দোহাই রাজনীতি- তুমি আর নিচে নেমো না by মোকাম্মেল হোসেন
অষ্টধার
উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শমসের সাহেব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। এ
ধরনের মানুষরা সাধারণত শব্দ করে হাসেন না। আজ তাকে হো হো করে হেসে উঠতে
দেখা গেল। ঘটনাটা ঘটল ইন্টারভিউ বোর্ডে। স্কুলে একজন বিজ্ঞান শিক্ষক নেয়া
হবে। ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত দৈনিক জাহান পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়ার
পর মোট আটজন প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষা দিতে হাজির হয়েছেন। তাদের মধ্যে নকলা
উপজেলা থেকে আসা প্রার্থীকে শমসের সাহেব জিজ্ঞেস করলেন-
: আপনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান কেন?
উত্তরে সেই প্রার্থী নিরীহ ভঙ্গিতে জানালেন-
: স্যার, শিক্ষক হওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। কিন্তু ইচ্ছা না থাকলেও শিক্ষক হয়েই আমাকে জীবন কাটাতে হবে। কারণ এটা আমার নিয়তি।
শমসের সাহেব বিষয়টির ব্যাখ্যা দাবি করলে প্রার্থী বললেন-
: স্যার, ছাত্রজীবনে আমি একবার ইতরামি করে এক বিধবা মহিলার বাড়ির উঠানের শসা গাছের প্রথম শসাটি চুরি করে খেয়ে ফেলেছিলাম। ঘটনাটা পরে জানাজানি হয়ে যায় আর সেই বিধবা আমাকে একদিন সামনে পেয়ে সুর করে বলে ওঠে-
চাইয়া খাইলে খাওয়া হয় মায়ের বুকের দুধ।
চুরি করলে খাওয়া হয় ছাগলের মুত
মহিলার কথা শুনে আমি খুবই লজ্জা পেলাম এবং তাকে তার কথা ফিরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানালাম। সে তখন বলল, এক শর্তে সে তার কথা ফিরিয়ে নিতে রাজি আছে। শর্তটা হল, বড় হয়ে আমাকে শিক্ষক হতে হবে আর চুরি করা যে খারাপ কাজ এটা ছাত্রদের বোঝাতে হবে।
নকলার এই প্রার্থীর নাম শামসুল হক। শেষ পর্যন্ত অষ্টধার স্কুলে শামসুল হকের চাকরিটা হয়ে গেল। চাকরিতে যোগদানের পর শামসুল হক ক্লাস টেন-এ পদার্থ বিজ্ঞানের ক্লাস নিতে গেলেন। প্রাথমিক আলাপ পরিচয় শেষে পাঠ্যসূচি অনুযায়ী শামসুল হক পদার্থের রূপান্তর সম্পর্কে ছাত্রদের পাঠদান শুরু করলেন। তিনি পানির উদাহরণ দিয়ে বললেন-
: পানি সাধারণ অবস্থায় তরল থাকে। তরল পানিকে তাপ দিলে বাষ্পে পরিণত হয়। আবার নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা করলে বরফের আকার ধারণ করে।
এবার ছাত্রদের পালা। শামসুল হক ছাত্রদের কাছে জানতে চাইলেন-
: পদার্থের রূপান্তর সম্পর্কে তোমরা কেউ নতুন কোনো উদাহরণ দিতে পারবা?
শামসুল হকের আহ্বানে হুরমুজ আলী নামের এক ছাত্র সাড়া দিল। হুরমুজ ছাত্র হিসেবে খারাপ না, তবে সুযোগ পেলে ফজুল টাইপের কথাবার্তা বলতে সংকোচ বোধ করে না। সে প্রথমেই শামসুল হকের কাছে জানতে চাইল-
: স্যার, চুল কি একটা পদার্থ?
কাঁধ ঝাঁকিয়ে শামসুল হক উত্তর দিলেন-
: যদি আকার, আয়তন ও ওজন বিবেচনায় আনা হয়, তাহলে চুল অবশ্যই একটা পদার্থ।
শামসুল হকের উত্তর শুনে হুরমুজ আলী বলল-
: স্যার, আমি এই পদার্থের রূপান্তর সম্পর্কে বলতে চাই।
-গুড। বল...
: এটা যখন আমাদের মাথায় থাকে তখন আমরা তাকে চুল বলি।
-অফকোর্স বলি।
: চোখের ওপরে থাকলে ভ্রু আর চোখের পাতায় থাকলে পাপড়ি বলি।
-রাইট।
: এটা যখন মুখমণ্ডলে থাকে তখন আমরা তাকে দাড়ি ও গোঁফ বলি।
-দাড়ি অ্যান্ড গোঁফ? হ্যাঁ, ঠিক আছে।
: এরপর বগলে ও বুকে যখন থাকে, তাকে বলা হয় লোম।
-বগল ও বুক- হুম, ইউ আর কারেক্ট।
: এরপর...
হুরমুজ আলী এ পর্যন্ত বলতেই শামসুল হক আঁতকে উঠে ছাত্রদের দিকে তাকালেন। দেখলেন- ছাত্ররা হাঁ করে হুরমুজ আলীর কথা গিলছে। তিনি অতি দ্রুত হুরমুজ আলীকে থামার নির্দেশ দিয়ে বললেন-
: স্টপ, স্টপ- আই আন্ডারস্ট্যান্ড! তোমাকে আর নিচে নামতে হবে না...
দেশের রাজনীতিতে চুল নিয়ে হঠাৎ ধাক্কাধাক্কি শুরু হওয়ার পর মনে হয়েছিল- এর স্থায়িত্ব এক-দুই দিনের বেশি হবে না। কিন্তু পরে দেখা গেল এটা রাবারের মতো লম্বা হতে শুরু করেছে। ব্যাপার দেখে আমার ভয় হল- শেষে বিষয়টি গালাগাল পর্যন্ত না গড়ায়। গালাগালের কথা মনে হতেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা ভয়াবহ স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এরশাদ সরকারের শাসনামলের মাঝামাঝি সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সংযুক্তি অনুযায়ী হাজী মুহম্মদ মহসিন হলে সিট পাওয়ার চেষ্টা করছি। স্বাভাবিক নিয়মে কিছু না হওয়ায় শেষে ময়মনসিংহের এক পাতি ছাত্রনেতার শরণাপন্ন হলাম। তিনি আমাকে তার কক্ষের মেঝেতে রাতযাপনের অনুমতি দিলেন। ঘুমিয়ে আছি- মাঝরাতে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ভয় পেয়ে উঠে বসলাম। নেতাকে খুবই উত্তেজিত মনে হল। দেখলাম- তিনি লাফ দিয়ে জানালার পাশে খাটের ওপর উঠছেন। কামানের গোলার মতো ফটফট করে কিছুক্ষণ গালাগাল বর্ষণের পর আবার নিচে নেমে আসছেন। গালাগালগুলোর মধ্যে কিছু ছিল এরকম-
‘ওই মাঙ্গির পুতেরা, বেশি ফাল পারিছ না। ধরলে কিন্তু কাঁচা খাইয়া ফালবাম- ন্যাংটা কইরা ছাইড়া দিয়াম। সাহস থাকলে ওইখানে ফালাফালি না কইরা এইমুড়া আয়...’
এইমুড়া আয় মানে এদিকে আয়। মহসিন হলের পাশেই বড়সড় একটা মাঠ। মাঠের পরে রাস্তা। রাস্তার ওপাশে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। সেসময় জহুরুল হক হল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনের ঘাঁটি আর আর মহসিন হল বিএনপির ছাত্রসংগঠনের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। দুই দলের অনুসারীরা একে অপরের উদ্দেশে গালি বিনিময় শুরু করার পর মনে হল, কে কার চেয়ে আরও মারাত্মক অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করতে পারে- তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কিছু গালাগাল ছিল অজু নষ্ট করে দেয়ার মতো। উত্তেজনা দমন করতে না পেরে এক পর্যায়ে আমার আশ্রয়দাতা নেতা দলবল নিয়ে ছাদে চলে গেলেন। অবস্থা দেখে অসহায়ের মতো মনে মনে বললাম- এ আমি কোথায় এসে পড়লাম!
উক্ত ঘটনার পর ২৫-২৬ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়কালে পৃথিবী সূর্যকে অসংখ্যবার প্রদক্ষিণ করেছে। সাগর-মহাসাগরে অজস বার জোয়ার-ভাটা সংঘটিত হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রুচিবোধের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মানুষ আরও বেশি জ্ঞানী, মার্জিত, সংস্কৃতিবান ও সভ্য হয়েছে। অথচ কী আশ্চর্য! দুই যুগেরও বেশি সময় আগে গালাগালের যে সংস্কৃতি আমি মাঝরাতে আমাদের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ করেছিলাম- তা থেকে মুক্তি তো মেলেইনি বরং তার বিস্তার ঘটতে ঘটতে জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক সুশীতল জাতীয় সংসদ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
জাতীয় সংসদে গালাগালের চর্চা হতে দেখে অনেকেই অনেক রকম ভাবেন। অন্যরকম চিন্তা করেন। যে যাই ভাবুক, জাতি গঠনে রাজনীতি বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কোনো বিকল্প কিছু আছে কি? অথচ রাজনীতি এখন যে ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে তাতে এ জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করলে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। আমার আব্বা বলেন, শিয়ালের পেট থেকে শিয়ালের বাচ্চাই হয়, সিংহের বাচ্চা হয় না। আমাদের রাজনীতি এখন শিয়ালের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এই হুক্কাহুয়ার আখড়া থেকে আসা দিকনির্দেশনায় আদর্শ জাতি গঠনের কাজ সম্পন্ন হবে কীভাবে?
রাজনীতির এই দুরবস্থার কারণ পেশাদার রাজনীতিবিদের অভাব। একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে গেছি। মা-বাবারা তাদের আণ্ডা-বাচ্চা নিয়ে সে অনুষ্ঠানে এসেছেন। খাওয়া-দাওয়ার আগে সবাই গোল হয়ে বসে সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। হঠাৎ ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার প্রসঙ্গ উঠল। একেক বাবা-মা তার সন্তান মেধা ও বুদ্ধিমত্তায় কতটা চৌকস- তা অন্যদের কাছে তুলে ধরে গর্ব করছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় এক শিশুকে একজন জিজ্ঞেস করলেন-
: সোনামণি, বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?
-ডাক্তার।
এরপর আরেকজন অন্য একটি শিশুর কাছে জানতে চাইলেন-
: বেবি, তুমি কী হতে চাও?
-ইঞ্জিনিয়ার।
শিশুরা ভবিষ্যতে কে কি হতে চায়- এ ব্যাপারে জানার আগ্রহ সবারই দেখলাম প্রবল। তাদের কাতারে শামিল হয়ে আমিও একজনকে জিজ্ঞেস করলাম-
: মা জননী, বড় হইয়া তুমি কী হইতে চাও?
-পাইলট।
সেদিনের সে অনুষ্ঠানে শিশুরা বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, জজ, ব্যারিস্টার, শিক্ষক, ব্যাংকার ইত্যাদি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেও নট অ্যা সিঙ্গেল- একটি শিশুও উচ্চারণ করল না, বড় হয়ে সে রাজনীতিবিদ হতে চায়। বিষয়টি নিয়ে আরও বড় পরিসরে যাওয়া যাক। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর কৃতী ছাত্রছাত্রীদের কাছে সংবাদকর্মীরা তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চায়। সেখান থেকেও একই রকম উত্তর আসে। মেধাবীরা অবশ্যই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। তবে তাদের মূল্যায়ন করার জন্য, তাদের সৃজনশীলতার সহযোগী হওয়ার কিছু মেধাবী রাজনীতিবিদও তো দরকার! গাড়ির সব চাকা সমান না হলে রাস্তায় চলা অসম্ভব। তেমনি একটি জাতি যত মেধাবীই হোক, রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্তদের সঙ্গে অন্যদের চিন্তার সমন্বয় না ঘটলে বিপর্যয় অনিবার্য। এ ধরনের বিপর্যয়কে আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয়- আউলা লাগা। বর্তমানে আমরা এই আউলার মধ্যে বসবাস করছি। এই আউলা রাজ্যে কেউ রাজনীতিবিদ হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে জীবন শুরু করে না। কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারে, রাজনীতির মধ্যে যে মধু আছে তা আর অন্য কোথাও নেই, তখন সে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে দেখা যায়, শিক্ষক শিক্ষকতায় মন না দিয়ে রাজনীতির পেছনে ছুটছে, চাকরিজীবী তার চাকরিকে বগলে রেখে রাজনীতির ঢোল বাজাচ্ছে। অর্থাৎ রাজমিস্ত্রির কাজ জোগালি করছে, দারোগার কাজ করছে দফাদার আর কাঠমিস্ত্রির কাজ করছে কামার। কাঠমিস্ত্রির কাজ কামার করলে যে কোনো শিল্পকর্ম ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আমাদের রাজনীতিতে এই ফাটাফাটির কারবারই চলছে। রাজনীতি যে একটা শিল্প, এই শিল্প যে যতœ, নৈপুণ্য ও সৃজনশীলতা দাবি করে, চলমান রাজনীতিতে তার অনুপস্থিতি প্রকট। ফলে এর অধঃপতন রোধ করা যাচ্ছে না। এরকম পরিস্থিতিতে আমরা যারা রাজনীতির বাইরে আছি অথচ যাদের জীবন রাজনীতির সুফল ও কুফলের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত, তারা রাজনীতির কাছে করজোড়ে একটাই মিনতি জানাতে পারি- হে রাজনীতি, তুমি আর নিচে নেমো না।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
: আপনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান কেন?
উত্তরে সেই প্রার্থী নিরীহ ভঙ্গিতে জানালেন-
: স্যার, শিক্ষক হওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। কিন্তু ইচ্ছা না থাকলেও শিক্ষক হয়েই আমাকে জীবন কাটাতে হবে। কারণ এটা আমার নিয়তি।
শমসের সাহেব বিষয়টির ব্যাখ্যা দাবি করলে প্রার্থী বললেন-
: স্যার, ছাত্রজীবনে আমি একবার ইতরামি করে এক বিধবা মহিলার বাড়ির উঠানের শসা গাছের প্রথম শসাটি চুরি করে খেয়ে ফেলেছিলাম। ঘটনাটা পরে জানাজানি হয়ে যায় আর সেই বিধবা আমাকে একদিন সামনে পেয়ে সুর করে বলে ওঠে-
চাইয়া খাইলে খাওয়া হয় মায়ের বুকের দুধ।
চুরি করলে খাওয়া হয় ছাগলের মুত
মহিলার কথা শুনে আমি খুবই লজ্জা পেলাম এবং তাকে তার কথা ফিরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানালাম। সে তখন বলল, এক শর্তে সে তার কথা ফিরিয়ে নিতে রাজি আছে। শর্তটা হল, বড় হয়ে আমাকে শিক্ষক হতে হবে আর চুরি করা যে খারাপ কাজ এটা ছাত্রদের বোঝাতে হবে।
নকলার এই প্রার্থীর নাম শামসুল হক। শেষ পর্যন্ত অষ্টধার স্কুলে শামসুল হকের চাকরিটা হয়ে গেল। চাকরিতে যোগদানের পর শামসুল হক ক্লাস টেন-এ পদার্থ বিজ্ঞানের ক্লাস নিতে গেলেন। প্রাথমিক আলাপ পরিচয় শেষে পাঠ্যসূচি অনুযায়ী শামসুল হক পদার্থের রূপান্তর সম্পর্কে ছাত্রদের পাঠদান শুরু করলেন। তিনি পানির উদাহরণ দিয়ে বললেন-
: পানি সাধারণ অবস্থায় তরল থাকে। তরল পানিকে তাপ দিলে বাষ্পে পরিণত হয়। আবার নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা করলে বরফের আকার ধারণ করে।
এবার ছাত্রদের পালা। শামসুল হক ছাত্রদের কাছে জানতে চাইলেন-
: পদার্থের রূপান্তর সম্পর্কে তোমরা কেউ নতুন কোনো উদাহরণ দিতে পারবা?
শামসুল হকের আহ্বানে হুরমুজ আলী নামের এক ছাত্র সাড়া দিল। হুরমুজ ছাত্র হিসেবে খারাপ না, তবে সুযোগ পেলে ফজুল টাইপের কথাবার্তা বলতে সংকোচ বোধ করে না। সে প্রথমেই শামসুল হকের কাছে জানতে চাইল-
: স্যার, চুল কি একটা পদার্থ?
কাঁধ ঝাঁকিয়ে শামসুল হক উত্তর দিলেন-
: যদি আকার, আয়তন ও ওজন বিবেচনায় আনা হয়, তাহলে চুল অবশ্যই একটা পদার্থ।
শামসুল হকের উত্তর শুনে হুরমুজ আলী বলল-
: স্যার, আমি এই পদার্থের রূপান্তর সম্পর্কে বলতে চাই।
-গুড। বল...
: এটা যখন আমাদের মাথায় থাকে তখন আমরা তাকে চুল বলি।
-অফকোর্স বলি।
: চোখের ওপরে থাকলে ভ্রু আর চোখের পাতায় থাকলে পাপড়ি বলি।
-রাইট।
: এটা যখন মুখমণ্ডলে থাকে তখন আমরা তাকে দাড়ি ও গোঁফ বলি।
-দাড়ি অ্যান্ড গোঁফ? হ্যাঁ, ঠিক আছে।
: এরপর বগলে ও বুকে যখন থাকে, তাকে বলা হয় লোম।
-বগল ও বুক- হুম, ইউ আর কারেক্ট।
: এরপর...
হুরমুজ আলী এ পর্যন্ত বলতেই শামসুল হক আঁতকে উঠে ছাত্রদের দিকে তাকালেন। দেখলেন- ছাত্ররা হাঁ করে হুরমুজ আলীর কথা গিলছে। তিনি অতি দ্রুত হুরমুজ আলীকে থামার নির্দেশ দিয়ে বললেন-
: স্টপ, স্টপ- আই আন্ডারস্ট্যান্ড! তোমাকে আর নিচে নামতে হবে না...
দেশের রাজনীতিতে চুল নিয়ে হঠাৎ ধাক্কাধাক্কি শুরু হওয়ার পর মনে হয়েছিল- এর স্থায়িত্ব এক-দুই দিনের বেশি হবে না। কিন্তু পরে দেখা গেল এটা রাবারের মতো লম্বা হতে শুরু করেছে। ব্যাপার দেখে আমার ভয় হল- শেষে বিষয়টি গালাগাল পর্যন্ত না গড়ায়। গালাগালের কথা মনে হতেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা ভয়াবহ স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এরশাদ সরকারের শাসনামলের মাঝামাঝি সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সংযুক্তি অনুযায়ী হাজী মুহম্মদ মহসিন হলে সিট পাওয়ার চেষ্টা করছি। স্বাভাবিক নিয়মে কিছু না হওয়ায় শেষে ময়মনসিংহের এক পাতি ছাত্রনেতার শরণাপন্ন হলাম। তিনি আমাকে তার কক্ষের মেঝেতে রাতযাপনের অনুমতি দিলেন। ঘুমিয়ে আছি- মাঝরাতে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ভয় পেয়ে উঠে বসলাম। নেতাকে খুবই উত্তেজিত মনে হল। দেখলাম- তিনি লাফ দিয়ে জানালার পাশে খাটের ওপর উঠছেন। কামানের গোলার মতো ফটফট করে কিছুক্ষণ গালাগাল বর্ষণের পর আবার নিচে নেমে আসছেন। গালাগালগুলোর মধ্যে কিছু ছিল এরকম-
‘ওই মাঙ্গির পুতেরা, বেশি ফাল পারিছ না। ধরলে কিন্তু কাঁচা খাইয়া ফালবাম- ন্যাংটা কইরা ছাইড়া দিয়াম। সাহস থাকলে ওইখানে ফালাফালি না কইরা এইমুড়া আয়...’
এইমুড়া আয় মানে এদিকে আয়। মহসিন হলের পাশেই বড়সড় একটা মাঠ। মাঠের পরে রাস্তা। রাস্তার ওপাশে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। সেসময় জহুরুল হক হল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনের ঘাঁটি আর আর মহসিন হল বিএনপির ছাত্রসংগঠনের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। দুই দলের অনুসারীরা একে অপরের উদ্দেশে গালি বিনিময় শুরু করার পর মনে হল, কে কার চেয়ে আরও মারাত্মক অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করতে পারে- তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কিছু গালাগাল ছিল অজু নষ্ট করে দেয়ার মতো। উত্তেজনা দমন করতে না পেরে এক পর্যায়ে আমার আশ্রয়দাতা নেতা দলবল নিয়ে ছাদে চলে গেলেন। অবস্থা দেখে অসহায়ের মতো মনে মনে বললাম- এ আমি কোথায় এসে পড়লাম!
উক্ত ঘটনার পর ২৫-২৬ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়কালে পৃথিবী সূর্যকে অসংখ্যবার প্রদক্ষিণ করেছে। সাগর-মহাসাগরে অজস বার জোয়ার-ভাটা সংঘটিত হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রুচিবোধের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মানুষ আরও বেশি জ্ঞানী, মার্জিত, সংস্কৃতিবান ও সভ্য হয়েছে। অথচ কী আশ্চর্য! দুই যুগেরও বেশি সময় আগে গালাগালের যে সংস্কৃতি আমি মাঝরাতে আমাদের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ করেছিলাম- তা থেকে মুক্তি তো মেলেইনি বরং তার বিস্তার ঘটতে ঘটতে জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক সুশীতল জাতীয় সংসদ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
জাতীয় সংসদে গালাগালের চর্চা হতে দেখে অনেকেই অনেক রকম ভাবেন। অন্যরকম চিন্তা করেন। যে যাই ভাবুক, জাতি গঠনে রাজনীতি বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কোনো বিকল্প কিছু আছে কি? অথচ রাজনীতি এখন যে ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে তাতে এ জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করলে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। আমার আব্বা বলেন, শিয়ালের পেট থেকে শিয়ালের বাচ্চাই হয়, সিংহের বাচ্চা হয় না। আমাদের রাজনীতি এখন শিয়ালের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এই হুক্কাহুয়ার আখড়া থেকে আসা দিকনির্দেশনায় আদর্শ জাতি গঠনের কাজ সম্পন্ন হবে কীভাবে?
রাজনীতির এই দুরবস্থার কারণ পেশাদার রাজনীতিবিদের অভাব। একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে গেছি। মা-বাবারা তাদের আণ্ডা-বাচ্চা নিয়ে সে অনুষ্ঠানে এসেছেন। খাওয়া-দাওয়ার আগে সবাই গোল হয়ে বসে সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। হঠাৎ ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার প্রসঙ্গ উঠল। একেক বাবা-মা তার সন্তান মেধা ও বুদ্ধিমত্তায় কতটা চৌকস- তা অন্যদের কাছে তুলে ধরে গর্ব করছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় এক শিশুকে একজন জিজ্ঞেস করলেন-
: সোনামণি, বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?
-ডাক্তার।
এরপর আরেকজন অন্য একটি শিশুর কাছে জানতে চাইলেন-
: বেবি, তুমি কী হতে চাও?
-ইঞ্জিনিয়ার।
শিশুরা ভবিষ্যতে কে কি হতে চায়- এ ব্যাপারে জানার আগ্রহ সবারই দেখলাম প্রবল। তাদের কাতারে শামিল হয়ে আমিও একজনকে জিজ্ঞেস করলাম-
: মা জননী, বড় হইয়া তুমি কী হইতে চাও?
-পাইলট।
সেদিনের সে অনুষ্ঠানে শিশুরা বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, জজ, ব্যারিস্টার, শিক্ষক, ব্যাংকার ইত্যাদি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেও নট অ্যা সিঙ্গেল- একটি শিশুও উচ্চারণ করল না, বড় হয়ে সে রাজনীতিবিদ হতে চায়। বিষয়টি নিয়ে আরও বড় পরিসরে যাওয়া যাক। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর কৃতী ছাত্রছাত্রীদের কাছে সংবাদকর্মীরা তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চায়। সেখান থেকেও একই রকম উত্তর আসে। মেধাবীরা অবশ্যই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। তবে তাদের মূল্যায়ন করার জন্য, তাদের সৃজনশীলতার সহযোগী হওয়ার কিছু মেধাবী রাজনীতিবিদও তো দরকার! গাড়ির সব চাকা সমান না হলে রাস্তায় চলা অসম্ভব। তেমনি একটি জাতি যত মেধাবীই হোক, রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্তদের সঙ্গে অন্যদের চিন্তার সমন্বয় না ঘটলে বিপর্যয় অনিবার্য। এ ধরনের বিপর্যয়কে আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয়- আউলা লাগা। বর্তমানে আমরা এই আউলার মধ্যে বসবাস করছি। এই আউলা রাজ্যে কেউ রাজনীতিবিদ হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে জীবন শুরু করে না। কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারে, রাজনীতির মধ্যে যে মধু আছে তা আর অন্য কোথাও নেই, তখন সে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে দেখা যায়, শিক্ষক শিক্ষকতায় মন না দিয়ে রাজনীতির পেছনে ছুটছে, চাকরিজীবী তার চাকরিকে বগলে রেখে রাজনীতির ঢোল বাজাচ্ছে। অর্থাৎ রাজমিস্ত্রির কাজ জোগালি করছে, দারোগার কাজ করছে দফাদার আর কাঠমিস্ত্রির কাজ করছে কামার। কাঠমিস্ত্রির কাজ কামার করলে যে কোনো শিল্পকর্ম ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আমাদের রাজনীতিতে এই ফাটাফাটির কারবারই চলছে। রাজনীতি যে একটা শিল্প, এই শিল্প যে যতœ, নৈপুণ্য ও সৃজনশীলতা দাবি করে, চলমান রাজনীতিতে তার অনুপস্থিতি প্রকট। ফলে এর অধঃপতন রোধ করা যাচ্ছে না। এরকম পরিস্থিতিতে আমরা যারা রাজনীতির বাইরে আছি অথচ যাদের জীবন রাজনীতির সুফল ও কুফলের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত, তারা রাজনীতির কাছে করজোড়ে একটাই মিনতি জানাতে পারি- হে রাজনীতি, তুমি আর নিচে নেমো না।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments