রাজনীতির দাসত্বে বাংলাদেশের মানুষ by একেএম শাহনাওয়াজ
প্রাচীন
বিশ্বে দাসত্ব প্রথা একটি বড় সামাজিক ক্ষত ছিল। এলেক্স হ্যালির ‘রুটস’
আধুনিক বিশ্বের সামনে সে ক্ষতের কথা স্পষ্ট করেছে। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস
বলছে স্পার্টাকাসের দাস বিদ্রোহ দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে ছিল প্রথম সরব
প্রতিবাদ। দাস শ্রমের ওপর দাঁড়িয়েছিল রোমের অর্থনীতি। তাই দাসত্ব প্রথার
ভাঙনে প্রাচীন রোমের পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। জার্মান বার্বারদের আক্রমণ
ছিল শেষ উপলক্ষ মাত্র। মধ্যযুগের সামন্ত সমাজে ইউরোপের ছোট ছোট রাজ্যগুলোর
সামর্থ্য ছিল না দাস প্রতিপালন করা। ফলে ক্রীতদাস প্রথা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই
অকার্যকর হয়ে যায়। তাই বলে দাসত্বের অবসান ঘটল না। সামন্ত সমাজে ভূমিদাসদের
অবস্থান স্পষ্ট হল। অন্যদিকে আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে ক্রীতদাস প্রথা চলতে
থাকল আধুনিক যুগের প্রাক্কাল পর্যন্ত। পনের শতকের শেষ দিকে বাংলার সুলতান
বারবক শাহ আবিসিনিয়া থেকে একদল দাস কিনে আনেন। সামরিক বাহিনীতে যুক্ত করা
হয় এদের। সুলতানদের দুর্বলতার সুযোগে ষোল শতকের প্রথমদিকে এই আফ্রিকান
দাসদের অভ্যুত্থান ঘটে। ফলে কয়েক বছর বাংলা দাস বা হাবশি শাসনের অধীনে চলে
আসে। এরও কয়েকশ’ বছর আগে (চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি) সোনারগাঁয়ে গৃহকর্মী
হিসেবে দাস-দাসী বেচাকেনা হতো বলে ইবনে বতুতা বর্ণনা করেছেন। সুতরাং বোঝা
যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ দাসত্ব ব্যবস্থার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে
ছিল। ফলে কারও মনোজগতে দাস মালিকের চরিত্র আছে আর কারও মধ্যে দাসের। মানতে
হবে স্পার্টাকাসের মতো বিদ্রোহ করার স্বভাবও রয়েছে এ দেশের মানুষের। এটি
বাংলার মাটির স্বাভাবিক প্রবণতা। তাই মনোজগতে দাস মালিক হয়ে যারা তাকিয়ায়
হেলান দিয়ে আয়েসে গুড়গুড়ি টানেন, শেষ পর্যন্ত তাদের স্বস্তিতে থাকা সম্ভব
নয়।
আমাদের ক্ষমতার রাজনীতিকরা এখন দাস মালিকদের চরিত্র বজায় রাখছেন। দেশের সব মানুষ তাদের হুকুমের দাস। তাই তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য, ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছার জন্য মই হিসেবে ব্যবহার করেন দেশবাসীকে। ক্রীতদাস গণ্য করে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর চালিয়ে দেন শানানো ছুরি। নিজেদের মোক্ষে পৌঁছার জন্য বিপর্যস্ত করেন জনজীবন। আর এসব করতে এতটুকু বিব্রতবোধ করেন না তারা।
গণতন্ত্র তো আমাদের সব পক্ষের নেতা-নেত্রীদের কাছে একটি স্লোগান মাত্র। প্রতারণার বাতাবরণে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা। নির্বাচন ছাড়া আর কোনো দৃশ্যমান গণতান্ত্রিক আচরণ নেই আমাদের রাজনৈতিক দল আর নেতানেত্রীদের মধ্যে। দেশপ্রেমের প্রমাণ তারা তাদের আচরণে কখনও দেখাতে পেরেছেন বিপন্ন মানুষ তা মনে করতে পারে না। জনগণের কষ্ট, ভালো লাগা-মন্দ লাগা কখনও তাদের ছুঁয়ে যায় না। নিজেদের মোক্ষ লাভের জন্য একের পর এক প্রাণঘাতী-সম্পদঘাতী কর্মসূচি চাপিয়ে দেন। আর তা বৈধ করতে চান অপ্রাসঙ্গিক শব্দ চয়নের মধ্য দিয়ে।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পার হয়ে গেল; কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে পারলেন না কোনো পক্ষ। একটি কাজই সাফল্যের সঙ্গে করতে পারলেন, তা হচ্ছে যার যার দলের পক্ষে একদল দলান্ধ অনুসারী তৈরি। এরা বোকা আÍঘাতী আলোর পোকার মতো যার যার দলের সুবিধাবাদী নেতা-নেত্রীদের মরীচিকার পেছনে জীবনপাত করে ছুটতে থাকেন। দেশপ্রেমের চেয়ে দলপ্রেম যখন বড় হয়ে যায় তখন অন্ধত্ব পেয়ে বসে। আর প্রতারক নেতৃত্ব এসব অন্ধকে ব্যবহার করে মানবতার বুক বিদীর্ণ করেন।
ক্ষমতার দৌড়ে ছোটা দলগুলো নির্বাচন ব্যবস্থাতেও কোনো স্থিতি দিতে পারেনি। গণতান্ত্রিক বোধের উপলব্ধি নেই বলে নির্বাচনে গণরায় মেনে নেয়ার মানসিক শক্তি কারও নেই। সবার দৃষ্টি শুধু মসনদের দিকে। তাই বিবদমান দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এখন চরমে। এভাবে একপক্ষ শিলের চরিত্রে থাকলে অন্যপক্ষ থাকে নোড়ার চরিত্রে। আর শিল-নোড়ার প্রবল ঘর্ষণে প্রাণপাত হয় সাধারণ মানুষের।
নির্বাচনে আমাদের দেশে পরাজিত পক্ষের অভ্যাস রয়েছে ফলাফল বর্জন করার। নির্বাচন গড়াপেটা করার সুনির্দিষ্ট বা প্রামাণ্য অভিযোগ না থাকলেও নির্বাচনের ফলাফল বর্জন বা বিরূপ মন্তব্য যে গণরায়কে অবজ্ঞা করা, তা গণতান্ত্রিক আচরণ-বিচ্ছিন্ন নেতা-নেত্রীদের বোঝানো কঠিন। পরাজিত পক্ষের একান্ত দলান্ধ মানুষ ছাড়া দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকসহ দেশের সব ভোটার গত জাতীয় নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। তারপরও বিপুল গণরায়ে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মহাজোটকে স্বাগত জানাতে পারেনি বিএনপি আর তার মিত্ররা। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা যে রাজনীতিকদের দায়িত্ব, তারাই নির্বাচনের পরদিন থেকেই শত্র“তায় লেগে গেল সরকার পক্ষের বিরুদ্ধে। চেষ্টা চলতে থাকল সংসদ অকার্য করার। গণরায়ে অভিষিক্ত সরকারি দলও জণকল্যাণমুখী হতে পারল না। সব দলের এমন আচরণ প্রতিদিন হতাশ করছে সাধারণ মানুষকে।
এসবের পরও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সরকার যখন পাঁচ বছর পূর্ণ করছে, তখন আশাবাদী মানুষের আশা করতে ইচ্ছে হয়েছিল যে, নির্বাচন একটি নিজস্ব গণতান্ত্রিক পথ পেয়ে যাবে। কিন্তু যে দেশে রাজনীতিকরা গণআস্থায় বিশ্বাসী নন, গণরায়ের প্রতি ভরসা রাখেন না, তারা নানা ঘোট পাকাবেনই। ফলে সাংবৎসর গণতান্ত্রিক আচরণ না করলেও হঠাৎ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে অতি বেশি গণতান্ত্রিক হয়ে গেল আওয়ামী লীগ। আদালতের নির্দেশনায় সুযোগ থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা উঠিয়ে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পথে হাঁটতে লাগল। জানা কথা, পারস্পরিক অবিশ্বাসের রাজনীতিতে ঝড় উঠবেই। আর সে ঝড়ে দলগুলোর রাজনীতিতে কী লাভ-ক্ষতি হবে তা তারা বুঝবেন, তবে সাধারণ মানুষের জীবন ও দেশের অর্থনীতি যে বিপন্ন হবে এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু তাতে কি এসে যায় আমাদের নেতা-নেত্রীদের? তারা তো দেশের মানুষকে বিশেষ এক ধরনের দাস বিবেচনা করেন। এ দাসদের ঘাড়ে যা চাপিয়ে দেবেন তাই মুখ বুজে বহন করতে হবে।
রাজনীতিকদের স্বেচ্ছাচারিতা এতটা উলঙ্গ হয়ে গেছে যে, জনজীবন ও অর্থনীতির ক্ষতি জেনেও দরকারে-অদরকারে মুড়ি-মুড়কির মতো হরতাল দেয়া শুরু হয়েছে। এখন আর জাতীয় ইস্যুর দরকার পড়ে না। একজন বিএনপি বা ছাত্রদল নেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করল তো তার জেলায় হরতাল ডাকা হয়ে যায়। ছাত্রশিবিরের নেতা গ্রেফতার হয়েছে তো দুটো জেলায় ডেকে ফেলা হল হরতাল। এতে গাড়ি-ঘোড়া ভাঙা হয়। জ্বালাও-পোড়াও হয়। এসব হরতালের রাজনৈতিক ফায়দা কী তাও বোঝা যায় না। এ ধারার হরতালে সরকার আদৌ কোনো চাপে পড়ে কিনা তা ভাবার বিষয়। কিন্তু যা দৃশ্যমান তা হচ্ছে, হরতাল-অঞ্চলের জনজীবন আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিপর্যস্ত হয়। আমাদের রাজনীতিকরা সাধারণ মানুষকে দাস বিবেচনা করেন বলেই এসব অনৈতিক-অযৌক্তিক হরতাল অবলীলায় চাপিয়ে দিতে পারেন তাদের ঘাড়ে।
নির্বাচনী সরকার পদ্ধতি নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে চলছিল অনড় অবস্থান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাসরূপ দেশবাসীর প্রতি সামান্য কৃপা করে একটু নড়ে বসেছিলেন। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে নিজের দলীয় সরকারের ধারণা থেকে খানিকটা সরে সর্বদলীয় সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রস্তাব করলেন। আমরা বলব, এ দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি একটি বড় অগ্রগতি। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করলেন না এ সরকারের প্রধান কে হবেন। আমরা যৌক্তিক কারণে ধরে নেই, এ প্রশ্নের সুরাহার জন্য আলোচনার টেবিল খোলা রয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রগলভ নেতারা কী বললেন না বললেন সেদিকে নজর দেয়া খুব জরুরি ছিল না। বিএনপি নেতা-নেত্রীরা যদি দেশপ্রেম দ্বারা চালিত হতেন, তবে মানুষের দুর্ভোগ না বাড়িয়ে সংলাপের মধ্য দিয়ে একটি ফয়সালা বের করে আনতেন। কিন্তু বিএনপি এখন চালিত হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের পরামর্শ ও পেশিশক্তি দিয়ে। ফলে ফয়সালার চেয়ে দেশজুড়ে হিংসার আগুন ছড়িয়ে দিতে চাইলেন তারা। এমন পরিকল্পনা সামনে এনে ২৫ অক্টোবর জনসভার নামে দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া হল আতংক। এ জনসভার অগ্রভাগে বিএনপি আর ছাত্রদল তেমন পাত্তা পেল না। শিবিরের অবস্থানই স্পষ্ট হল। দুর্বল হয়ে যাওয়া ছাত্রদল এর প্রতিবাদের সাহসও পায়নি। বেগম জিয়াও তার ভাষণে জামায়াত আর ছাত্রশিবিরকেই তোষণ করলেন বেশি। দু’দিন বললেও বাহ্যত দেড় দিনের আলটিমেটাম দিলেন সরকারকে। এর মধ্যে সংলাপের সূত্রপাত না করলে তিন দিনের লাগাতার হরতালের ডাক দিয়ে রাখলেন। অর্থাৎ আবারও নিজেদের লভ্যাংশ ঘরে তুলতে দাসসম দেশবাসীকে পায়ে মাড়িয়ে, দেশের অর্থনীতির চরম ক্ষতি করে, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার কথা না ভেবে, গরিব শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা না করে দেশনেত্রী সহাস্য বদনে হরতালের ডাক দিলেন।
বিএনপির আলটিমেটামের ভেতরেই প্রধানমন্ত্রী টেলিফোনে সংলাপ করলেন বিএনপি নেতার সঙ্গে। সংলাপের জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানালেন। একই কারণে হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহারের অনুরোধ করলেন। অথচ খালেদা জিয়া জানালেন, এত অল্প সময়ে জোট নেতাদের তিনি পাবেন না। এ মোবাইলের যুগে কথাটি খুব হাস্যকর লাগল। খুব বিস্ময় হল যখন জানানো হল তিন দিন হরতালের পর তারা সংলাপের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। অর্থাৎ সংলাপের আগে হরতালীয় ওয়ার্মআপের দরকার আছে। বিষয়টা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের রাজ মহীষীর মতো, ‘জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী/শীত নিবারিব অনলে।’ অর্থাৎ শিবিরের সন্ত্রাসীদের মাঠে নামিয়ে গাড়ি-ঘোড়া ভেঙে, সাধারণ মানুষকে আহত-নিহত করে, দেশের অর্থনীতির কোটি কোটি টাকার ক্ষতি করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে। আর এর পুরো খেসারতটিই দিতে হবে সাধারণ মানুষকে। দাসসম সাধারণ মানুষকে এসব অনাচার মুখ বুজে সইতে হবে।
কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠটি কখনও দেখেন না প্রভুরূপী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা। এ দেশের মানুষ শুধু দাসত্ব বরণ করতেই শেখেনি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নানা যুগপর্বেই ফুঁসে উঠেছে তারা। মানুষের দ্রোহ মোকাবেলার শক্তি নৈতিকভাবে দুর্বল এসব নেতা-নেত্রীর আছে বলে মনে হয় না। তাই সময় বয়ে যাওয়ার আগেই মেকি প্রভুত্বের খোলস পাল্টে সব পক্ষের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর উচিত হবে গণদুর্ভোগের কারণ না ঘটিয়ে গণমুখী হওয়া।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের ক্ষমতার রাজনীতিকরা এখন দাস মালিকদের চরিত্র বজায় রাখছেন। দেশের সব মানুষ তাদের হুকুমের দাস। তাই তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য, ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছার জন্য মই হিসেবে ব্যবহার করেন দেশবাসীকে। ক্রীতদাস গণ্য করে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর চালিয়ে দেন শানানো ছুরি। নিজেদের মোক্ষে পৌঁছার জন্য বিপর্যস্ত করেন জনজীবন। আর এসব করতে এতটুকু বিব্রতবোধ করেন না তারা।
গণতন্ত্র তো আমাদের সব পক্ষের নেতা-নেত্রীদের কাছে একটি স্লোগান মাত্র। প্রতারণার বাতাবরণে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা। নির্বাচন ছাড়া আর কোনো দৃশ্যমান গণতান্ত্রিক আচরণ নেই আমাদের রাজনৈতিক দল আর নেতানেত্রীদের মধ্যে। দেশপ্রেমের প্রমাণ তারা তাদের আচরণে কখনও দেখাতে পেরেছেন বিপন্ন মানুষ তা মনে করতে পারে না। জনগণের কষ্ট, ভালো লাগা-মন্দ লাগা কখনও তাদের ছুঁয়ে যায় না। নিজেদের মোক্ষ লাভের জন্য একের পর এক প্রাণঘাতী-সম্পদঘাতী কর্মসূচি চাপিয়ে দেন। আর তা বৈধ করতে চান অপ্রাসঙ্গিক শব্দ চয়নের মধ্য দিয়ে।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পার হয়ে গেল; কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে পারলেন না কোনো পক্ষ। একটি কাজই সাফল্যের সঙ্গে করতে পারলেন, তা হচ্ছে যার যার দলের পক্ষে একদল দলান্ধ অনুসারী তৈরি। এরা বোকা আÍঘাতী আলোর পোকার মতো যার যার দলের সুবিধাবাদী নেতা-নেত্রীদের মরীচিকার পেছনে জীবনপাত করে ছুটতে থাকেন। দেশপ্রেমের চেয়ে দলপ্রেম যখন বড় হয়ে যায় তখন অন্ধত্ব পেয়ে বসে। আর প্রতারক নেতৃত্ব এসব অন্ধকে ব্যবহার করে মানবতার বুক বিদীর্ণ করেন।
ক্ষমতার দৌড়ে ছোটা দলগুলো নির্বাচন ব্যবস্থাতেও কোনো স্থিতি দিতে পারেনি। গণতান্ত্রিক বোধের উপলব্ধি নেই বলে নির্বাচনে গণরায় মেনে নেয়ার মানসিক শক্তি কারও নেই। সবার দৃষ্টি শুধু মসনদের দিকে। তাই বিবদমান দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এখন চরমে। এভাবে একপক্ষ শিলের চরিত্রে থাকলে অন্যপক্ষ থাকে নোড়ার চরিত্রে। আর শিল-নোড়ার প্রবল ঘর্ষণে প্রাণপাত হয় সাধারণ মানুষের।
নির্বাচনে আমাদের দেশে পরাজিত পক্ষের অভ্যাস রয়েছে ফলাফল বর্জন করার। নির্বাচন গড়াপেটা করার সুনির্দিষ্ট বা প্রামাণ্য অভিযোগ না থাকলেও নির্বাচনের ফলাফল বর্জন বা বিরূপ মন্তব্য যে গণরায়কে অবজ্ঞা করা, তা গণতান্ত্রিক আচরণ-বিচ্ছিন্ন নেতা-নেত্রীদের বোঝানো কঠিন। পরাজিত পক্ষের একান্ত দলান্ধ মানুষ ছাড়া দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকসহ দেশের সব ভোটার গত জাতীয় নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। তারপরও বিপুল গণরায়ে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মহাজোটকে স্বাগত জানাতে পারেনি বিএনপি আর তার মিত্ররা। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা যে রাজনীতিকদের দায়িত্ব, তারাই নির্বাচনের পরদিন থেকেই শত্র“তায় লেগে গেল সরকার পক্ষের বিরুদ্ধে। চেষ্টা চলতে থাকল সংসদ অকার্য করার। গণরায়ে অভিষিক্ত সরকারি দলও জণকল্যাণমুখী হতে পারল না। সব দলের এমন আচরণ প্রতিদিন হতাশ করছে সাধারণ মানুষকে।
এসবের পরও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সরকার যখন পাঁচ বছর পূর্ণ করছে, তখন আশাবাদী মানুষের আশা করতে ইচ্ছে হয়েছিল যে, নির্বাচন একটি নিজস্ব গণতান্ত্রিক পথ পেয়ে যাবে। কিন্তু যে দেশে রাজনীতিকরা গণআস্থায় বিশ্বাসী নন, গণরায়ের প্রতি ভরসা রাখেন না, তারা নানা ঘোট পাকাবেনই। ফলে সাংবৎসর গণতান্ত্রিক আচরণ না করলেও হঠাৎ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে অতি বেশি গণতান্ত্রিক হয়ে গেল আওয়ামী লীগ। আদালতের নির্দেশনায় সুযোগ থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা উঠিয়ে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পথে হাঁটতে লাগল। জানা কথা, পারস্পরিক অবিশ্বাসের রাজনীতিতে ঝড় উঠবেই। আর সে ঝড়ে দলগুলোর রাজনীতিতে কী লাভ-ক্ষতি হবে তা তারা বুঝবেন, তবে সাধারণ মানুষের জীবন ও দেশের অর্থনীতি যে বিপন্ন হবে এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু তাতে কি এসে যায় আমাদের নেতা-নেত্রীদের? তারা তো দেশের মানুষকে বিশেষ এক ধরনের দাস বিবেচনা করেন। এ দাসদের ঘাড়ে যা চাপিয়ে দেবেন তাই মুখ বুজে বহন করতে হবে।
রাজনীতিকদের স্বেচ্ছাচারিতা এতটা উলঙ্গ হয়ে গেছে যে, জনজীবন ও অর্থনীতির ক্ষতি জেনেও দরকারে-অদরকারে মুড়ি-মুড়কির মতো হরতাল দেয়া শুরু হয়েছে। এখন আর জাতীয় ইস্যুর দরকার পড়ে না। একজন বিএনপি বা ছাত্রদল নেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করল তো তার জেলায় হরতাল ডাকা হয়ে যায়। ছাত্রশিবিরের নেতা গ্রেফতার হয়েছে তো দুটো জেলায় ডেকে ফেলা হল হরতাল। এতে গাড়ি-ঘোড়া ভাঙা হয়। জ্বালাও-পোড়াও হয়। এসব হরতালের রাজনৈতিক ফায়দা কী তাও বোঝা যায় না। এ ধারার হরতালে সরকার আদৌ কোনো চাপে পড়ে কিনা তা ভাবার বিষয়। কিন্তু যা দৃশ্যমান তা হচ্ছে, হরতাল-অঞ্চলের জনজীবন আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিপর্যস্ত হয়। আমাদের রাজনীতিকরা সাধারণ মানুষকে দাস বিবেচনা করেন বলেই এসব অনৈতিক-অযৌক্তিক হরতাল অবলীলায় চাপিয়ে দিতে পারেন তাদের ঘাড়ে।
নির্বাচনী সরকার পদ্ধতি নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে চলছিল অনড় অবস্থান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাসরূপ দেশবাসীর প্রতি সামান্য কৃপা করে একটু নড়ে বসেছিলেন। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে নিজের দলীয় সরকারের ধারণা থেকে খানিকটা সরে সর্বদলীয় সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রস্তাব করলেন। আমরা বলব, এ দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি একটি বড় অগ্রগতি। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করলেন না এ সরকারের প্রধান কে হবেন। আমরা যৌক্তিক কারণে ধরে নেই, এ প্রশ্নের সুরাহার জন্য আলোচনার টেবিল খোলা রয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রগলভ নেতারা কী বললেন না বললেন সেদিকে নজর দেয়া খুব জরুরি ছিল না। বিএনপি নেতা-নেত্রীরা যদি দেশপ্রেম দ্বারা চালিত হতেন, তবে মানুষের দুর্ভোগ না বাড়িয়ে সংলাপের মধ্য দিয়ে একটি ফয়সালা বের করে আনতেন। কিন্তু বিএনপি এখন চালিত হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের পরামর্শ ও পেশিশক্তি দিয়ে। ফলে ফয়সালার চেয়ে দেশজুড়ে হিংসার আগুন ছড়িয়ে দিতে চাইলেন তারা। এমন পরিকল্পনা সামনে এনে ২৫ অক্টোবর জনসভার নামে দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া হল আতংক। এ জনসভার অগ্রভাগে বিএনপি আর ছাত্রদল তেমন পাত্তা পেল না। শিবিরের অবস্থানই স্পষ্ট হল। দুর্বল হয়ে যাওয়া ছাত্রদল এর প্রতিবাদের সাহসও পায়নি। বেগম জিয়াও তার ভাষণে জামায়াত আর ছাত্রশিবিরকেই তোষণ করলেন বেশি। দু’দিন বললেও বাহ্যত দেড় দিনের আলটিমেটাম দিলেন সরকারকে। এর মধ্যে সংলাপের সূত্রপাত না করলে তিন দিনের লাগাতার হরতালের ডাক দিয়ে রাখলেন। অর্থাৎ আবারও নিজেদের লভ্যাংশ ঘরে তুলতে দাসসম দেশবাসীকে পায়ে মাড়িয়ে, দেশের অর্থনীতির চরম ক্ষতি করে, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার কথা না ভেবে, গরিব শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা না করে দেশনেত্রী সহাস্য বদনে হরতালের ডাক দিলেন।
বিএনপির আলটিমেটামের ভেতরেই প্রধানমন্ত্রী টেলিফোনে সংলাপ করলেন বিএনপি নেতার সঙ্গে। সংলাপের জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানালেন। একই কারণে হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহারের অনুরোধ করলেন। অথচ খালেদা জিয়া জানালেন, এত অল্প সময়ে জোট নেতাদের তিনি পাবেন না। এ মোবাইলের যুগে কথাটি খুব হাস্যকর লাগল। খুব বিস্ময় হল যখন জানানো হল তিন দিন হরতালের পর তারা সংলাপের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। অর্থাৎ সংলাপের আগে হরতালীয় ওয়ার্মআপের দরকার আছে। বিষয়টা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের রাজ মহীষীর মতো, ‘জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী/শীত নিবারিব অনলে।’ অর্থাৎ শিবিরের সন্ত্রাসীদের মাঠে নামিয়ে গাড়ি-ঘোড়া ভেঙে, সাধারণ মানুষকে আহত-নিহত করে, দেশের অর্থনীতির কোটি কোটি টাকার ক্ষতি করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে। আর এর পুরো খেসারতটিই দিতে হবে সাধারণ মানুষকে। দাসসম সাধারণ মানুষকে এসব অনাচার মুখ বুজে সইতে হবে।
কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠটি কখনও দেখেন না প্রভুরূপী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা। এ দেশের মানুষ শুধু দাসত্ব বরণ করতেই শেখেনি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নানা যুগপর্বেই ফুঁসে উঠেছে তারা। মানুষের দ্রোহ মোকাবেলার শক্তি নৈতিকভাবে দুর্বল এসব নেতা-নেত্রীর আছে বলে মনে হয় না। তাই সময় বয়ে যাওয়ার আগেই মেকি প্রভুত্বের খোলস পাল্টে সব পক্ষের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর উচিত হবে গণদুর্ভোগের কারণ না ঘটিয়ে গণমুখী হওয়া।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments