বিনা শুল্কে পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি by কামরুল হাসান
দ্রুত ও সহজে তৈরি পোশাক
রপ্তানির জন্য প্রচ্ছন্ন রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বন্ড সুবিধা
দেওয়া হয়েছিল প্যাকেজিং শিল্পকে। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ড সুবিধার
অপব্যবহার করছে। অভিযোগ উঠেছে, বন্ডের আওতায় বিনা শুল্কে পণ্য এনে তা
খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বিক্রি করা হচ্ছে
পলিদানা বলে পরিচিত পলিথিন
ব্যাগ তৈরির কাঁচামাল। এ অবৈধ কেনাবেচার সঙ্গে বন্ড কমিশনারেটের
কর্মকর্তাদের যোগসাজশও রয়েছে। যদিও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার বন্ধের
দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বন্ড কমিশনারেটদের। এনবিআরের
শুল্ক ও গোয়েন্দা তদন্ত অধিদপ্তরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র প্রথম আলোকে
জানায়, অধিদপ্তরের একটি অনুসন্ধানে এর প্রমাণও মিলেছে। বন্ড সুবিধা
পাওয়া ৩০টি প্যাকেজিং শিল্পের মধ্যে সাতটির কোনো অস্তিত্ব নেই। যা আছে তার
কোনোটির অফিস আছে তো মেশিন নেই, মেশিন থাকলেও স্থাপন করা হয়নি। আবার
কোনোটিতে মেশিন চালু থাকলেও যে ধরনের পণ্য আমদানির কাগজপত্র দেখানো হয়েছে,
তা সেখানে উৎপাদিতই হচ্ছে না। বর্তমানে দেশে পাঁচ হাজার ৮০০টি বন্ড অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান
আছে। এর মধ্যে সরাসরি রপ্তানিকারক চার হাজার ১২টি এবং প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠান
এক হাজার ৫৩৯টি। এর বাইরে বিদেশি মিশনের কিছু লাইসেন্স আছে। এই
লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য এনে তা প্রক্রিয়াজাত
করে হয় নিজে রপ্তানি করতে হয়, না হয় রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের কাছে
সরবরাহ করতে হয়। এসব পণ্য বাজারে বিক্রি সম্পূর্ণ বেআইনি। তবে সংশ্লিষ্ট
সূত্রগুলো বলছে, বন্ড সুবিধায় আমদানি করা প্যাকেজিং পণ্য চোরাই পথে
কেনাবেচার জন্য রীতিমতো সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল হিসেবে বিভিন্ন ধরনের
পলিদানা, রেজিন, আর্টকাড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, টেপ, কাঁচা তুলা, সুতা, জিপার,
উল ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক আমদানি করে।
জানতে চাইলে শুল্ক ও গোয়েন্দা তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মোহাম্মদ আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে
বলেন, প্যাকেজিং শিল্পের অনিয়মের ব্যাপারে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এনবিআরকে
চিঠি পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
যাদের পণ্য চোরাই পথে: শুল্ক গোয়েন্দারা
জানান, চোরাই পথে পণ্য বিক্রির এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান হলো কেরানীগঞ্জ
বিসিক শিল্প এলাকায় অবস্থিত দি পদ্মা প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ। এ
প্রতিষ্ঠানটি গত পাঁচ মাসে ছয় হাজার ৪০০ বস্তা পলি ব্যাগ তৈরির দানা
আমদানি করে। ২৭ জানুয়ারি শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দেখতে পান,
প্রতিষ্ঠানটি আমদানি করা ৮৯ টন পলিদানা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এটা করেছিলাম, পরে এর জন্য ধার্য করা জরিমানা দিয়েছি।’
গত ৩ এপ্রিল শুল্ক গোয়েন্দারা নারায়ণগঞ্জের দেলদুয়ারের
প্যাট্রিয়ট প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজে অনুসন্ধান করে দেখতে পান, তারা আমদানি
করা ১০ হাজার ৩১৭ কেজি গাম টেপ, ইন্টারলাইনিং, প্যারাফিন ওয়াক্স ও
স্টার্চ পাউডার চোরাই পথে বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। কারখানার ব্যবস্থাপক
মোহাম্মদ বখতিয়ার শুল্ক গোয়েন্দার কাছে লিখিতভাবে এসব অভিযোগ স্বীকার
করেন।
কার্টন তৈরির ৭০ হাজার ৮০৪ টন কাগজ চোরাই পথে বিক্রি করে
দিয়েছে আশুলিয়ার প্যারাগন প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। একইভাবে
গাজীপুরের মেসার্স ডাফ এক্সারসাইজও বিপুল পরিমাণ পণ্য বাজারে বিক্রি করে
দিয়েছে।
ডুপ্লেক্স বোর্ড, পলিয়েস্টার ও পলিথিন আমদানিকারী
প্রতিষ্ঠান তেজগাঁও শিল্প এলাকার মেসার্স মোমেনশাহী ৬৯ টন সামগ্রী চোরাই
পথে বিক্রি করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ২৬ লাখ টাকার
শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর এলাকার মেসার্স
গোল্ডেন সন লিমিটেডে পলিদানা বিক্রির ক্ষেত্রে চোরাবাজারের সবচেয়ে বড়
প্রতিষ্ঠান বলে শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে। শুল্ক গোয়েন্দা
কর্মকর্তারা এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে গুদামে অনুসন্ধান করে দেখতে পান
প্রতিষ্ঠানটি পলিথিন তৈরির আট লাখ ৯৫ হাজার কেজি কাঁচামাল বাজারে বিক্রি
করে দিয়েছে। এতে তিন কোটি ২১ লাখ টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়।
ভুয়া প্রতিষ্ঠান: শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র
জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে তারা ৩০টি বন্ড সনদ পাওয়া কারখানায় খোঁজখবর
শুরু করে। এতে দেখতে পায় সাতটি কারখানার কোনো কার্যালয়ই নেই। এসব
কারখানার কোনো কর্মকর্তাও নেই। যে ঠিকানা দিয়ে কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে
তা-ও ভুয়া।
সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এ রকম দুটি কারখানা
আছে পশ্চিম কাফরুলের ২০৫/৪ বেগম রোকেয়া সরণির ঠিকানায়। মেসার্স মাহমুদ
অ্যাপারেলস ও মারভেলাস অ্যাপারেলস নামের দুটি প্রতিষ্ঠান এই ঠিকানা ব্যবহার
করে বন্ড লাইসেন্স নিয়েছে। অথচ ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের কোনো ঠিকানা খুঁজে
পায়নি শুল্ক গোয়েন্দা পরিদপ্তর।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেলে
ভবনের দারোয়ান দুলাল মিয়া বলেন, সাত-আট মাস আগে এ বাড়িতে একটি
প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ছিল। তারা কোথায় গেছে তা তিনি জানেন না। ভবনের
দোতলায় হল-মার্কের একটি সাইনবোর্ড দেখা গেছে। প্রতিষ্ঠানটির নামে
বিজিএমইএর ডাইরেক্টরিতে যে ফোন নম্বর আছে, সেখানে ফোন করে কাউকে পাওয়া
যায়নি।
নিরীক্ষার নামে যা হচ্ছে: বন্ডের পণ্যে
আমদানি থেকে শুরু করে রপ্তানি পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখতে
নিরীক্ষার বিধান রয়েছে। কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনে দেখা গেছে,
একজন কর্মকর্তা এক বছরে আড়াই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব নিরীক্ষা করেছেন,
যা বাস্তবসম্মত নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরীক্ষার নামে সুবিধা নিয়ে সব
কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে দেন বন্ডের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বন্ড কমিশনার মো. সহিদুল ইসলাম বলেন, পাঁচ হাজার
৮০০ প্রতিষ্ঠান দেখার জন্য আছেন ৬৩ জন কর্মকর্তা। তার ওপর নেই যানবাহন।
ফলে কোনো কিছুই ভালো করে দেখা যায় না।
No comments