সম্প্রীতির বন্ধনে উদ্ভাসিত হোক স্বদেশ by নির্মল চক্রবর্তী
দেশের
কোথাও না কোথাও প্রায়ই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের দেব-দেবীর প্রতিমা
ভাংচুর করা হয়। এগুলোর তেমন আর্থিক মূল্য নেই। কারণ এ প্রতিকৃতিগুলো তৈরির
ক্ষেত্রে তেমন মূল্যবান কোনো ধাতব পদার্থ ব্যবহার করা হয় না। আর এসব তেমন
দর্শনীয় নয় যে তা বিশেষভাবে আকর্ষণীয় কোনো বস্তু। নয় অনিন্দ্যসুন্দর শোপিস
যা লুফে নেয়ার মতো কোনো কিছু। প্রশ্ন হল, তাহলে কেন ওগুলো ভাঙা হয় যখন-তখন?
হ্যাঁ, লাভ তো একটা আছেই; সেটা হল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া। একটি
নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষের মনে কষ্ট দেয়া, তাদের অসম্মান করা।
পরোক্ষভাবে অপমান-অপদস্থ করা। যাতে করে তারা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে এ দেশ থেকে
চলে যায়। আর সেই সুযোগে তাদের জায়গা-জমি, ভিটেমাটি জোর-জবরদস্তি করে কিংবা
অপেক্ষাকৃত কম দামে কিনে রাখা যায়। মূলত হিন্দু সম্প্রদায়কে দমিয়ে রাখার
অভিপ্রায়েই তাদের বিগ্রহগুলো ভেঙে ফেলা হয়।
প্রতিমা ভাঙার আরও কিছু বিচ্ছিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন- হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু টাউট প্রকৃতির মানুষও এর সঙ্গে জড়িত। তারা নিজেদের মধ্যে দলাদলি, কোন্দল, শরিকানা বিবাদ কিংবা নিতান্তই হিংসার বশবর্তী হয়ে স্বধর্মীয় মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নেন। প্রতিদ্বন্দ্বীকে হেয়প্রতিপন্ন কিংবা নিছক নাজেহাল করার উদ্দেশ্যে কখনও কখনও নিজেরাই তাদের ধর্মীয় বিগ্রহের প্রতিকৃতিগুলো ভেঙে চুপচাপ বসে থাকেন। যাতে করে এর দায় মুসলিম সম্প্রদায়ের কারও ঘাড়ে পড়ে, আর তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে করা হয় নাজেহাল। আবার কখনও এমনও দেখা যায়, নিজের মন্দিরের বিগ্রহ নিজেই ভেঙে পাড়া-প্রতিবেশীর নামে মামলা করা হয়েছে। সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে তাদের নাম, যারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক শত্র“। তবে এগুলো একবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এগুলোর সঙ্গে দেশে চলমান সামগ্রিক মূর্তি ভাঙার কোনো বিশেষ সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।
মূর্তি ভাঙা, প্রতিমা ভাংচুর, বিগ্রহ চুরি এবং মন্দিরে আগুন দেয়া, মন্দিরের থালাবাটি কিংবা দানের টাকা লুট করার মতো মানসিকতাসম্পন্ন শ্রেণী আলাদা। এরা নিজেদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুভূতির দিক থেকে একেবারে আঠারো আনা। অর্থাৎ পান থেকে চুন খসলেই উগ্রমূর্তি ধারণ করে। শুধু তাই নয়, ছোটখাটো বিষয়েও মীমাংসায় না গিয়ে রীতিমতো জিহাদ ঘোষণা করে বসে। প্রয়োজনে বিশেষ কোনো দিন-তারিখ ঠিক করে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যে কোনো অজুহাতেই ভাংচুর, লুটতরাজ কিংবা অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, তারা যে কোনো সংঘাতকে ধর্মের নামে জিইয়ে রাখতে চায়। এরা শুধু নিজেদের ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায় ছাড়া আর কোনো ধর্ম কিংবা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে মূলত স্বীকৃতি দেন না। তাদের প্রতি কোনো ধরনের সম্মানজনক মনোভাব পোষণ করা তো দূরে থাক, বরং সব সময় অসম্মানজনক পথটিই খুঁজে থাকে।
মন্দিরে হামলা হলে, প্রতিমা ভাংচুর হলে ‘সন্ত্রাসী’ নামটি ব্যবহৃত হয়। প্রশ্ন হল, সমসময় দুর্বৃত্ত কিংবা সন্ত্রাসীরাই কি মূর্তি ভাঙে? সন্ত্রাস, দুর্বৃত্তায়ন আর বেছে বেছে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে মানসিকভাবে আহত করা এক ব্যাপার নয়। কারণ চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিংবা দুর্বৃত্ত বলতে এ পর্যন্ত দেশী-বিদেশী এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের কেউ মূর্তি ভেঙেছে কিংবা মন্দিরে হামলা করেছে বলে শোনা যায়নি। তাই বলা যায়, যারা এগুলো করে, তাদের সব সময় সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত কিংবা জঙ্গি আখ্যায়িত করে প্রকৃত অপরাধ ও অপরাধীর দিক থেকে দৃষ্টিকে আড়াল করার অপচেষ্টা কোনোক্রমেই বাঞ্ছনীয় নয়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমরা কেন বলতে পরি না, হিন্দুর জায়গায় হিন্দু থাকুক, মুসলমান থাকুন মুসলমানের জায়গায়, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান থাকুক তাদের নিজস্ব ধর্মীয় সামাজিক কৃষ্টির জায়গায়। ধর্মীয় আদর্শগতভাবে থাকুক না যে যার মতো করে। কী দরকার অযথা হয়রানি-বিরক্ত করে, উপাসনালয়ে ভাংচুর-হামলা করে তাদের মানসিকভাবে কষ্ট দেয়ার? অন্য ধর্মাবলম্বীরা দেশ থেকে বিতাড়িত হলেই কি নিজেদের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে? পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, কোনো বিতাড়ন, কোনো হামলা-ভাংচুর কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ হতে পারে না। মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, কারও মনে তুমি দিও না আঘাত, সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে। অথবা পাবিনারে তুই, পাবিনা খোদারে, ব্যথা দিয়ে তারি মানুষের মনে। তাই ভাঙাভাঙির এ অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন এ অপসংস্কৃতির ধারক-বাহক-পৃষ্ঠপোষক তথা লালন-পালনকারীদের অপরাধ আড়াল করার মতো হীন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা। তা না হলে ওপরে ওপরে যতই সম্প্রীতির বার্নিশ করা হোক- বিদ্বেষের ঘুণ পোকা ভেতরে ভেতরে কেটেই যাবে। জ্বালিয়ে যাবে ক্রমাগত অশান্তির আগুন। প্রতিমা ভাংচুর, হামলা অব্যাহত থাকবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে। ভেতরে ক্যান্সার রেখে ওপরে মলম পট্টিতে নিরাময় হবে না। মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন, প্রয়োজন চিন্তা-চেতনার উদারতা।
হিন্দু বাঙালি সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। দেখা যায় প্রতিটি মন্দিরে পুলিশের প্রহরা, প্রশাসনের উপস্থিতি, স্থানীয় প্রতিনিধিদের ঘনঘন নজরদারি। এসব দেখে সত্যিই খুব দুঃখ হয়। মাটির প্রতিমা, তাও প্রায় অধিকাংশ অনুদান, চাঁদা ও অনেকের সহায়তায় গড়া, তাও মাত্র কয়েক দিনের জন্য। এর জন্য এত উৎকণ্ঠা? নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার এতই আশংকা যে পাহারার জন্য পুলিশের প্রয়োজন হয়। শহরের কথা না হয় বাদই দেয়া গেল, কারণ সেখানে নানা অচেনা-অজানা মানুষের আনাগোনা। কিন্তু গ্রামে তো সবাই সবাইকে চেনে জানে, একত্রে পাশাপাশি বসবাস করা মানুষ তারা। সেখানে কে মূর্তি বা প্রতিমা ভাঙবে? কারা ভাঙবে? তাদের কি চেনা যাবে না, ধরা যাবে না? আর কেন ভাঙবে,তার কারণ উদ্ঘাটন করা কি এতই কঠিন! আসলে আন্তরিকতার অভাবেই এমনটি ঘটে। ধর্ম নিয়ে, ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। ঠিক নয় সুপরিকল্পিতভাবে কারও সংস্কৃতিতে আঘাত করাও। কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দেব-দেবীর প্রতিকৃতি তথা উপাসনার উপকরণাদি ভাংচুর করাসহ উপাসনালয়ে আগুন দেয়াটা নিঃসন্দেহে গর্হিত অপরাধ। এটি যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই নিন্দনীয় ও অমানবিক। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যতই দিন যাচ্ছে, বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কারণ প্রতিবারই দেখা যায়, নির্বাচনের ফলাফল যে দলের বিপক্ষে যায়, তারাই চড়াও হন সংখ্যালঘুদের ওপর।
আজন্ম লালিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে এ প্রেতের নৃত্য থামবে কবে? থামবে কবে এ প্রতিমা ভাংচুরের অপসংস্কৃতি? বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় তথা মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা প্রহরামুক্ত হবে কবে? নিশ্চিন্তে নিরাপত্তায় একান্তে একমনে পরমেশ্বরের আরাধনায় আর কি কোনো দিনই বসা যাবে না? এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খায় সময়ের আবর্তে। তারপরও আশা, ভরসা- সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন আবার ফিরে আসবে সম্প্রীতির সেই ঐতিহ্য, হারিয়ে যাওয়া বন্ধন। আমরা সবাই একসঙ্গে সম্মিলিতভাবে অংশ নেব দেশ ও জাতির যে কোনো উন্নয়নে। যে কোনো ব্যর্থতার গ্লানি, যে কোনো সাফল্যের আনন্দ সমানভাবে ভাগ করে নেব। এগিয়ে চলব জাতীয় জীবনের সমৃদ্ধির পথে।
নির্মল চক্রবর্তী : উত্তরবঙ্গ সংবাদের বাংলাদেশ প্রতিনিধি
প্রতিমা ভাঙার আরও কিছু বিচ্ছিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন- হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু টাউট প্রকৃতির মানুষও এর সঙ্গে জড়িত। তারা নিজেদের মধ্যে দলাদলি, কোন্দল, শরিকানা বিবাদ কিংবা নিতান্তই হিংসার বশবর্তী হয়ে স্বধর্মীয় মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নেন। প্রতিদ্বন্দ্বীকে হেয়প্রতিপন্ন কিংবা নিছক নাজেহাল করার উদ্দেশ্যে কখনও কখনও নিজেরাই তাদের ধর্মীয় বিগ্রহের প্রতিকৃতিগুলো ভেঙে চুপচাপ বসে থাকেন। যাতে করে এর দায় মুসলিম সম্প্রদায়ের কারও ঘাড়ে পড়ে, আর তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে করা হয় নাজেহাল। আবার কখনও এমনও দেখা যায়, নিজের মন্দিরের বিগ্রহ নিজেই ভেঙে পাড়া-প্রতিবেশীর নামে মামলা করা হয়েছে। সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে তাদের নাম, যারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক শত্র“। তবে এগুলো একবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এগুলোর সঙ্গে দেশে চলমান সামগ্রিক মূর্তি ভাঙার কোনো বিশেষ সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।
মূর্তি ভাঙা, প্রতিমা ভাংচুর, বিগ্রহ চুরি এবং মন্দিরে আগুন দেয়া, মন্দিরের থালাবাটি কিংবা দানের টাকা লুট করার মতো মানসিকতাসম্পন্ন শ্রেণী আলাদা। এরা নিজেদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুভূতির দিক থেকে একেবারে আঠারো আনা। অর্থাৎ পান থেকে চুন খসলেই উগ্রমূর্তি ধারণ করে। শুধু তাই নয়, ছোটখাটো বিষয়েও মীমাংসায় না গিয়ে রীতিমতো জিহাদ ঘোষণা করে বসে। প্রয়োজনে বিশেষ কোনো দিন-তারিখ ঠিক করে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যে কোনো অজুহাতেই ভাংচুর, লুটতরাজ কিংবা অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, তারা যে কোনো সংঘাতকে ধর্মের নামে জিইয়ে রাখতে চায়। এরা শুধু নিজেদের ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায় ছাড়া আর কোনো ধর্ম কিংবা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে মূলত স্বীকৃতি দেন না। তাদের প্রতি কোনো ধরনের সম্মানজনক মনোভাব পোষণ করা তো দূরে থাক, বরং সব সময় অসম্মানজনক পথটিই খুঁজে থাকে।
মন্দিরে হামলা হলে, প্রতিমা ভাংচুর হলে ‘সন্ত্রাসী’ নামটি ব্যবহৃত হয়। প্রশ্ন হল, সমসময় দুর্বৃত্ত কিংবা সন্ত্রাসীরাই কি মূর্তি ভাঙে? সন্ত্রাস, দুর্বৃত্তায়ন আর বেছে বেছে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে মানসিকভাবে আহত করা এক ব্যাপার নয়। কারণ চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিংবা দুর্বৃত্ত বলতে এ পর্যন্ত দেশী-বিদেশী এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের কেউ মূর্তি ভেঙেছে কিংবা মন্দিরে হামলা করেছে বলে শোনা যায়নি। তাই বলা যায়, যারা এগুলো করে, তাদের সব সময় সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত কিংবা জঙ্গি আখ্যায়িত করে প্রকৃত অপরাধ ও অপরাধীর দিক থেকে দৃষ্টিকে আড়াল করার অপচেষ্টা কোনোক্রমেই বাঞ্ছনীয় নয়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমরা কেন বলতে পরি না, হিন্দুর জায়গায় হিন্দু থাকুক, মুসলমান থাকুন মুসলমানের জায়গায়, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান থাকুক তাদের নিজস্ব ধর্মীয় সামাজিক কৃষ্টির জায়গায়। ধর্মীয় আদর্শগতভাবে থাকুক না যে যার মতো করে। কী দরকার অযথা হয়রানি-বিরক্ত করে, উপাসনালয়ে ভাংচুর-হামলা করে তাদের মানসিকভাবে কষ্ট দেয়ার? অন্য ধর্মাবলম্বীরা দেশ থেকে বিতাড়িত হলেই কি নিজেদের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে? পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, কোনো বিতাড়ন, কোনো হামলা-ভাংচুর কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ হতে পারে না। মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, কারও মনে তুমি দিও না আঘাত, সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে। অথবা পাবিনারে তুই, পাবিনা খোদারে, ব্যথা দিয়ে তারি মানুষের মনে। তাই ভাঙাভাঙির এ অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন এ অপসংস্কৃতির ধারক-বাহক-পৃষ্ঠপোষক তথা লালন-পালনকারীদের অপরাধ আড়াল করার মতো হীন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা। তা না হলে ওপরে ওপরে যতই সম্প্রীতির বার্নিশ করা হোক- বিদ্বেষের ঘুণ পোকা ভেতরে ভেতরে কেটেই যাবে। জ্বালিয়ে যাবে ক্রমাগত অশান্তির আগুন। প্রতিমা ভাংচুর, হামলা অব্যাহত থাকবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে। ভেতরে ক্যান্সার রেখে ওপরে মলম পট্টিতে নিরাময় হবে না। মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন, প্রয়োজন চিন্তা-চেতনার উদারতা।
হিন্দু বাঙালি সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। দেখা যায় প্রতিটি মন্দিরে পুলিশের প্রহরা, প্রশাসনের উপস্থিতি, স্থানীয় প্রতিনিধিদের ঘনঘন নজরদারি। এসব দেখে সত্যিই খুব দুঃখ হয়। মাটির প্রতিমা, তাও প্রায় অধিকাংশ অনুদান, চাঁদা ও অনেকের সহায়তায় গড়া, তাও মাত্র কয়েক দিনের জন্য। এর জন্য এত উৎকণ্ঠা? নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার এতই আশংকা যে পাহারার জন্য পুলিশের প্রয়োজন হয়। শহরের কথা না হয় বাদই দেয়া গেল, কারণ সেখানে নানা অচেনা-অজানা মানুষের আনাগোনা। কিন্তু গ্রামে তো সবাই সবাইকে চেনে জানে, একত্রে পাশাপাশি বসবাস করা মানুষ তারা। সেখানে কে মূর্তি বা প্রতিমা ভাঙবে? কারা ভাঙবে? তাদের কি চেনা যাবে না, ধরা যাবে না? আর কেন ভাঙবে,তার কারণ উদ্ঘাটন করা কি এতই কঠিন! আসলে আন্তরিকতার অভাবেই এমনটি ঘটে। ধর্ম নিয়ে, ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। ঠিক নয় সুপরিকল্পিতভাবে কারও সংস্কৃতিতে আঘাত করাও। কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দেব-দেবীর প্রতিকৃতি তথা উপাসনার উপকরণাদি ভাংচুর করাসহ উপাসনালয়ে আগুন দেয়াটা নিঃসন্দেহে গর্হিত অপরাধ। এটি যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই নিন্দনীয় ও অমানবিক। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যতই দিন যাচ্ছে, বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কারণ প্রতিবারই দেখা যায়, নির্বাচনের ফলাফল যে দলের বিপক্ষে যায়, তারাই চড়াও হন সংখ্যালঘুদের ওপর।
আজন্ম লালিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে এ প্রেতের নৃত্য থামবে কবে? থামবে কবে এ প্রতিমা ভাংচুরের অপসংস্কৃতি? বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় তথা মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা প্রহরামুক্ত হবে কবে? নিশ্চিন্তে নিরাপত্তায় একান্তে একমনে পরমেশ্বরের আরাধনায় আর কি কোনো দিনই বসা যাবে না? এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খায় সময়ের আবর্তে। তারপরও আশা, ভরসা- সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন আবার ফিরে আসবে সম্প্রীতির সেই ঐতিহ্য, হারিয়ে যাওয়া বন্ধন। আমরা সবাই একসঙ্গে সম্মিলিতভাবে অংশ নেব দেশ ও জাতির যে কোনো উন্নয়নে। যে কোনো ব্যর্থতার গ্লানি, যে কোনো সাফল্যের আনন্দ সমানভাবে ভাগ করে নেব। এগিয়ে চলব জাতীয় জীবনের সমৃদ্ধির পথে।
নির্মল চক্রবর্তী : উত্তরবঙ্গ সংবাদের বাংলাদেশ প্রতিনিধি
No comments