সম্বল শুধু কান্না by জাবেদ রহিম বিজন
কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই পাল্টে গেল
দৃশ্যপট। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ হয়ে গেল নিঃস্ব। বস্ত্র নেই, অন্ন নেই।
মাথার ওপর চালা নেই। তিন দিন আগেও যাদের ঘরে ছিল ড্রামভর্তি চাল,
ঘর-সংসারের সব আয়োজন- তারাই আজ অন্যের মুখাপেক্ষী।
অপেক্ষায়
বসে থাকেন এক মুঠো খাবারের জন্য। ভাত আর নানা রকম সালুন দিয়ে আহার করা এসব
মানুষ অন্যের দেয়া চিড়া-মুড়ি, রুটি-বিস্কুুট খেয়ে কাটাচ্ছেন দিন। আর শূন্য
ভিটার দিকে তাকিয়ে হাহাকার করছেন। পুরনো বিছানার চাদর, পলিথিন দিয়ে
সেখানেই তাঁবু গেড়েছেন তারা। বেড়াহীন কয়েক হাতের ছোট্ট ছাউনিতে আশ্রয়
নিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা। এটিই এখন তাদের দিনরাতের আশ্রয়স্থল।
নানা দুঃশ্চিন্তায় রাত কাটে নির্ঘুম। এমনি অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা
করছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টর্নেডো বিধ্বস্ত এলাকার মানুষ। উড়ে যাওয়া ঘরের
বেড়া-চালা কুড়িয়ে এনে কোনরকম আব্রুর ব্যবস্থা করার চেষ্টাতেই ব্যস্ত দেখা
গেল তাদের। তা দুরূহ। ছিন্নবিচ্ছিন্ন বেড়া চালা খুঁজে খুঁজে হয়রান মানুষ
নিয়তির কাছে সব ছেড়ে দিয়ে শূন্য ভিটায় আবার ফিরে আসছে হতাশা নিয়ে। কোথায়
গেছে বেড়া-চালা, দরজা-জানালা তার কোন হদিস নেই। টর্নেডোর পর গত তিন দিনেও
চাল ছাড়া সরকারি সাহায্য বলতে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছায়নি কোন কিছুই।
যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারকে দেয়া হয়েছে ২০ হাজার টাকা করে। আহতরা
পেয়েছেন ৫ হাজার টাকা। এর বাইরে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়া শ’ শ’ পরিবারের
সরকারের তরফ থেকে তেমন কোন প্রাপ্তি নেই। প্রশাসনের লোকজনও তেমন একটা
খোঁজখবর নেয়নি। এমন অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্তদের সবার। এখন সবচেয়ে বেশি দরকার
মাথার ওপর চালা, থাকার সংস্থান। কিন্তু তারই অভাব বেশি এ টর্নেডো দুর্গত
এলাকায়। এখন পর্যন্ত কেউ টিন পায়নি। যদিও শনিবার ডিসি কার্যালয়ে এ
সংক্রান্ত এক বৈঠকে জানানো হয়, ডাচবাংলা ব্যাংক থেকে ৭০০ বান্ডেল ঢেউটিন ও
নগদ ৫০ লাখ টাকা দেয়া হবে। কিন্তু তা এখনও পৌঁছায়নি ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে।
গতকাল বিকালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চান্দি এলাকা
পরিদর্শন করে এ মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্তদের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করা জরুরি
বলে তার বক্তব্যে জানান।
দিশাহারা সবাই: টর্নেডো আসার মুহূর্তে যে যেদিকে পারেন ছুটে পালিয়েছিলেন। ঘর ছেড়ে পালানো এসব মানুষ পরে ফিরে এসে আর কোন কিছুই পাননি। কষ্ট হচ্ছিল নিজের ভিটা চিনতেই। পাননি ঘরের ভেতরে থাকা জিনিসপত্রের ছিটেফোঁটাও। আলমিরা, ফ্রিজ, টিভি, শোকেস- সবই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। শুরুতে সেই শূন্য ভিটা আঁকড়ে শুরু হয় বিলাপ। আহত-নিহত লোকজন নিয়ে টানাটানিতে তখন এসব নিয়ে ভাবার খুব একটা সুযোগও ছিলনা। কেউ হারিয়েছে পিতা, কেউ মা, বোন বা ভাই, বুক উজাড় করে চলে গেছে ছোট শিশু। আহত হয়ে কেউ গেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতালে, কেউ আখাউড়ায়, কেউ কুমিল্লায়। একই ঘরের মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে নানা দিকে। গত দু’দিনের এমনি অবস্থা আর শোক ছাপিয়ে এখন তাদের কাছে মাথা গোঁজার দুঃশ্চিন্তা হয়ে উঠেছে বড়। গতকাল থেকে প্রাণের সাড়া মেলে বিধ্বস্ত ভিটিতে। সরজমিন বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায় এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া টিন কুড়িয়ে এনে কোনরকমে থাকার একটি ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন ঘরবাড়ি হারা মানুষরা।
সম্বল শুধুই চোখের পানি: শূন্য ভিটায় বসে কাঁদছিলেন হামিরা আক্তার। কোলে ৬ মাসের শিশুকন্যা সাইমা। টর্নেডোর আঘাত তাকেও ছাড়েনি। সাইমার পিঠে দিতে হয়েছে ৮টি সেলাই। ক্ষণে ক্ষণেই ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে এই শিশু। আরেক সন্তান ৭ বছর বয়সের খায়রুলের মাথা ফেটে গেছে। হামিরার অবস্থাও সুবিধার নয়। জানালেন তার শরীরের এক পাশ অবশের মতো। তারপরও কচি বাচ্চার জন্য নিজে কষ্ট সইছেন। হামিরার স্বামী খোরশেদ আলম। চান্দি দক্ষিণ হাটি বাড়ি। চান্দির এই এলাকাটি পরিণত হয়েছে এক বিরান ভূমিতে। কোন ঘরবাড়ির চিহ্ন নেই। হামিরা জানান, টর্নেডোর সময় ঘরেই ছিলেন প্রথমে। পরে অবস্থা খারাপ দেখে নিজের ঘর ছেড়ে দিয়ে পাশের একটি খালি ঘরে ছুটে যান, বাড়ির আরও অনেকের সঙ্গে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকেন সেখানে। হঠাৎ করেই দেখেন খালি জায়গায় পড়ে আছেন তারা। নিজের দু’টি ঘরও নেই। একটু আগেও ছিল তার সাজানো সংসার। বাড়িতে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে বলে গলায় স্বর্ণের হার পরেছিলেন। কানের দুল পরা ছিল। সবই উধাও টর্নেডোর ঝাপটায়। ঘরের ভেতর আলমারি, শোকেস, ফ্রিজ ছিল। কিছুই নেই এখন আর। স্বামী খোরশেদ আগে থাকতেন সৌদি আরবে। তখন জুটিয়েছিলেন সবকিছু। এখন স্বামী দেশে, তেমন কাজকর্মও নেই। সব শেষ হয়ে যাওয়া শূন্য ভিটেয় কিভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াবেন হামিরা- সে চিন্তাতেই অবিরাম কেঁদে যাচ্ছিলেন তিনি। আত্মীয়-স্বজনরা এসে দিচ্ছে সান্ত্বনা। পাশের বাড়িটি শাহ আলমের। তারও কোন কিছু অবশিষ্ট নেই। বলেন, শুধু জানে বাঁইচ্চা রইছি। ঘরের ভেতরের চালের ড্রামটা পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আবদুর রশিদের ৪টি ঘরের কোন অস্তিত্ব নেই। তার স্ত্রী মোমিনা বেগম বলেন, একটা গৃহস্থ বাড়িতে কত কিছুই থাকে। এখন আর কিছুই নেই। টিনের চালা-বেড়া আশপাশে যেভাবে পড়ে আছে তা ভাঙারি ওয়ালারও নেবে না। যে ক্ষতি হয়েছে তা ২০-২৫ বছরেও পূরণ করতে পারবো না। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে খালি ভিটেতেই পড়ে আছি। হানিফ মিয়ার বাড়িরও একই দশা। তার স্ত্রী আরজু বেগম বলেন, আমরার আর কোন কিছু নাই। এহন মানুষের দেয়া কাপড় পইরা রইছি। ঘরে এত কাপড়-চোপড় ছিল এগুলো একটাও পেলাম না। শোকেসের ভেতর ছিল এসব কাপড়-চোপড়। শোকেসের এক টুকরো কাঠও পেলাম না। সম্পদ ও জান দু’টোই গেছে নূরুল ইসলামদের ৫ ভাইয়ের। তার পিতা ফজলু মিয়া (৯০) ও ভাই তাজুল ইসলাম (৬০) মারা গেছেন। নূরুল ইসলাম জানান, নিহত এই দু’জনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে ৪০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া তারা কোন সাহায্য পাননি। ৫ ভাইয়েরই ঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। টর্নেডোর সময় তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের এক বিল্ডিংয়ে। সেখান থেকে ফিরে দেখেন কোন কিছুই নেই। অথচ তাদের ঘর-গৃহস্থির কোন অভাব ছিল না। নূরুল ইসলাম বলেন, এখন সর্বহারা হয়ে গেলাম। আমার ২টা গরু মারা গেছে, ৮ কানি ক্ষেত পুড়ে গেছে। তার ছোট ভাই নজরুল ইসলামের ঘরের কোন জিনিসপত্রই মিলেনি। তার স্ত্রী নূরুন্নাহার বলেন, ৩টা খাট ছিল, স্টিলের আলমারি, ডাইনিং টেবিল- কোন জিনিসের অভাব ছিল না ঘরে। এখন এক পয়সার জিনিসও নেই। নিহত তাজুল ইসলামের ছেলে সাতক্ষীরায় পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অফিসে কর্মরত সালাউদ্দিন জামান জানান, টর্নেডোর সময় তিনি, তার মা ও বোন দৌড়ে দক্ষিণ দিকে চলে যান। তখন আব্বাকে খুঁজে পাইনি। পরে ফিরে দেখি আব্বা বাড়ির সামনে রাস্তায় পড়ে আছেন। হয়তো বাড়ির দিকে ছুটে আসছিলেন যেখানে ছিলেন সেখান থেকে। পথেই আক্রান্ত হন। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে আখাউড়া হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে লোকে ঠাসা থাকায় পাশে গোপীনাথপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। জামানের দাদা ফজলু মিয়ার লাশ পড়েছিল বাড়ির সামনের একটি পুকুরের পাড়ের ঢালুতে। দু’জনকে হারানোর শোক, চালচুলোহীন অবস্থায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত অবস্থাসম্পন্ন এই পরিবারের সদস্যরা। জামান বলেন, কিভাবে এখন মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করা যায় সে চিন্তাই করছি। আগে সীমানা প্রাচীর ছিল, দু’টি বড় ঘর ছিল। এখন ফাঁকা। দিশাহারা আঙ্গুরা বেগম। শূন্যভিটায় বসে বলেন, কই যামু, কেমনে থাহুম বুঝতে পারছি না। তার দু’টি ঘর উড়ে গেছে টর্নেডোতে। গত ৩ দিনে সাহায্য হিসেবে এক পোঁটলা চিঁড়া, ২ কেজি চাল, নগদ ৫শ’ টাকা পেয়েছেন তিনি। চান্দি দক্ষিণ পাড়ার সব ঘরবাড়িই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে টর্নেডোতে। এখানকার কয়েক শ’ কানি বিআর ২৮ ও ২৯ জাতের ধান গাছ টর্নেডোর আগুনের হল্কায় জ্বলে গেছে।
৩ দিন পর উদ্ধার তৎপরতা: টর্নেডোর আঘাতে জারুইলতলার ইয়াসিন ভূঁইয়ার নির্মাণাধীন পাকা বিল্ডিং পুরোপুরি ধ্বসে পড়ে। ওই ঘরে ঘটনার সময় ১০ জন ছিল বলে জানান স্থানীয় লোকজন। এর মধ্যে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখান থেকে পচা গন্ধ বেরুচ্ছে বলে এলাকার লোকজন জেলা প্রশাসককে জানানোর পর গতকাল সেখানে দমকল বাহিনীর লোকজন উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া দমকল বাহিনীর ২৫ জন সদস্য দিনভর মেশিন দিয়ে ছাদ কেটে ভেতরের অবস্থা দেখার চেষ্টা করে। ঘটনার পর থেকেই লোকজন আশঙ্কা করছিল এখানে কেউ চাপা পড়ে থাকতে পারে। সন্ধ্যা নাগাদ এই উদ্ধার তৎপরতা শেষে দমকল বাহিনী জানায়, ভেতরে কেউ নেই।
এরশাদ ঘুরে গেছেন, আজ যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী: জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গতকাল বিকালে টর্নেডোয় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। বিকাল ৪টায় একটি হেলিকপ্টারে করে এরশাদ কড্ডা এলাকায় অবতরণ করেন। সেখান থেকে প্রথমে যান চান্দি গ্রামে। এরপর চিনাইর ও আখাউড়ার আমোদাবাদ গ্রামে যান। তিনি ত্রাণসামগ্রীও বিতরণ করেন। এ সময় এরশাদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এখন ঘর দরকার। শুনেছি কাল প্রধানমন্ত্রী আসবেন। তাকে বলবেন ঘর করে দিতে। আমার সময় আমি এমন ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর করে দিয়েছি। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ আসছেন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে। জানা গেছে, বিকাল ৩টায় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছবেন। দুগর্ত এলাকা পরিদর্শনের পর তিনি চিনাইর কলেজে জনসভায় যোগ দেবেন বলে জানা গেছে।
ত্রাণ তৎপরতা: টর্নেডো আক্রান্ত এলাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ত্রাণ বিতরণ করছে। ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও। গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট শাহ জিকরুল আহমেদ খোকন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে নগদ টাকা ও হ্যারিকেন বিতরণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীও ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে নগদ টাকা বিতরণ করেন। তার উদ্যোগে চিনাইর স্কুল ও কলেজে লঙ্গরখানা চালু করা হয়েছে। এখানে দুর্গত লোকজনের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন আলাদাভাবে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মিনারা আলম ও সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট তাসলিমা সুলতানা খানমের নেতৃত্বে মহিলা আওয়ামী লীগের একটি দল ক্ষতিগ্রস্থদের বাড়িতে গিয়ে আহতদের সান্ত্বনা দেয় এবং ত্রাণ বিতরণ করে। কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি মাঈন উদ্দিন মঈন ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িতে যান এবং ত্রাণ সহায়তা দেন। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি মো: শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক মামুন নাজিরের নেতৃত্বে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়।
ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ: জারুইলতলা একটি ত্রাণ শিবির থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ হিসেবে ৩০ কেজি চাল বিতরণ করা হচ্ছে সরকারিভাবে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা এই চাল পাচ্ছে না বলে গতকাল অনেকে অভিযোগ করেন। মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশিদ অভিযোগ করেন, এখান থেকে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা একমুঠ চালও পাচ্ছে না। এমন অভিযোগ করেন ক্ষতিগ্রস্ত বাদল, খালেক, তারা মিয়া, হালিমা আক্তার, মোখলেছ, ইয়াসিন ও
তাজুল ইসলাম। এনিয়ে সেখানে উত্তেজনারও সৃষ্টি হয়। তারা বলেন, তাদের ঘরবাড়ি বলতে কোন কিছু নেই। তারপরও চাল দেয়া হচ্ছে না তাদের। সাজেদ মাহমুদ নামের এক যুবক বলেন, এলাকার প্রভাবশালীরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করেছে। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের বঞ্চিত করেছে। চাল বিতরণের দায়িত্বে থাকা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, চান্দি ও জারুইলতলার জন্য সাড়ে ৪ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। আর ক্ষতিগস্তদের তালিকা দিয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ। আমরা সেভাবেই বিতরণ করছি। তালিকার বাইরেতো কাউকে দেয়া যাবে না।
দিশাহারা সবাই: টর্নেডো আসার মুহূর্তে যে যেদিকে পারেন ছুটে পালিয়েছিলেন। ঘর ছেড়ে পালানো এসব মানুষ পরে ফিরে এসে আর কোন কিছুই পাননি। কষ্ট হচ্ছিল নিজের ভিটা চিনতেই। পাননি ঘরের ভেতরে থাকা জিনিসপত্রের ছিটেফোঁটাও। আলমিরা, ফ্রিজ, টিভি, শোকেস- সবই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। শুরুতে সেই শূন্য ভিটা আঁকড়ে শুরু হয় বিলাপ। আহত-নিহত লোকজন নিয়ে টানাটানিতে তখন এসব নিয়ে ভাবার খুব একটা সুযোগও ছিলনা। কেউ হারিয়েছে পিতা, কেউ মা, বোন বা ভাই, বুক উজাড় করে চলে গেছে ছোট শিশু। আহত হয়ে কেউ গেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতালে, কেউ আখাউড়ায়, কেউ কুমিল্লায়। একই ঘরের মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে নানা দিকে। গত দু’দিনের এমনি অবস্থা আর শোক ছাপিয়ে এখন তাদের কাছে মাথা গোঁজার দুঃশ্চিন্তা হয়ে উঠেছে বড়। গতকাল থেকে প্রাণের সাড়া মেলে বিধ্বস্ত ভিটিতে। সরজমিন বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায় এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া টিন কুড়িয়ে এনে কোনরকমে থাকার একটি ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন ঘরবাড়ি হারা মানুষরা।
সম্বল শুধুই চোখের পানি: শূন্য ভিটায় বসে কাঁদছিলেন হামিরা আক্তার। কোলে ৬ মাসের শিশুকন্যা সাইমা। টর্নেডোর আঘাত তাকেও ছাড়েনি। সাইমার পিঠে দিতে হয়েছে ৮টি সেলাই। ক্ষণে ক্ষণেই ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে এই শিশু। আরেক সন্তান ৭ বছর বয়সের খায়রুলের মাথা ফেটে গেছে। হামিরার অবস্থাও সুবিধার নয়। জানালেন তার শরীরের এক পাশ অবশের মতো। তারপরও কচি বাচ্চার জন্য নিজে কষ্ট সইছেন। হামিরার স্বামী খোরশেদ আলম। চান্দি দক্ষিণ হাটি বাড়ি। চান্দির এই এলাকাটি পরিণত হয়েছে এক বিরান ভূমিতে। কোন ঘরবাড়ির চিহ্ন নেই। হামিরা জানান, টর্নেডোর সময় ঘরেই ছিলেন প্রথমে। পরে অবস্থা খারাপ দেখে নিজের ঘর ছেড়ে দিয়ে পাশের একটি খালি ঘরে ছুটে যান, বাড়ির আরও অনেকের সঙ্গে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকেন সেখানে। হঠাৎ করেই দেখেন খালি জায়গায় পড়ে আছেন তারা। নিজের দু’টি ঘরও নেই। একটু আগেও ছিল তার সাজানো সংসার। বাড়িতে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে বলে গলায় স্বর্ণের হার পরেছিলেন। কানের দুল পরা ছিল। সবই উধাও টর্নেডোর ঝাপটায়। ঘরের ভেতর আলমারি, শোকেস, ফ্রিজ ছিল। কিছুই নেই এখন আর। স্বামী খোরশেদ আগে থাকতেন সৌদি আরবে। তখন জুটিয়েছিলেন সবকিছু। এখন স্বামী দেশে, তেমন কাজকর্মও নেই। সব শেষ হয়ে যাওয়া শূন্য ভিটেয় কিভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াবেন হামিরা- সে চিন্তাতেই অবিরাম কেঁদে যাচ্ছিলেন তিনি। আত্মীয়-স্বজনরা এসে দিচ্ছে সান্ত্বনা। পাশের বাড়িটি শাহ আলমের। তারও কোন কিছু অবশিষ্ট নেই। বলেন, শুধু জানে বাঁইচ্চা রইছি। ঘরের ভেতরের চালের ড্রামটা পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আবদুর রশিদের ৪টি ঘরের কোন অস্তিত্ব নেই। তার স্ত্রী মোমিনা বেগম বলেন, একটা গৃহস্থ বাড়িতে কত কিছুই থাকে। এখন আর কিছুই নেই। টিনের চালা-বেড়া আশপাশে যেভাবে পড়ে আছে তা ভাঙারি ওয়ালারও নেবে না। যে ক্ষতি হয়েছে তা ২০-২৫ বছরেও পূরণ করতে পারবো না। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে খালি ভিটেতেই পড়ে আছি। হানিফ মিয়ার বাড়িরও একই দশা। তার স্ত্রী আরজু বেগম বলেন, আমরার আর কোন কিছু নাই। এহন মানুষের দেয়া কাপড় পইরা রইছি। ঘরে এত কাপড়-চোপড় ছিল এগুলো একটাও পেলাম না। শোকেসের ভেতর ছিল এসব কাপড়-চোপড়। শোকেসের এক টুকরো কাঠও পেলাম না। সম্পদ ও জান দু’টোই গেছে নূরুল ইসলামদের ৫ ভাইয়ের। তার পিতা ফজলু মিয়া (৯০) ও ভাই তাজুল ইসলাম (৬০) মারা গেছেন। নূরুল ইসলাম জানান, নিহত এই দু’জনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে ৪০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া তারা কোন সাহায্য পাননি। ৫ ভাইয়েরই ঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। টর্নেডোর সময় তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের এক বিল্ডিংয়ে। সেখান থেকে ফিরে দেখেন কোন কিছুই নেই। অথচ তাদের ঘর-গৃহস্থির কোন অভাব ছিল না। নূরুল ইসলাম বলেন, এখন সর্বহারা হয়ে গেলাম। আমার ২টা গরু মারা গেছে, ৮ কানি ক্ষেত পুড়ে গেছে। তার ছোট ভাই নজরুল ইসলামের ঘরের কোন জিনিসপত্রই মিলেনি। তার স্ত্রী নূরুন্নাহার বলেন, ৩টা খাট ছিল, স্টিলের আলমারি, ডাইনিং টেবিল- কোন জিনিসের অভাব ছিল না ঘরে। এখন এক পয়সার জিনিসও নেই। নিহত তাজুল ইসলামের ছেলে সাতক্ষীরায় পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অফিসে কর্মরত সালাউদ্দিন জামান জানান, টর্নেডোর সময় তিনি, তার মা ও বোন দৌড়ে দক্ষিণ দিকে চলে যান। তখন আব্বাকে খুঁজে পাইনি। পরে ফিরে দেখি আব্বা বাড়ির সামনে রাস্তায় পড়ে আছেন। হয়তো বাড়ির দিকে ছুটে আসছিলেন যেখানে ছিলেন সেখান থেকে। পথেই আক্রান্ত হন। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে আখাউড়া হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে লোকে ঠাসা থাকায় পাশে গোপীনাথপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। জামানের দাদা ফজলু মিয়ার লাশ পড়েছিল বাড়ির সামনের একটি পুকুরের পাড়ের ঢালুতে। দু’জনকে হারানোর শোক, চালচুলোহীন অবস্থায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত অবস্থাসম্পন্ন এই পরিবারের সদস্যরা। জামান বলেন, কিভাবে এখন মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করা যায় সে চিন্তাই করছি। আগে সীমানা প্রাচীর ছিল, দু’টি বড় ঘর ছিল। এখন ফাঁকা। দিশাহারা আঙ্গুরা বেগম। শূন্যভিটায় বসে বলেন, কই যামু, কেমনে থাহুম বুঝতে পারছি না। তার দু’টি ঘর উড়ে গেছে টর্নেডোতে। গত ৩ দিনে সাহায্য হিসেবে এক পোঁটলা চিঁড়া, ২ কেজি চাল, নগদ ৫শ’ টাকা পেয়েছেন তিনি। চান্দি দক্ষিণ পাড়ার সব ঘরবাড়িই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে টর্নেডোতে। এখানকার কয়েক শ’ কানি বিআর ২৮ ও ২৯ জাতের ধান গাছ টর্নেডোর আগুনের হল্কায় জ্বলে গেছে।
৩ দিন পর উদ্ধার তৎপরতা: টর্নেডোর আঘাতে জারুইলতলার ইয়াসিন ভূঁইয়ার নির্মাণাধীন পাকা বিল্ডিং পুরোপুরি ধ্বসে পড়ে। ওই ঘরে ঘটনার সময় ১০ জন ছিল বলে জানান স্থানীয় লোকজন। এর মধ্যে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখান থেকে পচা গন্ধ বেরুচ্ছে বলে এলাকার লোকজন জেলা প্রশাসককে জানানোর পর গতকাল সেখানে দমকল বাহিনীর লোকজন উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া দমকল বাহিনীর ২৫ জন সদস্য দিনভর মেশিন দিয়ে ছাদ কেটে ভেতরের অবস্থা দেখার চেষ্টা করে। ঘটনার পর থেকেই লোকজন আশঙ্কা করছিল এখানে কেউ চাপা পড়ে থাকতে পারে। সন্ধ্যা নাগাদ এই উদ্ধার তৎপরতা শেষে দমকল বাহিনী জানায়, ভেতরে কেউ নেই।
এরশাদ ঘুরে গেছেন, আজ যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী: জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গতকাল বিকালে টর্নেডোয় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। বিকাল ৪টায় একটি হেলিকপ্টারে করে এরশাদ কড্ডা এলাকায় অবতরণ করেন। সেখান থেকে প্রথমে যান চান্দি গ্রামে। এরপর চিনাইর ও আখাউড়ার আমোদাবাদ গ্রামে যান। তিনি ত্রাণসামগ্রীও বিতরণ করেন। এ সময় এরশাদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এখন ঘর দরকার। শুনেছি কাল প্রধানমন্ত্রী আসবেন। তাকে বলবেন ঘর করে দিতে। আমার সময় আমি এমন ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর করে দিয়েছি। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ আসছেন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে। জানা গেছে, বিকাল ৩টায় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছবেন। দুগর্ত এলাকা পরিদর্শনের পর তিনি চিনাইর কলেজে জনসভায় যোগ দেবেন বলে জানা গেছে।
ত্রাণ তৎপরতা: টর্নেডো আক্রান্ত এলাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ত্রাণ বিতরণ করছে। ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও। গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট শাহ জিকরুল আহমেদ খোকন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে নগদ টাকা ও হ্যারিকেন বিতরণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীও ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে নগদ টাকা বিতরণ করেন। তার উদ্যোগে চিনাইর স্কুল ও কলেজে লঙ্গরখানা চালু করা হয়েছে। এখানে দুর্গত লোকজনের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন আলাদাভাবে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মিনারা আলম ও সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট তাসলিমা সুলতানা খানমের নেতৃত্বে মহিলা আওয়ামী লীগের একটি দল ক্ষতিগ্রস্থদের বাড়িতে গিয়ে আহতদের সান্ত্বনা দেয় এবং ত্রাণ বিতরণ করে। কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি মাঈন উদ্দিন মঈন ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িতে যান এবং ত্রাণ সহায়তা দেন। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি মো: শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক মামুন নাজিরের নেতৃত্বে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়।
ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ: জারুইলতলা একটি ত্রাণ শিবির থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ হিসেবে ৩০ কেজি চাল বিতরণ করা হচ্ছে সরকারিভাবে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা এই চাল পাচ্ছে না বলে গতকাল অনেকে অভিযোগ করেন। মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশিদ অভিযোগ করেন, এখান থেকে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা একমুঠ চালও পাচ্ছে না। এমন অভিযোগ করেন ক্ষতিগ্রস্ত বাদল, খালেক, তারা মিয়া, হালিমা আক্তার, মোখলেছ, ইয়াসিন ও
তাজুল ইসলাম। এনিয়ে সেখানে উত্তেজনারও সৃষ্টি হয়। তারা বলেন, তাদের ঘরবাড়ি বলতে কোন কিছু নেই। তারপরও চাল দেয়া হচ্ছে না তাদের। সাজেদ মাহমুদ নামের এক যুবক বলেন, এলাকার প্রভাবশালীরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করেছে। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের বঞ্চিত করেছে। চাল বিতরণের দায়িত্বে থাকা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, চান্দি ও জারুইলতলার জন্য সাড়ে ৪ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। আর ক্ষতিগস্তদের তালিকা দিয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ। আমরা সেভাবেই বিতরণ করছি। তালিকার বাইরেতো কাউকে দেয়া যাবে না।
No comments