শুকুইয্যা কডে?

প্রতিপক্ষকে অশ্লীল বাক্যবাণে বিদ্ধ করা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মজ্জাগত অভ্যাস। প্রতিপক্ষ তো বটেই, নিজের দলেও যাঁরা তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না, তাঁদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে কখনো দ্বিতীয়বার চিন্তা করেননি তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা বিপক্ষ দলের নেতা-কর্মীরাই যে শুধু তাঁর এই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত অশ্লীল বাক্যবাণের শিকার হয়েছেন তা কিন্তু নয়, খোদ তাঁর দলের প্রধান খালেদা জিয়া বা দলের অন্য সিনিয়র নেতারাও রেহাই পাননি এই আক্রমণ থেকে। অনেকের ধারণা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দীক্ষা যেমন তিনি পেয়েছিলেন তাঁর বাবা প্রয়াত রাজনীতিক ফজলুল কাদের চৌধুরীর কাছ থেকে, তেমনি দম্ভ, ঔদ্ধত্য এবং প্রতিপক্ষের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাষাটাও শিখেছিলেন তাঁর কাছ থেকেই। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়। ১৯৬২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক-এ সেকেন্ড লিড হিসেবে ছাপা হয়েছিল ‘শুকুইয্যা কডে?’ নামের কৌতূহলোদ্দীপক একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি চট্টগ্রাম থেকে পাঠিয়েছিলেন ইত্তেফাক-এর তৎকালীন তরুণ সাংবাদিক (বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী) মঈনুল আলম। প্রতিবেদনটি, বিশেষ করে এর শিরোনাম তখন পাঠকমহলে এতটাই সাড়া জাগিয়েছিল যে মুখে মুখে তো বটেই, অনেকের লেখায়ও এর উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। প্রয়াত সাংবাদিক কে জি মুস্তাফা দৈনিক ইত্তেফাক-এ শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘তাঁর কতিপয় সংবাদ শিরোনাম অমরত্ব লাভ করেছে। যেমন, “শুক্কুইয্যা কডে?” অথবা “চিনিল কেমনে?”
ধরনের হেডলাইনে জনমনে প্রতিক্রিয়া হয়েছে অসাধারণ।’ এই শিরোনাম ও প্রতিবেদনটির পশ্চাৎপট উল্লেখ করা বোধ করি এখানে প্রাসঙ্গিক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন এ অঞ্চলের খ্যাতিমান রাজনীতিক ফজলুল কাদের চৌধুরী। অথচ এর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘দারোয়ানের (আইয়ুব খান) কাজ পাহারা দেওয়া, আমি দারোয়ানের মন্ত্রী হই কী করে?’ এই দৃঢ়তা দেখে তাঁকে সংবর্ধনাও দিয়েছিল তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। মন্ত্রী হওয়ার খবরে তাই ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল এ অঞ্চলের গণতন্ত্রকামী মানুষ। মন্ত্রী হয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরী যখন প্রথম চট্টগ্রামে এলেন, সকালে রেলস্টেশনে তাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান পণ্ড হয়েছিল ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে। ওই দিন বিকেলে লালদীঘির ময়দানে আবার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে পরিস্থিতি হয়েছিল আরও ভয়াবহ। প্রবল প্রতিবাদধ্বনির মধ্যেও ফজলুল কাদের বক্তৃতা দিতে শুরু করলে মঞ্চের দিকে জুতা-স্যান্ডেল নিক্ষেপ শুরু হয়। মঈনুল আলম তাঁর কলমের সৈনিক গ্রন্থে এর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। উড়ে আসা জুতা মন্ত্রীর আশপাশের লোকজনের গায়ে এসে পড়তে লাগল।
তিনি রাগে অন্ধ হয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গর্জন শুরু করেছিলেন, ‘আয়ুব খাঁ আঁরে মন্ত্রী ন গরিব ত কারে গরিব? আঁরে ত দেইখতে ফাটানর বাইচ্চার মতো লাগে। আর বেওগ্গুন বাঙালি নেতা ত দেইখতে ম্যালেরিয়া রোগীর মতো...।’ (আইয়ুব খাঁ আমাকে মন্ত্রী করবে না তো কাকে মন্ত্রী করবে? আমাকে তো দেখতে পাঠানের বাচ্চার মতো লাগে, অন্য বাঙালি নেতারা তো সব দেখতে ম্যালেরিয়া রোগীর মতো।) তিনি একপর্যায়ে সমাবেশের উদ্দেশে গালিগালাজ শুরু করেছিলেন, ‘শুয়রের পোয়া অল...শুয়রের বাইচ্চার দাত উডিলে ফইল্যা বাপর ফোঁদৎ টেরাই গরে। তোরা বাফল্লয় বেয়াদবি গইত্য আইচ্ছস দে না?’(‘শুয়োরের বাচ্চারা...শুয়োরের বাচ্চার দাঁত উঠলে প্রথমে বাপের পাছায় কামড় দেয়। তোরা বাপের সঙ্গে বেয়াদবি করতে এসেছিস?’) এ সময় বিক্ষোভ প্রচণ্ড আকার ধারণ করে, অবস্থা বেগতিক দেখে ফজলুল কাদেরের সমর্থকেরা সমাবেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে। তিনি তখন মাইকের সামনে গিয়ে হাঁক দিলেন, ‘শুক্কুইয্যা কডে গেলি? ইনদি ছাআচো না...।’ (‘শুক্কুইয্যা কোথায় গেলি? এদিকে দেখ না।’) কিন্তু কোথায় তখন শুকুইয্যা?
পুলিশের লোকজন এসে কোনোক্রমে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন মন্ত্রীকে। ফজলুল কাদেরের রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আত্মম্ভরিতা, সাধারণ মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা এবং ‘শুকুইয্যানির্ভরতা’ (মাস্তান) তাঁকে জনবিচ্ছিন্ন করেছিল। অথচ ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান যখন নির্বাচন ঘোষণা করেন, তখন মুসলিম লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন। বলেছি, সাকা চৌধুরী রাজনীতিতে এসে সব দিক থেকেই অনুসরণ করেছেন তাঁর বাবাকে। তিনি বেশ কবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর এতটুকু আস্থা বা শ্রদ্ধার মনোভাব থাকলে, একজন জনপ্রিয় নেতার যে মাস্তান বাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজন হয় না—এ কথা কখনো উপলব্ধি করেননি। নব্বইয়ের দশকে এনডিপি নামের একটি দল গঠন করেন সালাউদ্দিন, সেই দল থেকে সাংসদও নির্বাচিত হন। এ সময় তাঁর মদদেই গড়ে ওঠে বিরাট এক সন্ত্রাসী বাহিনী।
তখন রাউজান, রাঙ্গুনিয়া এলাকায় তাঁর অনুগত ফজল হক, বিধান বড়ুয়া, জানে আলম, আবু তাহের, রমজান প্রমুখ সন্ত্রাসীর হাতে খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, অপহরণসহ হেন কোনো অপকর্ম নেই, যা সংঘটিত হয়নি। একদিকে ব্যঙ্গভরে ভোটারদের ছাগলের সঙ্গে তুলনা করে তাঁদের মুখের সামনে কাঁঠালপাতা ধরে দিলেই চলে বলে মন্তব্য করেছেন, অন্যদিকে তাঁর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন সন্ত্রাসী। পরে জাতীয় পার্টি হয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েও একই রকম কার্যক্রম চালাতে থাকেন তিনি। প্রতিপক্ষ তো বটেই, তাঁর দলেরই নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, মোরশেদ খান প্রমুখের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার করেছেন নানা সময়। সাদেক হোসেন খোকার মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘আগে কুকুর লেজ নাড়াত, এখন লেজ কুকুরকে নাড়ায়’। ১৯৯১ সালে আলমগীর নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীর হত্যাকাণ্ডে যেমন প্রধান আসামি ছিলেন তিনি, তেমনি নিজ দলেই আবদুল্লাহ আল নোমানের সমর্থক হিসেবে পরিচিত নিটোলের হত্যাকাণ্ডের জন্যও অভিযোগের আঙুল উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম শহরের রহমতগঞ্জ এলাকায় ফজলুল কাদের চৌধুরীর গুড হিলের বাসভবনে পাকিস্তানি সেনারা আশ্রয় নিয়েছিল এবং এই বাড়িতে বহু মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রফেসর সালেহউদ্দিন, সাংবাদিক নিজামউদ্দিন,
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ম. সলিমুল্লাহর মতো অনেকেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরেছেন ওই বাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি। অনেকেই অভিযোগ করেন, সেই নির্যাতনের নির্দেশদাতা হিসেবে ফজলুল কাদেরের সঙ্গে তাঁর ছেলে সালাউদ্দিনও ছিলেন। সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, কুণ্ডেশ্বরী বিদ্যালয় ও ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা। পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশফায়ার করে যাওয়ার পর সালাউদ্দিন আবার নিজের রিভলবার থেকে গুলি করে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেন বলে উল্লেখ করেছেন সাক্ষীরা। সালাউদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ২৯ মার্চ থেকেই দেশে ছিলেন না তিনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবছার পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে তিনিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রহমতগঞ্জ এলাকায় হামলা করেছিলেন সালাউদ্দিনের ওপর, এতে তিনি (সালাউদ্দিন) আহত হয়েছিলেন, মারা গিয়েছিলেন তাঁর ড্রাইভার। এর পরই দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। মানবতাবিরোধী অপরাধে সালাউদ্দিনের ফাঁসির দণ্ড ঘোষণার পর চট্টগ্রামে বিএনপি এক দিন মুখরক্ষার হরতাল ডেকেছে বটে, কিন্তু এই কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততা দেখা যায়নি।
অন্যান্য হরতাল চলাকালে বিএনপির নাসিমন ভবন কার্যালয় ও এর আশপাশের এলাকা থাকে মুখর। কিন্তু গত ২ অক্টোবর হরতালের দিনে জনশূন্য ও তালাবদ্ধ দলীয় কার্যালয়ের ছবি ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। এমনকি রায়ের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশের দিন ঢাকায় অবস্থান করেও এতে যোগ দেননি চট্টগ্রামের কোনো নেতা। আবদুল্লাহ আল নোমান, সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, গোলাম আকবর খোন্দকার দেখিয়েছেন অসুস্থতার অজুহাত, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ব্যস্ত ছিলেন পেশাগত কাজে। ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবেও খ্যাতি ছিল তাঁর। কিন্তু বাবার মতোই দাম্ভিক চরিত্রের এই মানুষটি একদিকে বাক্যবাণে ঘায়েল করতে চেয়েছেন দলের ভেতর-বাইরের প্রতিপক্ষকে, অন্যদিকে বাবার মতোই ‘শুকুইয্যানির্ভর’ বাহুবলের রাজনীতি করে বজায় রাখতে চেয়েছেন নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি। দুঃসময়ে তাই দলের ভেতরও পেলেন না পাশে এসে দাঁড়ানোর মতো কাউকে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.