দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কি গণতান্ত্রিক? by ড. কাজী আবদুস সামাদ
সুশাসনের
জন্য নাগরিক (সুজন) গত ২৮ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে
জানিয়েছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের
সক্ষমতা নেই। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান তো দূরের কথা,
একটি স্বাভাবিক নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও যোগ্যতা নেই। কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন
নির্বাচন আর কিছু সংসদ সদস্য পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানই নির্বাচন কমিশনের
যোগ্যতার মাপকাঠি নয়। ৩০০ আসনে দেশব্যাপী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই দিনে
অনুষ্ঠিত হয় এবং এটি একটি জাতীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটিকে সামাল দেয়া ও
ত্র“টিমুক্তভাবে সব ব্যবস্থাপনা করা অত সহজ কোনো কাজ নয়। নির্বাচন কমিশনকে
শক্তিশালী করা হয়নি এবং করা হয়নি দল নিরপেক্ষ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার
থেকে শুরু করে অন্য কমিশনারদের যোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে নানা
মহল থেকে। দেশের অভ্যন্তরে অভিজ্ঞ মহলও একই ধারণা পোষণ করে আসছেন। কিন্তু
আশ্চর্যের বিষয় হল, সরকারি দল আওয়ামী লীগ কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কোনো
সমালোচনা না করে বরং দৃঢ়তার সঙ্গে বলছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত
শক্তিশালী এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় শতভাগ সক্ষম। তার অর্থ
দাঁড়াচ্ছে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরাই তো বর্তমানে সিইসি এবং কমিশনার।
তাই তারা বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী অবশ্যই পক্ষপাতদুষ্ট। একে তো
নিরপেক্ষতার অভাব, অন্যদিকে আবার যোগ্যতারও অভাব। এই দুই সমস্যার কারণে
স্বভাবতই নির্বাচন কমিশনার নিয়ে জনমনে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে তার
সুরাহা হবে কিভাবে? সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন একেকটা একেক দিনে হয়েছে, তার
ব্যবস্থাপনা আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা কখনও এক হতে পারে না।
তাই দুই ধরনের নির্বাচনকে এক করে দেখছেন যারা, অবশ্যই তারা এক পেশে চিন্তা
করছেন।
২৯ সেপ্টেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) মত প্রকাশ করেছে, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে কখনোই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে না এবং এই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না এবং কোনো গ্রহণযোগ্যতাও পাবে না। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হলে জাতীয় সংসদ যথাসময়ে ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষও এরই মধ্যে নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কের অধীনেই নির্বাচন চায়। বিদেশী দাতা সংস্থাগুলো, জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও অন্য দেশগুলো এরই মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক পরিবেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর পুনঃপুন জোর দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারি দল এসব বক্তব্যকে কোনোরূপ গুরুত্ব না দিয়ে একতরফা নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সরকারের ভাব দেখে মনে হয়, সরকার যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ কি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মেনে নিয়েছিল? কেএম হাসান সাহেবের কি যোগ্যতার কোনো ঘাটতি ছিল? একের পর এক কতবার তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিবর্তিত হয়েছিল? একে পছন্দ হয় না, ওকে পছন্দ হয় না, এভাবে কতদিন লেগেছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পর্যন্ত গড়াতে? অর্থাৎ আওয়ামী লীগ মনে করে, তারা যা চায় তা আদায় করে নিতে পারবে, আর বিরোধী দল যা চায় তা আদায়যোগ্য নয়। তাই সরকারের আজ্ঞাবহ, অযোগ্য নির্বাচন কমিশন দিয়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। এখানে বিএনপির কোনো জোরালো বক্তব্যও কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য কী করেনি? ১৭৩ দিন হরতালসহ ধ্বংস করেছিল দেশের অর্থনীতি আর কত মানুষ যে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই।
বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে। সবাই একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন দেখতে চায়। এদেশের রাজনৈতিক অবস্থা এমনই যে, একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হল একটি শক্তিশালী নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং একটি নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এ দুটি শর্ত পূরণ হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের আর তেমন কোনো বাধা নেই। বিরোধী দল সব সময়ই এ দুটি রাষ্ট্রযন্ত্রকে সঠিক ধারায় গঠন করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। সরকারি দল অন্যদিকে বলছে, জাতীয় সংসদ বহাল রেখে প্রধানমন্ত্রী তার পদে আসীন অবস্থাতেই নাকি সুন্দর, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে বলে এসেছেন, দেশে সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তিনি জাতিসংঘকে বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে আগাম অনুরোধ জানিয়ে এসেছেন। যেখানে গোটা বিশ্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে আস্থাশীল হতে পারছে না, সেখানে সরকারি দল ও মহাজোট এ ব্যাপারে কিভাবে আস্থাশীল হচ্ছে, তা কেউ বুঝতে পারছে না। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন চায়, সেটা কি সরকারি দলের কাছে কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না? সরকারি দল এ পরিস্থিতিতে কিভাবে আশা করে যে, একদলীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যেনতেন করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে? জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকা? সেও কি এ যুগে সম্ভব?
আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত কয়েক দিনে যে ভাষায় কথা বলেছেন তা গণতন্ত্র থেকে যোজন যোজন দূরে। তিনি বলেছেন, সরকারি কর্তাব্যক্তিরা সরকারের কথামতো কাজ না করলে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অর্থাৎ সরকারের অভিপ্রায় মোতাবেক তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকার মতো করে সাজানো নির্বাচনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে, অন্যথায় গুরু শাস্তি হিসেবে বাড়িতে ফেরত যেতে হবে। কোনো সভ্য সমাজে কিংবা দেশে মানুষ এ ভাষায় কথা বলেছে? এটা কি গণতন্ত্রের ভাষা? বরং যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশেষ বিশেষ লোকদের ক্ষমতায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়, তারা দেশদ্রোহী। এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মোহাম্মদ নাসিম আরও বলেছেন, কেয়ামত হয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। কথা হচ্ছে, দলীয় সরকার এখন এত জনপ্রিয় একটি মতবাদ হল কেন? কোনো মানুষ যদি এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে ভাবে জগতের সব প্রাণীরই আত্মহত্যা করা সমীচীন। এটিই মুক্তির একমাত্র সোপান, একমাত্র পথ। বিকল্প বলে কিছু নেই। সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপিদের কথা শুনে সেই আত্মহত্যারই কথা মনে হয়। এর থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারছেন না এবং বিকল্পও দেখছেন না। আসলে সরকারি দলের কাছে ক্ষমতাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার কোনো মূল্য নেই। সংঘাত, সংকটময় পরিস্থিতি যে কারও কাম্য নয়, এটা বিবেচনায় নিচ্ছে না সরকারি দল। জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল তৃতীয়বারের মতো চ্যান্সেলর নির্বাচিত হলেন সপ্তাহখানেক আগে। অর্থাৎ ৮ বছর সফল রাজনীতির বখশিশ হিসেবে ওই দেশের জনগণ তাকে আরও ৪ বছরের জন্য এই পদে আসীন রেখেছেন। তার আগে তার অগ্রজ রাজনীতিক ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি হেলমুট কোহল পরপর সর্বোচ্চ ৪ টার্ম (মোট ১৬ বছর) চ্যান্সেলর পদে আসীন ছিলেন। জার্মানি এমনই একটি দেশ। কই সেখানে নির্বাচনের আগে বিরোধী দল তো কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা নিয়ে কোনো কথা বলেনি। নির্বাচনের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে, জনগণ যাকে খুশি তাকে ভোট দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছেন। এটাকেই বলে গণতন্ত্র। জোর করে কেউ ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। আর এটাও ঠিক যে, শুধু নির্বাচনী কৌশলই নির্বাচনে জেতা কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র নিয়ামক নয়। জনকল্যাণমুখী রাজনীতিই হতে পারে এক্ষেত্রে সহায়ক একটি নিয়ামক। সরকার যতই চেষ্টা করুক না কেন, তাদের সাজানো নাটক মঞ্চায়ন করার আগেই মঞ্চ ভেঙে পড়বে। বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, সরকারের মন্ত্রী, এমপিদেরই বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। নির্বাচনকে ঘিরে জনগণের উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের কোনো শেষ নেই। শুধু যে এদেশের জনগণই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে তাই নয়, বিশ্বব্যাপী বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সরকারি দল সংশ্লিষ্ট দেশী-বিদেশী সব সংস্থা/এজেন্সিকে প্রত্যাখ্যান করছে কেন? সবাইকে প্রত্যাখ্যান করে একেবারে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় জোর করে টিকে থেকে কি ফায়দা হাসিল করা যাবে? নাকি গণতান্ত্রিক ভাবধারায় উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনমতের ওপর আস্থা স্থাপন করা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত? আমাদের নেতানেত্রীরা গণতন্ত্র বলতে কী বোঝেন? বিশ্ব সভ্যতা, বিশ্বের ইতিহাস কি তাদের জানা নেই? তারা কি এমনি এমনি নেতানেত্রী হয়েছেন? দেশের স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র সাড়ে ৩ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আসতে ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগ কি সেই ইতিহাস ভুলে গেছে? আওয়ামী লীগ একটি ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে? অশুভ ঘোর থেকে দলটি যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসবে এবং যত তাড়াতাড়ি জনমতকে আস্থায় নিয়ে একটি সর্বজনীন, দেশী-বিদেশী সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করবে, দেশের জন্য ততই মঙ্গল হবে।
ড. কাজী আবদুস সামাদ : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
২৯ সেপ্টেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) মত প্রকাশ করেছে, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে কখনোই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে না এবং এই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না এবং কোনো গ্রহণযোগ্যতাও পাবে না। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হলে জাতীয় সংসদ যথাসময়ে ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষও এরই মধ্যে নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কের অধীনেই নির্বাচন চায়। বিদেশী দাতা সংস্থাগুলো, জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও অন্য দেশগুলো এরই মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক পরিবেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর পুনঃপুন জোর দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারি দল এসব বক্তব্যকে কোনোরূপ গুরুত্ব না দিয়ে একতরফা নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সরকারের ভাব দেখে মনে হয়, সরকার যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ কি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মেনে নিয়েছিল? কেএম হাসান সাহেবের কি যোগ্যতার কোনো ঘাটতি ছিল? একের পর এক কতবার তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিবর্তিত হয়েছিল? একে পছন্দ হয় না, ওকে পছন্দ হয় না, এভাবে কতদিন লেগেছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পর্যন্ত গড়াতে? অর্থাৎ আওয়ামী লীগ মনে করে, তারা যা চায় তা আদায় করে নিতে পারবে, আর বিরোধী দল যা চায় তা আদায়যোগ্য নয়। তাই সরকারের আজ্ঞাবহ, অযোগ্য নির্বাচন কমিশন দিয়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। এখানে বিএনপির কোনো জোরালো বক্তব্যও কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য কী করেনি? ১৭৩ দিন হরতালসহ ধ্বংস করেছিল দেশের অর্থনীতি আর কত মানুষ যে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই।
বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে। সবাই একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন দেখতে চায়। এদেশের রাজনৈতিক অবস্থা এমনই যে, একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হল একটি শক্তিশালী নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং একটি নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এ দুটি শর্ত পূরণ হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের আর তেমন কোনো বাধা নেই। বিরোধী দল সব সময়ই এ দুটি রাষ্ট্রযন্ত্রকে সঠিক ধারায় গঠন করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। সরকারি দল অন্যদিকে বলছে, জাতীয় সংসদ বহাল রেখে প্রধানমন্ত্রী তার পদে আসীন অবস্থাতেই নাকি সুন্দর, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে বলে এসেছেন, দেশে সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তিনি জাতিসংঘকে বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে আগাম অনুরোধ জানিয়ে এসেছেন। যেখানে গোটা বিশ্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে আস্থাশীল হতে পারছে না, সেখানে সরকারি দল ও মহাজোট এ ব্যাপারে কিভাবে আস্থাশীল হচ্ছে, তা কেউ বুঝতে পারছে না। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন চায়, সেটা কি সরকারি দলের কাছে কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না? সরকারি দল এ পরিস্থিতিতে কিভাবে আশা করে যে, একদলীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যেনতেন করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে? জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকা? সেও কি এ যুগে সম্ভব?
আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত কয়েক দিনে যে ভাষায় কথা বলেছেন তা গণতন্ত্র থেকে যোজন যোজন দূরে। তিনি বলেছেন, সরকারি কর্তাব্যক্তিরা সরকারের কথামতো কাজ না করলে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অর্থাৎ সরকারের অভিপ্রায় মোতাবেক তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকার মতো করে সাজানো নির্বাচনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে, অন্যথায় গুরু শাস্তি হিসেবে বাড়িতে ফেরত যেতে হবে। কোনো সভ্য সমাজে কিংবা দেশে মানুষ এ ভাষায় কথা বলেছে? এটা কি গণতন্ত্রের ভাষা? বরং যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশেষ বিশেষ লোকদের ক্ষমতায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়, তারা দেশদ্রোহী। এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মোহাম্মদ নাসিম আরও বলেছেন, কেয়ামত হয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। কথা হচ্ছে, দলীয় সরকার এখন এত জনপ্রিয় একটি মতবাদ হল কেন? কোনো মানুষ যদি এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে ভাবে জগতের সব প্রাণীরই আত্মহত্যা করা সমীচীন। এটিই মুক্তির একমাত্র সোপান, একমাত্র পথ। বিকল্প বলে কিছু নেই। সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপিদের কথা শুনে সেই আত্মহত্যারই কথা মনে হয়। এর থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারছেন না এবং বিকল্পও দেখছেন না। আসলে সরকারি দলের কাছে ক্ষমতাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার কোনো মূল্য নেই। সংঘাত, সংকটময় পরিস্থিতি যে কারও কাম্য নয়, এটা বিবেচনায় নিচ্ছে না সরকারি দল। জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল তৃতীয়বারের মতো চ্যান্সেলর নির্বাচিত হলেন সপ্তাহখানেক আগে। অর্থাৎ ৮ বছর সফল রাজনীতির বখশিশ হিসেবে ওই দেশের জনগণ তাকে আরও ৪ বছরের জন্য এই পদে আসীন রেখেছেন। তার আগে তার অগ্রজ রাজনীতিক ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি হেলমুট কোহল পরপর সর্বোচ্চ ৪ টার্ম (মোট ১৬ বছর) চ্যান্সেলর পদে আসীন ছিলেন। জার্মানি এমনই একটি দেশ। কই সেখানে নির্বাচনের আগে বিরোধী দল তো কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা নিয়ে কোনো কথা বলেনি। নির্বাচনের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে, জনগণ যাকে খুশি তাকে ভোট দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছেন। এটাকেই বলে গণতন্ত্র। জোর করে কেউ ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। আর এটাও ঠিক যে, শুধু নির্বাচনী কৌশলই নির্বাচনে জেতা কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র নিয়ামক নয়। জনকল্যাণমুখী রাজনীতিই হতে পারে এক্ষেত্রে সহায়ক একটি নিয়ামক। সরকার যতই চেষ্টা করুক না কেন, তাদের সাজানো নাটক মঞ্চায়ন করার আগেই মঞ্চ ভেঙে পড়বে। বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, সরকারের মন্ত্রী, এমপিদেরই বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। নির্বাচনকে ঘিরে জনগণের উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের কোনো শেষ নেই। শুধু যে এদেশের জনগণই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে তাই নয়, বিশ্বব্যাপী বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সরকারি দল সংশ্লিষ্ট দেশী-বিদেশী সব সংস্থা/এজেন্সিকে প্রত্যাখ্যান করছে কেন? সবাইকে প্রত্যাখ্যান করে একেবারে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় জোর করে টিকে থেকে কি ফায়দা হাসিল করা যাবে? নাকি গণতান্ত্রিক ভাবধারায় উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনমতের ওপর আস্থা স্থাপন করা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত? আমাদের নেতানেত্রীরা গণতন্ত্র বলতে কী বোঝেন? বিশ্ব সভ্যতা, বিশ্বের ইতিহাস কি তাদের জানা নেই? তারা কি এমনি এমনি নেতানেত্রী হয়েছেন? দেশের স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র সাড়ে ৩ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আসতে ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগ কি সেই ইতিহাস ভুলে গেছে? আওয়ামী লীগ একটি ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে? অশুভ ঘোর থেকে দলটি যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসবে এবং যত তাড়াতাড়ি জনমতকে আস্থায় নিয়ে একটি সর্বজনীন, দেশী-বিদেশী সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করবে, দেশের জন্য ততই মঙ্গল হবে।
ড. কাজী আবদুস সামাদ : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments