স্বাধীনতা অর্জনের মাস, বাঙালির চেতনারও বিজয়ের মাস by মাহমুদুল বাসার
বাঙালি
জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে বাঙালি
জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন বলে মাত্র নয়
মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক শক্তিকে পরাজিত করে
বিজয় অর্জন করেছিলাম আমরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল আধুনিক,
গণতান্ত্রিক, সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গিতে। এ কারণেই আমরা ভারত-রাশিয়াসহ
বিশ্ববিবেকের সমর্থন পেয়েছিলাম। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমাদের
মুক্তিযুদ্ধের মৌল কারণ, দর্শন ও প্রেক্ষাপট বিশ্ববিবেকের কাছে তুলে
ধরেছিলেন। বলেছিলেন, আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, আমরা নির্বাচনে
জয়ী হয়েছি, আমাদের ক্ষমতা পাওয়ার কথা, সেখানে আমাদের বুকে চালানো হয়েছে
গুলি। এখন আর আমাদের পিছু হটার উপায় নেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা ছাড়া। এ
কথা মনে রাখতে হবে যে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মুজিবনগর
সরকার গঠন করেছিলেন। তারাই নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। এ জন্য
মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তমের কথাটি অত্যন্ত মূল্যবান। ‘লক্ষ প্রাণের
বিনিময়ে’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ কোনো সামরিক
অভিযান নয়- স্বাধীনতার যুদ্ধ জনগণের যুদ্ধ। জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতীত কোনো
স্বাধীনতা সংগ্রাম হতে পারে না। মুক্তির সশস্ত্র চূড়ান্ত যুদ্ধে বিজয় অর্জন
সম্ভব হয় না।’
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের স্বাধীনতার ইশতেহার। বহুমুখী তাৎপর্যপূর্ণ। হটকারিতাকে পরিহার করার জন্য জিন্নাহর মতো ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা না করে তিনি কৌশলে শব্দচয়ন করে জনগণকে গেরিলা যুদ্ধের রূপরেখা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। চূড়ান্ত ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।’
একজন সিভিল সমাজের নেতা, একজন অসামরিক, অকম্যুনিস্ট জাতীয়তাবাদী, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবক্তা এর বাইরে কোনো কথা বলতে পারেন না।
জনাব জিয়াউর রহমানসহ আমাদের সেনা অফিসাররাও বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের কাছে সবুজ সংকেত’।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধাপগুলো ছিল গণতান্ত্রিক। বাঙালি জাতির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা, যেমন- শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, আবুল হাশিম- এরা প্রত্যেকে ছিলেন গণতান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিভূ। এরা আন্ডারগ্রাউন্ডের নেতা ছিলেন না, এরা কখনও গলা কাটা রাজনীতি কিংবা শ্রেণী-শত্র“ খতমের রাজনীতি করেননি। বঙ্গবন্ধু তার মুরুব্বিদের রাজনৈতিক ভূমিকা অনুকরণ করে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে অগ্রসর হয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে একক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করেন। এ জন্য মওলানা ভাসানী অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। এরও গুরুত্ব আছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিকে ইচ্ছে করলে সপ্তম শতাব্দীর শশাঙ্কের আমলেও নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের বিজয়ের ইতিহাসকে স্বচ্ছভাবে বোঝার জন্য ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করাই ভালো। বঙ্গবন্ধুও বলেছেন, তিনি ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকে একটু একটু করে দেশভিত্তিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন।
ভাষা আন্দোলন ছিল সর্বাংশে ধর্মনিরপেক্ষ- অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন। বাংলাভাষা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব বাঙালির ভাষা। বিদ্যাসাগর বলেছেন, আমরা বাংলাদেশে বসবাস করি, তাই আমরা বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমরা বাংলাভাষা বলি বলেই আমাদের বাঙালি বলা হয়। বাংলা ভাষা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ বলেই ভাষার ওপর আঘাতটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষতারও জন্ম দিয়েছিল। তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালি মুসলমানেরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিল। কবি অন্নদা শঙ্কর রায় বলেছেন, উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে যে রেনেসাঁর উদ্ভব ঘটেছিল, সেখানে মুসলমান ছিল না, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারির পর যে রেনেসাঁর উদ্ভব ঘটেছিল সেখানে বাঙালি মুসলমানের প্রাধান্য ছিল। এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯২৬ সালে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। তাই অনেকে মনে করেন, ১৯৭১-এর মুক্তি আন্দোলন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
১৯৫২ সালের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’ এবং ডি-এল-রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা’ গানটি গাওয়া হতে থাকে। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৭১ সালের বিজয় অর্জন পর্যন্ত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি’ গানটিও আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে।
১৯৫২ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালির লোকায়ত অসাম্প্রদায়িক চেতনা অপ্রতিরোধ্য গতিতে শক্তিশালী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাঙালিদের শিরায় শিরায় টগবগ করছিল অখণ্ড বাঙালিয়ানা। বাঙালি বীরেরা শ্রদ্ধাবান হয়ে উঠেছিলেন। হাজী শরিয়তুল্লাহ, দুদু মিঞা, তিতুমীর, সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা আমাদের কাছে অতি আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬৮ সালে চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন তার কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘সিরাজউদ্দৌলা’। সাংঘাতিক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ছবিটি। খান আতাকে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুই নাকি নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবি বানাইতেছস, আমার মতো কথা কওয়াইতেছস নবাবের মুখ দিয়া?’
(মাহবুব আজাদ- খান আতউর রহমান বাংলা একাডেমি পৃঃ ১৯৮)।
অসামান্য প্রেরণাদায়ক ব্যাপার। ১৯৭০ সালে নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’- অমর চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। সে ছবিতে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’, বিদ্রোহী কবির ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি’ গান ব্যবহার করা হয়েছিল। বাঙালির রক্তে আগুন ধরে গিয়েছিল। এ ছবিতেও দেখলাম বঙ্গবন্ধুর মতো আনোয়ার হোসেনও কারাগার থেকে বের হয়ে বাংলার জমিন থেকে একমুঠো মাটি নিয়ে কপালে ছুঁইয়ে শপথ নিলেন।
দুটো ছবিই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে শাণিত করেছিল।
একদা জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’ ১৯৭১ সালে জ্ঞানতাপস, বাঙালি মনীষীর ঘোষণা জয়যুক্ত হয়েছিল। একদা বিদ্রোহী কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে- বাঙালির বাঙলা- সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।’ একদা মনীষী এস ওয়াজেদ আলী বলেছিলেন, ‘সমগ্র ভারতে কেবল বাঙালিরাই পারে একটি রাষ্ট্র গঠন করতে; সেটা হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’ একদা রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, ‘আশা করব মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর এক দিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সব বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাওয়ার পথে।’ (সভ্যতার সংকট)।
১৯৭১ সালের বিজয়ের মাসে বাঙালি মনীষীদের চেতনারই বিজয় হয়েছিল।
মাহমুদুল বাসার : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, গবেষক
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের স্বাধীনতার ইশতেহার। বহুমুখী তাৎপর্যপূর্ণ। হটকারিতাকে পরিহার করার জন্য জিন্নাহর মতো ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা না করে তিনি কৌশলে শব্দচয়ন করে জনগণকে গেরিলা যুদ্ধের রূপরেখা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। চূড়ান্ত ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।’
একজন সিভিল সমাজের নেতা, একজন অসামরিক, অকম্যুনিস্ট জাতীয়তাবাদী, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবক্তা এর বাইরে কোনো কথা বলতে পারেন না।
জনাব জিয়াউর রহমানসহ আমাদের সেনা অফিসাররাও বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের কাছে সবুজ সংকেত’।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধাপগুলো ছিল গণতান্ত্রিক। বাঙালি জাতির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা, যেমন- শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, আবুল হাশিম- এরা প্রত্যেকে ছিলেন গণতান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিভূ। এরা আন্ডারগ্রাউন্ডের নেতা ছিলেন না, এরা কখনও গলা কাটা রাজনীতি কিংবা শ্রেণী-শত্র“ খতমের রাজনীতি করেননি। বঙ্গবন্ধু তার মুরুব্বিদের রাজনৈতিক ভূমিকা অনুকরণ করে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে অগ্রসর হয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে একক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করেন। এ জন্য মওলানা ভাসানী অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। এরও গুরুত্ব আছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিকে ইচ্ছে করলে সপ্তম শতাব্দীর শশাঙ্কের আমলেও নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের বিজয়ের ইতিহাসকে স্বচ্ছভাবে বোঝার জন্য ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করাই ভালো। বঙ্গবন্ধুও বলেছেন, তিনি ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকে একটু একটু করে দেশভিত্তিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন।
ভাষা আন্দোলন ছিল সর্বাংশে ধর্মনিরপেক্ষ- অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন। বাংলাভাষা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব বাঙালির ভাষা। বিদ্যাসাগর বলেছেন, আমরা বাংলাদেশে বসবাস করি, তাই আমরা বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমরা বাংলাভাষা বলি বলেই আমাদের বাঙালি বলা হয়। বাংলা ভাষা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ বলেই ভাষার ওপর আঘাতটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষতারও জন্ম দিয়েছিল। তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালি মুসলমানেরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিল। কবি অন্নদা শঙ্কর রায় বলেছেন, উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে যে রেনেসাঁর উদ্ভব ঘটেছিল, সেখানে মুসলমান ছিল না, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারির পর যে রেনেসাঁর উদ্ভব ঘটেছিল সেখানে বাঙালি মুসলমানের প্রাধান্য ছিল। এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯২৬ সালে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। তাই অনেকে মনে করেন, ১৯৭১-এর মুক্তি আন্দোলন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
১৯৫২ সালের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’ এবং ডি-এল-রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা’ গানটি গাওয়া হতে থাকে। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৭১ সালের বিজয় অর্জন পর্যন্ত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি’ গানটিও আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে।
১৯৫২ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালির লোকায়ত অসাম্প্রদায়িক চেতনা অপ্রতিরোধ্য গতিতে শক্তিশালী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাঙালিদের শিরায় শিরায় টগবগ করছিল অখণ্ড বাঙালিয়ানা। বাঙালি বীরেরা শ্রদ্ধাবান হয়ে উঠেছিলেন। হাজী শরিয়তুল্লাহ, দুদু মিঞা, তিতুমীর, সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা আমাদের কাছে অতি আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬৮ সালে চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন তার কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘সিরাজউদ্দৌলা’। সাংঘাতিক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ছবিটি। খান আতাকে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুই নাকি নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবি বানাইতেছস, আমার মতো কথা কওয়াইতেছস নবাবের মুখ দিয়া?’
(মাহবুব আজাদ- খান আতউর রহমান বাংলা একাডেমি পৃঃ ১৯৮)।
অসামান্য প্রেরণাদায়ক ব্যাপার। ১৯৭০ সালে নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’- অমর চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। সে ছবিতে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’, বিদ্রোহী কবির ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি’ গান ব্যবহার করা হয়েছিল। বাঙালির রক্তে আগুন ধরে গিয়েছিল। এ ছবিতেও দেখলাম বঙ্গবন্ধুর মতো আনোয়ার হোসেনও কারাগার থেকে বের হয়ে বাংলার জমিন থেকে একমুঠো মাটি নিয়ে কপালে ছুঁইয়ে শপথ নিলেন।
দুটো ছবিই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে শাণিত করেছিল।
একদা জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’ ১৯৭১ সালে জ্ঞানতাপস, বাঙালি মনীষীর ঘোষণা জয়যুক্ত হয়েছিল। একদা বিদ্রোহী কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে- বাঙালির বাঙলা- সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।’ একদা মনীষী এস ওয়াজেদ আলী বলেছিলেন, ‘সমগ্র ভারতে কেবল বাঙালিরাই পারে একটি রাষ্ট্র গঠন করতে; সেটা হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’ একদা রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, ‘আশা করব মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর এক দিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সব বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাওয়ার পথে।’ (সভ্যতার সংকট)।
১৯৭১ সালের বিজয়ের মাসে বাঙালি মনীষীদের চেতনারই বিজয় হয়েছিল।
মাহমুদুল বাসার : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, গবেষক
No comments