সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি by আল আমীন চৌধুরী
স্বাধীনতার
প্রায় ৪১ বছর এবং সামরিক শাসন অবসানের ২৩ বছর পর আজও নির্বাচন ঘিরে সহিংস
হরতাল, সশস্ত্র সংঘর্ষ ও ব্যাপক জানমালের ক্ষতিপূর্ণ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি
যেমন চিন্তার অতীত, তেমনি নির্বাচন আদৌ হবে কি-না, হলে অবাধ ও সুষ্ঠু এবং
সব দলের অংশগ্রহণে হবে কি, কোন সরকারের অধীনে হবে- এমনতর মৌলিক প্রশ্ন বড়
হয়ে দেখা দেবে, তা ভাবতে অবাক লাগে। বস্তুত এটা তো চাকার পুনঃআবিষ্কার নয়।
বিলেতের সংসদীয় গণতন্ত্রের যে আদলে আমাদের শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এবং
উন্নত বিশ্বে ও মালয়েশিয়া, ভারতসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক দেশে
যেভাবে নির্বাচন ও শাসনভার হস্তান্তর হয়ে থাকে- সেখানে এসব মৌলিক প্রশ্নের
কিংবা এহেন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি উদ্ভবের প্রশ্নই ওঠে না। এখানেও সেরূপ
ব্যবস্থা চালু ছিল। কিন্তু সামরিক শাসনামলে এবং পরে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার
কারণে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের
ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ধারণা ছিল, বার তিনেক এ ব্যবস্থা চললে
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত মজবুত হবে। তারপর নির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের
অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া যাবে। তবে আমাদের
অননুকরণীয় সৃজনশীলতা ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কারণে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা
দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং পরে সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের
অধীনে বিগত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এরই মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের খসড়া রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানসম্মত নয় মর্মে রায় দেয়া হয়। তবে সংসদ ইচ্ছা করলে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দু’বার ওই ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে বলে নির্দেশনাও রাখা হয়। কিন্তু সংসদ সে মর্মে কোনো আইন পাস করেনি এবং ওই ব্যবস্থা সংবিধানেও রাখা হয়নি। এসব ইতিবৃত্ত প্রায় সবারই জানা। এখন সরকার পক্ষ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে আর বিরোধী দল বলছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এ বিবাদ-বিরোধ নিয়েই হরতাল ও নৈরাজ্যকর অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে আলোচনা-সভা ও টকশোর বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ববর্গ, রাজনীতির পণ্ডিত কিংবা জনমত বিশেষজ্ঞরা অহর্নিশি নানা মতামত ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীর কাছে প্রধানমন্ত্রীর একটি টেলিফোন করতে কতক্ষণ সময় লাগে?
প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের নাম চেয়েছেন এবং সেই কাক্সিক্ষত টেলিফোনটি করেছেন। বিরোধী দলও ইতিমধ্যে তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সংসদে উত্থাপন করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব, মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ অনেক দেশের প্রতিনিধিরাও সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ নিরসনের পরামর্শ দিচ্ছেন। কেউ কেউ সালিশদার হতেও রাজি আছেন মর্মে জানা গেছে। তবে দুই নেত্রীর ফোন আলাপে বা চলমান কর্মকাণ্ড বিচারে মনে হয় না যে তারা ‘সালিশ মানি তবে তালগাছটা আমার’ এ অবস্থানের বাইরে যাবেন। সে কথায় পরে আসব। তার আগে আমার বেশ কিছু প্রশ্ন আছে।
প্রথম প্রশ্ন হল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে। রাজনীতি, টকশো ব্যক্তিত্ব, সুশীল সমাজ বা অন্যরা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেন কিংবা যে তত্ত্বাবধায়কের ব্যাপারে সংবাদপত্রসহ কয়েকটি জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান জরিপ করে বলেছে যে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ওই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন চায়, তারা কি ত্রয়োদশ সংশোধনীতে সংবিধানে সন্নিবেশিত এবং ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথা বলছেন, নাকি সংশোধিত কোনো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কথা বলছেন? সংশোধিত হলে কোন কোন স্থানে কী কী সংশোধনী আনার প্রস্তাব হয়েছে, তা কি সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে? উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন বা ওই সরকার কীভাবে গঠিত হবে, সংবিধানে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে এবং ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সেভাবে গঠিত সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় (যদিও পরাজিত দল ফলাফলের ব্যাপারে আপত্তি করেছে) বলেই জনগণ সেরূপ সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। আমার বিশ্বাস, পত্রিকা বা অন্যান্য জরিপ পরিচালনাকারী জনগণের কাছে পরিচিত এবং পূর্ব-পরীক্ষিত সেই তত্ত্বাবধায়কের ধারণার ওপরই জনমত যাচাই করেছেন। এখানে আরও উল্লেখ্য, বিরোধী দল সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃস্থাপন চায় না। বিশেষ করে সে বিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তারা মেনে নেবে না বলে বহু আগেই ঘোষণা দিয়েছে। তাছাড়া তাদের সর্বশেষ প্রস্তাবেও ওই সরকারপ্রধান হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নিরপেক্ষ বিশিষ্ট নাগরিকের কথা বলা হয়েছে। অনুরূপ প্রস্তাব রাজনীতিক, গণমাধ্যম, বিশেষজ্ঞ ও স্বনামধন্য অনেক ব্যক্তির কাছ থেকেও এসেছে। এরূপ একজন ব্যক্তি ১৯৯৫ সালে কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল চিফ এমেকা আনিয়াওকু বা পরে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন বহু চেষ্টা করেও খুঁজে পাননি। ঠিক তেমনি ২০০৬ সালে বিএনপির মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে দীর্ঘ সংলাপের সময়ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নিরপেক্ষ বিশিষ্ট নাগরিকের সাক্ষাৎ মেলেনি। মেলার কথাও নয়। দুই দল ও নেতৃত্বের মধ্যে যে চরম অবিশ্বাস ও আস্থার অভাব রয়েছে তাতে একপক্ষ রাজি হলে অন্যপক্ষ তাকে প্রতিপক্ষের লোক মনে করবে। প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য ব্যক্তি যত শ্রদ্ধেয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিই হোন না কেন, দুই পক্ষের প্রত্যেকেই তাদের প্রতি অনুগত বা তাদের পক্ষ সমর্থনকারীকেই শুধু মেনে নিতে রাজি, অন্য কাউকে নয়। বিদ্যমান অবস্থায় একমাত্র বিধাতার পক্ষেই মনে হয় সে ভূমিকা পালন করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রেও নির্বাচনের পর পরাজিত দল সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে বা আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে- এরূপ অভিযোগ যে উত্থাপন করবে না, তা হলফ করে বলা যাবে না। কেউ কেউ সার্চ কমিটির মাধ্যমে সরকারপ্রধান মনোনয়নের প্রস্তাব দিয়েছেন। কারা সে কমিটির সদস্য হবেন? কেইবা তাদের নিয়োগ দেবে? সেসব প্রশ্ন ছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, সেই কমিটির সুপারিশকৃত প্রার্থীকে দুই দল কি সমর্থন দেবে? সম্ভাব্য উত্তর : না। তাই কার্যকর কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রস্তাব করতে হলে এ ধরনের উন্মুক্ত প্রস্তাবের পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।
আমার দ্বিতীয় দফার প্রশ্নগুলো হচ্ছে সুপ্রিমকোর্টের খসড়া রায়ের নির্দেশনামূলক পরামর্শ অনুযায়ী আরও দু’বার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব সম্পর্কে। অনেক বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাসদসহ আরও দু’-একটি দল ওই প্রস্তাব দিয়েছে। এখানে তাদের কাছে প্রথম প্রশ্ন : তারা কি সত্যিই মনে করেন, আগামী দু’বারের পর বর্তমান সংবিধানের আলোকে ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মতো গণতান্ত্রিক ভিত রচিত হবে এবং সব দল সে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবে?
১৯৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসহ মোট চারটি নির্বাচন নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার পরও যেখানে একটি শক্তিশালী নির্বাচনী কাঠামো গড়ে ওঠেনি, স্বাধীন ও প্রকৃত ক্ষমতাবান নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়নি, রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো নিজেদের মধ্যে যেমন আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি তেমনি নির্বাচন কমিশনের ওপরও আস্থা স্থাপন করতে পারেনি, সেখানে আগামী দু’বার অনুরূপ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই অন্য কোনোরূপ মৌল পরিবর্তন ছাড়াই অবস্থা বদলে যাবে- তেমনটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ দেখি না। ওই প্রস্তাব বাস্তবায়নের সম্ভাব্য চিত্রটি একবার চিন্তা করে দেখুন। ১৯৯০ পরবর্তী নির্বাচনগুলোর ফলাফলে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল পরপর দু’বার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। সে অনুযায়ী যে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করা হয়েছে তার প্রথমটিতে অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের জায়গায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট জয়লাভ করে সরকার গঠন করবে। আর দ্বিতীয়বারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় যাবে এবং এরপর থেকে ক্ষমতাসীন দল বা জোটের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। তখন আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বিনা আপত্তিতে নির্বাচন মেনে নেবে- এরকম বিশ্বাস করা দুষ্কর। প্রতিটি দলের কার্যক্রম, আচার-আচরণ, মনমানসিকতার আমূল পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক চর্চা, পরস্পরের প্রতি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি, সবাই মিলে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ এবং নিরপেক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ প্রশাসন গড়ে তুললেই কেবল অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো নির্বিঘ্নে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং শাসনভার হস্তান্তর করা সম্ভব হবে। এর জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ও দৃঢ় সংকল্প। কিন্তু বিরাজমান অবস্থায় সে লক্ষণ কোনো দল বা জোটের মধ্যেই দেখা যায় না। তাছাড়া চার চারটি নির্বাচনে এমনকি সেনাসমর্থিত দু’বছর মেয়াদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কঠিন অভিজ্ঞতার পরও যখন আমাদের দলীয় রাজনীতির কৃষ্টি বদলায়নি, আরও দু’বারের বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন যে দেশকে দৃঢ় গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে এবং সব দলকে নির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত করবে, সে ভরসা কোনোক্রমেই করা যায় না। এখানে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের পর পাকিস্তান ও ভারতের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ধারা বিকাশের উদাহরণ একান্ত প্রাসঙ্গিক মনে করি। পাকিস্তান নিজেকে শিশুরাষ্ট্র হিসেবে গণ্য ও ঘোষণা করে প্রথম ৯ বছর পর্যন্ত জাতীয় সাধারণ নির্বাচন যেমন দেয়নি, তেমনি একটি শাসনতন্ত্র বা সংবিধানও রচনা করেনি পাছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের টানাপোড়েনে শিশুরাষ্ট্রটি সবল ও পুষ্ট হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তারপর যাও একটি সংবিধান রচিত হল, নানা অজুহাতে তার বাস্তবায়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠান স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করা হল। এরপর গণতন্ত্র বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের মতো ন্যায্য দাবিগুলো শিশুরাষ্ট্রের দোহাই দিয়ে নাকচ করা হল। শেষ পর্যন্ত ২৩ বছরেও যখন দুর্বল শিশুটি সাবালক হল না, তখন গণতন্ত্র ও ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হল এবং সেই শিশুরাষ্ট্রটির মৃত্যু হল। অন্যদিকে ভারত প্রথমেই সংবিধান রচনায় এবং গণতন্ত্রের প্রথায় জাতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যাপৃত হল এবং অল্প সময়ের মধ্যেই একটি সবল ও কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হল। নতুন রাষ্ট্রের দুর্বল গণতান্ত্রিক ভিতের দোহাই দিয়ে তারা নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকেনি। আসলে গণতন্ত্রে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা নিরসনে চাই আরও বেশি গণতন্ত্র- রাষ্ট্র কাঠামোয়, সরকারে, দলে ও প্রশাসনিক স্তরে। তার সঙ্গে চাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার পরিবেশ এবং জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐকমত্য।
আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে রাজনীতিবেত্তা, সুশীল সমাজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিত ও বিশ্লেষক এবং প্রগতিবাদী রাজনীতিকদের কাছে। প্রতিবার যখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসে, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধী দলের ক্ষমতার লড়াই চরম সহিংসতায় রূপ নিয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, তখন তারা স্থায়ী কোনো সমাধানের ব্যবস্থার কথা না বলে আপাত প্রশমনের ব্যবস্থা হিসেবে কেন সেবারের মতো একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে কোনোমতে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করে থাকেন? এতে প্রতিবারই একই অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। প্রতিবারই সেই দুই বিবদমান দলকে সংলাপে বসতে আহ্বান করা হবে। দুই নেতাকে ফোনালাপ করতে অনুরোধ করা হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা হবে। এরই মধ্যে গত তিন দিনের হরতালের মতো বা তার আগেরবারের মতো হালি হালি মানুষ মরবে, শত শত আহত হবে, কোটি কাটি টাকার সম্পদ নষ্ট হবে, অগণিত মানুষ আয় হারাবে, শান্তি হারাবে। আর তাতেও কাজ না হলে তৃতীয় কোনো অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ অচলাবস্থার অবসান হবে। এ দুষ্ট চক্র থেকে মুক্তির উপায় বোধ করি রাজনীতিকদেরই বের করতে হবে। সে লক্ষ্যে আমার মনে হয়, সার্চ কমিটির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের পরিবর্তে অনুরূপ কোনো সর্বসম্মত ব্যবস্থায় শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার দিকেই তাদের সর্বাÍক চেষ্টা চালানো সমীচীন হবে।
বড় বড় দল ও জোটগুলোর পালাক্রমে ক্ষমতায় থাকার সময় সব ধরনের বাজিকরি (বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ভাষায়) কর্মকাণ্ড দেখার পরও বলছি, প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব সব রাজনৈতিক দলের পক্ষে বিবেচনার দাবি রাখে। ওই প্রস্তাবের আলোকে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকারের অধীনে আবার সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ আছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো এবার থেকেই শুরু হতে পারে সে ব্যবস্থা। এতে নির্বাচনে মানুষের উৎসাহ বাড়বে, উৎকণ্ঠা নয়। রাজনীতিকরাও জনসমর্থন আদায়ে বেশি সময় ব্যয় করতে পারবেন, জনদুর্ভোগ বাড়াতে নয়।
আল আমীন চৌধুরী : কলাম লেখক ও সাবেক সচিব
এরই মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের খসড়া রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানসম্মত নয় মর্মে রায় দেয়া হয়। তবে সংসদ ইচ্ছা করলে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দু’বার ওই ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে বলে নির্দেশনাও রাখা হয়। কিন্তু সংসদ সে মর্মে কোনো আইন পাস করেনি এবং ওই ব্যবস্থা সংবিধানেও রাখা হয়নি। এসব ইতিবৃত্ত প্রায় সবারই জানা। এখন সরকার পক্ষ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে আর বিরোধী দল বলছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এ বিবাদ-বিরোধ নিয়েই হরতাল ও নৈরাজ্যকর অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে আলোচনা-সভা ও টকশোর বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ববর্গ, রাজনীতির পণ্ডিত কিংবা জনমত বিশেষজ্ঞরা অহর্নিশি নানা মতামত ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীর কাছে প্রধানমন্ত্রীর একটি টেলিফোন করতে কতক্ষণ সময় লাগে?
প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের নাম চেয়েছেন এবং সেই কাক্সিক্ষত টেলিফোনটি করেছেন। বিরোধী দলও ইতিমধ্যে তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সংসদে উত্থাপন করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব, মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ অনেক দেশের প্রতিনিধিরাও সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ নিরসনের পরামর্শ দিচ্ছেন। কেউ কেউ সালিশদার হতেও রাজি আছেন মর্মে জানা গেছে। তবে দুই নেত্রীর ফোন আলাপে বা চলমান কর্মকাণ্ড বিচারে মনে হয় না যে তারা ‘সালিশ মানি তবে তালগাছটা আমার’ এ অবস্থানের বাইরে যাবেন। সে কথায় পরে আসব। তার আগে আমার বেশ কিছু প্রশ্ন আছে।
প্রথম প্রশ্ন হল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে। রাজনীতি, টকশো ব্যক্তিত্ব, সুশীল সমাজ বা অন্যরা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেন কিংবা যে তত্ত্বাবধায়কের ব্যাপারে সংবাদপত্রসহ কয়েকটি জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান জরিপ করে বলেছে যে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ওই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন চায়, তারা কি ত্রয়োদশ সংশোধনীতে সংবিধানে সন্নিবেশিত এবং ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথা বলছেন, নাকি সংশোধিত কোনো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কথা বলছেন? সংশোধিত হলে কোন কোন স্থানে কী কী সংশোধনী আনার প্রস্তাব হয়েছে, তা কি সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে? উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন বা ওই সরকার কীভাবে গঠিত হবে, সংবিধানে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে এবং ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সেভাবে গঠিত সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় (যদিও পরাজিত দল ফলাফলের ব্যাপারে আপত্তি করেছে) বলেই জনগণ সেরূপ সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। আমার বিশ্বাস, পত্রিকা বা অন্যান্য জরিপ পরিচালনাকারী জনগণের কাছে পরিচিত এবং পূর্ব-পরীক্ষিত সেই তত্ত্বাবধায়কের ধারণার ওপরই জনমত যাচাই করেছেন। এখানে আরও উল্লেখ্য, বিরোধী দল সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃস্থাপন চায় না। বিশেষ করে সে বিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তারা মেনে নেবে না বলে বহু আগেই ঘোষণা দিয়েছে। তাছাড়া তাদের সর্বশেষ প্রস্তাবেও ওই সরকারপ্রধান হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নিরপেক্ষ বিশিষ্ট নাগরিকের কথা বলা হয়েছে। অনুরূপ প্রস্তাব রাজনীতিক, গণমাধ্যম, বিশেষজ্ঞ ও স্বনামধন্য অনেক ব্যক্তির কাছ থেকেও এসেছে। এরূপ একজন ব্যক্তি ১৯৯৫ সালে কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল চিফ এমেকা আনিয়াওকু বা পরে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন বহু চেষ্টা করেও খুঁজে পাননি। ঠিক তেমনি ২০০৬ সালে বিএনপির মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে দীর্ঘ সংলাপের সময়ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নিরপেক্ষ বিশিষ্ট নাগরিকের সাক্ষাৎ মেলেনি। মেলার কথাও নয়। দুই দল ও নেতৃত্বের মধ্যে যে চরম অবিশ্বাস ও আস্থার অভাব রয়েছে তাতে একপক্ষ রাজি হলে অন্যপক্ষ তাকে প্রতিপক্ষের লোক মনে করবে। প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য ব্যক্তি যত শ্রদ্ধেয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিই হোন না কেন, দুই পক্ষের প্রত্যেকেই তাদের প্রতি অনুগত বা তাদের পক্ষ সমর্থনকারীকেই শুধু মেনে নিতে রাজি, অন্য কাউকে নয়। বিদ্যমান অবস্থায় একমাত্র বিধাতার পক্ষেই মনে হয় সে ভূমিকা পালন করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রেও নির্বাচনের পর পরাজিত দল সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে বা আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে- এরূপ অভিযোগ যে উত্থাপন করবে না, তা হলফ করে বলা যাবে না। কেউ কেউ সার্চ কমিটির মাধ্যমে সরকারপ্রধান মনোনয়নের প্রস্তাব দিয়েছেন। কারা সে কমিটির সদস্য হবেন? কেইবা তাদের নিয়োগ দেবে? সেসব প্রশ্ন ছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, সেই কমিটির সুপারিশকৃত প্রার্থীকে দুই দল কি সমর্থন দেবে? সম্ভাব্য উত্তর : না। তাই কার্যকর কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রস্তাব করতে হলে এ ধরনের উন্মুক্ত প্রস্তাবের পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।
আমার দ্বিতীয় দফার প্রশ্নগুলো হচ্ছে সুপ্রিমকোর্টের খসড়া রায়ের নির্দেশনামূলক পরামর্শ অনুযায়ী আরও দু’বার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব সম্পর্কে। অনেক বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাসদসহ আরও দু’-একটি দল ওই প্রস্তাব দিয়েছে। এখানে তাদের কাছে প্রথম প্রশ্ন : তারা কি সত্যিই মনে করেন, আগামী দু’বারের পর বর্তমান সংবিধানের আলোকে ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মতো গণতান্ত্রিক ভিত রচিত হবে এবং সব দল সে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবে?
১৯৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসহ মোট চারটি নির্বাচন নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার পরও যেখানে একটি শক্তিশালী নির্বাচনী কাঠামো গড়ে ওঠেনি, স্বাধীন ও প্রকৃত ক্ষমতাবান নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়নি, রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো নিজেদের মধ্যে যেমন আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি তেমনি নির্বাচন কমিশনের ওপরও আস্থা স্থাপন করতে পারেনি, সেখানে আগামী দু’বার অনুরূপ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই অন্য কোনোরূপ মৌল পরিবর্তন ছাড়াই অবস্থা বদলে যাবে- তেমনটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ দেখি না। ওই প্রস্তাব বাস্তবায়নের সম্ভাব্য চিত্রটি একবার চিন্তা করে দেখুন। ১৯৯০ পরবর্তী নির্বাচনগুলোর ফলাফলে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল পরপর দু’বার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। সে অনুযায়ী যে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করা হয়েছে তার প্রথমটিতে অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের জায়গায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট জয়লাভ করে সরকার গঠন করবে। আর দ্বিতীয়বারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় যাবে এবং এরপর থেকে ক্ষমতাসীন দল বা জোটের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। তখন আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বিনা আপত্তিতে নির্বাচন মেনে নেবে- এরকম বিশ্বাস করা দুষ্কর। প্রতিটি দলের কার্যক্রম, আচার-আচরণ, মনমানসিকতার আমূল পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক চর্চা, পরস্পরের প্রতি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি, সবাই মিলে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ এবং নিরপেক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ প্রশাসন গড়ে তুললেই কেবল অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো নির্বিঘ্নে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং শাসনভার হস্তান্তর করা সম্ভব হবে। এর জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ও দৃঢ় সংকল্প। কিন্তু বিরাজমান অবস্থায় সে লক্ষণ কোনো দল বা জোটের মধ্যেই দেখা যায় না। তাছাড়া চার চারটি নির্বাচনে এমনকি সেনাসমর্থিত দু’বছর মেয়াদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কঠিন অভিজ্ঞতার পরও যখন আমাদের দলীয় রাজনীতির কৃষ্টি বদলায়নি, আরও দু’বারের বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন যে দেশকে দৃঢ় গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে এবং সব দলকে নির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত করবে, সে ভরসা কোনোক্রমেই করা যায় না। এখানে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের পর পাকিস্তান ও ভারতের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ধারা বিকাশের উদাহরণ একান্ত প্রাসঙ্গিক মনে করি। পাকিস্তান নিজেকে শিশুরাষ্ট্র হিসেবে গণ্য ও ঘোষণা করে প্রথম ৯ বছর পর্যন্ত জাতীয় সাধারণ নির্বাচন যেমন দেয়নি, তেমনি একটি শাসনতন্ত্র বা সংবিধানও রচনা করেনি পাছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের টানাপোড়েনে শিশুরাষ্ট্রটি সবল ও পুষ্ট হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তারপর যাও একটি সংবিধান রচিত হল, নানা অজুহাতে তার বাস্তবায়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠান স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করা হল। এরপর গণতন্ত্র বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের মতো ন্যায্য দাবিগুলো শিশুরাষ্ট্রের দোহাই দিয়ে নাকচ করা হল। শেষ পর্যন্ত ২৩ বছরেও যখন দুর্বল শিশুটি সাবালক হল না, তখন গণতন্ত্র ও ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হল এবং সেই শিশুরাষ্ট্রটির মৃত্যু হল। অন্যদিকে ভারত প্রথমেই সংবিধান রচনায় এবং গণতন্ত্রের প্রথায় জাতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যাপৃত হল এবং অল্প সময়ের মধ্যেই একটি সবল ও কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হল। নতুন রাষ্ট্রের দুর্বল গণতান্ত্রিক ভিতের দোহাই দিয়ে তারা নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকেনি। আসলে গণতন্ত্রে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা নিরসনে চাই আরও বেশি গণতন্ত্র- রাষ্ট্র কাঠামোয়, সরকারে, দলে ও প্রশাসনিক স্তরে। তার সঙ্গে চাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার পরিবেশ এবং জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐকমত্য।
আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে রাজনীতিবেত্তা, সুশীল সমাজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিত ও বিশ্লেষক এবং প্রগতিবাদী রাজনীতিকদের কাছে। প্রতিবার যখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসে, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধী দলের ক্ষমতার লড়াই চরম সহিংসতায় রূপ নিয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, তখন তারা স্থায়ী কোনো সমাধানের ব্যবস্থার কথা না বলে আপাত প্রশমনের ব্যবস্থা হিসেবে কেন সেবারের মতো একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে কোনোমতে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করে থাকেন? এতে প্রতিবারই একই অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। প্রতিবারই সেই দুই বিবদমান দলকে সংলাপে বসতে আহ্বান করা হবে। দুই নেতাকে ফোনালাপ করতে অনুরোধ করা হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা হবে। এরই মধ্যে গত তিন দিনের হরতালের মতো বা তার আগেরবারের মতো হালি হালি মানুষ মরবে, শত শত আহত হবে, কোটি কাটি টাকার সম্পদ নষ্ট হবে, অগণিত মানুষ আয় হারাবে, শান্তি হারাবে। আর তাতেও কাজ না হলে তৃতীয় কোনো অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ অচলাবস্থার অবসান হবে। এ দুষ্ট চক্র থেকে মুক্তির উপায় বোধ করি রাজনীতিকদেরই বের করতে হবে। সে লক্ষ্যে আমার মনে হয়, সার্চ কমিটির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের পরিবর্তে অনুরূপ কোনো সর্বসম্মত ব্যবস্থায় শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার দিকেই তাদের সর্বাÍক চেষ্টা চালানো সমীচীন হবে।
বড় বড় দল ও জোটগুলোর পালাক্রমে ক্ষমতায় থাকার সময় সব ধরনের বাজিকরি (বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ভাষায়) কর্মকাণ্ড দেখার পরও বলছি, প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব সব রাজনৈতিক দলের পক্ষে বিবেচনার দাবি রাখে। ওই প্রস্তাবের আলোকে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকারের অধীনে আবার সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ আছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো এবার থেকেই শুরু হতে পারে সে ব্যবস্থা। এতে নির্বাচনে মানুষের উৎসাহ বাড়বে, উৎকণ্ঠা নয়। রাজনীতিকরাও জনসমর্থন আদায়ে বেশি সময় ব্যয় করতে পারবেন, জনদুর্ভোগ বাড়াতে নয়।
আল আমীন চৌধুরী : কলাম লেখক ও সাবেক সচিব
No comments