতে অন্যূন ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি কমিশনার হওয়ার জন্য যোগ্য হবেন, কিন্তু কমিশন প্রতিষ্ঠা অবধি এ যাবৎকাল পর্যন্ত যে চারজন কমিশনের চেয়ারম্যান ও ছয়জন কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের সবার ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার পর কমিশনে তাদের নিয়োগ ঘটেছে। চারজন চেয়ারম্যানের মধ্যে প্রথমোক্ত জন ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, দ্বিতীয় জন ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদধারী অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান, তৃতীয়জন ছিলেন সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব এবং চতুর্থজন যিনি বর্তমানে কর্মরত, তিনি সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব।
এটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, বর্তমানে আমাদের দেশের প্রতিটি শ্রেণী-পেশার মানুষ আওয়ামী ও বিএনপি এ দুটি ধারায় বিভক্ত। এ বিভক্তি থেকে প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, প্রতিরক্ষা বাহিনী কোনোটিই মুক্ত নয়। তাই দুদক প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেছে, যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল সে দলের মতাদর্শের প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাছাই কমিটির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দলীয় সরকারের আকাক্সক্ষার বাইরের কোনো ব্যক্তি কমিটির সুপারিশে স্থান লাভ করতে পারেন না। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় সুপারিশকৃত দু’জনের একজন কমিটির আকাক্সক্ষায় স্থান লাভ করেছেন, সেক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শানুযায়ী নিয়োগ কার্যটি সমাধা হওয়ায় দলীয় সরকারের অধীনে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষার বাইরে যাওয়ার সুযোগ সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।
কমিশনারদের অপসারণ পদ্ধতি উচ্চ আদালতের বিচারকদের অনুরূপ হওয়ায় তারা দলীয় সরকারের সময় দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ লাভ করলেও তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কিছু চাঞ্চল্যকর বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম যথা- শেয়ার কেলেংকারি, হলমার্ক কেলেংকারি, পদ্মা সেতু কেলেংকারি ও রেলের কালোবিড়াল কেলেংকারি অবলোকনে দেখা যায়, কমিশন যে কোনো কারণেই হোক সরকারের ভাবমূর্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে অপরাধী সাব্যস্তে তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে কমিশনকে অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনা বিষয়ে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে আগের দুর্নীতি দমন আইন ১৯৫৭-এর অতিরিক্ত এ আইনের অধীনে অপরাধ হিসেবে বর্ণিত সহায় সম্পত্তির ঘোষণায় অসঙ্গতি ও জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পত্তির দখলসহ দণ্ডবিধির ১০৯, ১২০বি ও ৫১১-এর অপরাধসমূহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উল্লেখ্য, আগের দুর্নীতি দমন আইনের মতো বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে দণ্ডবিধির ১৬১-১৬৯, ২১৭, ২১৮, ৪০৮, ৪০৯ ও ৪৭৭ক-এর অপরাধসমূহ শাস্তিযোগ্য। সে নিরিখে বলা যায়, বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭সহ দণ্ডবিধির যেসব ধারার অপরাধ শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে তাতে দেখা যায় এ আইনটি সরকারি কর্মকর্তাসহ সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কমিশনার, মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি কার্যকর ও সময়োপযোগী আইন। দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমকে স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রেও আইনটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, সরকারি কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল পরবর্তী মামলা বিচারার্থে গ্রহণের উদ্দেশ্যে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারায় উল্লিখিত বিধানের অবলুপ্তি। এ অবলুপ্তিতে যে শুধু কমিশনের অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্য পরিচালনা স্বাধীনভাবে সম্পন্ন করার জন্য সহায়ক হয়েছে তাই নয়, বরং মামলা বিচারার্থে গ্রহণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগে ১৯৭ ধারার বাধা অপসারিত হওয়ায় স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ উন্মোচিত হয়েছে। কমিশন প্রতিষ্ঠার পর মামলা বিচারার্থে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের বিধানের অবসান কমিশনের কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালনাসহ কমিশন কর্তৃক দায়েরকৃত মামলাসমূহের বিচারকার্য স্বাধীনভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অর্জন। এ অর্জনটিকে কমিশন যখন সার্বিক ও সফলভাবে কাজ করার জন্য সহায়ক বিবেচনায় এর কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও বেগবান করার লক্ষ্যে কমিশন আইনে কতিপয় সংশোধনী আনার জন্য দীর্ঘ তিন বছরের অধিককাল চেষ্টা চালিয়ে আসছিল, তখন আকস্মিকভাবে আদালত কর্তৃক মামলা বিচারার্থে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের বিধানের পুনঃপ্রবর্তনকে কমিশনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ আইনাঙ্গন ও দুর্নীতি নির্মূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত অর্জনকে বিসর্জন হিসেবে দেখছেন। সংশোধিত আইনে মিথ্যা মামলা বিষয়ে যে বিধান করা হয়েছে তাতে উল্লেখ রয়েছে, মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে দুদকের কর্মকর্তাদের অপরাধের তদন্ত পুলিশ পরিচালনা করবে।
দুদকের মামলাকে মিথ্যা গণ্যে পুলিশ কর্তৃক তদন্তের যে বিধান করা হয়েছে তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমাদের দেশের প্রভাবশালীরা যেভাবে ক্ষমতাসীন দলের আনুকূল্যে বস্তুনিষ্ঠ মামলা থেকে অব্যাহতি লাভ করেন সে দৃষ্টিকোণ থেকে দুদকের একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবশালীদের মামলার ক্ষেত্রে সব সময় স্বাধীনভাবে তদন্তকার্য পরিচালনায় শংকিত থাকবেন। বস্তুত এ বিধানের অন্তর্ভুক্তি দুদকের সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ কর্মকর্তাদের সুষ্ঠুভাবে তদন্ত পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দেবে।
এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সমতার যে বিধান রয়েছে তার সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বিচারার্থে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের আবশ্যকতা সাংঘর্ষিক এবং কমিশন আইনে সংবিধানের সঙ্গে এ ধরনের কোনো সাংঘর্ষিক বিধানের অন্তর্ভুক্তি কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত ও যথার্থ বলে বিবেচিত হতে পারে না। তাছাড়া সংবিধানে উচ্চ আদালত ও নিু আদালত উভয় আদালতের বিচারকদের বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, সংবিধান অনুযায়ী বিচারকরা বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন হয়ে থাকলে মামলা বিচারার্থে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন সে স্বাধীনতার অন্তরায় নয় কি?
আইনের দৃষ্টিতে সমতা শুধু আমাদের সংবিধানে নয়, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের দিক থেকেও সুদীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন দেশ ও সমাজে অনুসৃত হয়ে আসছে। তাই একটি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন ও কার্যকর করার জন্য মামলা বিচারার্থে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের যে বৈষম্যমূলক বিধানের অবসান ঘটিয়ে কমিশন প্রতিষ্ঠাকালে তাকে অর্জন হিসেবে দেখা হয়েছিল, কমিশনের দীর্ঘ ৯ বছরের অধিক পথ পরিক্রমার পর সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ সার্বিকভাবে দেশের জনমানুষের আকাক্সক্ষার বিপরীতে ওই বিধানের অন্তর্ভুক্তি বিসর্জন বৈ অন্য কিছু কি হতে পারে!
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
কমিশনারদের নিয়োগ বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য আইনে পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটির বিধান রাখা হয়েছে। এ পাঁচ সদস্য হলেন- (ক) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক, (খ) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, (গ) বাংলাদেশের মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, (ঘ) সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং (ঙ) অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবদের মধ্যে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব। প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের বিচারককে কমিটির সভাপতির দায়িত্ব প্রদানপূর্বক বলা হয়েছে, কমিটি সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে দু’জন ব্যক্তির নামের তালিকা প্রণয়ন করে নিয়োগ প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবে।
আইনে কমিশনারদের অপসারণ বিষয়ে বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের একজন বিচারক যেরূপ কারণ ও পদ্ধতিতে অপসারিত হতে পারেন, সেরূপ কারণ ও পদ্ধতি ব্যতীত কোনো কমিশনারকে অপসারণ করা যাবে না।
কমিশনারদের যোগ্যতা বিষয়ে যদিও আইনে বলা হয়েছে- আইনে, শিক্ষায়, প্রশাসনে, বিচারে বা শৃংখলা বাহিনীতে অন্যূন ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি কমিশনার হওয়ার জন্য যোগ্য হবেন, কিন্তু কমিশন প্রতিষ্ঠা অবধি এ যাবৎকাল পর্যন্ত যে চারজন কমিশনের চেয়ারম্যান ও ছয়জন কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের সবার ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার পর কমিশনে তাদের নিয়োগ ঘটেছে। চারজন চেয়ারম্যানের মধ্যে প্রথমোক্ত জন ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, দ্বিতীয় জন ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদধারী অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান, তৃতীয়জন ছিলেন সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব এবং চতুর্থজন যিনি বর্তমানে কর্মরত, তিনি সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব।
এটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, বর্তমানে আমাদের দেশের প্রতিটি শ্রেণী-পেশার মানুষ আওয়ামী ও বিএনপি এ দুটি ধারায় বিভক্ত। এ বিভক্তি থেকে প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, প্রতিরক্ষা বাহিনী কোনোটিই মুক্ত নয়। তাই দুদক প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেছে, যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল সে দলের মতাদর্শের প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাছাই কমিটির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দলীয় সরকারের আকাক্সক্ষার বাইরের কোনো ব্যক্তি কমিটির সুপারিশে স্থান লাভ করতে পারেন না। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় সুপারিশকৃত দু’জনের একজন কমিটির আকাক্সক্ষায় স্থান লাভ করেছেন, সেক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শানুযায়ী নিয়োগ কার্যটি সমাধা হওয়ায় দলীয় সরকারের অধীনে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষার বাইরে যাওয়ার সুযোগ সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।
কমিশনারদের অপসারণ পদ্ধতি উচ্চ আদালতের বিচারকদের অনুরূপ হওয়ায় তারা দলীয় সরকারের সময় দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ লাভ করলেও তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কিছু চাঞ্চল্যকর বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম যথা- শেয়ার কেলেংকারি, হলমার্ক কেলেংকারি, পদ্মা সেতু কেলেংকারি ও রেলের কালোবিড়াল কেলেংকারি অবলোকনে দেখা যায়, কমিশন যে কোনো কারণেই হোক সরকারের ভাবমূর্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে অপরাধী সাব্যস্তে তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে কমিশনকে অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনা বিষয়ে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে আগের দুর্নীতি দমন আইন ১৯৫৭-এর অতিরিক্ত এ আইনের অধীনে অপরাধ হিসেবে বর্ণিত সহায় সম্পত্তির ঘোষণায় অসঙ্গতি ও জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পত্তির দখলসহ দণ্ডবিধির ১০৯, ১২০বি ও ৫১১-এর অপরাধসমূহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উল্লেখ্য, আগের দুর্নীতি দমন আইনের মতো বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে দণ্ডবিধির ১৬১-১৬৯, ২১৭, ২১৮, ৪০৮, ৪০৯ ও ৪৭৭ক-এর অপরাধসমূহ শাস্তিযোগ্য। সে নিরিখে বলা যায়, বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭সহ দণ্ডবিধির যেসব ধারার অপরাধ শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে তাতে দেখা যায় এ আইনটি সরকারি কর্মকর্তাসহ সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কমিশনার, মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি কার্যকর ও সময়োপযোগী আইন। দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমকে স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রেও আইনটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, সরকারি কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল পরবর্তী মামলা বিচারার্থে গ্রহণের উদ্দেশ্যে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারায় উল্লিখিত বিধানের অবলুপ্তি। এ অবলুপ্তিতে যে শুধু কমিশনের অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্য পরিচালনা স্বাধীনভাবে সম্পন্ন করার জন্য সহায়ক হয়েছে তাই নয়, বরং মামলা বিচারার্থে গ্রহণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগে ১৯৭ ধারার বাধা অপসারিত হওয়ায় স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ উন্মোচিত হয়েছে। কমিশন প্রতিষ্ঠার পর মামলা বিচারার্থে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের বিধানের অবসান কমিশনের কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালনাসহ কমিশন কর্তৃক দায়েরকৃত মামলাসমূহের বিচারকার্য স্বাধীনভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অর্জন। এ অর্জনটিকে কমিশন যখন সার্বিক ও সফলভাবে কাজ করার জন্য সহায়ক বিবেচনায় এর কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও বেগবান করার লক্ষ্যে কমিশন আইনে কতিপয় সংশোধনী আনার জন্য দীর্ঘ তিন বছরের অধিককাল চেষ্টা চালিয়ে আসছিল, তখন আকস্মিকভাবে আদালত কর্তৃক মামলা বিচারার্থে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের বিধানের পুনঃপ্রবর্তনকে কমিশনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ আইনাঙ্গন ও দুর্নীতি নির্মূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত অর্জনকে বিসর্জন হিসেবে দেখছেন। সংশোধিত আইনে মিথ্যা মামলা বিষয়ে যে বিধান করা হয়েছে তাতে উল্লেখ রয়েছে, মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে দুদকের কর্মকর্তাদের অপরাধের তদন্ত পুলিশ পরিচালনা করবে।
দুদকের মামলাকে মিথ্যা গণ্যে পুলিশ কর্তৃক তদন্তের যে বিধান করা হয়েছে তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমাদের দেশের প্রভাবশালীরা যেভাবে ক্ষমতাসীন দলের আনুকূল্যে বস্তুনিষ্ঠ মামলা থেকে অব্যাহতি লাভ করেন সে দৃষ্টিকোণ থেকে দুদকের একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবশালীদের মামলার ক্ষেত্রে সব সময় স্বাধীনভাবে তদন্তকার্য পরিচালনায় শংকিত থাকবেন। বস্তুত এ বিধানের অন্তর্ভুক্তি দুদকের সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ কর্মকর্তাদের সুষ্ঠুভাবে তদন্ত পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দেবে।
এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সমতার যে বিধান রয়েছে তার সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বিচারার্থে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের আবশ্যকতা সাংঘর্ষিক এবং কমিশন আইনে সংবিধানের সঙ্গে এ ধরনের কোনো সাংঘর্ষিক বিধানের অন্তর্ভুক্তি কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত ও যথার্থ বলে বিবেচিত হতে পারে না। তাছাড়া সংবিধানে উচ্চ আদালত ও নিু আদালত উভয় আদালতের বিচারকদের বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, সংবিধান অনুযায়ী বিচারকরা বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন হয়ে থাকলে মামলা বিচারার্থে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন সে স্বাধীনতার অন্তরায় নয় কি?
আইনের দৃষ্টিতে সমতা শুধু আমাদের সংবিধানে নয়, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের দিক থেকেও সুদীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন দেশ ও সমাজে অনুসৃত হয়ে আসছে। তাই একটি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন ও কার্যকর করার জন্য মামলা বিচারার্থে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের যে বৈষম্যমূলক বিধানের অবসান ঘটিয়ে কমিশন প্রতিষ্ঠাকালে তাকে অর্জন হিসেবে দেখা হয়েছিল, কমিশনের দীর্ঘ ৯ বছরের অধিক পথ পরিক্রমার পর সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ সার্বিকভাবে দেশের জনমানুষের আকাক্সক্ষার বিপরীতে ওই বিধানের অন্তর্ভুক্তি বিসর্জন বৈ অন্য কিছু কি হতে পারে!
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
No comments