সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনই কাম্য

পূজা আর ঈদের ছুটির পর থেকে ১০ দিনের মাথায় সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সময় শুরু হবে। ৯০ দিন, ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারি। ২৫ অক্টোবরের আগেই পরিষ্কার হবে দুই বিবদমান রাজনৈতিক জোটের চূড়ান্ত অবস্থান। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে ২৫ অক্টোবরের পর থেকে। তবে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনী সময়সূচি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত জনমনে নির্বাচনকালীন ব্যবস্থাপনা অপরিষ্কার থাকবে। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন একবার নির্বাচনী সময়সূচি ঘোষণা করলে সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। মনে হচ্ছে, দেশের বেশির ভাগ মানুষও মনে করেন যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুধু ১৪-দলীয় জোটই একতফা নির্বাচনে প্রস্তুত। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে জাতীয় পার্টির নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একাধিকবার বলেছেন যে অন্যান্য দল অংশগ্রহণ না করলে তিনি ও তাঁর দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ‘জাতীয় বেইমান’ হতে চাইবে না। এই ঘোষণার পরও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এরশাদের কথার ওপরে বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। তবে এ কথা ঠিক যে জাতীয় পার্টির ভেতরে তত্ত্বাবধায়ক অথবা নির্দলীয় সরকারের সপক্ষেই বেশির ভাগ নেতার অবস্থান। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টিও যদি ১৪ দলের একলা চলো নীতির সঙ্গে যোগ না দেয়, তাহলে সে নির্বাচনকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অবশ্যই বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। বিশেষ করে সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল যদি অংশগ্রহণ না করে, সেই নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য হবে না। এমন নয় যে সরকারি দল এমন সরল পাঠ বোঝে না। কিন্তু খুব বিচলিত নয়। নির্বাচন হবেই এবং সেই নির্বাচন যে সরকারি দলের ছকে হবে, সেটাই এখন প্রধান বিরোধী দলের মাথাব্যথা। এ অবস্থায় বিরোধী দল ও জোট এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার প্রত্যয় খুব পরিষ্কারভাবে দেশবাসীকে জানিয়েছে। সর্বশেষ সিলেটের জনসভায় ১৮-দলীয় জোট ও বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন প্রতিহত করতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপির নেত্রীর এই হুঁশিয়ারিকে হালকাভাবে নেওয়ার অবকাশ নেই। এমনটাই যদি হয়, তবে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কী হবে, তার ফলাফল এবং ভোটার উপস্থিতি কী হবে—এ সবই অনুমেয়। এমন নির্বাচন দেশের ও গণতন্ত্রের জন্য যে মঙ্গলজনক হবে না, অন্তত ইতিহাস তা-ই বলে।
বিভিন্ন জরিপ, আলোচনা, সেমিনার এমনকি বহুল আলোচিত টক শোগুলোতে প্রশ্নকর্তারা যে ধরনের প্রশ্ন করেন, তাতে প্রতীয়মান হয় যে সংখ্যাতত্ত্বের দিকে না গেলেও এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন যে অন্তত আগামী নির্বাচন নির্দলীয় অথবা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সরকারব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে না হলে তা শান্তিপূর্ণ হবে না। এমনকি সরকারি জোটের অনেক নেতা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে সংসদ রেখে নির্বাচন ভালো ব্যবস্থা নয়। তথাপি শাসক জোট সংবিধানের আওতায় বিদ্যমান পদ্ধতিতেই নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তুতি শেষ করতে যাচ্ছে। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, সরকারি দল আগামী নির্বাচনে বিরোধী গোষ্ঠীর অবর্তমানে মাঠকর্মীদের ৫১ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কাজ করতে বলেছে। এই সংবাদ যদি সত্য হয়, তাহলে বলতেই হবে যে বাস্তবতার নিরিখে তেমনটি হওয়ার নয়। এ অবস্থায় সরকারি দল ভোটার উপস্থিতিকে বাড়িয়ে দেখালে তা হবে গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের কাছ থেকে সেটি আশা করা যায় না। এ-ও সত্য, নির্বাচনে বিএনপি ও সমর্থক দল অংশগ্রহণ না করলে ৫০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি হবে না। এই সরল অঙ্ক কষতে বড় ধরনের পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না। মহাজোটের মধ্যে সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টির।
এর মধ্যে জাতীয় পার্টি নিজের পরিচয়ে নবম জাতীয় সংসদে নির্বাচন করেছে। বাকিরা আওয়ামী লীগের প্রতীক ‘নৌকা’ নিয়ে জয়ী হয়েছেন। তবে নিজস্ব প্রতীকেও জাসদের ২৫ জন এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির তিনজন নির্বাচন করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে জাসদের তিনজন এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির দুজন সদস্য নির্বাচিত হন। এ দুই দলের মধ্যে জাসদ সমষ্টিগত প্রদত্ত ভোটের শূন্য দশমিক ৭৪ এবং ওয়ার্কার্স পার্টি শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অপর দিকে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। কাজেই ১৪-দলীয় জোটের এই তিনটি দল, যারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে, তাদের মোট ভোটের প্রাপ্ত শতাংশ ছিল ৪৯ দশমিক ২৫। অবশ্য জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ ভোট। ১৪-দলীয় জোটের বাদ বাকি পার্টির কোনোটি শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ ভোটও পায়নি। কাজেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী জোটবিবর্জিত এবং ঘোষিত বাধার মুখে ৫১ শতাংশ ভোটারের ভোট প্রদান বাস্তবিক পক্ষে কতখানি সম্ভব হবে, তা ভেবে দেখার বিষয়। স্মরণযোগ্য যে দশম জাতীয় সংসদে নিবন্ধিত দল হতে যাচ্ছে ৩৮টি আর বিএনএফ নামক সংগঠনটি যদি নিবন্ধিত হয়, তবে আরেকটি বাড়বে।
সে ক্ষেত্রে নতুন দুটি দল কতখানি ভোট টানতে পারবে, তা সহজেই অনুমেয়। মাত্র কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত হয় বরগুনা-২ আসনের উপনির্বাচন। ওই নির্বাচনে দুজন প্রার্থী প্রতিযোগিতা করেন। যার মধ্যে একজন ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের, অপরজন ছিলেন ইসলামী আন্দোলন পার্টির প্রার্থী। মোট প্রদত্ত ভোট ছিল প্রায় ৫২ শতাংশ, যার মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম সরওয়ার হিরু পেয়েছিলেন ৫৭ হাজার ৯৯৩ এবং আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী পেয়েছিলেন ৬৫ হাজার ৮১২ ভোট। ওই নির্বাচনের পর ইসলামী আন্দোলনের নেতারা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেন। তাঁদের অভিযোগ, তিনটি ইউনিয়নে ভোট প্রদানে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ভোট গ্রহণের দুই দিন পর বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থকেরা পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা করে ব্যাপক ভাঙচুর করেন বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ পরিবেশিত হয়। যদিও বিজয়ী প্রার্থী এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেন, তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবরের সত্যতা পাওয়া যায়। এর পরই ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতা চরমোনাইয়ের পীর বলেন যে বর্তমান ব্যবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে তাঁরা ভবিষ্যতে নির্বাচন করবেন না। উল্লেখ্য, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ১৬৬ জন প্রার্থী দিয়েছিল এবং প্রদত্ত মোট ভোটের ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।
কাজেই ১৪ দল এককভাবে নির্বাচন করলে ভোটের পরিসংখ্যান কেমন হবে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। ওপরের আলোচনা এবং নিরিখে প্রতীয়মান হয় যে শাসক জোট তাদের ঘোষিত উপায়ে আগামী সংসদ নির্বাচন বর্তমান সংবিধানের আওতায় নির্বাচন করে এবং জাতীয় পার্টিসহ বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করলে সে নির্বাচনে ভোটার সমাগম করানো দুরূহ কাজ হবে। তদুপরি বিরোধী জোটের ঘোষিত বিরোধিতার মুখে নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের থাকবে, তা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে। স্মরণযোগ্য যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা, বজায় রাখা এবং ভোটারদের নিরাপত্তার বিধান করা নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তাবে। ওই সময় নির্বাচন কমিশনই মুখ্য, সরকারের ভূমিকা শুধু সহযোগিতার হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কী ধরনের পরিকল্পনা নেয় তা এ মাসেই হয়তো জানা যাবে, অবশ্য নির্বাচন কমিশন যদি কোনো পরিকল্পনা করে থাকে। তারা এখনো বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। সে কারণেও বিরোধী দল বিবর্জিত নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে নির্বাচন কমিশনকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। যত দূর জানা যায়, নির্বাচন কমিশনও সংবিধানের আওতায় সংসদ রেখে নির্বাচন করাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখনো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সর্বশেষ সংশোধনীতে এ ধরনের নির্বাচনে কমিশনকে কতখানি শক্তিশালী করতে হবে তার বিধান রাখা হয়নি। এমনকি বিগত কমিশনের সুপারিশ করা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্তি হতে বাদ পড়েছে।
এ অবস্থায় শুধু আচরণবিধি দ্বারা কমিশন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে—এমন কথা খোদ কমিশনাররাও বিশ্বাস করেন কি না সন্দেহ আছে। নির্বাচন কমিশন নতুন আচরণবিধি যত দেশের বিধি দেখে তৈরি করুক না কেন, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একজন সংসদ সদস্য যেভাবে পাঁচ বছরে সর্ববিষয়ে শেষ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন, সেখানে পদে বহাল থেকে তিনি নির্বাচনে অংশ নিলে অন্যদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কঠিন হয়ে পড়বে বৈকি। স্মরণ করা যায় ক্ষমতাসীন দলের একজন ক্ষমতাধর নেতার সরকারি কর্মকর্তাদের প্রদেয় হুমকির বিষয়টি। নির্বাচন কমিশন কি এ ধরনের পরিস্থিতিতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারবে? চলমান সরকারি উদ্যোগে নির্বাচনী প্রচারণা কি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে সাহায্য করছে? নতুন বিধি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার বিষয় খাটো করে দেখার সুযোগ নেই, তবে তার প্রয়োগ কতখানি করা যাবে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। নির্বাচন কমিশন প্রতিবারই নিশ্চিত করতে চাইছে যে তারা সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে সক্ষম হবে। প্রশ্ন থাকে যে যদি ওই ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে না পারে তাহলে কী হবে? নির্বাচন কমিশন ওই পরিস্থিতিতে সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন স্থগিত করতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই রয়েছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির উপাদান। উপসংহারে বলতে চাই যে আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দল একতরফা নির্বাচন করে কতখানি লাভবান হবে, তা নিশ্চয়ই বাস্তবতার নিরিখে ভেবে দেখা প্রয়োজন। তাই একতরফা নয়, সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই কাম্য। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে নির্বাচনই গণতন্ত্রের শেষ কথা নয়, নির্বাচন গণতন্ত্রের ভিত মাত্র। ভিত নড়বড় হলে গণতন্ত্র ভেঙে পড়তে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের দায়িত্বও অপরিসীম।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.