তিন উদ্দিনের পদধ্বনি! by অরবিন্দ রায়
২০০৭
সালের সূচনালগ্নে এদেশে নতুন এক ধরনের সরকার গঠিত হয়। সরকারটি ছিল- না
সামরিক, না সিভিল, না স্বৈর। আমলকী, হরীতকী ও বহেরা মিলিয়ে কবিরাজরা যেমন
ত্রিফলা নামের মহৌষধ বানায়, সে সময়ে সিভিল-সামরিক-স্বৈর এ তিন ‘স’-এর মিলনে
অদ্ভুত এক সরকার পয়দা হয়। যদিও সরকারটি তিন মাসের কথা বলে গদিনসীন হয়েছিল।
কিন্তু তাদের কাজ-কারবার দেখে জনগণ বুঝতে পেরেছিল, এ সরকার অক্ষয়
কোম্পানির টায়ারের জুতার মতো লাইফ লাস্টিং হতে চায়। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে
ওঠেনি। শুরুর দিকে সাধারণ মানুষের চাওয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে পারলেও পরবর্তী
সময়ে পাওয়ার সঙ্গে মিল রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারটি দু’বছরের মাথায় ক্ষমতার
সরাব থেকে চুমুক সরাতে বাধ্য হয়। জনগণের চাওয়া ও পাওয়া এ দুইয়ের ব্যাট-বলে
সংযোগ ঘটাতে না পারলে কোনো সরকার যত জনপ্রিয় হয়েই আসুক, তার জনপ্রিয়তা যে
বালুর বাঁধের মতো ধসে পড়বে- সে সময়ের তিন উদ্দিন সরকারই তার প্রমাণ।
কেউ চলে গেলে কিছু না কিছু চিহ্ন রেখে যায়। এমনকি ফকিরের ডাকে সাড়া দেয়া ভূত চলে যাওয়ার সময়ও নাকি গাছের ডাল ভেঙে দিয়ে যায়। তথাকথিত তিন উদ্দিন সরকারও চলে যাওয়ার সময় মনের গভীরে ক্ষত রেখে গেছে। সে ক্ষতটি হচ্ছে ভয়। এ ভয় অনির্বাচিত ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার। পুনরায় আসা সরকারটিও যে তিন উদ্দিনের মতো লাইফ লাস্টিংয়ের খায়েশ পোষণকারী হবে না, এ নিশ্চয়তা কে দেবে! কারণ দিন যতই গড়াচ্ছে, মানুষের মনে অনৈতিক বাসনার মাত্রা ততই বাড়ছে। তাই ২০০৭ সালের অনির্বাচিত সরকারটি দু’বছর লাস্টিং করলেও এবারের সরকার এক যুগের মনমানসিকতা নিয়ে এসে পাঁচ বছর লাস্টিং করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। আবার বিদায়ের আগে মাল্টি ফ্যাসাদ বাধিয়ে দিয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। প্রবাদ আছে, বর্জ্য সব সময়েই বর্জ্যরে জন্ম দেয়। কাজেই সেই অনির্বাচিত সরকারটি চলে যাওয়ার সময় নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা তুলে না দিয়ে যদি কোনো ষণ্ডা-গুণ্ডার হাতে দিয়ে যায়, তাহলে আশংকার ষোলকলা পূর্ণ হওয়ার আর বাকি থাকবে না।
কথায় বলে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে আগুন দেখে চমকায়। মূলত সেই ঘর পুড়ে যাওয়ার স্মৃতিকে ভুলতে না পারার কারণে হয়তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার বিলোপ ঘটানো হয়েছে। এ বিলোপ কাজটি পাকাপোক্ত করার জন্য সংবিধানেও সংশোধনী আনা হয়। সংবিধানকে ডিঙিয়ে এক কথায় উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো কেউই যেন ক্ষমতার সরাবে এসে আমরণ চুমুক বসানোর দিবাস্বপ্নে বিভোর হতে না পারে, তা ঠেকানোই এ সরকার প্রথা বিলোপের অন্যতম কারণ বলে দাবি করা হয়। কিন্তু বিরোধী দল সরকারের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকেই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তাদের তরিকাবাহী কতিপয় সুশীল ব্যক্তিরও ধারণা, সরকার তার জনপ্রিয়তা হ্রাসের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে অর্থাৎ আসন্ন নির্বাচনে পরাজয়ের ভয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে। কেননা সরকার ক্ষমতাসীন অবস্থায় যদি নির্বাচন পরিচালনা করে, তাহলে সে নির্বাচন কখনোই নিরপেক্ষ হবে না। অর্থাৎ নির্বাচনে প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটিয়েছেন।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে সম্পন্ন হওয়া সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বিরোধী দলের এ ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেছে। দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এ পরীক্ষায় ক্ষমতাসীনরা জিপিএ-৫ পেয়ে সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে। তারপরও বিরোধী দল সরকারের এ স্বচ্ছতায় আস্থা রাখতে পারছে না। তাদের ধারণা, ওস্তাদের শেষ রাতের মারটা সরকার নিজ হাতেই রেখেছে। সেই শেষ রাতের মারটা হচ্ছে দশম সংসদ নির্বাচন। প্রশ্ন জাগতে পারে, সরকারের নিরপেক্ষ থাকার মনমানসিকতা যদি না থাকত, তাহলে মান রক্ষার জন্য হলেও একটি সিটি কর্পোরেশনকে নিজেদের করে রাখতে পারত। সেটি তারা করেনি। সুবোধ যোদ্ধার মতো পরাজয় মেনে নিয়েছে। তারপরও কেন এই সন্দেহ? অনেকের ধারণা, পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকার বিষয়টি সরকারের একটা কৌশল মাত্র। সরকারের নিরপেক্ষতায় সন্দিহান হয়ে কেউ যেন তত্ত্বাবধায়কের দাবিকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে না পারে তারই কূটকৌশল হিসেবে সরকার এ পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শতভাগ নিরপেক্ষ থেকেছে। শেয়ালের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কুমির যেমন মরার অভিনয় করে নদীর ধারে শুয়েছিল। শেয়াল কুমিরকে মৃত ভেবে তাকে খাওয়ার জন্য এগিয়ে আসা মাত্রই খপ করে ধরে ফেলবে। সিটির নির্বাচনগুলোতে সরকারের নিরপেক্ষ থাকার বিষয়টিও কুমিরের মরার অভিনয়ে শুয়ে থাকার মতো। সংসদ নির্বাচন এলেই এ সরকার নিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়ে খপ করে ক্ষমতাকে গিলে ফেলবে। কিন্তু কুমিরের এ কূটচাল যে সফলতার মুখ দেখেনি, গল্পকারই তার দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তারপরও কেন এই ভয়। এখানে আরও একটি অপ্রিয় সত্য উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হচ্ছে, সম্পন্ন হওয়া পাঁচটি সিটি নির্বাচনে সরকার নিরপেক্ষ থেকেছে নাকি চাতুরী করার সুযোগ পায়নি এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো মন্তব্য করেনি। এমন তো হতে পারে, সরকার পক্ষপাতিত্বের চেষ্টা করেও জনরায়ের স্রোতে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সরকার সমর্থিত টিভি চ্যানেল যেখানে গুটিকয়েক কেন্দ্রের ফলাফল ফিসফাস করে প্রকাশ করছিল, তখন বিরোধী দল সমর্থিত চ্যানেল তার ১০-১২ গুণ কেন্দ্রের ফলাফল প্রকাশ করে তার সমর্থিত প্রার্থীকে ধরাছোঁয়ার বাইরে উন্নীত করতে পেরেছিল। ক্ষমতার জাল রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা অবস্থাতেও যখন জনরায় উপেক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়নি, তখন সর্বদলীয় অর্থাৎ উভয় দলের পাঁচজন করে এবং একজনকে (তিনি যেই হোন) প্রধান বানিয়ে নির্বাচন করলে জনরায় উল্টে যাবে এ আশংকা মনে হয় না ততটা সঠিক।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত, সরকার তত্ত্বাবধায়কের বদলে যে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি তাদের জন্য একটি মরণঘাতী প্রস্তাব। পাঁচ সিটির নির্বাচনী ফলাফলই বলে দেয় এটি কতটা মরণঘাতী। প্রেক্ষাপটের চুলচেরা বিশ্লেষণে তত্ত্বাবধায়ক ও সর্বদলীয় সরকার পদ্ধতিকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে তুলনা করা হলে তত্ত্বাবধায়ককে বলা হবে ডালডা আর সর্বদলীয়কে বলা যেতে পারে চলনসই ঘি। সরকার আবেগের বশে বিরোধী দলের হাতে ডালডার বদলে ঘিয়ের পাত্রটি তুলে দিতে চেয়েছে। সেই সর্বদলীয় সরকারপ্রধান যদি শেখ হাসিনা হন, তাহলে সেই ঘি যে ঘোষপাড়ার খাঁটি গাওয়া ঘি তাতে কোনো সন্দেহ থাকবে না। কেননা সর্বদলের পাঁচকে প্লাস মাইনাসে শূন্য ধরা হলে অবাধ মিডিয়ার যুগে একজন মহিলার পক্ষে গোটা দেশের নির্বাচনী ফলাফল উল্টে দেয়া কতটা সম্ভব, তা বোঝার জন্য চিন্তাশক্তিকে বেশি গভীরে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তারপরও বিরোধী দল সরকার ঘোষিত এ প্রস্তাবকে গ্রহণ না করে অসময়ের আন্দোলনে নেমে নিরীহ মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ালে পাঁচ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী ফলাফলকে অপমান করা হবে।
পরিশেষে আবারও সেই তিন উদ্দিন প্রসঙ্গে আসা যাক। বর্তমান প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালে অনির্বাচিত সরকার তিন মাসের কথা বলে দু’বছর পার করেছিল, সেই একই আবহ কিন্তু ২০১৩ সালে তৈরি হতে চলেছে। সরকার চাইছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পদ্ধতি। বিরোধী দল বলছে, সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। একটি বিষয় ভাবা উচিত- সরকার তত্ত্বাবধায়কের প্রশ্নে রাজি হলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে, তা নয়। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু শেষ হতে না হতেই সিইসিসহ আরও অনেক ইস্যু দেখা দেবে। এরকম ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেই কিন্তু আবির্ভাব ঘটতে পারে তিন উদ্দিন কিসিমের লাইফ লাস্টিং মানসিকতা সম্পন্ন সরকারের। তাকে শেষটায় ক্রেন লাগিয়েও গদি থেকে তোলা যাবে কি-না সন্দেহ।
অরবিন্দ রায় : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালক
কেউ চলে গেলে কিছু না কিছু চিহ্ন রেখে যায়। এমনকি ফকিরের ডাকে সাড়া দেয়া ভূত চলে যাওয়ার সময়ও নাকি গাছের ডাল ভেঙে দিয়ে যায়। তথাকথিত তিন উদ্দিন সরকারও চলে যাওয়ার সময় মনের গভীরে ক্ষত রেখে গেছে। সে ক্ষতটি হচ্ছে ভয়। এ ভয় অনির্বাচিত ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার। পুনরায় আসা সরকারটিও যে তিন উদ্দিনের মতো লাইফ লাস্টিংয়ের খায়েশ পোষণকারী হবে না, এ নিশ্চয়তা কে দেবে! কারণ দিন যতই গড়াচ্ছে, মানুষের মনে অনৈতিক বাসনার মাত্রা ততই বাড়ছে। তাই ২০০৭ সালের অনির্বাচিত সরকারটি দু’বছর লাস্টিং করলেও এবারের সরকার এক যুগের মনমানসিকতা নিয়ে এসে পাঁচ বছর লাস্টিং করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। আবার বিদায়ের আগে মাল্টি ফ্যাসাদ বাধিয়ে দিয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। প্রবাদ আছে, বর্জ্য সব সময়েই বর্জ্যরে জন্ম দেয়। কাজেই সেই অনির্বাচিত সরকারটি চলে যাওয়ার সময় নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা তুলে না দিয়ে যদি কোনো ষণ্ডা-গুণ্ডার হাতে দিয়ে যায়, তাহলে আশংকার ষোলকলা পূর্ণ হওয়ার আর বাকি থাকবে না।
কথায় বলে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে আগুন দেখে চমকায়। মূলত সেই ঘর পুড়ে যাওয়ার স্মৃতিকে ভুলতে না পারার কারণে হয়তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার বিলোপ ঘটানো হয়েছে। এ বিলোপ কাজটি পাকাপোক্ত করার জন্য সংবিধানেও সংশোধনী আনা হয়। সংবিধানকে ডিঙিয়ে এক কথায় উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো কেউই যেন ক্ষমতার সরাবে এসে আমরণ চুমুক বসানোর দিবাস্বপ্নে বিভোর হতে না পারে, তা ঠেকানোই এ সরকার প্রথা বিলোপের অন্যতম কারণ বলে দাবি করা হয়। কিন্তু বিরোধী দল সরকারের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকেই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তাদের তরিকাবাহী কতিপয় সুশীল ব্যক্তিরও ধারণা, সরকার তার জনপ্রিয়তা হ্রাসের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে অর্থাৎ আসন্ন নির্বাচনে পরাজয়ের ভয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে। কেননা সরকার ক্ষমতাসীন অবস্থায় যদি নির্বাচন পরিচালনা করে, তাহলে সে নির্বাচন কখনোই নিরপেক্ষ হবে না। অর্থাৎ নির্বাচনে প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটিয়েছেন।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে সম্পন্ন হওয়া সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বিরোধী দলের এ ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেছে। দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এ পরীক্ষায় ক্ষমতাসীনরা জিপিএ-৫ পেয়ে সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে। তারপরও বিরোধী দল সরকারের এ স্বচ্ছতায় আস্থা রাখতে পারছে না। তাদের ধারণা, ওস্তাদের শেষ রাতের মারটা সরকার নিজ হাতেই রেখেছে। সেই শেষ রাতের মারটা হচ্ছে দশম সংসদ নির্বাচন। প্রশ্ন জাগতে পারে, সরকারের নিরপেক্ষ থাকার মনমানসিকতা যদি না থাকত, তাহলে মান রক্ষার জন্য হলেও একটি সিটি কর্পোরেশনকে নিজেদের করে রাখতে পারত। সেটি তারা করেনি। সুবোধ যোদ্ধার মতো পরাজয় মেনে নিয়েছে। তারপরও কেন এই সন্দেহ? অনেকের ধারণা, পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকার বিষয়টি সরকারের একটা কৌশল মাত্র। সরকারের নিরপেক্ষতায় সন্দিহান হয়ে কেউ যেন তত্ত্বাবধায়কের দাবিকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে না পারে তারই কূটকৌশল হিসেবে সরকার এ পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শতভাগ নিরপেক্ষ থেকেছে। শেয়ালের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কুমির যেমন মরার অভিনয় করে নদীর ধারে শুয়েছিল। শেয়াল কুমিরকে মৃত ভেবে তাকে খাওয়ার জন্য এগিয়ে আসা মাত্রই খপ করে ধরে ফেলবে। সিটির নির্বাচনগুলোতে সরকারের নিরপেক্ষ থাকার বিষয়টিও কুমিরের মরার অভিনয়ে শুয়ে থাকার মতো। সংসদ নির্বাচন এলেই এ সরকার নিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়ে খপ করে ক্ষমতাকে গিলে ফেলবে। কিন্তু কুমিরের এ কূটচাল যে সফলতার মুখ দেখেনি, গল্পকারই তার দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তারপরও কেন এই ভয়। এখানে আরও একটি অপ্রিয় সত্য উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হচ্ছে, সম্পন্ন হওয়া পাঁচটি সিটি নির্বাচনে সরকার নিরপেক্ষ থেকেছে নাকি চাতুরী করার সুযোগ পায়নি এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো মন্তব্য করেনি। এমন তো হতে পারে, সরকার পক্ষপাতিত্বের চেষ্টা করেও জনরায়ের স্রোতে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সরকার সমর্থিত টিভি চ্যানেল যেখানে গুটিকয়েক কেন্দ্রের ফলাফল ফিসফাস করে প্রকাশ করছিল, তখন বিরোধী দল সমর্থিত চ্যানেল তার ১০-১২ গুণ কেন্দ্রের ফলাফল প্রকাশ করে তার সমর্থিত প্রার্থীকে ধরাছোঁয়ার বাইরে উন্নীত করতে পেরেছিল। ক্ষমতার জাল রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা অবস্থাতেও যখন জনরায় উপেক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়নি, তখন সর্বদলীয় অর্থাৎ উভয় দলের পাঁচজন করে এবং একজনকে (তিনি যেই হোন) প্রধান বানিয়ে নির্বাচন করলে জনরায় উল্টে যাবে এ আশংকা মনে হয় না ততটা সঠিক।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত, সরকার তত্ত্বাবধায়কের বদলে যে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি তাদের জন্য একটি মরণঘাতী প্রস্তাব। পাঁচ সিটির নির্বাচনী ফলাফলই বলে দেয় এটি কতটা মরণঘাতী। প্রেক্ষাপটের চুলচেরা বিশ্লেষণে তত্ত্বাবধায়ক ও সর্বদলীয় সরকার পদ্ধতিকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে তুলনা করা হলে তত্ত্বাবধায়ককে বলা হবে ডালডা আর সর্বদলীয়কে বলা যেতে পারে চলনসই ঘি। সরকার আবেগের বশে বিরোধী দলের হাতে ডালডার বদলে ঘিয়ের পাত্রটি তুলে দিতে চেয়েছে। সেই সর্বদলীয় সরকারপ্রধান যদি শেখ হাসিনা হন, তাহলে সেই ঘি যে ঘোষপাড়ার খাঁটি গাওয়া ঘি তাতে কোনো সন্দেহ থাকবে না। কেননা সর্বদলের পাঁচকে প্লাস মাইনাসে শূন্য ধরা হলে অবাধ মিডিয়ার যুগে একজন মহিলার পক্ষে গোটা দেশের নির্বাচনী ফলাফল উল্টে দেয়া কতটা সম্ভব, তা বোঝার জন্য চিন্তাশক্তিকে বেশি গভীরে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তারপরও বিরোধী দল সরকার ঘোষিত এ প্রস্তাবকে গ্রহণ না করে অসময়ের আন্দোলনে নেমে নিরীহ মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ালে পাঁচ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী ফলাফলকে অপমান করা হবে।
পরিশেষে আবারও সেই তিন উদ্দিন প্রসঙ্গে আসা যাক। বর্তমান প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালে অনির্বাচিত সরকার তিন মাসের কথা বলে দু’বছর পার করেছিল, সেই একই আবহ কিন্তু ২০১৩ সালে তৈরি হতে চলেছে। সরকার চাইছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পদ্ধতি। বিরোধী দল বলছে, সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। একটি বিষয় ভাবা উচিত- সরকার তত্ত্বাবধায়কের প্রশ্নে রাজি হলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে, তা নয়। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু শেষ হতে না হতেই সিইসিসহ আরও অনেক ইস্যু দেখা দেবে। এরকম ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেই কিন্তু আবির্ভাব ঘটতে পারে তিন উদ্দিন কিসিমের লাইফ লাস্টিং মানসিকতা সম্পন্ন সরকারের। তাকে শেষটায় ক্রেন লাগিয়েও গদি থেকে তোলা যাবে কি-না সন্দেহ।
অরবিন্দ রায় : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালক
No comments